নজরদারি করার গোপন মিশনে শত্রু এলাকায় ঢুকে পড়েছে স্পেশাল ফোর্সের একজন দুর্ধর্ষ কমান্ডো। সতর্কতার সাথে সামনে এগোচ্ছে সে। হঠাৎ সামনে পড়ে গেল শত্রুসেনাদের টহল দল! সুনসান নীরবতা ভেঙে চোখের পলকে এলাকাটি হয়ে উঠল রণক্ষেত্র। দুই পক্ষের মাঝে চলছে তুমুল গোলাগুলি। শেষ পর্যন্ত ঐ কমান্ডোর হাতে নিহত হলো শত্রুর টহল দলের সবাই!
থামুন!
কী মনে হচ্ছে আপনার? কোনো মিলিটারি অ্যাকশন মুভির গল্প শুনছেন? আজকে আপনারা Rambo Of Quebec বলে খ্যাত যে ব্যক্তির কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবেন, তার জীবনের গল্প হলিউড মুভিকেও হার মানাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমন কিছু সত্যিকারের ঘটনা জন্ম দিয়েছে যা পরবর্তীতে ইতিহাসের পাঠকদের চোখ কপালে তুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
কানাডিয়ান সেনাবাহিনীর ‘লিঁও মেজর’ নামক এক সৈনিকের গল্প অনেকটা এরকমই। বিভ্রান্তি এড়াতে প্রথমেই বলে নেয়া ভাল- এই ব্যক্তির নাম লিঁও মেজর (Léo Major)। তার সর্বশেষ পদবী ছিল সার্জেন্ট, মেজর নয়। তিনি ছিলেন একজন ফরাসি-কানাডিয়ান সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও কোরিয়া যুদ্ধে তিনি স্বীয় কৃতিত্বের জন্য একমাত্র কানাডিয়ান হিসেবে দুবার Distinguished Conduct Medal (DCM) পেয়েছেন। তিনি প্রথমবার পদকটি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তা নাহলে সংখ্যাটি তিন হয়ে যেত। এই পদকটি ব্রিটেনের রানীর দেয়া কমনওয়েলথ দেশগুলোর জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা, যা দুবার পেয়েছেন মাত্র তিনজন ব্যক্তি। লিঁও মেজর তাদের মধ্যে একজন।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
লিঁও মেজর ১৯২১ সালের ২৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস এর নিউ বেডফোর্ড শহরে জন্ম নেন। এক বছর বয়সের আগেই তার বাবা-মা কানাডার মন্ট্রিলে স্থানান্তরিত হন। বাবার সাথে লিঁওর সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। তার সাথে রাগ করে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি বাড়ি ছাড়েন এবং এক আন্টির কাছে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু একজন বেকার ছেলে কতদিন আরেকজনের ঘরে থাকবে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪০ সালে ১৯ বছর বয়সে কানাডিয়ান সেনাবাহিনীতে প্রাইভেট (তৎকালীন সৈনিক পদের নাম) হিসেবে যোগ দেন। সামরিক জীবনে তিনি বেশ সফল ছিলেন। তিনি সফলভাবে প্যারাট্রুপার কোর্স সম্পন্ন করেন। এটি ছিল তখনকার সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে কষ্টকর ও বিপদজনক যুদ্ধের ট্রেনিং। পরবর্তীতে লিঁওকে কানাডিয়ান সেনাবাহিনীর ফরাসি বংশোদ্ভূত সৈনিকদের নিয়ে গঠিত ‘ডে লা শ্যাউডিয়েঁর‘ রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। রেজিমেন্টটি ব্রিটিশ এয়ারবোর্ন ব্রিগেডের সাথে অপারেশন পরিচালনা করত। উল্লেখ্য, ফ্রান্স ও কানাডা, দুটি দেশই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর হয়ে ব্রিটিশদের সাথে ইউরোপে যুদ্ধ করে। ফলে একই সময়ে বাবা-মায়ের দেশের সেবা করার সুযোগ পান লিঁও মেজর।
অপারেশন ওভারলর্ড
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীকর্তৃক নাৎসি জার্মানি অধিকৃত ইউরোপ পুনরুদ্ধারের অভিযান ‘অপারেশন ওভারলর্ড‘ এর প্রথম মিশনের নাম ছিল D-Day, যা সামরিক পরিভাষায় ‘অপারেশন নেপচুন’ নামে পরিচিত। বিখ্যাত এই মিলিটারি অপারেশনের প্রসঙ্গ আসলেই সকলে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন ফ্রান্সের নরম্যান্ডির সমুদ্র সৈকতে ১ লাখ ৬০ হাজার সৈনিকের অবতরণের কথা মনে করেন। কিন্তু আপনি কি জানেন যে তাদের অবতরণের কয়েক ঘন্টা আগে দেড় হাজার বিমানে করে মিত্রবাহিনীর ২০ হাজার দুঃসাহসী প্যারাট্রুপার রাতের অন্ধকারে ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে জার্মান সেনাবেষ্টিত এলাকায় জাম্প করেছিলেন।
সেদিন রাতের যুদ্ধে আড়াই হাজারের বেশি প্যারাট্রুপার মারা গিয়েছিল। লিঁও মেজরের ডে লা শ্যাউডিয়েঁর রেজিমেন্ট ছিল নরম্যান্ডিতে প্যারাজাম্প করা একমাত্র কানাডিয়ান সেনাদল। পরের দিন তাকে রিকনসিস (গোয়েন্দা) মিশনে জার্মান অধিকৃত এলাকায় পাঠানো হয়। এ সময় তিনি একাই রেডিও অপারেটর জার্মান সৈনিকসহ একটি কমিউনিকেশন হাফট্রাক আটক করেন। উক্ত আর্মার্ড ভেহিকেলে শত্রুর রেডিও যোগাযোগ ডিভাইস, মেসেজ ডিক্রিপশন করার কোডবুকসহ আরো বেশ কিছু গোপন নথিপত্র ছিল। লিঁও মেজর সেগুলো হস্তগত করে নিজের কাছে রাখেন এবং ভেহিকেলটি চালিয়ে ব্রিটিশ সেনাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে যান।
ব্রিটিশরা জার্মান সামরিক যান দেখেই ট্যাংক বিধ্বংসী কামান দাগাতে শুরু করে। এ সময় তিনি গতি বাড়াতে ঐ বন্দি সৈনিককে নির্দেশ দেন এবং ভেহিকেলটির ছাদে উঠে নিজের ব্যারেট (সামরিক টুপি) নাড়িয়ে ইশারা করতে থাকেন। খুব কাছে আসার পর মিত্রবাহিনীর সৈনিকরা গোলাবর্ষণ বন্ধ করে। সেখানকার ব্রিটিশ কমান্ডিং অফিসার তার পাগলামি দেখে অবাক হন এবং জানতে চান কেন তিনি এমন কাজ করলেন? তিনি তো নিজ পক্ষের গুলিতে মারাও যেতে পারতেন। জবাবে তিনি যা বলেছিলেন তা ব্রিটিশ সেনাদের জন্য কিছুটা অপমানজনকই বলা যায়। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ব্রিটিশ সেনারা তার দখলকৃত জার্মান ভেহিকেলে কামানের একটি গোলা লাগাতেই পারবে না!
এ সময় তার সাথে ব্রিটিশ কমান্ডারের বাদানুবাদ হয়। কেননা তিনি চাচ্ছিলেন গোপন নথিপত্র ও কোডবুক যেন ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়া হয়। অন্যদিকে লিঁও মেজর চাচ্ছিলেন এসব গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ফরাসি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কাছে যাক। শেষ পর্যন্ত লিঁও মেজরের জেদের কাছে হার মানেন ব্রিটিশ কমান্ডার।
আমার এক চোখই যথেষ্ট
এর পরের দিন তাকে আরেকটি রিকনসিস মিশনে জার্মান অধিকৃত অঞ্চলে গোপনে পর্যবেক্ষণ করতে পাঠানো হয়। সেদিন হঠাৎ করেই চারজনের জার্মান SS পেট্রোল দলের মুখোমুখি হয়ে যান তিনি। লিঁও তৎক্ষণাৎ গুলি শুরু করেন এবং টহল দলের চারজনকেই হত্যা করেন। শেষেরজন মারা যাওয়ার আগে একটি ফসফরাস গ্রেনেড ছুড়ে মারে। এটি মেজরের একদম সামনে বিস্ফোরিত হয় এবং এই আঘাতেই তার বাম চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনোরকমে এবার তিনি ঘাঁটিতে ফিরে আসেন এবং চিকিৎসা নিতে শুরু করেন। তিনি জলদস্যুদের মতো বাম চোখে কালো পট্টি পরতে শুরু করেন। স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি হারানোর কারণে তাকে সেনাবাহিনী থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে অব্যাহতিপত্র দেয়া হয়। কিন্তু লিঁও মেজর অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। তিনি কমান্ডিং অফিসারের কাছে অব্যাহতি পত্রের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এ সময় তিনি বলেন
I’m a scout sniper. I only need one eye.
লিঁওর হার না মনোভাব ও তার দক্ষতা বিবেচনা করে তাকে নীতিবিরুদ্ধভাবে আবারও যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতিপত্র দেয়া হয়। এরপর তিনি যা ঘটান তা ছিল কল্পনাঅতীত।
একজন ধুরন্ধর সৈনিক
দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীর ফিল্ড হাসপাতালে থেকে লিঁও চিকিৎসা নেন। সুস্থ হয়ে ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে অ্যাক্টিভ সার্ভিসে ফিরে আসেন। মিত্রবাহিনীর ততদিনে নেদারল্যান্ডে অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে। Battle of the Scheldt সময় আবারও তার ডাক পড়ে রিকনসিস মিশনের জন্য। পুরো ব্যাটালিয়নে স্কাউটিংয়ের কাজে তিনি ছিলেন সবার সেরা। কমান্ডার তাকে শত্রুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি নিখোঁজ ৫০ জন ‘জোম্বি’কে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। কানাডিয়ান আর্মিতে জোম্বি বলে গালি দিয়ে তরুণ, অনভিজ্ঞ, বোকা সৈনিকদের বোঝানো হতো।
সম্প্রতি টহল দিতে গিয়ে নিখোঁজ সৈনিকদের খুঁজে বের করতে শত্রু এলাকায় ঢুকে পড়েন লিঁও মেজর। এ সময় তিনি পরিখা খননের পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়া ট্রেঞ্চ গ্যারিসনের একদল জার্মান সৈনিক দেখতে পান। পাহারারত গার্ডদের চোখ এড়িয়ে তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে তাঁবুর ভিতর চেয়ারে বসে নাক ডেকে ঘুমানো কমান্ডিং অফিসারকে স্টেন গান দিয়ে গুঁতো মেরে জাগিয়ে নিঃশব্দে গ্রেফতার করেন। তিনি চেয়েছিলেন তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে অন্যদের গ্রেফতার করবেন। তাই মিত্রবাহিনী তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে- এই মিথ্যা কথা তাকে শুনিয়ে ভয় দেখান। এ সময় এক জার্মান গার্ড তাকে দেখে ফেলে অস্ত্র তোলার চেষ্টা করতেই তিনি তাকে হত্যা করেন এবং বাকিদের আত্মসমর্পণ করার জন্য জার্মান ভাষায় নির্দেশ দেন। এ সময় চালাকির চেষ্টা করে আরো তিন জার্মান সেনা তার হাতে নিহত হন। লিঁও মেজরের এই রুদ্রমূর্তি দেখে ট্রেঞ্চ গ্যারিসনের সবাই (৯৩ জন) তার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়!
জার্মান বন্দি সেনাদের হাঁটিয়ে নিজেদের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন লিঁও মেজর। একটু দূরে থাকা একটি আর্টিলারি ব্যাটারি (৬টি কামানের সেট) একদল এসএস সৈনিক দূর থেকে তাদের দেখতে পান। তারা ঘটনা কী সেটা বুঝতে না পেরে গুলি চালায় এবং সাত জার্মান বন্দি নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। মেজর বন্দীদের নিয়ে মার্চ করা অব্যাহত রাখেন। ভাগ্য ভালো থাকায় এ সময় রাস্তায় তিনি কানাডিয়ান শেরম্যান ট্যাংক বহরের দেখা পান। তাদেরকে উক্ত এসএস সৈনিকদের উপর কামান দাগানোর নির্দেশ দেন।
লিঁও মেজর যখন তার কমান্ডিং অফিসারের কাছে বন্দীদের হস্তান্তর করেন তখন তার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। মাত্র একজন সৈনিক শত্রুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সবাইকে আত্মসমর্পণ করিয়ে ফেলবে- এটা ছিল একেবারেই কল্পনাতীত। এই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাকে Distinguished Conduct Medal (DCM) এর জন্য মনোনীত করা হয়। কিন্তু ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারির হাত থেকে পদক নিতে হবে শুনে পদক নিতে অস্বীকৃতি জানান! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত এই ব্রিটিশ জেনারেলের প্রতি লিঁও কেন রাগান্বিত ছিলেন তা জানা যায়নি। তবে তিনি তাকে ‘অপদার্থ’ বলে সম্বোধন করেছিলেন!
ওয়ান ম্যান আর্মি
এবারের মিশনে তার সাথে সঙ্গী ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্পোরাল উইলি আর্সেনাল্ট। এক মাসব্যাপী যুদ্ধের পর গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর মিত্রবাহিনীর লক্ষ্য এবার নেদারল্যান্ড মুক্ত করা। দেশটির রাজধানী আমস্টারডামের প্রায় ১০০ কি.মি. পূর্বে জ্বোলে (ইংরেজি Zwolle) নামক শহরে ১৯৪৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে মেজর ও আর্সেনাল্টকে গোয়েন্দা মিশনে পাঠানো হয়। তাদের কাজ ছিল দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে জার্মান সামরিক অবস্থানগুলো ম্যাপে নিখুঁতভাবে শনাক্ত করা যেন মিত্রবাহিনীর আর্টিলারিগুলো বেসামরিক প্রাণহানি এড়িয়ে হামলা করতে পারে, কারণ শহরটিতে তখন প্রায় ৫০ হাজার লোকের বসবাস ছিল।
যুদ্ধের প্রথমদিকে স্থানীয় যোদ্ধারা সক্রিয় থাকলেও তারা এখন নিষ্ক্রিয়। গোয়েন্দা মিশনের কাজে তাদের সাহায্য নেয়ার কথা ভাবলেন মেজর। কিন্তু শহরে ঢোকার আগেই একটি মেশিনগান পোস্টের সামনে পড়েন। উইলি আর্সেনাল্টের রেডিওর শব্দ শুনেই গুলি শুরু হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বন্ধু আর্সেনাল্ট জার্মানদের গুলিতে নিহত হন। লিঁও স্ক্রল করে ফায়ারিং লাইন থেকে সরে গিয়ে মেশিনগানারদের পেছনে উপস্থিত হন। তার পাল্টা গুলিতে দুই জার্মান সেনা নিহত হয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়ে লিঁও মুষড়ে পড়েন। একদফা গোলাগুলির পর জার্মানরা এবার সতর্ক। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে তিনি শত্রু এলাকার আরো ভেতরে ঢুকে পড়েন। এবার জার্মান টহল দলের হাতে ধরা পড়া থেকে বাঁচতে রাতের অন্ধকারে ঝোঁপের ভেতর প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে বাধ্য হন। লিঁও মেজরের ভাষায়,
“I am frozen and wet because of you. so you will pay”
পরিকল্পনা মোতাবেক আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে একজনকে গ্রেফতার করেন। অপরজন নিজের অস্ত্র তাক করার চেষ্টা করতেই তাকে হত্যা করেন। এ সময় তিনি জার্মানদের ধোঁকা দেয়ার চমৎকার বুদ্ধি বের করেন। তিনি ঐ সৈনিককে বলেন, “জ্বোলে শহর কানাডিয়ান সৈনিকরা ঘিরে ফেলেছে”- এই বার্তাটি নিজের ইউনিট কমান্ডারের কাছে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ভয়ার্ত জার্মান সেনার আস্থা অর্জনে তার অস্ত্রটিও ফেরত দিয়ে তাকে চলে যাওয়ার সুযোগ দেন! অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় লিঁও যাকে অস্ত্র ফেরত দেন তিনি ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ অফিসার যাকে তিনি স্থানীয় হোটেলের বারে মদ্যপানের সময় গ্রেফতার করেন। লিঁও তাকে বলেছিলেন আগামীকাল সকাল ৬ টায় ব্যাপক গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা শুরু হবে। জার্মান সেনারা যদি এখনই পশ্চাদপসরণ করতে শুরু করে তবে প্রাণে বাঁচতে পারবে। তার মনে হয়েছে তিনি কমান্ডারকে হতোদ্যম করে দিতে পারবেন।
মিথ্যাকে বানাও সত্য
লিঁও মেজর নিজেও জানতেন যে তার এই চাপাবাজিতে এত সহজে কাজ হবে না। এই ভেবে তিনি এবার আরেক কাজ করেন। ভিন্ন পথে জার্মান নজরদারি এড়িয়ে শহরের ভেতরে ঢুকে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দেন। প্রথমে একটি মেশিনগান পোস্ট দখল করে সেখানকার সৈনিককে নিরস্ত্র করেন। এবার টহল দিতে আসা একটি আর্মার্ড জিপের ড্রাইভারকে অস্ত্রের মুখে আটক করেন। তার কাছে নিজের ও নিহত বন্ধুর স্টেনগানসহ একটি এমপি-৪০ জার্মান সাবমেশিনগান আগে থেকেই ছিল। এবার জিপের উপর মেশিনগান বসান।
অপর বর্ণনায় পাওয়া যায়, সেই গাড়িটি ছিল স্থানীয় যোদ্ধাদের নেতার। লিঁও মেজর এবার শহরের ভেতরে চলতে শুরু করেন এবং আন্দাজে গুলি চালাতে থাকেন। জ্বোলে শহরের এখানে-ওখানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়। তিনি এবার গাড়ি ছেড়ে বারবার নিজের অবস্থান বদল করেন। (দ্বিতীয় বর্ণনামতে, অস্ত্র ফেরত দেয়া ঐ উচ্চপদস্থ অফিসারকে সম্মান করে গাড়িটি ছেড়ে দেন)। মেজরের সাথে যোগ দেয় স্থানীয় কয়েকজন যোদ্ধা। তারাও কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্র নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে দেয়। পুরো শহরে যুদ্ধাবস্থা আরো ভালোভাবে তৈরি করতে লিঁও এবার জ্বোলে শহরে জার্মান গোয়েন্দা পুলিশ গেস্টাপোর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত ভবনে হামলা চালিয়ে চারজন অফিসার হত্যা করে ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। বাকি চারজন জান নিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচে। এই ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন,
“With one eye, I can see better than most people at night. I killed four of them; the other four ran away”
কারা হামলা করছে, কোনদিক থেকে আক্রমণ হচ্ছে সেটি বুঝবার আগেই জার্মান বাহিনীর আরেক কমান্ডার লিঁও মেজরের হাতে গ্রেফতার হন। তার জলদস্যুদের কালো পট্টি বাধা ভয়ংকর চোখ এবং বৃষ্টিতে কানাডিয়ান সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম দেখে যে কেউই ভয় পাবে। পুরো শহর মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা ঘিরে ফেলেছে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে- এমন ভুয়া গল্প তাকেও শুনিয়ে বিশ্বাস করিয়ে ফেলেন।
এ সময় তিনি সারা রাতে মোট বেশ কয়েকবার বন্দী সেনাদের নিয়ে নিজেদের ক্যাম্পে হস্তান্তর করে ফেরত আসেন। তাকে এই কাজে সাহায্য করেছিল স্থানীয় যোদ্ধাদের একটি দল। এভাবে সেদিন রাতে প্রায় শতাধিক জার্মান সেনা তিনি ও তার ডাচ সঙ্গীরা গ্রেফতার করেন। বিভিন্ন বর্ণনায় ৯৩ জন গ্রেফতারের ঘটনাটি জ্বোলে শহরের বলে বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুটো ঘটনা ভিন্ন স্থানে ঘটেছে। এই লেখাটি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে কানাডিয়ান সূত্রের বর্ণনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
যা-ই হোক, সেদিন প্রচণ্ড পরিশ্রমে ক্লান্ত লিঁও এক ডাচ পরিবারের বাড়িতে শেষ রাতে বিশ্রাম নেন। সকালের আগেই বাকিরা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। লিঁও মেজরের মেসেজ পেয়ে তার কমান্ডিং অফিসার আর্টিলারি স্ট্রাইক বাতিল করেন এবং বিনা যুদ্ধে, অবকাঠামো ও বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি ব্যতীত জ্বোলে শহর দখল করেন। লিঁও তার বন্ধু কর্পোরাল উইলি আর্সেনাল্টের মরদেহ উদ্ধার করেন। তার জন্য পরবর্তীতে শহরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এই যুদ্ধে কৃতিত্বের জন্য লিঁও মেজরকে আবারো Distinguished Conduct Medal (DCM) পদক দেয়া হয়। এবার তিনি পদক গ্রহণ করেন।
একজন জাত সৈনিক
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবারও আহত হন। এবারের আঘাতের মাত্রা ছিল আগের চেয়ে গুরুতর। লিঁও মেজর একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত টাইগার ট্যাংকের আহতদের উদ্ধার করে নিজেদের গাড়িতে ওঠানোর কাজে তার সহকর্মীদের সাহায্য করছিলেন। হঠাৎ তাদের ব্রেন আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ারটি এন্টি ট্যাংক মাইনের ফাঁদে পড়ে। বিস্ফোরণে উপর থেকে ছিটকে মাটিতে পড়েন মেজর। এতে তার পাজরের কয়েকটি হাড় ভেঙে যায়। দুই গোড়ালি এবং স্পাইনাল কর্ডে মারাত্মক আঘাত পান। তিনি ব্যতীত ঐ ভেহিকেলের সবাই নিহত হন।
অন্য সহযোদ্ধারা তাকে বয়ে ৩০ মাইল দূরের হাসপাতালে নিয়ে যান। ব্যথা কমানোর জন্য তাকে ১৫ মিনিট পরপর মরফিন ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। উচ্চতর চিকিৎসার জন্য তাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে টের পেয়ে সপ্তাহখানেক পর লিঁও এবার হাসপাতাল থেকে পালান! শরীরের এই অবস্থায় কীভাবে পালিয়েছেন সেটা কেউ জানে না। এক ফরাসি পরিবারের আশ্রয়ে প্রায় একমাস থেকে সুস্থ হয়ে আবারও নিজের বাহিনীতে ফিরে আসেন। অপর বর্ণনায় শোনা যায়, তিনি নেদারল্যান্ড-বেলজিয়াম সীমান্তে এক বান্ধবীর আশ্রয়ে ছিলেন। অন্য সময় হলে এই অপরাধের দায়ে তার কোর্ট মার্শাল হয়ে যেত। কিন্তু স্কাউট হিসেবে দক্ষতার কথা বিবেচনা করে তাকে শাস্তি পেতে হয়নি।
কোরিয়া যুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লিঁও মেজর সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন। পরে কিছুদিন পাইপ ফিটিং মিস্ত্রির কাজ করেন। কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হলে আবার ভেটেরান সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তিনি এবার সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫১ সালের নভেম্বর মাসে হিল ৩৫৫ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড় দখলের যুদ্ধে তিনি অসামান্য কৃতিত্ব দেখান।
লিটল জিব্রাল্টার নামে পরিচিত এই পাহাড়টি ছিল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দখলে রাখার জন্য মার্কিন সেনাবাহিনী থার্ড ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন শক্তি বৃদ্ধি করতে কানাডিয়ান রয়্যাল ২২ই রেজিমেন্টকে ডেকে আনে। ২২ নভেম্বর ৪০ হাজার চীনা সৈন্য আক্রমণ শুরু করে। দুদিন ব্যাপী তীব্র যুদ্ধের পর মার্কিন বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়, কিন্তু কানাডিয়ানরা হিল ৩৫৫-তে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। এ সময় চাইনিজ আর্মি পাশ্ববর্তী হিল ২২৭ দখল করে নিলে কানাডিয়ানরা চারপাশ থেকে ঘেরাও হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের আর্টিলারি সাপোর্ট পেয়ে তারা একপাশে সরে আসতে সক্ষম হয়। পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ তখন অনেকটাই চীনাদের হাতে চলে যায়। এসময় লিঁও মেজর আঠারজনের একটি স্কাউট স্নাইপার টিম নিয়ে রাত পৌনে একটার সময় অন্ধকারে নিঃশব্দে হিল ৩৫৫ এর চূড়ায় উঠে যান। উঁচু জায়গায় থাকার সুবাদে স্নাইপাররা যখন পাখির মতো গুলি করে চীনাদের মারা শুরু করে তখন তারা অবাক হয়ে যায়। কেননা গুলি আসছে তাদেরই দখলকৃত এলাকার মাঝখান থেকে! দুই ঘন্টা পর চাইনিজরা ১৪ হাজার সৈন্য নিয়ে পুনরায় হামলা শুরু করে। কানাডিয়ানরা স্নাইপার রাইফেল ও স্টেনগান নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। সকাল পর্যন্ত পজিশন ধরে রাখতে লিঁওর দরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হেভি আর্টিলারি স্ট্রাইক, যেটি সেই মুহূর্তে পাওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে তাকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেয়া হয়।
কিন্তু লিঁও আদেশ অমান্য করেন এবং কানাডিয়ান মর্টার প্লাটুনকে তার পজিশনের খুবই কাছে ব্যারেজ (আর্টিলারি হামলা) চালাতে বলেন। মর্টারের গোলাগুলো লিঁও মেজরের খুবই কাছে এসে পড়ছিল। তারপরও তিনি এর ফলাফলে খুশি ছিলেন না। ‘ডেঞ্জার ক্লোজ‘ প্রটোকলের আওতায় নিজের পজিশনে আরো কাছে গোলা ফেলতে নির্দেশ দেন। (এই প্রটোকলে যদি তার মৃত্যু হয় তবে কেউ দায়ী নয়)। রেডিওতে তিনি যখন মর্টার প্লাটুনকে গোলা ফেলার পজিশন মার্ক করে দিচ্ছিলেন, বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দ তারাও শুনতে পাচ্ছিলেন। এই ঘটনা সম্পর্কে মর্টার প্লাটুনের কমান্ডার ক্যাপ্টেন চার্লি ফোর্বস এর বর্ণনা,
“Major was an audacious man … not satisfied with the proximity of my barrage and asks to bring it closer…In effect, my barrage falls so close that I hear my bombs explode when he speaks to me on the radio.”
লিঁও মেজর ও তার টিমের সাহসিকতার কারণে তাদের বাহিনী পরদিন সকালে হিল ৩৫৫ এর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে পুরোপুরিভাবে নিতে সক্ষম হয়। এজন্য তাকে দ্বিতীয়বারের মতো DCM পদকে ভূষিত করা হয়।
একজন কিংবদন্তি
কানাডিয়ান আর্মি ২০০৮ সালের আগে লিঁও মেজরের কৃতিত্ব সরাসরি জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি। লিঁও মেজর নিজেও ছিলেন নিভৃতচারী মানুষ। এমনকি জ্বোলে শহরের ঘটনাটি তার পরিবারও ৩০ বছর পর ডাচ কর্তৃপক্ষের কৃতজ্ঞতা স্বীকারমূলক চিঠি পেয়ে জানতে পারেন। তার সম্মানে জ্বোলে সিটি করপোরেশন সেদিন রাতে তান্ডব চালানো সেই রাস্তাটি তার নামে নামকরণ করে। সেখানকার স্কুলের বাচ্চাদের শহরের স্বাধীনতা লাভের ঘটনা ও লিঁওর অসামান্য কৃতিত্ব সম্পর্কে পড়ানো হয়। ১২ অক্টোবর, ২০০৮ সালে লিঁও মারা গেলে ডাচ ইতিহাসবিদ, সংসদ সদস্য, আর্মি জেনারেল, জ্বোলে শহরের মেয়র ও কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দা তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও কয়েকবার ঐ শহরে গিয়েছিলেন এবং স্থানীয়রা তাকে অনেক সম্মান করতো। এক সাক্ষাৎকারে শহরের মেয়র হ্যাংক জেন মেজিনের বলেন,
“He was the first Canadian who walked through the streets of Zwolle. We honour Léo Major. He is a symbol of our freedom.“
হলিউড মুভির মিথ্যা কাহিনীতে আমরা নায়কদের অসামান্য কৃতিত্ব দেখে থাকি। কিন্তু বাস্তব জীবনের নায়ক লিঁও মেজরের সম্মানে একটি সংক্ষিপ্ত ডকুমেন্টারি ব্যতীত আজ পর্যন্ত কোনো মুভি বা উল্লেখযোগ্য ফিচার আর্টিকেল প্রকাশিত হয়নি। কানাডিয়ান সেনাবাহিনী কেন এত বছর তার কৃতিত্ব প্রকাশ করেনি তা বোধগম্য নয়। এভাবে আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায় লিঁও মেজরের মতো অসংখ্য বীরযোদ্ধা।