নিনজাদের নিয়ে গড়ে উঠা কিংবদন্তী, লোককথা এবং গাল গল্পের মধ্যে হারিয়ে গেছে প্রায় পুরো ইতিহাসই। এরপরেও যা টিকে আছে, অতিরঞ্জিত উপকথাগুলোর মধ্যে যেসব সত্য লুকায়িত আছে, সেসব আমাদের প্রতিনিয়ত শিহরিত করে তোলে। রক্ত-মাংসে গড়া মানুষগুলোকে করে তুলে অতিমানবীয়। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পরিচয় গোপন রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুবাদে বিখ্যাত নিনজারাও থেকে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে তার মধ্য থেকেও কিছু বিখ্যাত নিনজার পরিচয় প্রকাশ হয়েছে। যদিও তাদের নিয়ে প্রচারিত হয়েছে বহু উপকথা, রূপকথা। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন প্রকাশ হওয়া নিনজাদের মধ্যে অনেকেই কাল্পনিক চরিত্র।
আজ আপনাদের ইতিহাসে আলোচিত বিখ্যাত কয়েকজন নিনজা যোদ্ধাদের গল্প শোনাবো, যাদের কর্মকান্ড জি.আই.জো’র স্টর্ম শ্যাডো এবং স্নেক আই, নিনজা এবং শ্যাডো অফ অ্যা টেয়ারের কেসি বোম্যান, নিনজা অ্যাসাসিনের রাইয়ুজু এবং নিনজা টার্টলের রাফায়েল, লিওনার্দো এবং ডোনাটেললোর মত সিনেমা কিংবা এনিমেশনের বিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্রগুলোর চেয়েও বেশি শিহরিত করবে।
হিনো কুমাওয়াকা
জাপানী ঐতিহাসিক মহাকাব্য তাইহেইকির ধারাবিবরণী মতে, হিনো কুমাওয়াকার জন্ম ১৪শ শতাব্দীর দিকে। কুমাওয়াকার বাবা হিনো সুকেমতু ছিলেন গু-ডাইমু সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ উপদেষ্টা। ঐ সময়কার জাপানী সামরিক সরকার কামাকুরা শুগানেতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে সাদু প্রদেশের একটি দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়। সেখানকার রাজকীয় আদালতের প্রধান বিচারপতি সন্ন্যাসী হুমা সুবেরো, সুকেমতুকে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উল্লেখ করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।
ঐ সময়টাতে ১৩ বছর বয়সী কুমাওয়াকা ওমুরো স্কুলের প্রধান মঠ নিনা-জিতে আত্মগোপনে ছিল। বাবার মৃত্যুদণ্ডের আদেশের খবর পেয়ে সে দ্বীপে আসে এবং বিচারপতি হুমা সুবোরোর কাছে বাবাকে শেষ বারের মতো দেখতে দেওয়ার জন্য আবেদন জানায়। কিন্তু সুবোরো তার আবেদন নাকচ করে দেয় এবং কাছাকাছি একটি বাড়িতে আটকে রাখে। কয়েকদিন পরেই শিরশ্ছেদ করে হিনো সুকেমতুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কুমাওয়াকে মাউন্ট কুয়ায় তার বাবার মৃতদেহ দাহ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হলেও সে অসুস্থতার ভান করে সেখানে রয়ে যায় এবং প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে।
এক রাতে সুযোগ পেয়ে কুমাওয়াকা হুমার ছেলেকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বের হয়। সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করে পাশের কক্ষেই হুমা সুবোরো নিজেই ঘুমিয়ে রয়েছে। তাৎক্ষনিক মত পাল্টে ছেলের বদলে তাকেই হত্যা করে প্রতিশোধ নেওয়ার পণ করে। কক্ষে ঢুকে কুমাওয়াকা দেখতে পায় ঘরে আলো জ্বলছে। যেকোনো সময় সন্ন্যাসী জেগে গেলে আলোর কারণে তার উপস্থিতি জেনে যাবে। তাই সে পাশের জানালা খুলে দেয়। জানালা দিয়ে প্রবেশের করা বাতাসের কারণে আলো নিভে যায়। ছুরিকাঘাতের পূর্বে তার মনে হলো, ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করা মানে মৃত ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করা। তাই সে সন্ন্যাসীকে জাগিয়ে তোলে এবং বুকে ও গলায় ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দুর্গের লম্বা দেয়ালের কারণে পালাতে না পেরে একটি বাঁশ ঝোপে অবস্থান করে।
ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার কিছুক্ষণ পর একজন রক্ষী রক্তমাখা পায়ের ছাপ দেখে কুমাওয়াকাকে অনুসরণ করে। ধরা পরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সে লম্বা বাঁশ বেয়ে দুর্গের দেওয়াল অতিক্রম করতে সচেষ্ট হয় এবং একটি তামাক ক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকে সে দেখতে পায় শতশত মানুষ তার খোঁজে পাহাড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে। ঐদিনই স্থানীয় একটি মঠে সে আশ্রয় নেয় এবং সেখানকার প্রধানকে তার গল্প বলে সন্তুষ্ট করতে সফল হয়। তার সহযোগিতাতেই পরবর্তীতে নানান চড়াই উৎচড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিরাপদে ইছিগো প্রদেশে পালিয়ে যায় সে।
কাতু ডানযু
কমিক্স সিরিজ ‘পাথ অফ অ্যাসাসিন’-এ কাইট কাটু হিসেবে পরিচিত চরিত্রটি নিনজা যোদ্ধা কাতু ডানযু। পনের শতাব্দীর প্রথম দিকে জন্ম নেওয়া এই নিনজা যোদ্ধা সেসময়ে তবি কাতু বা ফ্লাইং কাতু নামে পরিচিত ছিল। অনেকের মতে সেনগকু সময়কালে নিনজাদের নিয়ে গড়ে উঠা কল্পকাহিনীর জন্য এই যোদ্ধাই সবচাইতে বেশি দায়ী। বিশেষ করে নিনজাদের অতিমানবীয় এবং অতিপ্রাকৃতিক শক্তি নিয়ে যেসব কিংবদন্তীগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা ডানযুর সময় থেকেই।
ডানযু মূলত বিখ্যাত ছিল জাদুকর হিসেবে। প্রায় বিশ-পঁচিশজন মানুষের সামনে পুরো একটি ষাঁড়কে খেয়ে ফেলা, খালি মাঠে বীজ ছড়িয়ে দিয়ে সেখান থেকে শাখা-প্রশাখাসহ গাছ এবং ফুল তৈরি করা সহ নানা রকমের যাদুকরী কীর্তি এবং কৌশলের জন্য সে সময়কার সামন্ত প্রভুরাও তাকে সমীহ করত।
ঐতিহাসিক ধারাবিবরণী মতে, সেনগকু সময়ের সবচাইতে শক্তিশালী ডাইম্যু (Daimyo) লর্ড হিসেবে পরিচিত উসুগি কেনশিন ডানযুর সুনামের কথা জানতে পেরে তাকে প্রধান দুর্গে আমন্ত্রণ জানায়। ডানযুর দক্ষতা পরীক্ষা করার জন্য কেনশিন তাকে নাওই কানেতসুগু নামের একজন উকিলকে উপহার দেওয়া নাগিনাতা (একধরনের তলোয়ার) উদ্ধার করে দিতে বলে। ডানযু কানেতসুগুর দুর্গে অনুপ্রবেশ করে এবং দুর্গের সবচাইতে শক্তিশালী রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে নাগিনাতা উদ্ধার করে এবং সাথে সাথে জিম্মি হিসেবে একজন চাকরানীকেও ধরে নিয়ে আসে।
কেনশিন ডানযুর কর্মকাণ্ড দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার জন্য কাজ করার আহ্বান জানায়। কিন্তু ডানযু আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় মনক্ষুন্ন হয়। পরবর্তীতে ডানযুর সুনাম, কীর্তিকলাপের কথা লোকমুখে আরো বেশি করে ছড়াতে থাকে। সে দিন দিন আরো বেশি শক্তিশালী এবং বিখ্যাত হয়ে উঠে। কেনশিন, ডানজুর পক্ষ থেকে তার সাম্রাজ্যের উপর আঘাত আসতে পারে ভেবে ডানযুকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। সুযোগ বুঝে কেনশিন তার প্রতিদ্বন্দ্বী টাকেডা শিনজেন নামক ডাইম্যুর আরেকজন শক্তিশালী সামন্ত প্রভুর উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য ডানযুর উপর বল প্রয়োগ করে এবং কৌশল খাটিয়ে শিনজেনকে এই কথা বোঝাতে সচেষ্ট হয় যে, ডানযু ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। শিনজেন ডানযুকে হত্যার আদেশ দেয় এবং পরবর্তীতে শিরশ্ছেদ করে তার হত্যা কার্যকর করা হয়।
মুচিযুকি চাওমি
ফুল বকু হিরোস, ব্লাড ব্রাদার, হিরো হান্টার, জিকু হাওডিন, লিজেন্ড অফ ড্রিফট, সেনগকু কালেকশনের মতো অসংখ্য চাইনিজ ভিডিও গেমের এই পরিচিত নিনজা যোদ্ধা মুচিযুকি চাওমির জন্ম ইগা বংশে। তাকে ইতিহাসে প্রথম প্রকাশিত কুনোইচি বা মহিলা নিনজা হিসেবে ধরা হয়।
চাওমির স্বামী মুচিযুকি নবুমাসা ছিল পনের শতকের সবচাইতে বিখ্যাত এবং অভিজাত ডাইম্যু সামন্ত প্রভু টাকেডা শিনজেনের ভাতিজা এবং শিনানোর শাকু এলাকার সামুরাই সেনাপতি। কাওয়ানা কাজিমার চতুর্থ যুদ্ধে তার মৃত্যুর পর চাওমি, টাকেডা শিনজেনের আশ্রয়ে থাকা শুরু করে। সে সময়ই টাকেডা তাকে আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের খবরাখবর রাখার জন্য একদল নারী গুপ্তচর তৈরির কাজ দেয়।
চাওমি প্রায় ৩০০ মহিলা নিয়ে শিনশো এলাকার নাজু গ্রামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল স্থানীয় পতিতা, এতিম এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মহিলা। ইতিহাসবিদদের মতে, চাওমি এমন একটি মহিলা নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল যা পতিতালয় থেকে শুরু করে বড় বড় রাজ দরবার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গুপ্তচরবৃত্তি থেকে শুরু করে হত্যা, অপহরণ, ব্লাকমেইলিং ইত্যাদি নানা কাজের জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ১৫৭৩ সালে চাওমির রহস্যজনক মৃত্যুর পর এই আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কটির কার্যক্রমের ব্যাপারে আর কোনো কিছু জানা যায় নি।
আরো পড়ুন: নিনজাঃ একদল নিঃশব্দ আততায়ীর ইতিকথা