অখন্ড চীনের প্রথম সম্রাট বলা হয়ে থাকে কিন শি হুয়াংকে। মাত্র তের বছর বয়সেই রাজা হয়েছিলেন তিনি। ২২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আটত্রিশ বছর বয়সে যুদ্ধে লিপ্ত চীনের অন্যান্য সকল রাজ্য জয় করে তিনি নিজেকে চীনের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
মৃত্যুর কথা শুনতেই পারতেন না এ সম্রাট। সকল প্রাণীকেই যে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, এ কথা মানতে নারাজ ছিলেন তিনি, অন্তত নিজের বেলায়। আজীবন তাই অমরত্ব সুধার সন্ধান করে বেড়িয়েছেন তিনি। অমরত্ব লাভের আশায় তার নেয়া নানাবিধ অদ্ভুত পদ্ধতি নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এ লেখা।
অমরত্ব সুধার সন্ধানে বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রম
জ্ঞানার্জন মানুষের চোখ খুলে দেয়, অতীতের ঘটনা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে তাকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। আর কিন শি হুয়াং ঠিক এ ব্যাপারেই ভয় পেতেন। তিনি ভাবতেন যে, লোকেরা হয়তো বইপত্র পড়ে তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয় বিদ্রোহ করে বসবে রাজার বিরুদ্ধে। এজন্য ইতিহাস, কাব্য ও দর্শনের সব বই সংগ্রহ করে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বিষয়টাই মেনে নিতে পারছিলেন না সম্রাট। তিনি চাইতেন তার রাজ্যের বিজ্ঞানীরা যেন শুধু অমরত্বের রহস্য অনুসন্ধানেই নিজেদের ব্যস্ত রাখেন, অন্য সবকিছু তার কাছে ছিলো সময়ের অপচয়। একবার দুজন অ্যালকেমিস্টকে তিনি যখন অমরত্বের সুধা বানাতে বলেছিলেন, তখন এ ব্যাপারে তারা নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করলে হুয়াং মারাত্মক ক্ষেপে গিয়েছিলেন। এ কাজে ব্যর্থতার দায়ে ৪৬০ জন বিজ্ঞানীকে তার নির্দেশে জীবন্ত কবরও দেয়া হয়েছিলো!
জু ফু’র কারসাজি
বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে কোনো ফল না পেয়ে একইসাথে ক্ষিপ্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন সম্রাট কিন। এমন সময় তিনি খবর পান ঝিফু দ্বীপে জু ফু নামে এক জাদুকর আছেন যিনি কিনা অমরত্ব সুধার সন্ধান দিতে পারবেন।
এ কথা শুনে আর দেরি করলেন না রাজা, সাথে সাথে জু ফু’র সাথে দেখা করতে তিনি ছুটে গেলেন ছোট্ট সেই দ্বীপে। জু ফু জানালেন যে, তিনি অমরত্বের সুধা এনে দিতে পারবেন। কিন্তু এজন্য তাকে যেতে হবে পেংলাই পর্বতে। চীনের উপকথা অনুযায়ী পেংলাই পর্বত এক কাল্পনিক জায়গা যেখানে রয়েছে আটজন অমর ব্যক্তির বাস। সেখানে রয়েছে ১,০০০ বছর বয়সী এক লোক যার নাম আন্কি শেং। তার কাছ থেকেই এ সুধা তৈরির গোপন রহস্য সম্বন্ধে জানা যাবে।
অবশেষে রাজা যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। আর দেরি না করে তিনি তাড়াতাড়ি জু ফু’র জন্য কয়েকটি জাহাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। অল্প কিছুদিন পর ফু ফিরেও আসলেন। তিনি জানালেন যে, পেংলাই পর্বত থেকে তিনি ঘুরে এসেছেন। সেখানে থাকা অমর ব্যক্তিরা সেই সুধার গোপন ফর্মুলা দিতে রাজিও হয়েছেন। তবে এজন্য বিনিময়ে তারা ৬,০০০ (মতান্তরে ৫,০০০) অবিবাহিত বালক-বালিকাকে চেয়েছেন!
রাজা সরলমনে কথাগুলো বিশ্বাস করে ফু-কে সবই দিলেন। আনুমানিক ২১৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বিশাল সেই নৌবহর নিয়ে পেংলাই পর্বতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান ফু। পরবর্তী আট বছর ধরে রাজা কেবল ফু’র ফিরে আসার জন্যই অপেক্ষা করে গেছে। অন্যদিকে ফু সেই ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সমুদ্রের বুকে!
আট বছর পর তিনি ফিরে এলে রাজা আবারো তার কাছে এলেন। এবার একটু চেপে ধরায় ফু জানালেন যে, তারা ঠিকই পেংলাই পর্বতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে যেন বিশাল বড় এক দানব এসে হাজির হয় সমুদ্রে। এ দানবটিকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেও তারা পারেন নি। তাই খালি হাতেই ফিরে আসতে হয়েছে।
এমন কথা শুনে রাজা বললেন, “ঠিক আছে, তবে সেই দানবটিকেই হত্যার ব্যবস্থা করা দরকার।” তবে ফু’র উপরে বিশ্বাস কমে এসেছিলো রাজার। তাই তিনি এবার নিজেই ফু-কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সমুদ্রের সেই দানবটিকে হত্যা করতে, সাথে নিলেন রাজ্যের ঝানু তীরন্দাজদের। একসময় তারা সত্যি সত্যিই সেই দানবের দেখা পেলেন। ধারণা করা হয় যে, সেই দানবটি আসলে একটি তিমি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। রাজার তীরন্দাজ বাহিনীর হাতে সেই তিমির মৃত্যুর পর ফু-এর হাতে আর কোনো অজুহাত ছিলো না।
আনুমানিক ২১০ খ্রিষ্টাপূর্বাব্দে তিনি আবারো বেরিয়ে যান পেংলাই পর্বতের উদ্দেশ্যে। তবে এবার সেই ৬,০০০ অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের নিয়ে আর চীনে ফিরে আসেন নি তিনি। ফু সোজাসুজি সমুদ্রপথে পালিয়ে চলে যান জাপানে, সেখানেই জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
ঘোড়ার গাড়িতে কৌশল
জু ফু বেরিয়ে যাবার পর সম্রাটের কাজ ছিলো নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার হরেক রকম কৌশল বের করা। ক্ষমতার শীর্ষপদে আরোহণ করতে গিয়ে অনেক শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তাই তখন তার কাজ ছিলো যেভাবেই হোক ফু ফিরে আসার আগে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ কৌশলের একটা অংশ ছিলো ঘোড়ার গাড়ি। দেখা যেত খুব রাজকীয় গাড়িগুলোতে যেখানে কিন থাকার কথা, সেখানে থাকতো অন্যান্যরা। তিনি থাকতেন সাধারণ অন্য কোনো গাড়িতে যাতে কারো নজর সেখানে না পড়ে।
এ কৌশল একবার তার জীবনও বাঁচিয়েছিল। ঝ্যাং লিয়াং নামে এক ব্যক্তির হান সাম্রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হবার কথা ছিলো। কিন্তু এর আগেই কিন সেই রাজ্যে হামলা চালিয়ে তা দখল করে নেন এবং কেড়ে নেন রাজ্যের অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সকল পদমর্যাদা। এজন্য মারাত্মক ক্ষিপ্ত ঝ্যাং প্রতিশোধ গ্রহণে মুখিয়ে ছিলেন।
একবার তিনি গেন বা নামে তৎকালীন চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী লোকটিকে এ উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করলেন। প্রায় সাড়ে বাহাত্তর কেজি ভরের একটি হাতুড়ি নিয়ে গেন তখন উঠে গিয়েছিলেন এ পাহাড়ের উপর, উদ্দেশ্য সম্রাট এ পথ দিয়ে গেলে তার গাড়ির উপর ছুঁড়ে ফেলবেন হাতুড়িটি। যথাসময়ে গাড়ির বহর চলে আসলে রাজকীয় গাড়ির উপরই গেন নিক্ষেপ করেন হাতুড়িটি। উপর থেকে এত ভারী জিনিসের আঘাতে ভেঙে টুকরো টুকরো যায় গাড়িটি, মারা যায় ভেতরে থাকা প্রতিটি লোক।
সৌভাগ্যই বলতে হবে কিনের। কারণ তিনি ছিলেন পেছনের সাদামাটা গাড়িতেই। এরপরই বেরিয়ে আসে রাজার লোকজন। অসম সেই যুদ্ধে মারা যান গেন, তবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন ঝ্যাং।
সুড়ঙ্গপথে চলাচল
সময়ের সাথে সাথে আততায়ীর হাতে কিনের প্রাণ হারানোর আশঙ্কা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। একসময় একান্ত প্রয়োজন না হলে প্রাসাদে বাইরে যাওয়া ছেড়ে দেন তিনি। রাজপ্রাসাদের নিচে খনন করিয়ে নিয়েছিলেন অনেকগুলো সুড়ঙ্গপথ যাতে করে এদিক দিয়ে যাতায়াত করেই প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নেয়া যায়।
কিনের থাকার জায়গাটি ছিলো প্রায় এক মাইলের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বিস্তৃত। মূল প্রাসাদকে ঘিরে ছিলো আরো দশটি ভবন যেগুলোতে সুড়ঙ্গ দিয়েই যাতায়াত করা যেত। শুধু তা-ই না, কিন ভাবতেন যে, মৃত্যু বুঝি তার জন্য বাইরে ওঁত পেতে আছে। তাই প্রাসাদ আর সুড়ঙ্গের বাইরে যাওয়া একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। তিনি ভাবতেন এভাবে করে হয়তো তার সন্ধানে থাকা অশুভ আত্মাদের থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
উল্কাপিন্ডের ভবিষ্যদ্বাণী
কিন মারা যাওয়ার এক বছর আগের কাহিনী। চীনে সেইবার এক উল্কাপিন্ড এসে পড়লো। কেউ তাতে মজা করে কিনের মৃত্যু ও পরবর্তীতে বিশাল সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী লিখে দিয়েছিলো।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সম্রাটকে জেঁকে ধরে মৃত্যুভয়। ভয় থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নেয় মারাত্মক ক্রোধ। কে এমন কাজটি করেছে তাকে খুঁজে বের করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ঘোষণা দেয়া হয় যে এমন করেছে সে যেন নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়, নাহলে এর ফল ভোগ করতে হবে সবাইকেই। কেউই যখন দোষ স্বীকার করলো না, তখন উল্কাপিন্ড পতনের কাছাকাছি জায়গার সবাইকে ধরে এনে জেলে পুরে দেয়া হয়েছিলো। এরপর একে একে হত্যা করা হয় সবাইকেই। রাজার লোকেরা সেই উল্কাপিন্ডটিও ধ্বংস করে ফেলেছিলো। এরপরও যখন তার মনে শান্তি আসলো না, তখন তিনি ডেকে আনালেন রাজ্যের শিল্পীদের। তারা কিনের অমরত্ব সম্পর্কে গান গেয়ে শোনালে তবেই শান্ত হয়েছিলো তার মন!
আর্সেনিক পান
জু ফু ফিরে না আসলেও অমরত্ব সুধার খোঁজ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করেন নি কিন। তার রাজ্যের অ্যালকেমিস্ট ও রাজসভার অন্যান্য চিকিৎসকদের তিনি এ জিনিসটি বানানোর জন্য নিয়মিতভাবে তাগাদা দিতেন। আর তারা একেক সময় একেক জিনিস বানিয়ে এনে রাজাকে খেতে দিতো। অমরত্ব সন্ধানী রাজা সেটাকেই অমরত্বের সুধা মনে করে খেয়ে নিতেন। এভাবে তিনি আর্সেনিক পান করাও শুরু করেছিলেন।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটি ছিলো ২১০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর। পূর্ব চীনে এক রাজকীয় সফরে দলবল নিয়ে বেরিয়েছিলেন রাজা। নিজের রাজধানী জিয়ানইয়াং থেকে প্রায় দু’মাসের পথের সমান দূরত্বে থাকাকালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন চিরকাল অমরত্বের সন্ধানে থাকা এ সম্রাট, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো মাত্র ৪৯ বছর।
অমরত্ব সুধা কিন শি হুয়াংকে অমরত্ব দান না করলেও মৃত্যু ঠিকই উপহার দিয়েছিলো। যে আর্সেনিকের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি অমরত্বের সন্ধানে, সেই আর্সেনিকই বয়ে এনেছিলো তার মৃত্যু। তার মৃত্যুর খবর খুব কাছের অল্প কিছু মানুষই শুরুতে জানতে পেরেছিলো। কিনের পরামর্শক লি সি বুঝতে পারছিলেন না সম্রাটের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশাল এ সাম্রাজ্যের কী হবে। পরিশেষে তিনি বিচিত্র এক উপায় বের করেছিলেন। কিনের মৃত্যুর পর কয়েকমাস রাজ্য পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ নানা সিদ্ধান্ত সম্রাটের নাম করে তিনিই দিতেন।
ওদিকে কিনের মৃতদেহ ঠিকই তার পরিবারের লোকদের কাছে পৌঁছেছিলো। তবে সেই মৃতদেহকে ঢেকে রাখা হয়েছিলো পচা মাছ দিয়ে যাতে করে মৃতদেহের পচা গন্ধ মাছের গন্ধের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়! জীবিতাবস্থায় কিন জোর গলায় বলতেন যে, তার বংশধরেরা ১০,০০০ প্রজন্ম পর্যন্ত চীনের শাসনভার পরিচালনা করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- তার মৃত্যুর পর মাত্র তিন বছরের মাঝেই শেষ হয়ে যায় সবকিছু!