যখন একটি ভালো রেস্টুরেন্টের কথা আসে, তখন অবশ্যই প্রথমে সেখানকার খাবারের কথাটি উঠে। তবে রান্নার পাশাপাশি পরিবেশটাও বেশ ভূমিকা রাখে। খাবার ভাল হবার সাথে সাথে পরিবেশটাও সুন্দর এবং মনোরম হলে যেকোনো রেস্টুরেন্ট মানুষের বেশ প্রিয় একটি জায়গাতে পরিণত হয়ে যায়। আর একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে প্রয়োজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা, দৃষ্টিনন্দন ও রুচিশীলভাবে সাজানো সবকিছু এবং খাবার পরিবেশক অর্থাৎ ওয়েটারদের ভদ্র, অমায়িক এবং মিশুক ব্যবহার। একজন ওয়েটার তার ব্যবহার দিয়ে যেমন আপনার একটি সন্ধ্যা বেশ স্মরণীয় করে রাখতে সাহায্য করবে, তেমনি তার কদর্য ব্যবহারে আপনার সামনে থাকা সুস্বাদু খাবারের প্রতি রুচিও উঠে যাবে। শুধু একজন ওয়েটারের বিরূপ আচরণের কারণে আর কখনো ওই রেস্টুরেন্ট-মুখো না হওয়ার সিদ্ধান্তও অনেকে নিয়ে নেন।
কিন্তু এডসেল ফোর্ড ফং এর জন্য বিষয়টি ছিল পুরোটাই ভিন্ন। তাকে বলা হয় দুনিয়ার সবচেয়ে অভদ্র ওয়েটার! তিনি তার রেস্টুরেন্টে আসা কাস্টমারদের সাথে উদ্ধত ব্যবহার করার দিক দিয়ে ছিলেন কুখ্যাত। তবুও তার রেস্টুরেন্টে মানুষের অভাব হতো না! আসুন আজকে তার সম্পর্কে জানা যাক।
১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের সময়টুকুতে এডসেল সানফ্রানসিসকোর স্যাম উ্যু রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন রেস্টুরেন্টটির মালিকের ছেলে। রেস্টুরেন্ট হিসেবে স্যাম উ্যু মোটেও সুবিধাজনক ছিল না। জরাজীর্ণ এবং নড়বড়ে পাটাতন, আবদ্ধ ও গুমট কক্ষ, আসবাবপত্রগুলো ছিল অতিব্যবহৃত; খাবারও ছিল সস্তা। এমনকি সেখানকার ছুরি-চামচ ব্যবহার করার আগেও নিজ দায়িত্বে সেগুলো মুছে পরিষ্কার করে নেওয়া লাগতো!
তবুও স্যাম উ্যু রেস্টুরেন্ট সানফ্রানসিসকোর মানুষদের বেশ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। এর মূল কারণ ছিলেন ছয় ফুট উচ্চতা এবং ২০০ পাউন্ড ওজনের এডসেল ফোর্ড ফং। সবসময় চুলে মিলিটারি কাট দিয়ে রাখা এডসেল অভদ্রতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার রুক্ষ এবং উদ্ধত আচরণের কারণে তিনি এতটাই বিখ্যাত ছিলেন যে, তৎকালীন বিখ্যাত অভিনয়শিল্পী এবং রাজনীতিবিদদের চেয়েও এডসেল পরিণত হয়েছিলেন মানুষের মূল আকর্ষণে। অনেক কাস্টমার তো শুধু এডসেলের তিরিক্ষি মেজাজের শিকার হওয়াটা উপভোগ করার জন্যেই স্যাম উ্যু-তে যেতেন!
এডসেল বিভিন্ন কায়দায় রীতিমতো অপমান করতেন তার কাস্টমারদের। একজন কাস্টমার তৎকালীন এডসেলের এরকম অদ্ভুত ব্যবহার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেন,
“যদি কখনো রেস্টুরেন্টটিতে ভিড়ের ফলে লাইন লাগতো এবং আপনি যদি সেখানে নতুন বা নিয়মিত কাস্টমার না হয়ে থাকতেন, তাহলে আপনাকে খাবার এবং সিটের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। আপনি যদি লাইনের একদম শুরুতেও থাকতেন তবুও আপনাকে এডসেল কোনো গুরুত্বই দিতো না। যদি খাবার সম্পর্কে আপনি তাকে জিজ্ঞেস করতেন, সে কোনো কথা না বলে দেয়ালে টাঙানো মেনুর দিকে আঙুল তাক করে দেখিয়ে দিতো। যা থাকতো পুরো চাইনিজ ভাষায়। ভাষা না বুঝে আন্দাজেই অনেককে খাবার অর্ডার দেয়া লাগতো।
এরপর খাবার তৈরি হয়ে গেলে এডসেল সেই খাবারের বাটি এনে আপনার টেবিলে পিছলিয়ে ছুঁড়ে দেবে। এতে কাপড়ে খাবার বা ঝোল ছিটকে পড়লেও আপনাকে নীরবে তা মেনে নিতে হবে। তারপর সে আপনার সামনে চপস্টিকগুলো এমনভাবে ছুঁড়ে মারবে যে মনে হবে সে যেন লুডু খেলার গুটি ছুঁড়ে মাড়ছে। এরপর আপনার অসহায়ত্ব দেখে মজা নিয়ে সে আপনার নিরুপায় মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসবে।”
জো ফ্রাংকো নামের আরেকজন কাস্টোমার স্যাম উ্যু-তে তার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন। রেস্টুরেন্টটিতে ঢোকার সাথে সাথে এডসেল তাকে বলেছিলেন, “Sit down and shut up!“। যখন তিনি সুইট-এন্ড-সাওয়ার পোর্ক এবং ডায়েট কোকের অর্ডার দিলেন তখন এডসেল ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন, “এই যে স্টুপিড, নো কোক! শুধু চা! নো সুইট-এন্ড-সাওয়ার পোর্ক! মেনু দেখতে পাচ্ছেন না? স্পেশাল খাবার খেতে চাইলে বাসায় গিয়ে খান…নো কাঁটাচামচ! শুধু চপস্টিক! তো মোটামানুষ, আপনি কী চান বলেন?”
চাইনিজ ভাষার মেনু হাতে নিয়ে সেটি বুঝে কোনো অর্ডার দিতে যদি আপনি বেশি সময় লাগিয়ে দেন, তাহলেও শোনা লাগতো এডসেলের বিখ্যাত এক প্রথম শ্রেণীর অপমানবাক্য, “কী পেয়েছেন এটা আপনি, হ্যাঁ? একটা লাইব্রেরি?” কাস্টমাররা যা-ই অর্ডার করুক না কেন, খাবার পরিবেশিত হতো এডসেলের মর্জিমতো। কারো অর্ডার দেওয়া খাবার যদি এডসেলের পছন্দ না হয়, তাহলে সে সেটা যারপরনাই এড়িয়ে যেতো। কখনো কখনো এডসেল অর্ডার গ্রহণ করলেও, মাঝেমধ্যেই এক টেবিলের অর্ডার করা খাবার অন্য টেবিলে পরিবেশন করতো। কারণ, সে এক কাগজেই সকলের খাবারের অর্ডার লিখে নিতো। যার ফলে এই ভুলটা হতো। তবে ভুল খাবার পরিবেশন করলেও এডসেলের ভুল ধরার কোনো প্রশ্নই আসতো না। আপনি অন্য খাবার অর্ডার করলেও এডসেল যা-ই দেবে আপনাকে মুখ বুজে তা-ই খাওয়া লাগবে সেখানে।
এডসেল প্রায়ই তার কাস্টোমারদের রীতিমতো ঝাড়ু দিয়ে মুছে বের করতো রেস্টুরেন্ট থেকে। আপনার খাওয়া শেষ হলো কি হলো না, সেটা দেখার কোনো প্রয়োজনই মনে করতো না সে। নতুন আগত কাস্টমারদের জায়গা দেওয়ার জন্য কাউকে সে বের করে দিতেও দ্বিধাবোধ করতো না। এমনকি সে কোনো কারণ ব্যতীত মাঝে মাঝে কাস্টোমারদের ঝাড়ু হাতে তাড়িয়ে বের করতো শুধু এটি দেখানোর জন্য যে, সে হচ্ছে সর্বেসর্বা এবং সে-ই হচ্ছে এই শো-এর পরিচালক।
এডসেল অপেক্ষায় থাকা কাস্টমারদেরকেও নিজের কাজে ব্যবহার করত। মাঝেমধ্যে লাইনে থাকা কাস্টমারদের দিয়েও সে ওয়েটারদের কাজ করিয়ে নিত। যেমন- একজন কাস্টমার তার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, এডসেল তাকে দেখেই চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, “আপনি বসতে চান এবং খেতে চান? তাহলে টেবিলগুলো থেকে আগে থালাগুলো পরিষ্কার করে ফেলুন!“। এরপরের পনেরো মিনিট ধরে সেই ব্যক্তি এবং তার সাথীরা শুধু থালার স্তুপেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শুধুমাত্র এডসেল কর্তৃক পরিবেশিত হওয়ার জন্য।
একসময় তারা খাবারের সুযোগ পেলেন এবং খেতে শুরু করলেন। তবে খাবার খাওয়ার মাঝপথেই এডসেল হুট করে এসে তাদের উঠে যেতে বললেন। কারণ, এইমাত্র তার কিছু নিয়মিত কাস্টমার এসেছে। তারা এডসেলের আদেশ কোনো কথা না বলে মেনে নিতে বাধ্য হলেন এবং বাকি খাবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খেলেন। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, এটিই ছিল তার জীবনের সবচাইতে স্মরণীয় খাবারের স্মৃতি।
১৯৭০ সালের শেষের দিকের এক ঘটনা সম্পর্কে গ্রেগরি সি. ফোর্ড বলেন,
“রেস্টুরেন্টে প্রবেশের সাথে সাথেই এডসেল আমাকে দিয়ে তার টেবিলগুলো পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছিলো। সে আমাকে পানি ভরে আনার পাশাপাশি অন্যান্য টেবিলে পানি দিয়ে আসার কাজও করিয়ে নিয়েছিলো। তারপর সে আমার দিকে অর্ডারের টিকেট ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলো সকলের অর্ডার টুকে নিতে। যখন আমি টিকেটটা তাকে ফেরত দিতে গেলাম, সে আমাকে আরো কিছু অর্ডার যোগ করতে আদেশ দিলো। এমনকি রান্নাঘর থেকে খাবার আসার পর এডসেল সেগুলো পরিবেশন করার আদেশও দিয়েছিল আমাকে।”
খাবার খাওয়া শেষে এডসেলের আরেকটি বিখ্যাত কথা প্রচলিত ছিলো। আপনার খাবার খাওয়া হলে সে এসে বলবে, “small check, big tip“। সে আপনার কাছে বখশিশ দাবি করবে। আপনি যদি কোনোভাবে ২০% এর কম বখশিশ রেখে যান, তাহলে এডসেলের অমানবিক ভর্ত্সনা জুটবে আপনার কপালে। এডসেল কুখ্যাত ছিলেন আরেকটি কারণে। এক্ষেত্রে এডসেল সত্যিই অন্যায় করত। নারী কাস্টমারদের প্রতি তার দুর্বলতা এবং বখাটেপনার জন্যও বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল সে।
বিভিন্ন লেখক-সাহিত্যিকরাও এডসেলের রেস্টুরেন্টে আসতেন। তারা মাঝেমধ্যেই এডসেলকে নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে লিখতেন। পুলিৎজার পুরষ্কার বিজয়ী হার্ব কেইন ছিলেন এডসেলের একজন নিয়মিত কাস্টমার। তিনি সানফ্রানসিসকো ক্রনিকলে মাঝে মাঝে এডসেলের কর্মকাণ্ড নিয়ে লিখতেন। এডসেল সেই পত্রিকা হাতে নিয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে তার খাবার ঘরে পায়চারী করত এবং তার নামের দিকে আঙুল তাক করে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াত।
এডসেলের এত অদ্ভুত আচরণ সত্ত্বেও প্রায়ই সকলে বারবার তার রেস্টুরেন্টে আসতো শুধুমাত্র তার গালাগালি উপভোগ করার জন্য। এই অদ্ভুত ব্যক্তিটির বাজে ব্যবহারের মধ্যেও এমন কিছু ছিল। যা সকলকে আকৃষ্ট করতো। জেন বিলাওস্কি তার ১৯৬০ সালের এক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, “একজন অতিথি চেয়েছিলেন তার অর্ডারটি পরিবর্তন করে অন্য একটি খাবার অর্ডার করবেন। এটি শুনে ওয়েটারটি পুরো ক্ষেপে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “You order it, you pay for it, you EAT it!”।”
১৯৮০ সালে তিনি যখন আবার এডসেলের রেস্টুরেন্টে আসেন, খেয়াল করে দেখেন এডসেল পূর্বের তুলনায় অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছেন। তার ভেতর আগের সেই রুক্ষতা, বদমেজাজি ভাবটা আর নেই। তিনি বলেন,
“কোনো কারণে আগেভাগেই আমাকে রেস্টুরেন্টটি ত্যাগ করতে হচ্ছিলো। কেন জানি আমার মনে হলো একবার পেছন ফিরে তাকাই। যখন আমি পেছন ফিরে তাকালাম দেখলাম এডসেল; রান্নাঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে! তারপর সে ঝুঁকে মাথা নিচু করে আমাকে সম্মান জানালো। আমি জানি না তার আগেকার মেজাজ দেখানোটা কি আসল ছিল, নাকি কোনো অভিনয়।”
১৯৮৪ সালে ৫৫ বছর বয়সে এডসেল মারা যান। এডসেল মারা যাবার পরেও প্রায় ২৮ বছর স্যাম উ্যু রেস্টুরেন্টটি চালু ছিল। এরপর ২০১২ সালে তা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ফিচার ইমেজ: YouTube