দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কর্তৃক আকস্মিকভাবে পার্ল হারবার নৌ ঘাঁটি আক্রমণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের ভয়াবহতম সামরিক ক্ষয়ক্ষতি। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। এই হামলায় ১৯টি জাহাজ ডুবে যাওয়া/ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও ২,৪০৩ জন নিহত ও ১,১৩৮ জন আহত হয়।
পার্ল হারবার আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো। তিনি ছিলেন ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভির কম্বাইন্ড ফ্লিটের সর্বাধিনায়ক এবং ক্ষুরধার মস্তিষ্কের তুখোড় মিলিটারি ট্যাক্টিশিয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পেছনে তার নেয়া অনেক অবদান রয়েছে। মিডওয়ে, কোরাল সি, স্যাভো আইল্যান্ড ইত্যাদি যুদ্ধে তিনি ছিলেন নেপথ্যের নায়ক। কিন্তু ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে গুয়াডালক্যানেল, নিউ গুয়েনা, সলোমন আইল্যান্ড ক্যাম্পেইনের একাধিক যুদ্ধে জাপান হেরে গিয়ে নাবিকদের মনোবল তখন তলানিতে। এ সময় ইয়ামামোতো বিভিন্ন জাপানি ঘাঁটি পরিদর্শন ও ভাষণ দিয়ে সেনাদের উজ্জীবিত করতে সফর শুরু করেন।
ঘটনাক্রমে একটি সফরের কথা জেনে যায় মার্কিন নৌবাহিনীর সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। যুক্তরাষ্ট্র জানতো যে ইয়ামামোতোর মতো টপ লেভেল এডমিরালকে হত্যার ফলে জাপানিদের মনোবল একলাফে বহুগুণ কমে যাবে। এছাড়া পার্ল হারবারের প্রতিশোধের ব্যাপার তো ছিলই। এজন্য তাকে হত্যার গোপন মিশন হাতে নেয়া হয়। এর নাম দেয়া হয় অপারেশন ভেনজেন্স!
তুরুপের তাস কোডব্রেকার
পার্ল হারবার আক্রমণের পর থেকেই মার্কিন সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সকে শক্তিশালী করা হয়। নতুন করে গঠন করা হয় Military Intelligence Service (MIS)। এখানে ‘Nisei’ নামে পরিচিত সেকেন্ড জেনারেশন জাপানিজ-আমেরিকান নাগরিকরা ও জাপানি ভাষা জানা মার্কিনীদের রেডিওতে আড়ি পাতার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই ইউনিটে ছিলেন একদল দক্ষ ক্রিপ্টোগ্রাফার যারা জাপানিদের নেভাল কোডবুক JN-25 এর বেশিরভাগ অংশের অর্থ বের করে ফেলেছেন! এর ফলে এনক্রিপ্টেড জাপানি রেডিও মেসেজ তখন প্রায় পুরোটা বা আংশিক অনুবাদ করা সম্ভব হচ্ছিল। এসকল মেসেজ থেকে জাপানিদের অনেক তথ্য অগ্রিম জেনে গিয়ে মিত্রবাহিনী পাল্টা যুদ্ধকৌশল ঠিক করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্যাসিফিক থিয়েটারে একের পর এক মার্কিন বিজয়ের নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই কোডব্রেকাররা।
এপ্রিলের শুরুতেই এডমিরাল ইয়ামামোতো সলোমন আইল্যান্ড, নিউ গুয়েনার জাপানি ঘাঁটিগুলোতে ইনস্পেকশন ট্যুরের সিদ্ধান্ত নেন। ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের জাপানিজ-আমেরিকান সৈনিক ‘হ্যারল্ড ফুদেন্না’ বিশেষ ধরনের রেডিও মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করেন। উক্ত মেসেজে ‘ম্যাজিক‘ শব্দটি বারবার ব্যবহৃত হতে দেখেন। তখনও ম্যাজিক এর অর্থ বের করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে মেসেজ নাম্বার NTF131755 এ জাপানের এগারো ও ছাব্বিশতম এয়ার ফ্লোটিলার দুটো বেজ ইউনিট কমান্ডারের মেসেজে ‘অমুক তারিখে ম্যাজিক আসবেন’ কথাটি জানা যায়।
এতক্ষণে তারা বুঝতে পারে যে ‘ম্যাজিক‘ আসলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যাকে দেখলে সাধারণ সৈনিকরা জাদুর মতো মোহাচ্ছন্ন হবে। সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের ক্রিপ্টোগ্রাফার জন পল স্টিভেন্স এর অর্থ বের করেন এই যে সম্ভবত এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো ঘাঁটিগুলো পরিদর্শনে আসবেন। কিন্তু তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেটি প্রথমে বিশ্বাস করেনি। ইয়ামামোতোর মতো হাই প্রোফাইল মিলিটারি কমান্ডারগণ সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে না এসে দূর থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু একই মেসেজ আলাস্কা-হাওয়াই দ্বীপের আরো তিনটি সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ইন্টারসেপ্ট করার পর স্টিভেন্সের ধারণা সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি কবে, কোথায়, কীভাবে, কোন বিমানে, কখন ইয়ামামোতো আসবেন- এর সবই রেডিওতে আড়ি পেতে মার্কিনিরা জানতে পারে!
এই বিষয়টি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নজরে আনা হলেও তিনি তাকে হত্যার জন্য সরাসরি কোনো এক্সকিউটিভ অর্ডার দেননি। তবে তার নেভাল সেক্রেটারি ফ্র্যাঙ্ক নক্সের সূত্রে অনেকেই প্রেসিডেন্টের আনঅফিশিয়াল অর্ডারের কথা বলেছেন যার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার প্যাসিফিক অঞ্চলের ফ্লিট কমান্ডার এডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিটজ এর উপর ছেড়ে দেয়া হয়। নিমিটজ তার সবচেয়ে বড় শত্রুকে শেষ করে দেয়ার ব্যাপারে ভাইস এডমিরাল উইলিয়াম হ্যালসির সাথে পরামর্শ করেন। কারণ ইয়ামামোতোকে হত্যা করা হলে জাপানিরা টের পেয়ে যাবে যে মার্কিন ক্রিপ্টোগ্রাফারগণ তাদের নেভাল কোডবুক ক্র্যাক করে ফেলেছে। যদি তারা এনক্রিপ্টেড কমিউনিকেশনের পদ্ধতি পরিবর্তন করে ফেলে তবে জাপানিদের কার্যক্রম সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার সবচেয়ে বড় উৎসটি বন্ধ হয়ে যাবে।
এডমিরাল নিমিটজ তাই এমনভাবে অপারেশন শুরু করেন যেন ইয়ামামোতো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি দেখে বাংলা প্রবাদ “ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে” মনে হয়। এজন্য রেডিওতে ভুয়া গল্প ছড়ানো হয় যে অস্ট্রেলিয়ান কোস্ট ওয়াচার গোয়েন্দারা রাবাউলে একজন হাই র্যাঙ্কিং অফিসারকে আসতে দেখেছেন। মার্কিনিরা উক্ত অফিসার সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না এমন তথ্যও ছড়ানো হয়। মার্কিনীরা জানতো এসব ভুয়া তথ্য অবশ্যই জাপানিরা আড়ি পেতে শুনে ফেলেছে। তাছাড়া হাই র্যাঙ্কিং অফিসার তো নিয়মিতই যাওয়া-আসা করে। কিন্তু ইয়ামামোতোর বিষয়টি যে ফাঁস হয়ে গেছে তা জাপানিরা জানতো না। মূলত তিনি নিহত হলে শত্রুর মনোবল ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া এবং তার জায়গায় তুলনামূলক কম দক্ষ এডমিরাল নেতৃত্বে আসবে জেনে প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ এই অপারেশন গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছিল।
অপারেশন প্রস্তুতি
এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতোর পরিকল্পনা ছিল ১৮ এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে রাবাউল নৌঘাঁটি থেকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের বুগেনভাইল আইল্যান্ডের জাপানি নেভাল এয়ার ইউনিট পরিদর্শনে যাবেন। এই ইউনিটের পাইলটরা ৭ এপ্রিল থেকে চলা ‘অপারেশন আই-গো’তে লড়াই করছিল। সংক্ষিপ্ত এই ফ্লাইটের ব্যাপ্তি ছিল মাত্র দুই ঘন্টা। তাই ইয়ামামোতো ও তার চিফ অব স্টাফ ভাইস এডমিরাল মাতোমে উকাগিসহ অন্য স্টাফদের দুটি মিতসুবিশি জি-৪এম (ডাকনাম বেট্টি) বোমারু বিমানে করে বহন করা হচ্ছিল। তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছিল মিতসুবিশি এ-৬এম বিমান যা ‘জিরো’ ফাইটার’ নামেই অধিক পরিচিত।
মার্কিন রাডারে শনাক্ত হওয়া এড়াতে পানির উপর দিয়ে এমনভাবে উড়ে যাওয়ার ফ্লাইট প্ল্যান সাজানো হয় যেখানে মার্কিন বিমানঘাঁটির সাথে সবসময় ৪০০ মাইলের মতো দূরত্ব বজায় থাকে। এটি জানতে পেরে নৌবাহিনীর এফ-৪ ওয়াইল্ডক্যাট ফাইটার বাদ দিয়ে পি-৩৮ লাইটনিং বিমানকে মিশনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। কারণ বিমানগুলোকে যেতে ৬০০ মাইল, আসতে ৪০০ মাইল দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। অপারেশনাল রেঞ্জ বাড়ানোর জন্য পি-৩৮ বিমানগুলোর ডানায় ৬২০ লিটারের দুটো বাড়তি ফুয়েল ট্যাংক লাগানো যেত। কিন্তু এগুলো বিমানটির ম্যানুভার সক্ষমতা কমিয়ে দেয় যা জাপানি জিরো ফাইটারের জন্য সহজ টার্গেট। তাই ১,২০০ লিটারের বিশেষ ফুয়েল ট্যাংক নিউ গুয়েনা থেকে জরুরি ভিত্তিতে উড়িয়ে আনা হয়।
মেজর জন ডব্লিউ মিচেলের ৩৩৯ তম ফাইটার স্কোয়াড্রনের মোট ১৮টি বিমানকে এই মিশনের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। নিখুঁত নেভিগেশনের জন্য মিচেল তার বিমানে নেভাল কম্পাস লাগিয়ে নেন। প্রতিটি পি-৩৮ বিমানে ছিল একটি ২০ মিলিমিটার ক্যানন ও চারটি .৫০ ক্যালিবার মেশিনগান যার প্রতিটি ৫০০ রাউন্ড করে বুলেট ধারণ করত। চারটি বিমানকে ‘কিলার ফ্লাইট‘ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আরো চারটি বিমানকে ‘টপ কভার‘ হিসেবে ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায় ওড়ান হবে যেন জাপানি ফাইটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। বাকিরা আশেপাশের জাপানি ঘাঁটি থেকে আসা আক্রমণ সামলানোর জন্য ব্যাকআপ হিসেবে থাকবে।
এই ফ্লাইট প্ল্যান সাজিয়েছিলেন ইউএস মেরিনের মেজর জন কনডন। কিন্তু মেজর মিচেল এই প্ল্যানে ত্রুটি খুঁজে পান। তিনি রীতিমতো গ্রাফে অঙ্ক কষে সময় ও স্থানের কার্ভ অঙ্কন করে ইয়ামামোতোর বিমানের সম্ভাব্য পাঁচটি ইন্টারসেপ্ট পয়েন্ট বের করে সেই অনুযায়ী ফ্লাইট প্ল্যান সাজান। ঠিক করা হয় সকাল নয়টা পঁয়ত্রিশ মিনিটে বুগেনভাইলে ল্যান্ড করার ঠিক দশ মিনিট আগে যখন ভিআইপি বহনকারী বিমানটি নিচে নামতে শুরু করবে তখনই হামলা করা হবে। এজন্য তিনি কিলার গ্রুপকে কোরাল সাগরের মাত্র ৫০ ফুট উচ্চতা দিয়ে রেডিও সাইলেন্স বজায় রেখে উড়তে নির্দেশ দেন।
কিলার ফ্লাইট
১৮ এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে সকাল সাড়ে সাতটায় অপারেশনের শুরুতেই গন্ডগোল লাগে। কিলার গ্রুপের একটি বিমানের টেকঅফের সময় চাকা ফেটে যায়। অন্য একটি বিমানের এক্সট্রা ফুয়েল ট্যাংকে সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাকআপ বিমানগুলো থেকে দুটো বিমান রিপ্লেসমেন্ট করে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। মার্কিন টপ কাভার গ্রুপকে রাডারে ডিটেক্ট করে জাপানিজ কমান্ডাররা এডমিরাল ইয়ামামোতোর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ট্যুর বাতিল করতে রেডিও মেসেজ চালাচালি করেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়েই ইয়ামামোতোর বিমান আকাশে ওড়ে।
বিমানগুলো দুই ভাগ হয়ে সাড়ে ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় V ফর্মেশনে উড়তে শুরু করে। এসময় শিকার ও শিকারির দূরত্ব ছিল ৫০৭ মাইল। মেজর মিচেলের ফ্লাইট গ্রুপের চারটি বিমান কিলার গ্রুপের বিমানগুলোকে পথ দেখিয়ে খুবই কম উচ্চতায় উড়ে আসতে থাকে। কিলার গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন থমাস ল্যানফিয়ের। এই গ্রুপের অন্য পাইলটদের মাঝে ছিলেন ছিলেন যথাক্রমে লেফটেন্যান্ট রেক্স টি.বার্বার, লেফটেন্যান্ট বেসবি হোমস, এবং লেফটেন্যান্ট রেমন্ড হাইন। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগেই ইন্টারসেপ্ট পয়েন্টে এসে পৌঁছান মেজর মিচেল। ইয়ামামোতোর বিমানটি এর একটু পরেই ল্যান্ডিংয়ের জন্য উচ্চতা কমাতে শুরু করে।
পি-৩৮ ফাইটারগুলো প্রায় খালি হয়ে যাওয়া এক্সটার্নাল ফুয়েল ট্যাংক ফেলে দিয়ে ফুল স্পিডে আক্রমণের জন্য ধেয়ে যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে লেফটেন্যান্ট হোমসের ড্রপ ট্যাংকগুলো যান্ত্রিক কারণে খসে পড়তে অস্বীকৃতি জানায়। আকাশযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আগে বাড়তি পেলোড ফেলে দিলে পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধ করা যায়। আবার ফাইটার পাইলটরা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় আক্রমণ করেন যেন একজনের বিপদে আরেকজন ব্যাকআপ দিতে পারেন।
লেফটেন্যান্ট হোমস আক্রমণে যেতে পারবেন না দেখে তার উইংম্যান লেফটেন্যান্ট রেমন্ড হাইন আক্রমণে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। মেজর মিচেল ক্যাপ্টেন ল্যানফিয়ের ও লেফটেন্যান্ট রেক্স টি.বার্বারকে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেন। তাদের সাহায্য করতে ব্যাকআপ ফাইটারদের কল করেন। তিনি কাছাকাছি থাকলেও বা তার গ্রুপের বিমানগুলোকে নিয়ে আক্রমণে যাননি। কারণ মার্কিন হামলার খবর শুনে কয়েক মাইল সামনের বুগেনভাইল দ্বীপ থেকে আসা জাপানি রিএনফোর্সমেন্ট ফাইটার ঠেকানোর জন্য আবার ব্যাকআপ লাগবে। একই সঙ্গে ল্যানফিয়ের-বার্বার ব্যর্থ হলে তিনি যেন মিশন কমপ্লিট করতে পারেন সেজন্য নিচ থেকে টার্গেট বিমান ফলো করতে থাকেন।
মার্কিন বিমানের উপস্থিতি টের পেয়ে দুটো জিরো ফাইটার তাদের ফুয়েল ট্যাংক ফেলে আক্রমণ ঠেকাতে এগিয়ে আসে। ক্যাপ্টেন ল্যানফিয়ের এসকর্ট ফাইটারগুলোকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে লেফটেন্যান্ট রেক্স টি. বার্বারকে ভিআইপি বহনকারী বিমানে হামলার নির্দেশ দেন। উক্ত ‘মিতসুবিশি জি-৪এম’ ওরফে বেট্টি এর নিরাপত্তায় তখনও একটি জিরো ফাইটার তার পাশে উড়ছিল। বার্বার তাকে প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ না দিয়ে বেট্টির ডান ইঞ্জিনসহ রিয়ার ফিউজলাজে (যেখানে ভিআইপি থাকার কথা) গুলি করেন। বাম ইঞ্জিনে গুলি করার সাথে সাথেই জাপানি পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারান। বিমানটি এত বিপদজনকভাবে ঘুরে যায় যে আর একটু হলেই লেফটেন্যান্ট রেক্স টি. বার্বারের বিমানের সাথে মাঝ আকাশে সংঘর্ষ হতো! তিনি বেট্টিকে দ্বীপের জঙ্গলে বিধ্বস্ত হতে দেখেন।
বার্বার এবার দ্বিতীয় টার্গেটের দিকে নজর দেন। কারণ তিনি জানতেন না কোন বিমানে এডমিরাল ইয়ামামোতো আছেন। তাই দুটো বিমানই ধ্বংসের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আক্রমণ এড়াতে নিচু হয়ে উড়তে থাকা দ্বিতীয় বেট্টিকে শনাক্ত করে ধাওয়া শুরু করেন তিনি। কিন্তু তার বিমানকে আরেকটি জিরো ফাইটার ধাওয়া শুরু করে। বার্বার জাপানি পাইলটের সাথে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রেখে দ্বিতীয় বোম্বারের পিছু নেন। কিন্তু আগেই কে যেন উক্ত মিতসুবিশি জি-৪এমকে ধাওয়া শুরু করছে! রেডিওতে কথা বলে নিশ্চিত হন যে সেটি লেফটেন্যান্ট হোমসের বিমান। অবশেষে তিনি এক্সটার্নাল ফুয়েল ট্যাংক ফেলে আক্রমণে যোগ দিয়েছেন।
হোমস গুলি করে বেট্টির ডান ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত করেন। এটি সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গতি কমতে শুরু করায় ও নিজের উচ্চগতির কারণে উইংম্যান রেমন্ড হাইন বাম ইঞ্জিনে গুলি করার সুযোগ মিস করেন। এদিকে লেফটেন্যান্ট রেক্স টি. বার্বারের যেন শিকারি টি-রেক্স ডাইনোসরের ন্যায় ক্ষুধা পেয়েছে। তিনি উড়ে এসে ক্ষতিগ্রস্ত বেট্টিকে খুব কাছ থেকে গুলি করেন। এতে বিমানের ধাতব টুকরাগুলো বার্বারের বিমানে আঘাত করে। ফলে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পি-৩৮ বিমানটি তখনও পাইলটের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে জাপানি বোম্বারটি অগভীর পানিতে ক্রাশ ল্যান্ডিং করে। আক্রমণ শেষ হওয়ার পর বার্বার, হোমস, হাইন তিনজনেই এবার জিরো ফাইটারের পাল্টা আক্রমণের শিকার হন। তারা এঁকেবেঁকে মেশিনগানের গুলি ফাঁকি দিতে শুরু করেন। বার্বারের বিমানে ১০৪টি গুলি বিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে যেন তার বিমান তখনও উড়ছিল।
সংক্ষিপ্ত ঐ আকাশযুদ্ধে লেফটেন্যান্ট হোমস ও বার্বার দুজনেই দুটি জিরো ফাইটার ভূপাতিত করার দাবি করেন। কিন্তু জাপানি ওয়্যার লগ অনুযায়ী সেদিন কোনো জিরো ফাইটার ভূপাতিত হয়নি। লেফটেন্যান্ট হাইনের বিমানের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি জিরো ফাইটারের গুলিতে ভূপাতিত হয়েছেন নাকি জ্বালানি শেষ হয়ে সাগরে পতিত হয়ে মারা গেছেন তা আর জানা যায়নি। তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে ব্যাকআপ ফাইটাররা এসে পড়েছে। ভিআইপিদের হারিয়ে বিপর্যস্ত জাপানি পাইলটরা রণে ভঙ্গ দেয়। বুগেনভাইল বিমানঘাঁটি থেকে রিএনফোর্সমেন্ট না আসায় মেজর মিচেল সবাইকে নিয়ে গুয়াডালক্যানেলে ফিরে যাওয়ার পথ ধরেন। একমাত্র লেফটেন্যান্ট হোমস জ্বালানির অভাবে ফিরে যেতে পারবেন না ভেবে রাসেল আইল্যান্ডে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে ল্যান্ড করতে বাধ্য হন। টপ কাভারের দায়িত্বে থাকা চার বিমানের সাথে এসকর্ট বিমানের গুলিবিনিময় হয়েছিল বটে। কিন্তু কোনো পক্ষের বিমানই ভূপাতিত হয়নি।
সংক্ষিপ্ত সেই আকাশ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন থমাস ল্যানফিয়েরের ভূমিকা কী ছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত নন। তবে অনেকেই তাকে মিথ্যাবাদী বলে মনে করেন। তিনি একটি জিরো ফাইটার ভূপাতিত করার দাবি করেন যা যুদ্ধে অংশ নেয়া জাপানি জিরো ফাইটার পাইলট ও ওয়্যার লগের বক্তব্য থেকে সত্যতা পাওয়া যায় না। ক্যাপ্টেন ল্যানফিয়ের সেই দাবি তো করেছেনই, এমনকি ইয়ামামোতোর বিমানও ভূপাতিত করার দাবি করেন! কিলার গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে তার দেয়া আফটার একশন রিপোর্টকেই কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত ধরে নেয়। যদিও পরবর্তীতে এই কৃতিত্ব লেফটেন্যান্ট রেক্স টি. বার্বারকেই দেয়া হয়। তার ভূপাতিত করা প্রথম বিমানেই এডমিরাল ইয়ামামোতো ছিলেন। দ্বিতীয় বিমানে থাকা ভাইস এডমিরাল মাতোমে উকাগি ও তার দুই সঙ্গী পানিতে ক্রাশ করে অল্পের জন্য বেঁচে যান।
ক্যাপ্টেন ল্যানফিয়ের ঘাঁটিতে ফেরার পথে উত্তেজনার অতিশয্যে রেডিও কমিউনিকেশন প্রোটোকল ভেঙে মেসেজ পাঠান, “That son of a ***** will not be dictating any peace terms in the White House”, এর ফলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। কেননা জাপানিরা এই মেসেজ শুনে থাকলে বুঝে যেত যে এডমিরাল ইয়ামামোতোকে হত্যার জন্যই এই অপারেশন চালানো হয়েছে।
ঘটনার প্রতিক্রিয়া
পরদিন জাপানিজ সার্চ এন্ড রেসকিউ টিম ক্রাশ সাইট থেকে এডমিরাল ইয়ামামোতোর মৃতদেহ উদ্ধার করে। তার বিমানটি ভূমিতে আছড়ে পড়ার ফলে তিনি তার আসনসহ ছিটকে বাইরে এসে গাছের নিচে গিয়ে পড়েন। সাদা গ্লাভস পরা হাতে তার ‘কাতানা’ তলোয়ারের বাট ধরা ছিল। জাপানের ঐতিহ্য অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর অফিসাররা অন্যান্য অস্ত্রের পাশাপাশি তাদের র্যাঙ্ক অনুযায়ী তলোয়ার সঙ্গে রাখতেন। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তার দেহে দুটো বুলেটের আঘাত পাওয়া গেছে। একটি বুলেট বাম কাঁধের পেছনে বিদ্ধ হয়েছিল। অপরটি বাম চোয়ালের নিচ দিয়ে ঢুকে ডান চোখ দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার ফলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্টে বলা হয়।
১৯৪৩ সালের ১৮ এপ্রিল তার মৃত্যু হলেও ২১ মে সেটি প্রকাশ করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তিনি বীরের মতো যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছেন। তার দেহভস্ম তার প্রিয় ব্যাটলশিপ মুশাসিতে (ব্যাটলশিপ ইয়ামাটোর সিস্টারশিপ) করে জাপানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সৎকার করা হয়। মূলত সেনাদের মনোবলে যেন আঘাত না পড়ে সেজন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে প্রকৃত সত্য গোপন করা হয়- এমনটি দাবি করেছেন ইয়ামামোতোর জীবনী লেখক হিরোয়োকি আগায়া। তারপরও তার মৃত্যুর ঘটনা জাপানি সেনা ও জনগণকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
মার্কিনীরা নিজেদের স্বার্থে এই ঘটনার কৃতিত্ব দাবি করে প্রচার করেনি। শুধু ক্যাপ্টেন ল্যানফিয়েরের বরাতে নিয়মিত মিশনে দুটো জাপানি বোম্বার ভূপাতিত করার ঘটনা প্রকাশ করেছিল। ফলে জাপানিরা জানতে পারেনি যে মার্কিনীরা ঘটনাক্রমে নয়, বরং পরিকল্পনা করেই ঐ বিমান ভূপাতিত করেছিল। ২১ মে-র পর মার্কিনীরা প্রোপাগান্ডা ছড়ায় যে সম্ভবত যুদ্ধের অবস্থা ইয়ামামোতোর অনুকূলে যাচ্ছিল না বিধায় তিনি জাপানি সংস্কৃতিতে সম্মানজনক আত্মহত্যার প্রথা seppuku বা ‘হারা-কিরি‘ অনুসরণ করেছেন। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এই ঘটনায় ব্যাপক অসন্তুষ্ট হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী চার্চিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে উষ্মা প্রকাশ করেন। কেননা একজন এডমিরালকে হত্যার অগুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের ফলে জাপানিরা তাদের নেভাল কোডবুক ক্র্যাকের বিষয়টি টের পেয়ে যেতে পারত। উল্লেখ্য, ব্রিটেন তখন ইন্দো-প্যাসিফিক থিয়েটারে (বার্মাসহ এশিয়ার দেশগুলো) উক্ত কোডবুকের সাহায্যে নিয়ে মিত্রবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিল।
এই অপারেশনের ছয় মাস পর সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (AP) ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ফাঁস করে দেয়! মার্কিন কর্তৃপক্ষ এতে ব্যাপক অসন্তুষ্ট হয়। এই ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে মেজর মিচেল ও কিলার গ্রুপের পাইলটগণ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘মেডেল অফ অনার’ এর জন্য মনোনীত হয়েও শেষ পর্যন্ত সেই পদক পাননি। ক্রেডিট নিয়ে লেফটেন্যান্ট রেক্স টি. বার্বারের সাথে ল্যানফিয়েরের তিক্ততা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বার্বার অর্ধেক ক্রেডিট ভাগাভাগি করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ল্যানফিয়ের ইয়ামামোতোর বিমানে গুলি না করেও পুরো ক্রেডিট দাবি করেন। পরবর্তীতে ব্যাপক তদন্তের পর বার্বারকেই ইয়ামামোতোর বিমান ভূপাতিত করার ক্রেডিট দেয়া হয় এবং ল্যানফিয়ের তার ACE স্ট্যাটাস হারান। উল্লেখ্য, কমপক্ষে পাঁচটি বিমান ধ্বংসকারী পাইলটদের এইস বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকজন বিখ্যাত এইসদের গল্প পড়ুন এই লিংকে।
ইয়ামামোতোর বিমানের ধ্বংসাবশেষ এখনও একই স্থানে রয়েছে যা ২০১৫ সাল থেকে একটি পর্যটক গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এর ভাঙা অংশবিশেষ স্যুভেনির হিসেবে অনেকেই চুরি করে নিয়ে গেছেন। এছাড়া বিমানের ডানার অংশ জাপানে ইয়ামামোতো পরিবারের পারিবারিক জাদুঘর ও দরজার অংশ পাপুয়া নিউগিনির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রাখা আছে।