বিভিন্ন সময়ে নারীদের ক্ষমতায়ন, অধিকার ও নানা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নানান চড়াই-উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এদের মাঝে এমন কিছু ইতিহাস আছে, যেগুলো হয়তো বা আমাদের জানা নেই। আপনার জানা আছে কি ইতিহাসে নারীদের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে?
প্রাচীন রোমের মেয়েদের নিজেদের সংস্করণের বার্বি পুতুল ছিলো
প্রাচীন রোমের মেয়েরা মাত্র বারো বছর বয়সেই বিয়ে করে ফেলতো। এতে করে যদিও তাদের শৈশবের সময়টা খুব বেশি বিরাজমান হতো না, তবুও তারা পুতুল খেলায় মগ্ন থাকতো। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এক আবিষ্কারে দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে একজন ছিলো একটি কাঠের পুতুল! ভাস্কর্যশিল্প অলংকৃত শিলালিপি সমন্বিত প্রস্তর শবাধারে এটি পাওয়া যায়, এর স্বত্ত্বাধিকারী ছিলো রোমে বসবাসকারী দ্বিতীয় শতাব্দীর মেয়ে ক্রেপেরিয়া ট্রাইফায়েনা। আর এর সামঞ্জস্য ছিলো আজকের দিনের বার্বি পুতুলের সাথে। তবে আধুনিককালের বার্বি পুতুলের গড়নের সাথে এর গড়নের তেমন একটা মিল নেই বললেই চলে। পুতুলের জন্য ছোট এক বাক্স ভর্তি কিছু জামাকাপড়ও পাওয়া গিয়েছিলো সেই শবাধারটিতে।
সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয় নারীদের সমঅধিকার
অন্য যেকোনো প্রাচীন রাজ্যের চাইতে মিশর ছিলো বেশ গণতান্ত্রিক। আর এর প্রমাণ পাওয়া যায় এ বিষয়ের মাধ্যমে যে, সেখানকার শাসকদের সন্তানদের যে কেউ (ছেলে হোক বা মেয়ে) তাদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারতো। নারী ও পুরুষদের প্রায় সবকিছুতেই সমঅধিকার ছিলো, যা তখন অন্য কোথাও প্রচলিত ছিলো না বললেই চলে। এছাড়াও বাবা নয় মায়ের পরিবার থেকে বংশপরম্পরা রক্ষা করা হতো। মায়ের পরিচয় দিয়েই সন্তানদের উত্তরাধিকারসূত্র বিবেচনা করা হতো। এমনকি সেসময়ে সন্তানের মা-বাবা শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে বাবার বদলে মায়ের ডিএনএ পরীক্ষা করার নিয়ম ছিলো।
গ্রীসের নারীদের নিজেদের সম্মতি মোতাবেক বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ছিলো
প্রাচীন গ্রীসের নারীদের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হতো না, এমনকি তাদের স্বাধীনতা, অধিকারও ছিলো কঠোরভাবে সীমিত। তবে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ছিলো ন্যায্য বিচার। যদি একজন মহিলা তার স্বামীকে তালাক দিতে চাইতো, তাহলে তার নামে একটি চুক্তি করার জন্য তার একজন পুরুষ প্রতিনিধির প্রয়োজন হতো। তবে একজন স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইতো, তাহলে স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দিলেই হতো। এর বেশি কিছু করার প্রয়োজন ছিলো না।
মিশরীয় নারীরা ধর্মীয় ব্যবস্থায় উচ্চ অবস্থানের অধিকারী হতে পারতো
ধর্মীয় জীবনে গুরুতরভাবে জড়িত নারীর জন্য জীবনযাপন করাটা খুব বেশি সাধারণ বা সার্বজনীন ছিলো না আগেকার দিনগুলোতে। তবে প্রাচীন মিশরে এই ব্যবস্থাটি ছিলো একেবারেই ব্যতিক্রম। মিশরের নারীরা বিভিন্ন দেবতাদের স্ত্রী হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম ছিলো। তবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানটি ছিলো ‘ঈশ্বরের আমল আমীন’। এই শিরোনামটি (মূলত যেকোনো শ্রেণীর নারীদেরকে এই শিরোনামে অভিহিত করা যেত, তবে পরবর্তীতে কেবল উচ্চ শ্রেণীর নারীদের জন্যই এই শিরোনাম ধার্য করা হতো) সেসব নারীর জন্য ধার্য করা হতো, যারা প্রধান পুরোহিত বা যাজকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সহায়তা এবং ঈশ্বরের মূর্তি তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব পালন করতো। তাছাড়া খুব কম সংখ্যক নারীদেরই গৃহবধূ হতে দেখা যেত এবং সমাজে মেলামেশা করা নিয়ে তাদের কোনো ধরনের বাধা ছিলো না। বিভিন্ন নিদর্শনে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, নারীদেরকে পেশাদার সংগীতশিল্পী, নাচিয়ে বা নর্তকী এবং বিভিন্ন আয়োজনের অতিথি হিসেবে চিত্রিত করা হয়ছে।
রোমের নারীরা ছিলো শিক্ষিত
প্রাচীন রোমের নারীদের শিক্ষা ছিলো একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। বেশিরভাগ মেয়েদের স্কুলেই লেখাপড়ার কেবল মৌলিক জ্ঞানটাই দেয়া হতো। তবে কিছু কিছু পরিবার চেয়েছিলো, তাদের মেয়েরা যেন বিস্তৃত জ্ঞান আহরণ করতে পারে। আর এজন্যই তারা মেয়েদের জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ করতো, যারা তাদেরকে উন্নত ব্যাকরণ ও গ্রীক বিষয়ে পাঠদান করতেন। তাদের বিশ্বাস ছিলো যে, এতে করে মেয়েরা তাদের স্বামীর কাছে শিক্ষিত ও সম্মানিত সঙ্গী হিসেবে মর্যাদা পাবে। আর এভাবেই তারা প্রভাবশালীও হয়ে উঠবে।
গ্রীসের নারীরা জ্যাক খেলতো
গ্রীসের নারীরা বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলতো। সেগুলোর মধ্যে একটি খেলা ছিলো ‘নাকলবোন’ (অ্যাস্ট্রাগেলস), যার সাথে আধুনিক খেলা ‘জ্যাক’-এর মিল রয়েছে। খেলাটা ছিলো অনেকটা এরকম যে, নাকলবোনগুলোকে আকাশে ছুঁড়ে মারতে হবে এবং যতগুলো সম্ভব হাতে ধরতে হবে। নাকলবোনগুলোকে আসলে ছিলো ভেড়া বা ছাগলের গোড়ালির হাড়। আবার কোনো কোনোটি বানানো হতো হাতির দাঁত, ব্রোঞ্জ বা পোড়ামাটি দিয়ে।
প্রাচীন রোমের নারীরা ছিলো সৌন্দর্যের পূজারী
প্রাচীন রোমের নারীদেরকে যেন দেখতে সুন্দর দেখায়, সে বিষয়ে তারা বেশ চাপের মুখেই থাকতো! কারণ তাদের বিশ্বাস ছিলো যে, তাদের বাহ্যিক রূপের প্রতিফলন তাদের স্বামীর জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করতো। এছাড়াও প্রাচীন রোম ছিলো প্রসাধনী শিল্পে অনেক সমৃদ্ধ। ভেষজ বিভিন্ন উপাদান, যেমন- গোলাপের পাঁপড়ি, মধু দিয়ে রূপচর্চা করা হতো। আর ত্বকের যেকোনো দাগ সারানোর জন্য মুরগির চর্বি ও পেঁয়াজ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হতো। কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পাওয়া প্রমাণ অনুযায়ী, নারীদের সেই সৌন্দর্যচর্চার পদ্ধতিগুলো অনেক অদ্ভুত ছিলো।
এ সময়ের ফার্স্ট লেডির ভূমিকা পালন করতো প্রাচীন রোমের সম্রাটদের স্ত্রীরা
প্রাচীন রোমের শাসকদের স্ত্রীরা নির্বাচনের প্রচারণা অভিযানে তাদের সহায়তা করতো। রোমের প্রাচীন ও প্রত্নতাত্ত্বিক শহর পম্পেইয়ের দেয়ালে বিভিন্ন গ্রাফিতি দেখলে বোঝা যায় যে, সেখানে কিছু নারী নির্দিষ্ট কিছু ভোটপ্রার্থী পুরুষদের সমর্থন করছেন। রোমের প্রায় সকল সম্রাটেরাই পুরো রোম জুড়ে তাদের স্ত্রী, কন্যা ও মায়ের সাথে আদর্শ সম্পর্কের ভাবমূর্তি প্রকাশ করতো। পয়সা ও ভাস্কর্যের প্রতিকৃতিগুলোতে স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক চিত্রিত হতো। যখন অগাস্টাসকে রোমের প্রথম সম্রাট হিসেবে ঘোষণা কর হয়, তখন ব্যয়বহুল পোশাকের বদলে তিনি তার পরিবারের স্ত্রীলোকদের হাতে বোনা একেবারে সাধারণ উলের পোশাক পরার বিষয়টি খুব করে প্রচার করেন।
বেশি কথা বলার কারণে চীনের নারীরা স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হতো
চীনে প্রাচীনকালে নারীদের কোনো অধিকার ছিলো না বললেই চলে এবং তাদেরকে স্বামীদের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বিয়ের আয়োজন করা হতো পেশাদার ঘটকদের মাধ্যমে। আর একজন মেয়ে বিয়ের দিনই প্রথম তার স্বামীকে দেখতে পারতো। সে সময়কার ঐতিহ্যবাহী বিয়ের রীতি অনুযায়ী, বরের বাবা-মা বসে থাকতো এবং লাল পোশাক ও নীল রঙের মাথার কাপড় পরে কনে তার হবু শ্বাশুড়ির জন্য চা নিয়ে আসতো। তবে যা-ই হোক, স্বামীরা যেসব কারণে স্ত্রীদেরকে ত্যাগ করতো, সেগুলো বেশ উদ্ভট ছিলো। যেমন- ছেলেসন্তান না হলে, বিশ্বাস ভঙ্গ করার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে, স্বামীর পিতা-মাতার সেবায় কমতি হলে, চুরি করলে, কোনো ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে, ঈর্ষা বা সন্দেহ করলে, এমনকি বেশি কথা বললেও স্বামীরা তাদের স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দিতো।
ভারতীয় নারীরা তাদের স্বামী নিজের ইচ্ছেমতো বাছাই করতে পারতেন
বিষয়টি বেশ আকর্ষণীয় বটে! কারণ এখনও পর্যন্ত ভালোবেসে বিয়ে করার ব্যাপারটা ভারতের বেশিরভাগ স্থানেই সহজে মেনে নেয়া হয় না। কিন্তু প্রাচীনকালে সেখানে একজন নারীকে পুরুষের সমতুল্য ধরা হতো। তখন নারীরা যে শুধু তাদের পছন্দের পুরুষদের বিয়ে করতে পারতো তা-ই নয়, বরং তার ইচ্ছেমতো সময়ে বিয়ে করার স্বাধীনতাটাও ছিলো। ভারতীয় নারীরা বেশ ভাল শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেত এবং বেদের দীক্ষা অধ্যয়ন করারও অনুমতি ছিলো তাদের।
ফিচার ইমেজ: Pinterest