পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা তাকে এডিক নামে ডাকতেন। কিন্তু তার আসল নাম ছিল অ্যাডলফ তোলকাচেভ। ধূসর বর্ণের চোখ, চওড়া কপাল, নাকের বাঁকানো হাড় আর ঘন বাদামী বর্ণের চুল ছিল তোলকাচেভের। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটি ছিলেন খুবই চাপা স্বভাবের। সোভিয়েত মিলিটারি ল্যাবরেটরিতে বিমানের রাডার তৈরির বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু এর বাইরে তিনি আর কী কাজ করেন, সে সম্পর্কে তার একমাত্র ছেলেও কিছু জানত না!
এদিকে মানসিকভাবে কখনোই ঠিক স্বস্তিতে থাকতেন না তোলকাচেভ। সোভিয়েত সরকারের এক কালো অধ্যায় তাকে সবসময় তাড়া করত। তিনি মনে-প্রাণে তার প্রতিশোধ নিতে চাইতেন। তার এই ক্ষোভ একসময় তার সমস্ত গাম্ভীর্যের অবসান ঘটায়। চাপা স্বভাবের তোলকাচেভ একসময় হয়ে যান চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট৷
আশির দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তিনি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর এমন কিছু তথ্য ও চিত্র তুলে দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের রাডার সম্পর্কে গোপন সব তথ্য জেনে যায়। এছাড়া তারা সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর অস্ত্রের ওপর গবেষণার অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আগে থেকেই পেয়ে যায়।
সিআইএ-এর হয়ে তোলকাচেভের গুপ্তচরবৃত্তি যুক্তরাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যেকোনো আকাশ যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রুজ মিসাইল ও বোমারু বিমানগুলোর পক্ষে যে সোভিয়েত বাহিনীর রাডার ফাঁকি দেয়া খুব সহজ, এমন সব তথ্য প্রদানের দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রকে সোভিয়েত বাহিনীর দুর্বলতাগুলো আগেভাগেই জানিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি।
স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই সোভিয়েতরা চেষ্টা করছিল প্রযুক্তির বিভিন্ন দিকে পশ্চিমাদের সমকক্ষ হওয়ার। কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বড় এক খুঁত ছিল। সত্তরের দশকের শুরুতে তারা বুঝতে পারে তাদের রাডারগুলো ভূমির কাছাকাছি দিয়ে যাওয়া বস্তুগুলো শনাক্ত করতে পারছে না। এর অর্থ হলো- হামলার উদ্দেশ্যে কোনো বোমারু বিমান অথবা ক্রুজ মিসাইল ভূপৃষ্ঠের কাছ ঘেঁষে উড়ে আসলে তারা টেরও পাবেন না।
তখন সোভিয়েত সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায় থেকে এমন এক রাডার তৈরি করার জন্য চাপ দেওয়া হয়, যা ওপর থেকে ভূমির একেবারে কাছে দিয়ে যাওয়া যেকোনো বস্তুর নড়াচড়া শনাক্ত করতে পারবে। আর এই কাজের দায়িত্ব বর্তায় অ্যাডলফ তোলকাচেভ ও তার সাথে কাজ করা প্রকৌশলীদের। এই কাজ করতে গিয়েই তোলকাচেভ ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে পুষে রাখা প্রতিশোধের আগুন নেভানোর রাস্তা খুঁজে পান এবং ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন সাধারণ এক গুরুগম্ভীর মানুষ থেকে অসাধারণ এক গুপ্তচর।
তোলকাচেভ কেন প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন?
১৯২৭ সালের ৬ জানুয়ারি, কাজাখস্তানের আকতোবেতে জন্মগ্রহণ করেন অ্যাডলফ তোলকাচেভ। ১৯৪৮ সালে তিনি অপটিক্যাল মেকানিকাল রাডার ট্রেইনিং সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে তিনি খারকভ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পড়াশোনা শেষ করে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর রেডিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ফ্যাজোট্রন রাখা হয়।
পঞ্চাশের দশক থেকে ফ্যাজোট্রন তাদের গবেষণার বিস্তৃতি ঘটানোর পাশাপাশি উন্নতমানের রাডার তৈরির দিকে মনোনিবেশ করে, যে রাডারগুলো সাধারণ কোনো বস্তু থেকে জটিল কোনো বিমানের চলাচলকে শনাক্ত করতে পারবে। সেই সাথে তারা অস্ত্রের পরিচালনা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করেন।
তোলকাচেভ তার পরিবার নিয়ে সরকারের দেওয়া বিলাসবহুল এক অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করতেন। তার পাশের অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে সোভিয়েত বিমানবাহিনী এবং মিসাইল তৈরির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও পরিবার নিয়ে থাকতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ভ্যালেন্টিন গ্লাশকো, যিনি সোভিয়েত রকেট ইঞ্জিন প্রকল্পের প্রধান নকশাকার ছিলেন। তার প্রতিবেশী হিসেবে আরো ছিলেন ভ্যাসিলি মিশিন, যিনি রকেট ইঞ্জিন প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি চাঁদে যাওয়ার মতো রকেট তৈরিতে ব্যর্থ হন।
আশেপাশে অনেক প্রতিবেশী থাকলেও তোলকাচেভ একাকী থাকতেই ভালোবাসতেন। একমাত্র ল্যাবরেটরিতে তিনি সহকর্মীদের সাথে অল্প সময়ের জন্য গল্পগুজব করতেন। তার কাছে আসলে গল্পগুজবও ক্লান্তিকর মনে হতো। এ কারণে তিনি চেষ্টা করতেন এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখার।
তোলকাচেভের স্ত্রী নাটালিয়া ইভানোভা, ডাকনাম নাতাশা৷ তিনিও তোলকাচেভের সাথে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন অ্যান্টেনা বিশেষজ্ঞ। তারা দুজনে ভালোই আয় করতেন। সব মিলিয়ে সুখের সংসার বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিল তাদের।
স্ত্রী নাতাশা ও ছেলে ওলেগকে নিয়ে তোলকাচেভ যেখানে থাকতেন, তার পাশেই ছিল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। এর পাশে দ্বীপপুঞ্জের মতো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ইনস্টিটিউট, কারখানা এবং টেস্টিং রেঞ্জ ছিল। তার নিজেরও সরকারী সর্বোচ্চ গোপনীয় বিষয় পর্যন্ত প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু তাদের বিভিন্ন লোকজনের সাথে মেলামেশা ও আচার-আচরণের ওপর নজরদারি করা হতো।
পরিবার নিয়ে সুখে থাকলেও স্ত্রী নাতাশার শৈশবের কষ্টগুলো তাকে সবসময় অস্থির করে তুলত। জোসেফ স্টালিনের শাসনামলে, ১৯৩৬ সাল থেকে সন্দেহজনক মনে হলেই যে কাউকে আটক করার রীতি চালু হয়। আটক হওয়া অনেক ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানো, আটক এবং মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হয়। ১৯৩৭ সালের গ্রীষ্ম থেকে এর হার আরো বেড়ে যায়।
অপারেশন লুলাকসের নামে প্রায় ১৮ লাখ সাধারণ মানুষকে আটক করা হয়। যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো সময় আটক করা হতো। যদি কেউ সামান্যতম ভুলও করতেন, তার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এই অপারেশন শেষ হওয়ার পর স্টালিনের মনে সন্দেহ হয় যে, জেল থেকে তার প্রতি অসন্তুষ্ট ও তীব্র বিরোধীরা ফিরে আসছেন।
তখন আবার তার নীল নকশা অনুযায়ী পরবর্তী দুই বছর নির্বিচারে অসংখ্য মানুষকে আটক ও হত্যা করা হয়। এমনকি যদি কেউ বিদেশ ভ্রমণ করতেন অথবা বিদেশে থাকে এমন কাউকে চিনতেন, তাহলে তাকে দেশের শত্রু হিসেবে সন্দেহ করা হতো।
তোলকাচেভের স্ত্রী নাতাশার মায়ের সাথে এমনই হয়েছিল। নাতাশার বয়স যখন দুই বছর, তখন তার মা সোফিয়া এফিমোভনা বামদাস ডেনমার্কে তার স্বামীর সাথে দেখা করতে যান। সোফিয়া বামদাস তখন সোভিয়েত সরকারের কাঠশিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছিলেন। অন্যদিকে, তার তার স্বামী ইভান কুজমিন ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের সমর্থক। একজন পুঁজিবাদী অর্থনীতি সমর্থকের সাথে দেখা করার অপরাধে নাতাশার মাকে আটক করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
এরপর তার বাবা দেশে ফিরে আসলে তাকে স্ত্রীর সম্পর্কে প্রকাশ্যে নিন্দা করতে বলা হয়। কিন্তু কুজমিন তা করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে মস্কোর কুখ্যাত বুটুরস্কায়া জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়। পরে তাকে সোভিয়েত বিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিলেও দূরের এক লেবার ক্যাম্পে পাঠানো হয়। আর নাতাশাকে পাঠানো হয় এক সরকারি এতিমখানায়।
এরপর নাতাশার বয়স যখন ১৮ বছর, তখন আবার তার বাবার সাথে দেখা হয়। কিন্তু লেবার ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার তিন বছরের মাথায় তিনি মস্তিষ্কের এক রোগে মারা যান। এরপরের বছর নাতাশা ও তোলকাচেভের বিয়ে হয়। মৃত্যুর আগে নাতাশার বাবা তার কাছে তাদের পরিবারের দুঃখ দুর্দশার সব কথা বলে যান।
বাবার মুখে সেসব শোনার পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক দলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতি তার তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি হয়৷ তার এই ঘৃণা পরবর্তীতে তোলকাচেভের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। তিনি নিজেও শ্বশুর-শাশুড়ির পরিণতি মেনে নিতে পারেননি। এই ঘটনা তার মধ্যে তীব্র এক আগুন সৃষ্টি করেছিল, যা নেভানোর জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করে তাদের সাথেই বেঈমানি করেছিলেন।
সিআইএ’র সাথে যোগাযোগের চেষ্টা
১৯৭৭ সালের জানুয়ারি, মস্কোর শীতের এক বিষণ্ণ বিকেল। স্থানীয় সিআইএ প্রধান নিজের অফিস থেকে বের হয়ে কাছের এক গ্যাস স্টেশনে গেলেন। সেই গ্যাস স্টেশনটি সাধারণত মস্কোতে থাকা কূটনীতিকরা ব্যবহার করতেন। তিনি যখন গ্যাস নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, একজন মাঝবয়সী রুশ নাগরিক তার দিকে এগিয়ে আসছেন। কাছাকাছি এসে সিআইএ প্রধানের কাছে ইংরেজিতে জানতে চাইলেন তিনি আমেরিকান কিনা।
যখন তিনি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন, তখন সেই রাশিয়ান লোকটি মোড়ানো একটি কাগজ গাড়ির সিটের মধ্যে রেখে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করেন। পরে সিআইএ প্রধান লক্ষ করলেন গ্যাস স্টেশনে একমাত্র তার গাড়িতেই আমেরিকান নাম্বার প্লেট লাগানো ছিল। অর্থাৎ লোকটি সম্ভবত একজন আমেরিকান নাগরিকের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এর পেছনে অবশ্যই তার কোনো উদ্দেশ্য আছে।
এরপর সেই মোড়ানো কাগজ খুলে মস্কোতে নিয়োজিত সিআইএ প্রধান দেখেন, সেই লোকটি রুশ ভাষায় অল্প কিছু কথা লিখেছেন। যার সারমর্ম হচ্ছে, তিনি অত্যন্ত গোপনীয় একটি বিষয় নিয়ে উপযুক্ত কোনো আমেরিকান কর্মকর্তার সাথে বৈঠক করতে চান। সেই সাথে তিনি নির্দিষ্ট এক সময়ে নির্দিষ্ট এক স্থানে কোনো আমেরিকান কর্মকর্তার গাড়ির মধ্যে অথবা কোনো মেট্রো স্টেশনের প্রবেশপথে সতর্কতার সাথে বৈঠকটি করতে চান। কাগজে তিনি মেট্রো স্টেশনের কোথায়, কখন, কীভাবে গাড়ি পার্ক করা থাকবে তার একটি চিত্রও এঁকে দেন।
কিন্তু পরবর্তীকালে সেই ইন্টেলিজেন্স ভলান্টিয়ার ও সিআইএ-এর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন একটি দীর্ঘ ও বিরক্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়। কারণ সেই লোকের ডাকে সাড়া দেওয়া সিআইএ-এর পক্ষে খুব সহজ ছিল না৷ তারা জানতো, কেজিবি লোকদেখানো ইন্টেলিজেন্স ভলান্টিয়ারদের জাল বুনে রেখেছে এবং এসব ভলান্টিয়ার সাহায্য করার নাম করে এসে উল্টো বিভিন্ন তথ্য হাতিয়ে নিয়ে যাবে৷ কেজিবির পাতা এমন ফাঁদে আমেরিকান গোয়েন্দারা যদি পা দেন, তাহলে তাদের একই সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সাথে অজস্র তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে চলে যাওয়ার ভয়।
অপরদিকে সিআইএ বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের এজেন্টদের কাজে লাগিয়েছে। এদের একজন ছিলেন কর্নেল ওলেগ পেনকোভস্কি। যিনি সোভিয়েত মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। ১৯৬০ সালের দিকে তিনি পশ্চিমাদের হয়ে মস্কোতে কাজ করেন। পশ্চিমা গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য পেনকোভস্কিকেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল।
পেনকোভস্কি দুজন মার্কিন ছাত্র, একজন ব্রিটিশ ও একজন কানাডিয়ান ব্যবসায়ীর কাছে তার চিঠি দিয়েছিলেন। কয়েক মাস চেষ্টা করার পর ব্রিটিশ ব্যবসায়ী গ্রেভিল ওয়েনের মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দাদের হয়ে এক বছরের কিছু বেশি সময় কাজ করেছিলেন।
এই অল্প সময়ের মধ্যে পেনকোভস্কি সিআইএ-কে সোভিয়েত রাজনীতি এবং সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনা ও মনোভাব সম্পর্কে অত্যন্ত দামি কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। পাশাপাশি সোভিয়েত মিসাইলের বিস্তৃতি ও অপারেশন সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছিলেন, যা কিউবার মিসাইল সঙ্কটের সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাজে লেগেছিল।
কিন্তু পেনকোভস্কির সাথে সিআইএ যেসব বৈঠক করেছিল, তার সবই হয়েছিল পাশ্চাত্যে। তিনি যখন সোভিয়েত প্রতিনিধিদের সাথে বিদেশ সফরে যেতেন, তখন সেই সুযোগকে কাজে লাগানো হতো। কিন্তু তোলকাচেভ চাইছেন মস্কোরই কোনো এক জায়গায় বৈঠক করতে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
এছাড়া পরবর্তী কয়েক মাসে মস্কোতে থাকা সিআইএ সদস্যদের পূর্ব-নির্ধারিত কিছু কাজ ছিল। এর মধ্যে কোনো সদস্য কেজিবির হাতে ধরা পড়ুক- এমন কিছু সিআইএ হেড কোয়ার্টার আশা করছিল না। যে কারণে সেখান থেকে তোলকাচেভের চিঠির উত্তর দিতে নিষেধ করা হয়।
এর মধ্যে জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করার ঘোষণা দেন। তিনি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর মধ্যে নাম পরিচয়হীন কোনো ভলান্টিয়ার ইন্টেলিজেন্সের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন সৃষ্টি হোক- এমন কিছু মস্কোর সিআইএ শাখাও চাইছিল না। ফলে প্রথম চেষ্টায় তোলকাচেভকে ব্যর্থ হতে হয়।
তোলকাচেভের বারংবার চেষ্টা, সিআইএ’র সময়ক্ষেপণ
১৯৭৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, তোলকাচেভ আবারো মস্কোতে থাকা সিআইএ প্রধানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তিনি আবারো সিআইএ কর্মকর্তার গাড়িতে একটি চিরকুট রেখে যান। গাড়িটি মার্কিন দূতাবাসের কাছেই পার্ক করা ছিল। কিন্তু দূতাবাসের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সোভিয়েত সেনাদের সামনে বরফের স্তুপ থাকায় তারা তোলকাচেভকে দেখতে পাননি।
চিরকুটে তিনি আগের মতোই বৈঠকের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু সিআইএ-এর হেডকোয়ার্টারের পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবারো চিরকুটের জবাব দেওয়া থেকে মস্কোর সিআইএ শাখা বিরত থাকে।
দুই সপ্তাহ পর তোলকাচেভ সিআইএ প্রধানের গাড়িতে আবারো একটি চিরকুট রেখে যান৷ এবারের চিরকুটে তিনি উল্লেখ করেন যে, বৈঠকের প্ররোচনায় তাদের চিন্তিত হওয়ার বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরেছেন৷ কিন্তু যেহেতু তিনি একজন প্রকৌশলী এবং একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেহেতু তিনি গোপন কোনো তথ্য জানেন না বা দিতেও পারবেন না।
সেই সাথে সাথে তোলকাচেভ উল্লেখ করেন যে, কেন তিনি নিজের সম্পর্কে কোনো তথ্য দিচ্ছেন না। তিনি আসলে দেখতে চাইছিলেন তার চিরকুটের বিষয়টি কীভাবে দেখা হয়। তিনি আবারো বৈঠকের অনুরোধ করেন এবং নতুন করে বৈঠকের দিকনির্দেশনা দেন।
মস্কোর সিআইএ প্রধান নাছোড়বান্দা তোলকাচেভের ধৈর্য দেখে একটু অবাক হন। এবার তিনি বৈঠকের অনুমতি দেওয়ার জন্য প্রধান কার্যালয়ে অনুরোধ করেন৷ যাতে চিরকুটে বলে দেওয়া জায়গায় গাড়ি পার্কিং করে লোকটি আসলে কে এবং তিনি কী তথ্য শেয়ার করতে চান, সে সম্পর্কে জানা যায়৷ কিন্তু এবারও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংকোচ বোধ করা হয় এবং তোলকাচেভকে ইতিবাচক কোনো সাড়া দিতে নিষেধ করা হয়।
একই বছরের মে মাসে তোলকাচেভ আবারো একদফা চেষ্টা চালান৷ তোলকাচেভ সিআইএ প্রধানের গাড়ির জানালায় কড়া নাড়লেও, তিনি কোনো পাত্তা না দিয়ে চলে যান৷ এর ছয় মাস পর তোলকাচেভ আবারো দৃশ্যপটে হাজির হন। এবার তিনি স্থানীয় বাজারে আমেরিকান নম্বর প্লেটের গাড়ি নিয়ে কেনাকাটা করতে আসা এক লোকের কাছে একটি চিঠি দেন এবং সেই চিঠি দায়িত্বশীল কোনো আমেরিকান কর্মকর্তার হাতে তুলে দিতে বলেন।
পরবর্তীতে সেই চিঠি মার্কিন দূতাবাসের সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তার কাছে এসে পৌঁছায়। পরে তিনি সেই চিঠি সেখানকার সিআইএ প্রধানের হাতে তুলে দেন৷ চিঠিতে তিনি আগের মতোই বৈঠকের কথা বলেন এবং সেই সাথে কোথায় কীভাবে দেখা করবেন, তার বিস্তারিত এঁকেও জানিয়ে দেন।
তবে এবার তোলকাচেভ আরো একটু এগিয়ে যান৷ তিনি টাইপ করা দুই পৃষ্ঠা কাগজ চিঠির সাথে দেন, যেখানে তিনি সোভিয়েত যুদ্ধবিমানের ইলেকট্রনিক্স সিস্টেমের কিছু তথ্য দেন, যা মস্কোতে নতুন আসা সিআইএ প্রধান গার্ডনার হ্যাথাওয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
তিনি সাথে সাথে ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান এবং ভলান্টিয়ার ইন্টেলিজেন্সের সাথে যোগাযোগের অনুমতি চান। এবার সিআইএ প্রধান কার্যালয় থেকে সরাসরি নিষেধ না করা হলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময়ক্ষেপণ করা হয়।
১৯৭৮ সালের জানুয়ারিতে এসে সিআইএ প্রধান কার্যালয় থেকে আবারো মস্কোর শাখার অনুরোধ নাকচ করে দেওয়া হয়। কারণ এক সপ্তাহ আগে সোভিয়েত সরকার এক আমেরিকান কর্মকর্তাকে পারসন নন গ্রাটা (কূটনীতিক ভাষায় বহিষ্কার) ঘোষণা করেছে৷ যার ফলে মস্কোর দুই সিআইএ কর্মকর্তাকে দেশে ফেরত পাঠাতে হয়। তারা দুজনই স্থানীয় ভলান্টিয়ার ইন্টেলিজেন্সদের সাথে আপোসের মাধ্যমে কাজ করছিলেন। এই কারণে সিআইএ হেডকোয়ার্টারের বক্তব্য ছিল যে, তারা নতুন করে আর কোনো কর্মকর্তাকে হারাতে চান না৷
তাদের ধারণা ছিল তোলকাচেভ সর্বশেষ যেসব তথ্য দিয়েছে, তা সোভিয়েত সরকারের প্ররোচনার অংশ হতে পারে। যদিও তার দেওয়া তথ্য গার্ডনার হ্যাথাওয়ের কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু তাকে হেডকোয়ার্টারের আদেশ মেনে চলতে হবে। এ কারণে তার ইচ্ছা থাকলেও করার কিছুই ছিল না তখন।
ভাগ্যক্রমে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পেন্টাগন থেকে সিআইএ হেডকোয়ার্টারে একটি স্মারক পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, যে ইউএস আর্মি এমন একজন গোয়েন্দা নিয়োগ দিতে খুবই আগ্রহী যে, সোভিয়েত যুদ্ধবিমানের ইলেকট্রনিক্স এবং যুদ্ধাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে। তোলকাচেভ ঠিক এই কাজই করতে চাইছিলেন। কিন্তু ওপর মহলের আগ্রহ না থাকায় মস্কোর সিআইএ শাখা তাকে নিয়োগ দিতে পারছিল না।
অবশেষে অধ্যাবসায়ের পুরস্কার
১৯৭৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, মস্কোর সিআইএ প্রধান হ্যাথাওয়ে ও তার স্ত্রী যখন কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তারা গাড়ি আবারো একটি চিরকুট পান। এবার চিরকুটে তোলকাচেভ লেখেন,
আমি আমার নিরাপত্তার শঙ্কায় নিজের সম্পর্কে বেশি তথ্য দিতে পারছি না। একই কারণে আপনারা আমার সাথে যোগাযোগ করছেন না। আপনারা ভাবছেন এটি একটি প্ররোচনা।
তোলকাচেভ এবার মার্কিন গোয়েন্দাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য একটি উপায় বের করেন। তিনি তার টেলিফোনের শেষের দুই ডিজিট বাদে বাকি সব নম্বর চিরকুটে লিখে দেন এবং তিনি বলে দেন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে বাকি দুই ডিজিট লিখে দাঁড়িয়ে থাকবেন। পরবর্তীকালে হ্যাথাওয়ের স্ত্রী গাড়ি নিয়ে তোলকাচেভের বলা সেই জায়গায় গিয়ে তাকে শনাক্ত করেন এবং তার লেখা দুই ডিজিট খাতায় লিখে নিয়ে আসেন।
হ্যাথাওয়ে অতিদ্রুত সিআইএ হেডকোয়ার্টারে সবকিছু জানিয়ে বার্তা পাঠান৷ এবার সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি, সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা করে এই কাজে জন গুলিশার নামে একজন কেস অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। যিনি রুশ ভাষায় খুবই পারদর্শী ছিলেন।
সেদিন দীর্ঘ সময় নজরদারির পর গুলিশার পাবলিক টেলিফোন থেকে ফোন করেন। কিন্তু অপর পাশে ফোন ধরেন তোলকাচেভের স্ত্রী নাতাশা। গুলিশার কেন ফোন করেছেন, সে বিষয়ে জানার জন্য নাতাশা বারবার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু কোনো কিছু না বলেই গুলিশার ফোন রেখে দেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি আবারো ফোন করেন, কিন্তু একই ঘটনা ঘটে৷
এরপর ১ মার্চ, তোলকাচেভ আবারো হ্যাথাওয়ের গাড়িতে কিছু কাগজ ফেলে যান। তবে এবার তিনি নিজের হাতে ১১ পৃষ্ঠায় সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। সেই সাথে তিনি নিজে কী করেন, কোথায় থাকেন, সব তথ্যই দেন।
এবার তিনি শেষে লিখে দেন,
আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় ঘুরেছি শুধু মার্কিন কূটনীতিকদের কোনো গাড়ি খোঁজার জন্য৷ আমি যদি একবার পেয়েছি, তো দশবারই অনুকূল পরিস্থিতি না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে গেছি। আমার চেষ্টার ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছিলাম। যদি আপনারা এবার সাড়া না দিতেন, তাহলে আমি হয়তো হাল ছেড়ে দিতাম।
তোলকাচেভকে এবার আর হতাশ হতে হয়নি। যদিও তার প্রস্তাব গ্রহণে সিআইএ-এর সাবধান হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল। ভাগ্যক্রমে অনেক খোঁজখবর নেওয়ার পর তার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় সিআইএ। আর এই একটি সিদ্ধান্ত থেকেই রচিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সফল এক গুপ্তচরের গল্পের। কেমন ছিল সেই গল্প? জানতে হলে পড়ুন পরের কিস্তি।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে