ধরুন, চমৎকার আবহাওয়ায় বেড়িয়ে পড়লেন প্রিয় দ্বিচক্রযানটি নিয়ে! আচমকা বৃষ্টির কবলে পড়ে হয়ে গেলো দুর্ঘটনা! তেমন কিছুই হয়নি বলে বিষয়টি উড়িয়ে দেবার কিছুক্ষণ পরেই দেখলেন এ কী! রক্ত বন্ধ হচ্ছে না! কেটে গেলে যেখানে রক্ত কিছুক্ষণ পরই জমাট বেঁধে যাবার কথা, সেখানে রক্ত বন্ধই হচ্ছে না!
এক্ষেত্রে হয়তো আপনি হেমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত। হেমোফিলিয়া হলো এমন একটি রোগ, যাতে স্বাভাবিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে রক্ত জমাট বাধার প্রক্রিয়াটি কম বা অনুপস্থিত। রক্ত পড়া না বন্ধ হবার কারণে একে ‘bleeders disease’-ও বলা হয়। রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টরগুলোর অনুপস্থিতিতে এই রোগ হয়।
জীনগত এই রোগটি বাসা বেঁধে থাকে মানবদেহের কোষের ক্রোমোসোমে, যা বংশানুক্রমে পরবর্তী প্রজন্মে পরিবাহিত (রোগাক্রান্ত কিংবা রোগের জীনবাহক) হতে পারে। এর অন্যতম উদাহরণ হতে পারে ইউরোপীয় রাজবংশ, যেখানে রাজরক্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এ রোগ, পতন ডেকে এনেছিল রোমানভ রাজবংশের। চলুন জেনে আসি রাজবংশের অভিশাপ বনে যাওয়া এই রোগের কথা।
রোগের ইতিহাস দেখে আসার আগে এর ইতিবৃত্ত একটু জেনে নিতে হবে। হেমোফিলিয়া রক্তপাত বন্ধ না হবার একটি রোগ, যা রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টরগুলির অভাবে হয়ে থাকে। কেটে গেলে রক্তপাত বন্ধ না হওয়া, শরীরের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, গিঁট ও মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ এর অন্যতম লক্ষণ।
এই রোগের বীজ লুকিয়ে আছে মানবকোষের নিউক্লিয়াসের ক্রোমোসোমে। পুরুষ ও নারীর প্রত্যেকের এক জোড়া করে সেক্স ক্রোমোসোম রয়েছে, পুরুষের ক্ষেত্রে যা এক্স-ওয়াই এবং নারীর ক্ষেত্রে এক্স-এক্স। হেমোফিলিয়া একটি এক্স ক্রোমোসোম বাহিত প্রচ্ছন্ন রোগ। যেহেতু সন্তান ছেলে হবার জন্য দায়ী ওয়াই ক্রোমোসোম এবং পুরুষের ক্ষেত্রে এক্স ক্রোমোসোম মাত্র একটি, তাই তার মায়ের থেকে হেমোফিলিয়াবাহী এক্স ক্রোমোসোম পেলেই সে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে। অপরপক্ষে মেয়েদের দুইটি এক্স ক্রোমোসোম হওয়ায় মা’র থেকে একটি রোগবাহী এক্স ক্রোমোসোম পেলেও সে শুধুমাত্র রোগটির বাহক হবে, রোগাক্রান্ত নয়। তাই একটি মেয়েকে হেমোফিলিয়াক হতে হলে তার মা ও বাবা দুজনের থেকেই রোগবাহী এক্স ক্রোমোসোম পেতে হবে।
তাই সুস্থ পিতা ও হেমোফিলিয়াক মায়ের ছেলে সবসময় হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত এবং মেয়ে হেমোফিলিয়ার বাহক হবে। এক্ষেত্রে মা যদি হেমোফিলিয়ার বাহক হয়, তাহলে তার ছেলে হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে কিংবা না-ও হতে পারে, মেয়েও বাহক হতে বা না-ও হতে পারে (নির্ভর করছে মা’র থেকে সুস্থ নাকি রোগবাহী ক্রোমোসোম পেয়েছে তার উপর)।
হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত পিতার কন্যা হেমোফিলিয়ার বাহক হবে এবং পুত্র স্বাভাবিক হবে (যদি মা সুস্থ হয়)। ফ্যাক্টর ৮ যথেষ্ট তৈরি না হলে হেমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ফ্যাক্টর ৯ এর অভাবে হেমোফিলিয়া ‘বি’ হয়। এছাড়াও ফ্যাক্টর ১১ এর অভাবে হেমোফিলিয়া ‘সি’ এবং ফ্যাক্টর ৫ এর অভাবে প্যারাহেমোফিলিয়া হয়।
এবার পাঠক চলুন ঘুরে আসি ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়ার সময় থেকে। ভিক্টোরিয়া নিজেই এই রোগের বাহক ছিলেন, যদিও তার বাবা-মা’র পরিবারে এই রোগের কোনো পাকাপাকি খবর পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে ধারণা করা হয় যখন তার মা সন্তানসম্ভবা ছিলেন, তখনই হয়তো কোনোভাবে মিউটেশনের (জীনগত অস্বাভাবিক পরিবর্তন) কারণে ভিক্টোরিয়া রোগটির বাহক হয়ে যান। রানী ভিক্টোরিয়া এবং প্রিন্স আলবার্ট সাক্সে-কোবার-গোথার ৯ জন সন্তানের কারো কারো মধ্যে ছড়িয়ে যায় রোগটির জীন।
জীন হলো মানবদেহের ক্রোমসোমের ডি.এন.এ -এর সেই অংশ যা কোনো প্রোটিন তৈরির নির্দেশ বা বার্তা হিসেবে কাজ করে। এই বার্তানুযায়ী তৈরি প্রোটিনসমূহ মানবদেহের শারীরবৃত্তীয় নানান কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই জীনে কোনো পরিবর্তন আসলে তার প্রভাব প্রোটিনেও এসে পড়বে, যা বয়ে নিয়ে আসে মারাত্মক বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ের সূচনাই ঘটে গিয়েছিল ইউরোপীয় রাজপরিবারগুলোয়।
ভিক্টোরিয়ার প্রথম সন্তান ভিক্টোরিয়া প্রিন্সেস রয়্যাল কখনোই হেমোফিলিয়ার বাহক বা আক্রান্ত ছিলেন না। এমনকি রানি ভিক্টোরিয়ার পুত্রত্রয় এডওয়ার্ড, আলফ্রেড ও আর্থারও হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন না। ৫ম সন্তান হেলেনের দুই ছেলে সুস্থ ও জীবিত ছিলেন, অন্য দুজন ছোটবেলাতেই মারা যায়। হেলেনের দুটি মেয়ের কোনো সন্তান ছিল না। কাজেই হয়তো তিনি রোগটির বাহক ছিলেন কিংবা আদৌ ছিলেন না। ভিক্টোরিয়ার ৬ষ্ঠ সন্তান লুইস তার প্রজন্মকে সামনে বাড়াননি। কাজেই তিনি বাহক ছিলেন কিনা তা জানার উপায়ও তখন ছিল না।
ভিক্টোরিয়ার সন্তানদের মধ্যে হেমোফিলিয়ার বাহক ছিলেন তার দুই মেয়ে প্রিন্সেস এলিস এবং প্রিন্সেস বিয়াট্রিস। আর রক্তপাতের নিয়তির এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন ৮ম সন্তান প্রিন্স লিওপল্ড, ডিউক অফ আলবেনি। ১৮৫৩ সালের ৭ই এপ্রিল ভিক্টোরিয়া ও আলবার্টের অষ্টম সন্তান ও চতুর্থ পুত্র হিসেবে তার জন্ম। ১৮৫৮ কিংবা ‘৫৯ সালে তার এই রোগ ধরা পরার পর ভিক্টোরিয়া তার জন্য কড়া বিধিনিষেধ জারি করেন। তবে লিওপল্ড তা হেসেই উড়িয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে প্রিন্স লিওপল্ড পড়ে যাবার আঘাত থেকে মারা যান। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে তিনি হাঁটু এবং মাথায় আঘাত পান। পরদিন মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি।
মারা যাবার দু’বছর আগে প্রিন্স লিওপল্ড জার্মান প্রিন্সেস হেলেনা অফ ওয়ালডেক এন্ড পিরমন্টের সাথে পরিণয়ে আবদ্ধ হন, যার ফলশ্রুতিতে জন্ম হয় প্রিন্সেস এলিস অফ আলবেনির (পরবর্তীতে কাউন্টেস অফ এথলোন) এবং চার্লস এডওয়ার্ডের্। প্রিন্স চার্লস সুস্থ হলেও প্রিন্সেস এলিস তা ছিলেন না। তিনি এই রোগটির বাহক ছিলেন এবং যার ফলশ্রুতিতে তার ছেলে রুপার্ট আলেক্সান্ডার জর্জ অফ টেক, ভিসকাউন্ট ট্রেমাটন হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হন। হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রুপার্ট আলেক্সান্ডার ১৯২৮ সালের ১৫ই এপ্রিল ফ্রান্সে সড়ক দুর্ঘটনার দরুণ অন্ত:মস্তিস্কের (ইনট্রাসেরেব্রাল) রক্তক্ষরণে মারা যান।
তবে এখানেই কাহিনীর শেষ নয়! সবেমাত্র প্রিন্স লিওপল্ডের বংশানুক্রমে রোগটির স্ফীতিপর্ব শেষ হলো। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ভিক্টোরিয়ার দুই কন্যা এলিস এবং বিয়াট্রিসের কথা। হেমোফিলিয়ার বাহক এই দুই বোনই ছড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলেন এই রোগকে সমগ্র ইউরোপের বিভিন্ন রাজপরিবারগুলোয়।
সর্বকনিষ্ঠ কন্যা বিয়াট্রিস প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন প্রিন্স হেনরি অফ ব্যাটেনবার্গকে। তাদের দুই পুত্র প্রিন্স লিওপল্ড মাউন্টব্যাটেন ও মরিস অফ ব্যাটেনবার্গ হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন যার মধ্যে লিওপল্ড ১৯২২ সালে ৩২ বছর বয়সে অস্ত্রোপচারের সময় মারা যান। মরিস প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের সময় তাকে হত্যা করা হয়। বিয়াট্রিসের কন্যা ভিক্টোরিয়া ইউজিন অফ ব্যাটেনবার্গ হেমোফিলিয়ার বাহক ছিলেন এবং রাজা ত্রয়োদশ আলফোনসোকে বিয়ের সময় এই রোগ স্প্যানিশ রাজপরিবারে ছড়িয়ে দেন। তার পুত্র (এবং উত্তরাধিকারী) আলফোনসো প্রিন্স অফ দি এস্টিরিয়াস এবং ইনফ্যান্টে গঞ্জালো অফ স্পেন দুজনেই হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন।
ভিক্টোরিয়ার স্বামী আলফোনসো এই রোগ স্প্যানিশ রাজপরিবারে বয়ে আনার জন্য কোনোদিনই তাকে ক্ষমা করতে পারেননি। পরবর্তীতে একজন সাধারণ নারীকে বিয়ে করে সিংহাসনের অধিকার ছেড়ে দেন তিনি। ইনফ্যান্টে গঞ্জালো তার বোন বিয়াট্রিসকে নিয়ে গাড়ি চালাবার সময় দুর্ঘটনায় পতিত হন। আপাতদৃষ্টিতে তেমন গুরুতর আঘাত না হওয়ায় দুজনই বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু পরে জানা যায় গঞ্জালোর তলপেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং দুদিন পর তিনি মারা যান। ভিক্টোরিয়ার অপর ছেলে জুয়ান সুস্থ ছিলেন। জুয়ানের পুত্র জুয়ান কার্লোস স্পেনের প্রাক্তন রাজা ছিলেন।
এদিকে রাণী ভিক্টোরিয়ার অন্য কন্যা প্রিন্সেস এলিস পরিণয়ে আবদ্ধ হন প্রিন্স লুইস অফ হেসে ডার্মসটাডট এর সাথে। ১৮৭০ সালে তাদের পরিবারে জন্ম নেয় ফ্রেডরিখ অফ হেসে, যাকে পরিবারে আদর করে ফ্রিটি নামে ডাকতেন সবাই। দুর্ভাগ্যবশত সকলের প্রিয় ফ্রিটি ছিল হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত। ১৮৭৩ সালে মাত্র তিন বছর বয়সে জানালা থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ায় রক্তপাত হতে হতে মারা যায় সে।
প্রিন্সেস এলিসের অন্য ছেলেটি (ভবিষ্যৎ গ্র্যান্ড ডিউক আর্নস্ট লুইস অফ হেসে) সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার পাঁচ কন্যার মধ্যে দুজন ছিলেন হেমোফিলিয়ার বাহক। এরা হলেন আইরিন এবং এলিক্স অফ হেসে। ভয়াল এই রোগটি ব্রিটেনের রাজপরিবার থেকে প্রুসিয়ান রাজবংশে ছড়িয়ে পড়ে যখন প্রিন্সেস এলিসের তৃতীয় কন্যা আইরিন তার খালাতো ভাই প্রিন্স হেনরি অফ প্রুসিয়া এর (রানি ভিক্টোরিয়ার কন্যা ভিক্টোরিয়া প্রিন্সেস রয়্যালের দ্বিতীয় পুত্র) সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই রোগটি তাদের দুই ছেলে ওয়ালডেমার এবং হেনরি অফ প্রুসিয়ার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
১৯০৪ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান প্রিন্স হেনরি। অন্যদিকে প্রিন্স ওয়ালডেমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বাভারিয়ার টুটযিং এর একটি ক্লিনিকে মারা যান। মার্কিন সেনাবাহিনী সকল চিকিৎসা সুবিধা সরিয়ে নেয়ায় ব্লাড ট্রান্সফিউশনের পর্যাপ্ত সুবিধা সেখানে ছিল না। ফলে ১৯৪৫ সালের ২রা মে তার মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে পরোক্ষভাবে রচিত হচ্ছিল জারদের পতনের গল্প। বলা হয় রোমানভ রাজবংশের পতনের পিছনের অনেকগুলো কারণের একটি এই হেমোফিলিয়াও। রোমানভ রাজবংশে এই রোগ ছড়িয়ে দেন প্রিন্সেস এলিসের অপর কন্যা প্রিন্সেস এলিক্স। ১৮৮৪ সালে বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয় প্রিন্সেস এলিক্স এবং দ্বিতীয় নিকোলাস আলেক্সান্দ্রোভিচের। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের পাঁচ বছর পর এলিক্সের সাথে নিকোলাসের পুনরায় দেখা হয়। প্রণয়কে পরিণয়ে পরিণতি দেবার সিদ্ধান্তটা চলে আসে সেবারই। যদিও নিকোলাসের রুশ পিতামাতা জার্মান রাজকন্যাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে চাননি, তবুও নিকোলাস তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। এদিকে রাণী ভিক্টোরিয়াও এলিক্সের বিয়ে ডিউক অফ ক্ল্যারেন্স এন্ড এভনডেল আলবার্ট ভিক্টরের সাথে দিতে চেয়েছিলেন। তবে দুজনের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষেই বরফ গলেছিল। যদি তা না হতো, হেমোফিলিয়া আবারো একবার ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রবেশ করতো।
নিকোলাসের পিতা জার তৃতীয় আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর প্রায় তিন সপ্তাহ পর তিনি এলিক্সকে বিয়ে করেন। বাগদানের সময় এলিক্স লুথেরানিজম (এক ধরণের প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাস) থেকে রুশদের বিধিবদ্ধ ধর্মবিশ্বাসে দীক্ষিত হন এবং বিয়ের পর প্রিন্সেস এলিস থেকে হয়ে যান জারিনা আলেক্সান্দ্রা ফিওদরভনা। জারিনা আলেক্সান্দ্রা চারটি কন্যার পর একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। ওলগা, তাতিয়ানা, মারিয়া ও আনাস্তাসিয়ার পর জন্ম হয় এলেক্সিস এর। এলেক্সিসকে জারেভিচ বা পরবর্তী জার বলা হতো। কিন্তু জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই জানা যায় এলেক্সিস হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত। এলেক্সিসের এই হেমোফিলিয়ার সুযোগ নিয়েই তার চিকিৎসক হিসেবে আগমন ঘটে গ্রেগরী রাসপুতিনের।
উত্তরাধিকারীর রোগ নিরাময়ের নিমিত্তে আগত এই লোকটি জারিনার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে বসে। ভাগ্য এবং কিছু কাকতালীয় ব্যাপার তার উদ্দেশ্য চরিতার্থে সাহায্য করেছিল। পরবর্তীতে এটাকে কাজে লাগিয়ে নানান হঠকারী ও নীতিহীন সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে রাসপুতিন। যুদ্ধের পূর্বে একবার সেনাবাহিনীকে আশীর্বাদ করতে চাইলে সেনানায়ক তাকে সর্বসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারবেন বলে জানান।
এ সময় রাসপুতিন ভবিষ্যৎবাণী করে বসে- স্বয়ং জার সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব না দিলে তারা যুদ্ধে হেরে যাবে। তার কথায় সায় দিয়ে নিকোলাস যুদ্ধে চলে গেলে অনেকেই অসন্তুষ্ট হন, পাশাপাশি সকল ক্ষমতা চলে যায় আলেক্সান্দ্রার হাতে। যুদ্ধের দরুণ দেশে খাদ্য ও জ্বালানির অভাব দেখা দেয়। মানুষের মনে বিদ্রোহীভাব জেগে ওঠে। রাসপুতিনের পরেই সর্বোচ্চ ঘৃণা জার্মান আলেক্সান্দ্রাকে করা হতো সেখানে। ঘটনা পরিক্রমায় রাসপুতিনকে খুন এবং নিকোলাস ও তার পরিবারকে বন্দী করা হয়। পরবর্তীতে নৃশংসভাবে বোলশেভিক রক্ষীদের হাতে সপরিবারে খুন হন জার। এভাবেই শেষ হয় রাজকীয় শাসনের অধ্যায়, লেনিনের হাত ধরে শুরু হয় কমিউনিজমের- যার পেছনে কিছুটা হলেও হেমোফিলিয়া দায়ী।
এভাবেই হেমোফিলিয়া ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ রাজবংশ হয়ে একে একে প্রুসিয়ান, স্প্যানিশ ও রোমানভ রাজবংশে এবং রেখে যায় তার সর্বগ্রাসী প্রভাব। রাজপরিবারের লোকেরা নিজেদের মধ্যেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন বলেই এই রোগ তাদের মধ্যেই বেশি আকারে দেখা যেত। এ কারণেই একে রাজকীয় রোগও বলা হত। আধুনিক বিজ্ঞান বর্তমানে এর কারণ বের করলেও রক্তপাত বন্ধ না হওয়া এই রোগের আজ অবধি কোনো ফলপ্রসূ চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে উপযুক্ত চিকিৎসা আবিষ্কৃত হবে জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে নেমে আসা এই বংশবাহিত রোগের।
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/Haemophilia_in_European_royalty
২) englishmonarchs.co.uk/haemophilia.html
৩) onlinelibrary.wiley.com/doi/10.1111/j.1365-2141.1999.01327.x/full
৪) lisawallerrogers.com/category/people/royaltynobility/the-romanovs-of-russia/tsar-nicholas-and-tsarina-alexandra/
৫) esp.org/misc/vignettes/alexis.html
৬) en.wikipedia.org/wiki/Grigori_Rasputin
৭) en.wikipedia.org/wiki/Haemophilia