প্রায় ৪,০০০ বছরের পুরনো ইতিহাস সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সংস্কৃতির আজকের চীন গড়ে উঠেছে নানা বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে। ইতিহাসের জটিল বাঁক পেরিয়ে জনবহুল দেশটির ক্রমশ উত্থানের মতো তাদের ভাষাও একটি বিষ্ময় জাগানিয়া ব্যাপার। আধুনিক পৃথিবীতে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মানুষের দেশের ভাষা নিয়ে গোটা দুনিয়ার আগ্রহের কারণ ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক ইত্যাদি।
বিশাল এই জনগোষ্ঠীর ভাষা বলতে আমরা যা বুঝি, তা হলো চীনা ভাষা। আসলে চীনের সবচেয়ে বেশি লোক যে ভাষায় কথা বলে, তা হলো অনেকগুলো চীনা ভাষার মধ্যে অন্যতম এবং প্রচলিত একটি ভাষা। চীনের মহা-প্রাচীরের মতো বিশাল ও বিস্তৃত চাইনিজ ভাষার অবাক করা কিছু তথ্য নিয়ে আজকের আয়োজন। আপনি যদি জেনে থাকেন তো দারুণ, কিন্তু না জানলে চীনা প্রবাদের মত করে বলতে হয়, “wéi shíbù wǎn” (ওয়েই শুপু আয়ান), যার বাংলা করলে দাঁড়ায়,”খুব দেরি হয়ে যায়নি।”
প্রাচীন লিখন পদ্ধতি
বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ভাষা ব্যতীত পৃথিবীতে যেসব ভাষা আজও ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে চীনা ভাষার লিখন পদ্ধতি সবচেয়ে পুরনো, যা এখনও প্রচলিত। চীনা লিখন পদ্ধতি প্রায় ৩,০০০ বছরের পুরনো, কচ্ছপের খোলস ও প্রাণীর হাড়ে প্রথম ভাষাটির লিখিত রূপের সন্ধান পাওয়া যায়।
নানা প্রদেশ, নানা ভাষা
প্রাচীনকাল থেকে আজকের আধুনিক কাল পর্যন্ত চীনের সুবিশাল বিস্তৃত অঞ্চলের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের মুখে মুখে গড়ে উঠেছে তাদের নিজস্ব ভাষা। প্রদেশ ভেদে চীনারা কথা বলে ম্যান্ডারিন, উ, পিং, মিন, শাওঝিয়াং, হাক্কা, ক্যান্টনিজ এবং আরো অনেক ভাষায়। এমনকি একই প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষারও প্রচলন রয়েছে। যেমন ফুঝিয়ান প্রদেশে মিন, ম্যান্ডারিন এবং ফুঝোনিজ ব্যবহৃত হয়। বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায় এক প্রদেশের ভাষা আরেক প্রদেশের লোক বুঝতেই পারে না।
ভাষা নাকি উপভাষা?
চীনা ভাষাগুলোকে আলাদা করে ভাষা কিংবা উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কিনা সেটি তর্ক-সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে তাদের উপভাষা হিসেবে অবহিত করা হলেও দেখা যায় সেগুলোর আলাদা অভিধান ও ব্যাকরণ রয়েছে। একজন ক্যান্টনিজ বক্তা আরেকজন মিন বা হাক্কা ভাষাভাষী মানুষের কথা বুঝতে পারবেন না। নিজস্ব নিয়ম, নীতি ও উচ্চারণের বিস্তর পার্থক্যের বিচারে সেগুলো পৃথক ভাষা বলা যায়।
অন্যদিকে, সকল চীনা ভাষার লিখন পদ্ধতি ও রীতি সাধারণত অভিন্ন। চীনা ভাষার লিখিত রূপ সব অঞ্চলে একই রকম এবং যেকোনো ভাষাভাষীর লোকই তা পড়তে পারবে। ভাষা বা উপভাষা ভেদে উচ্চারণ ও অর্থ অবশ্যই ভিন্ন হবে।
চীনা অক্ষর, প্রতীকের সমাহার
চীনা ভাষা লেখার জন্য অন্যান্য প্রচলিত ভাষা যেমন বাংলা, আরবী বা ইংরেজির মতো প্রচলিত বর্ণমালা নেই। অন্যান্য ভাষার বর্ণমালাগুলো শুধু একটি আওয়াজ, যার নিজস্ব কোনো অর্থ নেই, বর্ণগুলো পাশাপাশি বসে আনুষঙ্গিক সাহায্য নিয়ে শব্দ গঠন করে। কিন্তু চীনা ভাষা লেখা হয় প্রতীক আকারে, যাদের চীনা অক্ষর (Chinese Characters) বলে। প্রতিটি অক্ষরের একটি স্বতন্ত্র অর্থ রয়েছে। প্রতিটি অক্ষর গঠিত হয় এমন কিছু অংশ নিয়ে, যা প্রতিফলিত করে কোনো বিমূর্ত ধারণা, বিষয়বস্তু, উচ্চারণ বা অর্থ। চীনা ভাষার লিখন পদ্ধতির শুরুটা হয়েছিল চিত্রলিপির মাধ্যমে, যা অনেক চীনা অক্ষরে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে, অবশ্যই আরো সরল ও অনেকটা ভিন্ন রূপে।
চীনা অভিধানে প্রায় ৫০,০০০ এর বেশি অক্ষর রয়েছে। মতান্তরে ধারণা করা হয়, আধুনিক চীনা ভাষায় অক্ষর সংখ্যা প্রায় ১,০০০০০ এবং দিনে দিনে ভাষার ক্রমবিকাশের মাধ্যমে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনা ভাষা শিখতে আগ্রহীরা এই অক্ষরের সংখ্যা শুনে ঘাবড়ে যাবেন না। চীনাদের প্রতিদিনের জীবনে সবগুলো অক্ষর ব্যবহার করতে হয় না। একজন স্নাতক পাশ করা চীনা ব্যক্তি প্রায় ৩,০০০-৬,০০০ অক্ষর জানেন। সবচেয়ে প্রচলিত ও সাধারণত প্রায় ২,৫০০ অক্ষর শিখে নিতে পারলেই আপনি একটি চীনা খবরের কাগজ পড়তে পারবেন এবং প্রতিদিনের ভাষার ৯৭.৯৭% বুঝতে পারবেন।
সরলীকৃত ও চিরাচরিত অক্ষর
১৯৫০ সালের পূর্ব পর্যন্ত চীনা ভাষার লিখন পদ্ধতির একটিমাত্র প্রচলিত রূপ ছিল, যা হলো চিরাচরিত বা ঐতিহ্যগত অক্ষর। ঐতিহ্যগত অক্ষরগুলো বেশি জটিল হওয়ায় অনেক অক্ষরে পরিবর্তন এনে আরো সরল রূপ দেওয়া হয়। চীন সরকার দেশের জনগণের স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি করতে, লিখন পদ্ধতি সহজ ও উন্নত করতে ১৯৫০ ও ১৯৬০ সালে চিরাচরিত অক্ষরের বদলে সরলীকৃত অক্ষর চালু করে। সরলীকৃত অক্ষরের চেয়ে চিরাচরিত অক্ষর বেশি জটিল হলেও তাইওয়ান ও হংকং এ এটিই এখনো ব্যবহৃত হয়। চীনের মূল ভূখন্ডে অবশ্য সরলীকৃত রূপ বেশি জনপ্রিয়। রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করে চীনা ভাষা লেখার আরেকটি পদ্ধতি চালু রয়েছে, যেটি পিন-ইন নামে পরিচিত।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা
পুরো বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ চীনা ভাষায় কথা বলে। সবচেয়ে বেশি লোকের কথ্য ভাষা হলো চীনা ম্যান্ডারিন। প্রায় ৯৫৫ মিলিয়ন ম্যান্ডারিন ভাষাভাষী ছড়িয়ে রয়েছে গোটা দুনিয়ায় এবং প্রায় ৭০% চীনের অধিবাসী ম্যান্ডারিনে কথা বলে। অর্থাৎ আপনি যদি ম্যান্ডারিন জানেন তাহলে এই ভাষায় আপনি কথা বলতে পারবেন বিশ্বের প্রায় ১৪.৪% এর বেশি মানুষের সাথে। চীন ও তাইওয়ানের অফিসিয়াল ভাষা হলো ম্যান্ডারিন এবং সিঙ্গাপুরের অন্যতম একটি অফিসিয়াল ভাষাও এটি। জাতিসংঘের ছয়টি অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে যে চীনা ভাষা ব্যবহার করা হয় সেটি হলো প্রচলিত ম্যান্ডারিন। চীনের বাইরে, চীনা অধ্যুষিত অঞ্চলে অবশ্য ম্যান্ডারিনের চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্যান্টনিজ।
বিভিন্ন উচ্চারণের ম্যান্ডারিন
বিশাল চীনকে ঐক্যবদ্ধ করতে একটি সাধারণ ভাষার প্রয়োজনীয়তা থেকে আধুনিক ম্যান্ডারিনের ক্রমবিকাশ ও উন্নতি সাধন। ম্যান্ডারিন ছিল মূলত উত্তর চীনের জনগণের কথ্য ভাষা। দশম ও একাদশ শতকের দিকে চীনের উত্তরাঞ্চলে ম্যান্ডারিনের বিকাশ শুরু হয়। চীনের অফিসিয়াল ভাষা হলেও ম্যান্ডারিনেরও উপশাখা রয়েছে যেমন– মধ্য বেইজিং, দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ, উত্তর-পশ্চিম, উত্তরের ম্যান্ডারিন। এসব অঞ্চলের ম্যান্ডারিনের উচ্চারণের পাশাপাশি ব্যাকরণেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যে ম্যান্ডারিন চীনের অফিসিয়াল ভাষা, সেটি মূলত বেইজিং ঘরানার।
চীনা বাচনভঙ্গি
চীনা ভাষাগুলোর লিখিত রূপ অভিন্ন হওয়ায় একই অক্ষরের ভিন্ন ভিন্ন বাচনভঙ্গি বা স্বরভঙ্গি রয়েছে, প্রতিটি অক্ষরের অর্থ বদলে যায় উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গির সাথে সাথে। ক্যান্টনিজের রয়েছে নয়টি বাচনভঙ্গি, ম্যান্ডারিনের চারটি এবং অতিরিক্ত হিসেবে আরেকটি রয়েছে, যেটিকে বলা হয় নিরপেক্ষ স্বরভঙ্গি। বিখ্যাত একটি চীনা কবিতা হলো Shī shì shí shī shǐ (The Lion-Eating Poet in the Stone Den), কবিতাটিতে প্রায় ১২০টি অক্ষর রয়েছে এবং প্রতিটিই ‘shi’। শুধুমাত্র স্বরের ওঠা-নামা বা উচ্চারণের ভিন্নতায় প্রতিটির অর্থ বদলে একটি পরিপূর্ণ অর্থবোধক কবিতায় রূপ পায় ১২০ টি অক্ষর।
ডান থেকে বাম, বাম থেকে ডান
প্রাচীনকাল থেকে চীনা ভাষা লেখা হত উলম্ব বা খাড়াভাবে ডান থেকে বামে। কিন্তু ১৯৫৫ সালে এটি পরিবর্তন করে চীন সরকার এবং বর্তমানে এটি লেখা হয় আনুভূমিকভাবে বাম থেকে ডানে অর্থাৎ আমরা বাংলা বা ইংরেজি যেভাবে লিখি।
ফিচার ইমেজ: pixabay.com