মিশরের ফারাও রাজত্বের কনিষ্ঠতম শাসক ছিলেন তুতানখামেন। কিশোর বয়সেই মিশরের সম্রাট হয়ে যাওয়া তুতানখামেন নিয়ে রহস্যের যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই! নীল নদের বাসিন্দাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, যে বা যারা তুতানখামেন মমিকে বিরক্ত করবে, তাদের মৃত্যু অনিবার্য। এই বিশ্বাসটা গাঢ় হওয়ার পিছনে রয়েছে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা।
মাত্র দশ বছর বয়সে তুতানখামেন রাজ্যের হাল ধরেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩২ থেকে ১৩২৩ সাল পর্যন্ত ছিল তার রাজত্বকাল। ন’বছর সিংহাসন সামলানোর পর খ্রিস্টপূর্ব ১৩২৩ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তরুণ ফারাওয়ের। কিন্তু তার মৃত্যু নিয়ে রয়েছে ব্যাপক রহস্য। মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও বিজ্ঞানীরা উদ্ঘাটন করতে পারেননি।
তার মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদের রয়েছে নানা মত। কেউ মনে করেন তুতানখামেন সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলেন। কেউ বা বলেন তাকে খুন করা হয়েছে। কারও মতে ম্যালেরিয়াতে তিনি মারা যান। আবার প্রত্নতত্ত্ববিদদের একাংশ বিশ্বাস করেন, ভারী কিছুতে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন এই ফারাও।
১৯২২ সালে তুতানখামেনের মমি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় তার মৃত্যু নিয়ে গবেষণা। মমি আবিষ্কারের বেশ কিছুদিন পর একদল বিশেষজ্ঞ জানান যে, যে ছুরি দিয়ে তাকে খুন করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, সেই ছুরিটি পাওয়া গছে। ১৯২৫ সালে তুতানখামেনের সমাধি থেকে তার ব্যবহৃত সোনা আর স্ফটিকের হাতল বিশিষ্ট ছুরিটি উদ্ধার হয়। প্রাচীন মিশরে লোহা ছিল দুর্লভ। কিন্তু তুতানখামেনের ছুরির ধারালো অংশটি লোহা, নিকেল আর কোবাল্টের সংমিশ্রণে তৈরি। পরে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে ছুরির ধারালো অংশটি লোহা নয়, আসলে উল্কার অংশ। গবেষকদের ধারণা, এই উল্কা সম্ভবত কয়েক হাজার বছর আগে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ১৪০ মাইল দূরে ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় মারসা শহরে পড়েছিল। মিশরীয় চিত্রলিপি হায়রোগ্লিফিকেও এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি। ছুরিটি আসলে একটি উল্কাখণ্ড! অপূর্ব কারুকাজ করা সোনা আর স্ফটিকের হাতল বিশিষ্ট এই ‘ছুরি’। এই মতের সাথে আবার অনেকেই একমত নন।
খুন নাকি দুর্ঘটনা তা নিয়ে আবার শুরু হয় নয়া বিতর্ক! এ ঘটনার আরো বেশ কিছুদিন পর মিশরের তুতানখামেন-বিশেষজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ক্রিস নাউনটন জানান যে, তুতানখামেনের যে খুনের তত্ত্ব প্রচলিত ছিল, তা সঠিক নয়। বরং তার গবেষণা বলছে, যুদ্ধের ময়দানে কোনো ভাবে ঘোড়া গাড়ির তলায় চাপা পড়েছিলেন তুতানখামেন। তাতেই তার মৃত্যু হয়।
এজন্য একাধিক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়েছিলেন বলে জানান ক্রিস। প্রথম দিকে কৌতূহলের বশেই ময়না-তদন্ত করান তুতানখামেনের মমিটির। বাদ পড়েনি এক্স-রে, সিটি স্ক্যানের মতো আধুনিক পরীক্ষাও। তারপরই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন তত্ত্বটি তুলে ধরেন ক্রিস। ক্রিসের মতে, ঘোড়ার গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন তুতানখামেন। আর তাতেই সম্পূর্ণ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল দেহটি। চাকার তলায় ভেঙে গিয়েছিল বাঁ-হাত। ভেঙে গিয়েছিল বুকের হাড়ও। টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল মাথার খুলি। এহেন ক্ষতবিক্ষত দেহ সমাহিত করতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছিল বলেই ধারণা ক্রিসের। ডি.এন.এ. পদ্ধতির সাহায্যে তুতানখামেন দেখতে কেমন ছিলেন, নাউনটন তাও বের করবার চেষ্টা করছেন বলে জানানো হয়।
তুতানখামেনের মৃত্যুকে ঘিরে নানা ধোঁয়াশা জাল তৈরি হলেও মমি আবিষ্কারের পর তাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল যেন আরো বেড়েই চলেছে। কারণ ব্রিটিশ হাওয়ার্ড কার্টার ও জর্জ হার্বার্ট নামের দুই প্রত্নতত্ত্ববিদের নেতৃত্বে তুতানখামেনের মমি আবিষ্কারের সময় তার সমাধি প্রায় অক্ষত অবস্থায় ছিল। কিন্তু মৃতদেহটি মোটেও অক্ষত ছিল না।
কালো হয়ে পুড়ে গিয়েছিল তুতানখামেনের দেহ। ছিল অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন। তা দেখে মিশরের একদল গবেষক দাবি করেছিলেন, সমাহিত করার আগে রহস্যজনকভাবে আচমকা আগুনে লেগে যায় মৃতদেহতে। তবে এই পুড়ে যাওয়ার কারণ কী, তা নিয়েও রয়েছে একাধিক মত। কারও মতে, মমি তৈরিতে যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হতো, তার বিক্রিয়াতেই ঘটে এই দুর্ঘটনা। আবার কারো মত, দীর্ঘদিন ধরে বিষ প্রয়োগে খুন করা হয়েছিল এই সম্রাটকে। আর সে বিষের কারণেই কালো হয়ে যায় তার গায়ের রং। ঐ রং দেখেই পোড়া বলে ভ্রম হয় গবেষকদের।
মিশরের বেশির ভাগ পিরামিডে থাকা মূল্যবান সম্পত্তি লুঠ হয়ে গেলেও তুতেনখামেনের সমাধিতে পাওয়া গিয়েছিল বিপুল সম্পত্তি ও পাকা সোনা দিয়ে বানানো রত্নখচিত মুখোশ।
মুখোশটি কায়রো সংগ্রহশালায় বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে যা এখন পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল বেশ কিছু নানা গুরুত্বপূর্ণ দলিল যা মিশর সভ্যতার ইতিহাসে এক নয়া দিগন্তের সূচনা করবে বলে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদদের অভিমত।
তেমনি একজন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ নিকোলাস রিভেস। তুতানখামেনের সমাধি নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। তার দাবি, তুতানখামেনের সমাধির ভিতর লুকানো রয়েছে কয়েকটি গোপন চেম্বার। সেই চেম্বারের রহস্য ভেদ করতে তিনি কিছুদিনের মধ্যে একটি অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন বলে জানান। তিনি আরো জানান, সমাধির একটি গুপ্তপথের সূত্র খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিকোলাস জানান যে, তিনি ৯০ শতাংশ নিশ্চিত, ১৯২০ সালের মতো এবারেও চাঞ্চল্যকর নতুন কিছু তথ্য উন্মোচিত হবেই। তার অনুমান তুতেনখামেনের সমাধিতে আরও দুটি গোপন কক্ষ রয়েছে। যার মধ্যে একটি হতে পারে রাণী নেফারতিতির সমাধি, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫১ থেকে ১৩৩৪ সাল পর্যন্ত নেফাতিতি মিশরে রাজত্ব করেছিলেন। আর অন্য কক্ষটি হতে পারে কোন গুদাম ঘর বা সংরক্ষণাগার।
তুতানখামেন সমাধির এ রহস্য ভেদ করতে নিকোলাসকে সাহায্য করবে ইতালির তুরিনের একটি পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি। এবং এর সঙ্গে থাকবে দু’বছর ধরে চালিয়ে যাওয়া অনুসন্ধানকারীর দলও। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এ গবেষণা কাজ পরিচালিত হবে বলে জানান তুরিনের পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর ফ্রাঙ্কো পরসেলি। মাটির তলায় ৩২ ফুট গভীর পর্যন্ত স্ক্যান করতে পারবে এমন শক্তিশালী রাডার সিস্টেম ব্যবহার করা হবে বলে তিনি জানান। এই রাডারের তরঙ্গায়িত হওয়ার ক্ষমতা ২০০ মেগা হার্টজ থেকে ২ গিগা হার্টজ পর্যন্ত।
তবে মিশরের অধিবাসীদের অনেকের মনের মধ্যে বারবার একই চিন্তা উঁকি দিচ্ছে তুতানখামেন সমাধি ঘিরে তৈরি হওয়া নানা ভয়ঙ্কর কাহিনী। এই সমাধিতে ঢোকার চেষ্টা করার ফল কখনও ভালো হয় না। তাদের আশঙ্কা, তুতানখামেনের সমাধিতে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে ফের ১৯২২ সালের মতো বিভিষীকাময় ঘটনা আবার ফিরে আসবে না তো! নতুন করে অভিশাপের ছায়া পড়বে না তো মিশরবাসীদের উপর! বিজ্ঞানমনস্ক মন এসবকে অস্বীকার করলেও বিশ্বাসকে কি অত সহজে টলানো যায়! এই মমিকে ঘিরে কী ঘটেছিল ১৯২২ সালে?
১৯২২ সালে তুতানখামেনের মমি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। মমি আবিষ্কারের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হোয়ার্ড কার্টার ও জর্জ হার্বার্ট। এই আবিষ্কারের কয়েকদিন পরেই ঘটে সেই অভিশপ্তময় ঘটনা। জর্জ হার্বার্ট ও কার্টারের নেতৃত্বে যেসব কর্মী এই খননকার্যে যুক্ত ছিলেন, ঘটনাচক্রে তাদের মধ্যে ২১ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। এরপর থেকেই এঅঞ্চলের মানুষের মধ্যে অভিশাপের কাহিনীটি ছড়াতে থাকে।
এবার আরও এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদের তত্ত্ববধানে অভিযান চলবে তুতেনখামেনের সমাধির গোপন ডেরায়। দীর্ঘ ৩৩০০ বছর ধরে লুকিয়ে থাকা সমাধির গোপন চেম্বারে কি মিলবে, এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার, নাকি বিশ্ববাসী হতে চলেছে আরেক অভিশপ্ত ঘটনার সাক্ষী! তা জানতে আমদের অপেক্ষা করতে হবে আরো বেশ কিছুটা সময়।
তথ্যসূত্র
১) http://www.primaryhomeworkhelp.co.uk/tut.html
২) http://www.historyextra.com/article/bbc-history-magazine/8-facts-tutankhamun
৩) https://en.wikipedia.org/wiki/Tutankhamun
৪) http://www.dailymail.co.uk/sciencetech/article-3585251/New-scans-King-Tut-s-tomb-NO-hidden-chambers-Experts-dash-hopes-Queen-Nefertiti-s-grave-lies-walls.html