১৯৮৬ সালের ১৫ই এপ্রিল। রাতের আঁধার ভেদ করে মার্কিন বিমানবাহিনীর অর্ধশতাধিক প্লেন ছুটে যাচ্ছে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে। অপারেশনের সাথে জড়িত সবাই দারুণ উত্তেজিত, কারণ এটি ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর মার্কিন বিমানবাহিনীর প্রথম কোনো অভিযান এবং একইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রথম ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’। আনুষ্ঠানিকভাবে এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ‘সন্ত্রাসবাদী’ হামলায় ব্যবহৃত লিবিয়ার সামরিক ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করা। কিন্তু অপারেশনে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাদেরকে কেউ পরিষ্কারভাবে বলে না দিলেও তাদের অনেকেই জানতেন, এ অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই- লিবীয় নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফীকে হত্যা করা।
গাদ্দাফীকে হত্যার চেষ্টা অবশ্য আমেরিকার এটাই প্রথম ছিল না। পুরো আশির দশক জুড়েই আমেরিকার অন্যতম প্রধান প্রচেষ্টা ছিল গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত অথবা হত্যা করা। এর প্রধান কারণ ছিল গাদ্দাফীর ইসরায়েল বিরোধিতা এবং ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি তার আর্থিক সহায়তা। সেসব অপারেশনের কথা আমরা আলোচনা করবো ভবিষ্যতের অন্য কোনো লেখায়। আজকের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু ১৯৮৬ সালের কয়েকটি ঘটনার মধ্যেই।
পরপর অনেকগুলো গোপন অপারেশন ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৮৫ সালের শেষ দিক থেকে সিআইএ সরাসরি গাদ্দাফীর উপর আক্রমণের অজুহাত খুঁজছিল। ঠিক সে সময় এপ্রিলের ৫ তারিখে সংঘটিত হয় লা বেল ডিস্কো বম্বিং, যার উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই সিরিজের পূর্ববর্তী লেখায়। লা বেল হামলার আরো আগে থেকেই অবশ্য সিআইএ গাদ্দাফীর উপর সরাসরি আক্রমণের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল, কিন্তু উপযুক্ত সুযোগ খুঁজে পাচ্ছিল না। এই হামলাটি আমেরিকাকে ঠিক সে সুযোগটিই করে দেয়।
লা বেল হামলার মাত্র তিন মাস আগে ভিয়েনা এবং রোম এয়ারপোর্টে আরেকটি সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়েছিল। ফিলিস্তিনি সংগঠন আবু নিদাল অর্গানাইজেশনের করা ঐ সন্ত্রাসী হামলার পরপরই আমেরিকা কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই লিবিয়াকে দায়ী করে বসে এবং সিদরা উপসাগরে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। সে সময় আমেরিকার দুটি নৌবহর ইউএসএস সারাটোগা এবং ইউএসএস আমেরিকা অবস্থান করছিল লিবিয়ার তীরবর্তী সিদরা উপসাগরে। ২৩ মার্চ সেগুলো থেকে পরিচালিত হামলায় বিধ্বস্ত হয় লিবিয়ার চারটি রণতরী এবং নিহত হয় ৩৫ জন লিবিয়ান নাবিক।
আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল সিদরা উপসাগরে লিবিয়ার দাবী করা সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশ করে গাদ্দাফীকে উস্কে দেওয়া, যেন গাদ্দাফী মার্কিন নৌবহরে পাল্টা হামলা করে বসে এবং সেই অযুহাতে লিবিয়াতে সরাসরি আক্রমণ করা যায়। কিন্তু ৩৫ জন নাবিক নিহত হওয়ার পরেও লিবিয়া তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন নৌবহরের উপর পাল্টা আক্রমণ না করায় আমেরিকা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারছিল না। তবে আমেরিকা লিবিয়ার উপর আক্রমণের সুযোগ পেয়ে যায় এর মাত্র তিন মাস পরেই, যখন সিদরার ঘটনার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে লিবিয়ান গোয়েন্দাবাহিনীর সদস্য মেসবাহ বিলগাসেম ইতেরের উদ্যোগে এপ্রিলের ৫ তারিখে পশ্চিম বার্লিনের লা বেল নাইট ক্লাবটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
লা বেল ডিস্কো বম্বিংয়ের ঐ ঘটনায় নিহত হয়েছিল এক তুর্কি নারী এবং দুই মার্কিন সেনা। আহত হয়েছিল আরো ২৩০ জন, যাদের মধ্যে ছিল ৫০ জন মার্কিন সেনা সদস্য, এবং আরো ২৯ জন মার্কিন নাগরিক। তবে ঐ হামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল, তা আমেরিকার হাতে লিবিয়ার উপর আক্রমণ করার উপলক্ষ্য তুলে দিয়েছিল। লা বেল ডিস্কো বম্বিং যে আসলেই লিবিয়ার কাজ ছিল, সেটি প্রমাণিত হতে সময় লেগেছিল আরো ১৫ বছর। কিন্তু ঘটনার পরপরই, কোনো প্রমাণ ছাড়াই আমেরিকা সরাসরি এর জন্য লিবিয়াকে দায়ী করে এবং লিবিয়ার উপর আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে।
আমেরিকার পক্ষ থেকে দাবী করা হয়, তারা হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে এবং পরে ত্রিপলীর সাথে পূর্ব জার্মানির লিবিয়ান দূতাবাসের বার্তা আদান প্রদানের প্রমাণ পেয়েছে, যা থেকে নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হয়, এ হামলা লিবিয়ানরাই করিয়েছে। কিন্তু হোয়াইট হাউজের এ দাবি বহির্বিশ্বকে তো বটেই, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) অনেক কর্মকর্তাকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কারণ স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের বার্তার মর্ম উদ্ধার এবং তার সত্যতা যাচাই করার কথা এনএসএর, কিন্তু এক্ষেত্রে এনএসএর উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞদেরকে এড়িয়ে তা সরাসরি পাঠানো হয়েছিল হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তাদের কাছে।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান গাদ্দাফীকে উৎখাত করতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু সরাসরি লিবিয়ার উপর সামরিক শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে তিনি রাজি ছিলেন না। কিন্তু লা বেল ডিস্কো বম্বিংয়ের পর হামলার পেছনে গাদ্দাফীর ভূমিকার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়ার দাবী করে সিআইএ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্মকর্তারা তাকে লিবিয়ার উপর অভিযান চালানোর ব্যাপারে রাজি করতে সক্ষম হন। হামলার পরদিন বিকেলেই রিগ্যান তার মত পরিবর্তন করেন এবং সামরিক অভিযানের ব্যাপারে সবুজ সংকেত দেন। শুরু হয় অপারেশন এল ডোরাডো ক্যানিয়নের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি।
প্রেসিডেন্টের অনুমতি পাওয়ামাত্রই মার্কিন বিমান এবং নৌবাহিনীর প্রধানরা লিবিয়ার উপর আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, রাজধানী ত্রিপলী এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী বেনগাজির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় আক্রমণের পাশাপাশি লেজার গাইডিং সিস্টেম সম্বলিত অত্যাধুনিক নয়টি সুপারসনিক এফ-১১১এফ যুদ্ধ বিমান নিয়োগ করা হবে শুধুমাত্র গাদ্দাফীকে হত্যা করার জন্য। কোনো প্রমাণ যেন না থাকে সেজন্য সরাসরি গাদ্দাফীকে হত্যার ব্যাপারে কাউকে কোনো লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়নি, কিন্তু বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছিলেন, তাদের অভিযানে গাদ্দাফীর নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ৯৫%।
লা বেল ডিস্কো বম্বিংয়ের মাত্র ১০ দিনের মাথায়, এপ্রিলের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে শুরু হয় এল ডোরাডো ক্যানিয়নের মূল অভিযান। গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ দেখাতে না পারায় জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালিসহ ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রই মার্কিন যুদ্ধ বিমানগুলোকে তাদের দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করার অনুমতি দেয়নি। ফলে ইংল্যাণ্ডের বিমানঘাঁটি থেকে যাত্রা শুরু করতে হয় মার্কিন বিমানবাহিনীর ৫৮টি প্লেনকে। ইউরোপের উপর দিয়ে সরাসরি যাওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে হয় প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে জিব্রালটার প্রণালী দিয়ে বিস্তীর্ণ পথ ঘুরে।
আগে থেকেই ভূমধ্যসাগরে দুটি মার্কিন রণতরী অবস্থান করছিল। ভিয়েনা এবং রোম এয়ারপোর্টে হামলার পর ইউএসএস কোরাল সী নামে আরো একটি রণতরী সেখানে নিয়োগ করা হয়েছিল। ইংল্যাণ্ড থেকে উড়ে আসা বিমানবাহিনীর প্লেনগুলোর সাথে এই রণতরীগুলো থেকে অভিযানে যোগ দেয় মার্কিন নৌবাহিনীর আরো ২৭টি প্লেন। বিমানবাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল লিবিয়ান হোয়াইট হাউজ নামে খ্যাত গাদ্দাফীর বাসভবন বাব আল-আজিজিয়া কম্পাউণ্ডসহ ত্রিপলীর বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা আর নৌবাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল বেনগাজির বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি।
ইংল্যাণ্ডের ল্যাকেনহিথ এয়ারবেজ থেকে যাত্রা শুরু করা প্লেনগুলোর মধ্যে ছিল ২৪টি এফ-১১১এফ আর্ডভার্ক, ইলেক্ট্রনিক জ্যামিং ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি ইএফ-১১১এ র্যাভেন, জ্বালানীবাহী ১৯টি কেসি-১০এ এক্সটেণ্ডার এবং ১০টি কেসি-১৩৫ স্ট্রাটোট্যাঙ্কার। এফ-১১১এফ বিমানগুলোর মধ্যে ১২টি বহন করছিল চারটি করে ২ হাজার পাউণ্ড ওজনের লেজার গাইডেড বোমা। এদের মধ্যে নয়টির দায়িত্ব ছিল গাদ্দাফীর বাসভবন বাব আল-আজিজিয়া কম্পাউণ্ডে আক্রমণ করার আর বাকি তিনটির দায়িত্ব ছিল সিদি বিলাল নামের একটি সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করার। বাকি প্লেনগুলোর মধ্যে ৬টিতে ছিল নয়টি করে ৫০০ পাউণ্ড ওজনের বোমা। এদের লক্ষ্যবস্তু ছিল ত্রিপলী এয়ারফিল্ড। আর বাকি ৬টি এফ-১১১এফ ছিল অতরিক্ত।
স্থানীয় সময় রাত ১টা ৫৯ মিনিটে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো আঘাত হাতে ত্রিপলী এবং বেনগাজিতে। মাত্র ১২ মিনিট স্থায়ী এ অভিযানে মোট ২২৭টি বোমা এবং ৪৮টি মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়, যাদের সম্মিলিত ওজন ছিল ৬০ টনেরও বেশি। ধ্বংস করে দেওয়া হয় ২০টিরও বেশি লিবিয়ান যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার এবং ৫টি রাডার সাইট। আক্রমণ করা হয় গাদ্দাফীর বাসভবন বাব আল-আজিজিয়া কম্পাউণ্ডেও। এফ-১১১এফ বিমানগুলো থেকে ১২টি ২,০০০ পাউণ্ড ওজনের বোমা ফেলে আংশিক ধ্বংস করে দেওয়া হয় তার দোতলা বাড়িটি। কিন্তু প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান গাদ্দাফী।
গাদ্দাফীর অবস্থান শনাক্ত করার জন্য আমেরিকা সাহায্য নিয়েছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনীর। হামলার পৌনে তিন ঘণ্টা আগে, স্থানীয় সময় রাত ১১টা ১৫ মিনিটেও ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী নিশ্চিত করেছিল, গাদ্দাফী তার তাঁবুতেই ছিলেন। কিন্তু তারপরেও যে এতগুলো বোমা গাদ্দাফীকে হত্যা করতে পারেনি, সেটা অনেক মার্কিন কর্মকর্তার কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। গাদ্দাফীর মৃত্যু সম্পর্কে আমেরিকা এতই নিশ্চিত ছিল যে, হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিয়ে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের জন্য একটি বক্তব্যও তৈরি করে রাখা হয়েছিল।
গাদ্দাফীকে হত্যা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল ৯টি এফ-১১১এফ বিমান। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে কাজ করেছিল মাত্র চারটি। এর মধ্যে তিনটি লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছিল, অন্যটির নিক্ষিপ্ত বোমাগুলো গিয়ে পড়েছিল ত্রিপলীর একটি আবাসিক এলাকায়। সেখানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। বাকি পাঁচটি প্লেনের মধ্যে চারটির লেজার গাইডিং সিস্টেমে শেষ মুহূর্তে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়, ফলে সেগুলো আক্রমণ না করেই ফেরত যেতে বাধ্য হয়। আর অবশিষ্ট বিমানটি তার দুজন ক্যাপ্টেনকে নিয়ে বিধ্বস্ত হয় ভূমধ্যসাগরের বুকে।
গাদ্দাফীকে হত্যা নিশ্চিত করতে আমেরিকা নিয়োগ করেছিল সে সময়ের অন্যতম সেরা প্রযুক্তিবিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই প্রযুক্তির ত্রুটির কারণেই পরিকল্পিত ৩৬টি বোমার মধ্যে গাদ্দাফীর বাসভবনে আঘাত করতে সক্ষম হয় মাত্র ১২টি বোমা। বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তার মতে, তারা সবকিছুই পরিকল্পনা মতোই করেছিলেন, কিন্তু গাদ্দাফী যে বেঁচে গিয়েছিলেন, তার জন্য দায়ী ছিল অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সমষ্টি। তার মতে, দিনটি ছিল আমেরিকার জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক দিন।
অপারেশন এল ডোরাডো ক্যানিয়নের অতর্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে লিবিয়া তেমন কোনো প্রতিরোধই সৃষ্টি করতে পারেনি। তাদের একমাত্র সাফল্য ছিল একটি এফ-১১১এফ বিমানকে ভূপাতিত করা। ওটাকেই অবশ্য গাদ্দাফী বিশাল সাফল্য হিসেবে প্রচার করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে লিবিয়ার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘সোশ্যালিস্ট পিপলস লিবিয়ান আরব জামাহিরিয়া’। জামাহিরিয়া শব্দটির অর্থ জনগণের সরকার। কিন্তু মার্কিন বিমান ভূপাতিত করাকে অসাধারণ সাফল্য হিসেবে দাবি করে সে উপলক্ষ্যে গাদ্দাফী তার দেশের নাম আরো একবার পরিবর্তন করেন। লিবিয়ার নতুন নাম হয় ‘দ্য গ্রেট সোশ্যালিস্ট পিপলস লিবিয়ান আরব জামাহিরিয়া।
তবে গাদ্দাফী সাফল্যের দাবি করলেও এ হামলার ফলে লিবিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে নিহত হয় লিবিয়ান সেনাবাহিনীর ৪৫ জন সদস্য এবং আরো অন্তত ৩০ জন বেসামরিক নাগরিক। হামলায় আহত হয় গাদ্দাফীর তিন সন্তান। প্রচণ্ড কম্পনের ফলে আতঙ্কিত এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় গাদ্দাফীর স্ত্রী সাফিয়া এবং তার আট সন্তান-সন্ততির সবাইকে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, হামলায় নিহত হয় গাদ্দাফীর ১৫ মাস বয়সী পালিত শিশুকন্যা হ্যানা গাদ্দাফী।
এই হামলার রাজনৈতিক প্রভাবও ছিল সুদূরপ্রসারী। নিজের উপর হত্যাপ্রচেষ্টাকে গাদ্দাফী সহজভাবে নেননি। বিশ্বব্যাপী মার্কিন এবং ব্রিটিশ স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি তিনি সহায়তা আরো বাড়িয়ে দেন। ১৯৮৬ থেকে শুরু ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে অনেকগুলো সন্ত্রাসী হামলা ঘটে, যেগুলোর পেছনে গাদ্দাফীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৮ সালের ২১ ডিসেম্বর, যখন স্কটল্যাণ্ডের লকারবির আকাশে মার্কিন প্যান অ্যাম ফ্লাইট ১০৩কে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
লকারবির হামলায় ২৭০ যাত্রীর সবাই নিহত হয়েছিল। পরবর্তীতে নেদারল্যাণ্ডের আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারে এর মূল কারিগর হিসেবে এক লিবিয়ান নাগরিকের ভূমিকা প্রমাণিত হয় এবং গাদ্দাফী আমেরিকাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হন। লকারবি হামলা নিয়ে আমরা আলোচনা করব পরবর্তী কোনো সময়, কিন্তু তার আগে আগামী পর্বে থাকবে অপারেশন এল ডোরাডো ক্যানিয়নে নিহত গাদ্দাফীর শিশুকন্যা হ্যানা গাদ্দাফীর কথা। আসলেই কি হ্যানা গাদ্দাফী সে হামলায় নিহত হয়েছিল? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, হ্যানা গাদ্দাফী নামে কি আসলেই কারো অস্তিত্ব ছিল? নাকি ওটা ছিল বিশ্ববাসীর সহানুভূতি আদায়ের জন্য গাদ্দাফীর প্রচারণা?
ফিচার ইমেজ- radiodixie.cz