তাইওয়ান মিরাকল: তাইওয়ানের অর্থনীতি পাল্টে গেল যেভাবে | পর্ব-০৪

[তৃতীয় পর্ব পড়ুন]

রপ্তানিভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ১৯৫৯-৬১ সালের মধ্যে ‘নাইন্টিন-পয়েন্ট প্রোগ্রাম’ (19-point Program) ও ‘স্ট্যাটিউট ফর দ্য এনকারেজমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট’ ইত্যাদি বাণিজ্যিক সংস্কারের বিধান ও আইন প্রণয়ন করা হয়। তাইওয়ানে কুয়োমিনতাং সরকার প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় শিল্পগুলোকে সুবিধা করে দিতে ‘ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ‘নাইন্টিন-পয়েন্ট প্রোগ্রাম’-এর মাধ্যমে এই বিধিনিষেধগুলো তুলে দেয়া হয়। ‘স্ট্যাটিউট ফর দ্য এনকারেজমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট’ আইনের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগের জন্য সরকারি রেজিস্ট্রেশনকে অনেক সহজ করে তোলা হয়। এর পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার জন্য অতিরিক্ত করের বোঝা থেকে মুক্তি দেয়ার বিধান রাখা হয় এই আইনে।

জতকগপগপ
রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে সুবিধা দেয়ার জন্য ‘নাইন্টিন-পয়েন্ট প্রোগ্রাম ও ‘স্ট্যাটিউট ফর দ্য এনকারেজমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট’ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়; image source: nature.com

তাইওয়ান সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বেশ কিছু ‘এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন’ বা ইপিজেড তৈরি করে। এতে শুধু বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নয়, বরং তাইওয়ানের দেশীয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও অতিরিক্ত করের বোঝা থেকে মুক্তি লাভ করে। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, তাইওয়ান সরকার কর উঠিয়ে দিয়ে হয়তো বিশাল অংকের অর্থ হাতছাড়া করেছে। কিন্তু এর জন্য দেশে বিদেশি বিনিয়োগ নতুন মাত্রা লাভ করেছিল, যেটি আমরা পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখতে পাব। ১৯৫২-৫৯ সাল পর্যন্ত আট বছরে তাইওয়ানে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ১১ মিলিয়ন। এরপর বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্য যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়, সেগুলোর প্রভাবে ১৯৬০-৬৩, মাত্র তিন বছরে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ মিলিয়নে! অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে সরকারনিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। এতে ব্যাপক প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন শিল্প বিকাশ লাভ করে।

পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে কীভাবে তাইওয়ান সরকার ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় মালিকানার খাতগুলো অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি অনুযায়ী বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দিয়েছিল। প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মালিকানার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ১৯৫২ সালে ভারী ও রাসায়নিক শিল্পের ৫৬.২০ শতাংশের মালিক ছিল তাইওয়ান সরকার, অপরদিকে ৪৩.৮০ শতাংশ বেসরকারি মালিকানার অধীনে ছিল। ১৯৭০ সালে তাইওয়ান সরকার একই শিল্পের মাত্র ২৭ শতাংশের মালিক ছিল, অপরদিকে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল প্রায় ৭৩ শতাংশ। আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, দেশটিতে ধীরে ধীরে হালকা শিল্পের পরিমাণ কমে আসছিল। ১৯৬০ সালে হালকা শিল্প ছিল দেশটির মোট শিল্পের প্রায় ৭৬ শতাংশ, অর্থাৎ চারভাগের তিনভাগই ছিল হালকা শিল্প। ১৯৯০ সালে, ত্রিশ বছর পর হালকা শিল্প ছিল মোট শিল্পের ৩৩ শতাংশ। বিপরীতভাবে, ১৯৬০ সালে দেশে ভারী ও রাসায়নিক শিল্পের পরিমাণ ছিল মোট শিল্পের মাত্র ২৪ শতাংশ অর্থাৎ চারভাগের একভাগ। ১৯৯০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬.৪০ শতাংশে। সুতরাং পরিসংখ্যানে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, সময়ের ব্যবধানে তাইওয়ানে বেসরকারি মালিকানায় ভারী ও রাসায়নিক শিল্পের কেবল প্রসার ঘটেছে।

জতজতপগ
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ‘এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন’ বা ইপিজেড নির্মাণ করা হয়; image source: crooksteven.blogspot.com

বৈশ্বিক পরিমন্ডলে তাইওয়ানের উত্থানের পেছনে যে শিল্প সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তা হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স। ১৯৫০ এর দশকের শুরুতেই তাইওয়ানে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রেডিও কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ট্রানজিস্টর রেডিও তৈরির শিল্প সেখানে আরও প্রসার লাভ করে। ট্রানজিস্টর রেডিওর যন্ত্রাংশগুলো তাইওয়ানে উৎপাদিত হতো না, এটি ছিল একটি বড় সমস্যা। মূলত জাপানি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অর্ডার গ্রহণ করে সস্তা শ্রম ও অবকাঠামোগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় ইলেক্ট্রনিক্স প্রতিষ্ঠানগুলো রেডিও উৎপাদন করতো। এরপর জাপানি কোম্পানিগুলো সেগুলো আমেরিকায় রপ্তানি করে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত। তাইওয়ানের উদ্ভাবনী ক্ষমতা তেমন না থাকায় সেখানে আসলে এমন কিছু তৈরি হতো না, যেগুলো বিশ্ববাজারে জাপানকে টেক্কা দিতে পারবে। তবে নিজস্ব তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান গঠন না হলেও জাপানের প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্ডার অনুযায়ী কাজ করার জন্য তাইওয়ানে অনেকগুলো প্রস্তুতকারী ইউনিট গড়ে ওঠে। কে জানত যে এই রেডিও নির্মাণশিল্পই ভবিষ্যতে তাইওয়ানকে প্রযুক্তি বিশ্বে অগ্রযাত্রার গোড়াপত্তন করবে?

রেডিওর পর উন্নত দেশগুলোতে যে পণ্যের সবচেয়ে বেশি চাহিদা তৈরি হয় তা টেলিভিশন। জাপানি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বিভিন্ন চুক্তি কিংবা যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে তাইওয়ানের প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো টেলিভিশন উৎপাদন শুরু করে। এছাড়া আমেরিকার বাজারে টেলিভিশন রপ্তানির জন্য আমেরিকান বিনিয়োগও তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো গ্রহণ করে। যেহেতু তাইওয়ানের নিজস্ব কোম্পানিগুলোর ইলেকট্রনিক্স পণ্যের যন্ত্রাংশ তৈরির মতো উদ্ভাবনী দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সুবিধা ছিল না, তাই দেশটির সরকার এমন আইন প্রণয়ন করে, যে আইনের বলে তাইওয়ানের বাজারে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের ব্যবসা করা বিদেশি কোম্পানিগুলো তাইওয়ানে উৎপাদিত যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এতে তাইওয়ানের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করা জাপানি প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের যন্ত্রাংশ নির্মাণের কৌশল স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হয়। এভাবে তাইওয়ানে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ নির্মাণশিল্প প্রসার লাভ করে। এর ফলে তাইওয়ানের নিজস্ব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর যন্ত্রাংশের জন্য জাপানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না।

তখনকার বিশ্ববাজারে জাপানের প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করতো। কারণ তারা বিভিন্ন দেশের সস্তাশ্রম কাজে লাগিয়ে এমন পণ্য সরবরাহ করতো যেগুলো ছিল টেকসই ও গুণগত মানসম্পন্ন। এজন্য অন্য কোন কোম্পানি এসে খুব বেশি সুবিধা করতে পারতো না। তাইওয়ানের প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এই বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত ছিল। তাই তারা লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলগুলোর বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কারণ, এসব অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ছিল সীমি, আর তাইওয়ানে তৈরিকৃত ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দামও ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালের মধ্যে। অপরদিকে জাপানের পণ্য ছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মানুষের জন্য, যাদের অঢেল টাকা আছে এবং ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য ক্রয়ের জন্য অকাতরে খরচ করতেও রাজি আছে। তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো ওইসব অঞ্চলের ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করেছিল। সেই মুনাফার একটা অংশ তারা গবেষণা ও উদ্ভাবনখাতে বিনিয়োগ করে, যাতে পরবর্তীতে জাপানি কোম্পানিগুলোর সাথে টেক্কা দেয়া যায়।

ওডওতওতপত
তাইওয়ানে ইলেকট্রনিক্স পণ্য উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোর বাজার দখল করেছিল; image source: taiwantoday.tw

তাইওয়ানের ইতিহাসে আরেকটি বড় ঘটনা ছিল সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণশিল্পের অগ্রযাত্রা, যেটি তাইওয়ানের পরবর্তী বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে বড় ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৬৪ সালে তাইওয়ানের উত্তরাঞ্চলে জাতীয় তিয়াও চুং বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেমিকন্ডাক্টর ল্যাব নির্মাণ করা হয়। তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণশিল্পে যেসব প্রকৌশলী কাজ করতেন, তারা প্রায় সবাই এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছিলেন। মজার বিষয় হলো, তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণশিল্পে প্রথম কয়েক বছর বিনিয়োগকারীদের দেখা মেলেনি। কারণ এখানে বিশাল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হতো এবং তৈরিকৃত সেমিকন্ডাক্টর শেষপর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হবে কি না– সেই নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে ফিলকো. কর্পোরেশন এই শিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এভাবে তাইওয়ানে সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণশিল্পের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে পৃথিবীতে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসি চিপ নির্মাণে তাইওয়ান পৃথিবীর শীর্ষ দেশগুলোর একটি।

Related Articles

Exit mobile version