আমেরিকার ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের ফ্রাঙ্কলিন অ্যাভিনিউয়ের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক ব্যাক্তি। তখন সন্ধ্যা হয়েছে কেবল। রাস্তায় সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে সবে। হঠাৎ একটি বাড়ির ভেতর থেকে করুণ সুরে কোনো শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। চারদিকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পাড়লেন শব্দটি আসছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন আমলের একটি গোথিক অট্টালিকার ভেতর থেকে। একটু ইতস্তত করছিলেন লোকটি। তারপর চলে যেতে উদ্যত হলে আবার কান্নার শব্দ শুনলেন। এবার আরো করুণ সে শব্দ। ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভেতরে কী হয়েছে জানার জন্য। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লোকটি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বাড়ি থেকে ছুটে বের হলেন এবং কোনো বিরতি ছাড়াই একদম ফ্রাঙ্কলিন অ্যাভিনিউ পার করে দিলেন! কী দেখেছিলেন তিনি বাড়ির ভেতরে?
ফ্রাঙ্কলিন দুর্গ বা ‘টাইডম্যান হাউজ’, প্রাচীন গোথিক নির্মানশৈলীর এই বাড়িটি দীর্ঘদিন যাবত ওহাইয়োর সবচেয়ে ভুতুড়ে বাড়ি হিসেবে পরিচিত। ওহাইয়ো শহরের অনেক বাসিন্দাই বাড়িতে বিভিন্ন সময় প্রবেশ করে কথিত ভয়ানক পরিস্থির মুখোমুখি হয়েছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষের দাবি অনুযায়ী এই বাড়ির জানালা দিয়ে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় ‘উইম্যান ইন ব্ল্যাক’ কে, শোনা যায় করুন স্বরে শিশুর কান্না, বাড়ির সামনে গেলেই দরজা খুলে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে, বাতিগুলো জ্বলতে-নিভতে শুরু করে, মাঝে মাঝে পেছন দিয়ে কেউ দৌড়ে চলে যায় আর কানের কাছে দিয়ে যায় গাঁ শিউরে ওঠা হাসি! কতটুকু সত্য এসব তথ্য? দুনিয়াজুড়ে আরো শত শত ভুতুড়ে বাড়ির মতো এ বাড়ির এই গল্পগুলোর পেছনেও রয়েছে এক লম্বা ইতিহাস। ইতিহাসটা জানলে মন্দ হয় না।
টাইডম্যান হাউজ
সম্ভবত ১৮৮১ থেকে ১৮৮৩ সালের মধ্যে ফ্রাঙ্কলিন দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। জার্মানি থেকে আমেরিকায় আগত হ্যানস টাইডম্যান নামক এক অভিবাসী ভদ্রলোক এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। টাইডম্যান ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকার। তিনি ফ্রাঙ্কলিন অ্যাভিনিউতে একটি ব্যারেল তৈরির কারখানা চালাতেন। পরবর্তীতে ‘ইউক্লিড সেভিংস অ্যান্ড ট্রাস্ট’ নামক একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। প্রভাব এবং প্রতিপত্তি খুব দ্রুতই লাভ করলেন টাইডম্যান। ফলে নিজের জন্য একটি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন তিনি। আর সেই পরিকল্পনা থেকেই ফ্রাঙ্কলিন অ্যাভিনিউয়ের ‘মিলিয়নিয়ারস রো’তে স্থাপিত হলো অভিশপ্ত বাড়ি ফ্রাঙ্কলিন ক্যাসেল তথা টাইডম্যান হাউজ।
টাইডম্যান যখন বাড়িতে প্রবেশ করেন, তখন তার পরিবার ছিল ছয় সদস্যের। টাইডম্যান, তার স্ত্রী লোইস, মা উইবেকা ও তিন সন্তান অগাস্ট, এমা ও ডোরা। পরবর্তীতে ফ্রাঙ্কলিন আরো সন্তানের জনক হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু গল্পটাতে মৃত্যু হানা দিয়েছিল বারংবার এক অনিবার্য অভিশাপের মতো! সেই অভিশাপের আনুষ্ঠানিক শুরু ১৮৯১ সাল থেকে।
রহস্যজনক মৃত্যুকাহিনী
১৮৯১ সালে টাইডম্যান হাউজে প্রথম মৃত্যু হয়। টাইডম্যানের ১৫ বছর বয়সী কন্যা সন্তান এমা মারা যায়। শহরময় খবর ছড়িয়ে পড়লো প্রভাবশালী টাইডম্যানের কন্যা এমা ডায়বেটিসে মারা গেছে। কিন্তু সাথে একটি গুজবও ডালপালা মেলতে থাকে যে, এমার মৃত্যু হয়েছিল চিলেকোঠা থেকে ফাঁসিতে ঝুলে এবং টাইডম্যানের বাড়ির কোনো এক চাকর ঝুলন্ত এমাকে দেখেছে। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহের মাথায় মৃত্যু হয় টাইডম্যানের মা উইবেকার। এবার মৃত্যুর কারণ অজানা!
পরবর্তী তিন বছরে টাইডম্যান হাউজ রীতিমত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। টাইডম্যানের আরো তিন সন্তান একে একে মারা যায় যাদের কারোরই মৃত্যুর কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে বের করা যায়নি। সন্দেহের তীর টাইডম্যানের দিকে ধেয়ে আসতে থাকে। অন্যদিকে টাইডম্যানের বাড়িতে অনেক গোপন টানেল ও কক্ষ রয়েছে বলেও একটা গুজব চালু ছিল। একে একে চার সন্তানের মৃত্যুর পর হঠাৎ আরো একটি গুজব চালু হয় যে, টাইডম্যান সে বাড়ির কোনো এক গোপন টানেলে তার ভ্রাতুষ্পুত্রীকে গলা টিপে হত্যা করেছিলেন!
মৃত্যুর মহড়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন টাইডম্যানের স্ত্রী লোইস। তাকে মানসিকভাবে সতেজ করতে টাইডম্যান বাড়ির ব্যাপক সংস্কার করেন এবং আক্ষরিক অর্থে বাড়ির রূপ বদলে দেন। তখন থেকেই মূলত বাড়ির আকার এবং গঠনের জন্য এর নামের সাথে দুর্গ শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে। সে যা-ই হোক, ১৮৯৫ সালে ফ্রাঙ্কলিন দুর্গে ঝরে পড়ে আরো একটি প্রাণ, ফ্রাঙ্কলিনের স্ত্রী লোইস। খবর প্রকাশিত হয় তিনি লিভারের সমস্যায় ভুগে মারা গিয়েছেন। কিন্তু সন্দেহবাদীরা বিশ্বাস করতো ফ্রাঙ্কলিন তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। ১৯০৮ সালে হ্যানস টাইডম্যান মারা গেলে টাইডম্যান পরিবারের সমাপ্তি ঘটে। তবে মারা যাবার আগে বাড়িটি একটি জার্মান সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন টাইডম্যান।
গোপন কামরা এবং টানেল রহস্য
ফ্রাঙ্কলিন দুর্গে টানেল ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে এই বাড়িতে অনেকগুলো গোপন কামরা ঠিকই রয়েছে। এর মধ্যে একটি কামরায় মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল! ধারণা করা হয় এই কামরাতেই টাইডম্যান তার সন্তান ও অন্যান্যদের হত্যা করে ফেলে রাখতেন। অন্যদিকে লোকমুখে শোনা যেত ফ্রাঙ্কলিন দুর্গে এমন এক টানেল আছে যা কিনা ওহাইয়োর বিখ্যাত এরি লেকে গিয়ে যুক্ত হয়েছে!
নাৎসি গুপ্তচরবৃত্তি ও গুজবের নতুন শুরু
বেশ কয়েক বছর খালি পড়ে থাকার পর ১৯১৩ সাল থেকে ফ্রাঙ্কলিন দুর্গে আবার মানুষের বসতি শুরু হয়। তবে এবার কারা সেখানে বাস করছিলেন তা ছিল রহস্যে ঘেরা। পরবর্তী ৫৫ বছর যাবত বাড়িটি সেই গোপন জার্মান সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের হাতেই ছিল। এই সময়ে বাড়ির ভেতরে কী হতো না হতো তা আশেপাশের কেউ জানতে পেত না। তারা এই বাড়ি ছেড়ে যাবার পরই কেবল প্রকাশিত হয় নানান মুখরোচক তথ্য; যেমন- বাড়িতে নাৎসিদের একটি গোপন দল বসবাস করতো যারা উভয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকায় গুপ্তচরবৃত্তি করেছে, বাড়ির ভেতরে গণহত্যা চালিয়েছে এবং মানুষের উপর অমানুষিক নির্যাতন ও পরীক্ষা চালিয়েছে।
দ্য উইমেন ইন ব্ল্যাক
উপরের ছবিতে মিনার আকৃতির অংশের চূড়ায় গম্বুজের মধ্যে যে জানালা রয়েছে সেখানে ‘উইমেন ইন ব্ল্যাক’কে দেখেছেন বলে দাবি করেছেন অনেক। অধিকাংশই বলেছেন যে জানালা দিয়ে করুণ চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা কালো পোশাক পরিহিত এক মহিলাকে তারা দেখেছেন। আবার কেউ বলেন মহিলাটি তাদের ডাকছিল! জনশ্রুতি অনুযায়ী এই রহস্যমানবীর নাম ‘রেচেল’ যাকে টাইডম্যান ওই জানালাওয়ালা ঘরে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে বর্বরোচিত পন্থায় হত্যা করেছিল! হত্যার ব্যাপারে কোনো বিতর্ক না থাকলেও রেচেল কে ছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন রেচেল ছিলেন টাইডম্যানের বাড়ির একজন কাজের মেয়ে, আবার কেউ বলেন রেচেল হচ্ছে টাইডম্যানের অসংখ্য উপপত্নীর একজন।
কঙ্কাল
১৯৭০ সালে ফ্রাঙ্কলিন দুর্গের তৎকালীন মালিক একটি ছোট্ট গোপন কক্ষ উদঘাটন করেন যেখানে ডজনখানেক শিশুর কঙ্কাল পাওয়া যায়! এই কঙ্কাল ফ্রাঙ্কলিন দুর্গ নিয়ে জনশ্রুতির আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। নতুন করে এই বাড়ি সম্বন্ধে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। বলা হয়ে থাকে এই শিশুগুলো ছিল টাইডম্যানের উপপত্নীদের ঘরের এবং টাইডম্যান এদের হত্যা করেছিলেন। তবে কেউ কেউ বলেন সেগুলো মেডিকেলের নমুনা কঙ্কালও হতে পারে। তবে কঙ্কালগুলো যা-ই হোক না কেন, এরপর থেকেই কিন্তু সেখানে শিশুর কান্না শোনা যেত!
যত ভুতুড়ে গল্প
- চতুর্থ তলার বলরুমের মেঝেতে রাতেরবেলা রক্তের দাগ দেখা যায়। বাড়ির মালিকানা যখন যাদের কাছে গিয়েছে তারাই নাকি এই রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছে যা সকাল হলে আপনা থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
- ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৬ সালে এই বাড়িতে যে পরিবার বসবাস করতো তারা বাড়ি ছেড়ে যাবার কারণ হিসেবে বলেছিল যে কোনো এক (ভালো!) ভূত এসে তাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিল খুব শীঘ্রই সেখানে কেউ মারা পড়তে যাচ্ছে!
- যে ব্যক্তি কঙ্কালের গোপন কক্ষটি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি খুব দ্রুতই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি তার ঘরের আসবাবপত্রগুলো প্রায়শই নিজে থেকে নড়াচড়া করতে দেখতেন!
- একবার এক পত্রিকা ফেরি করা যুবক ফ্রাঙ্কলিন দুর্গে ভূত দেখেছে বলে দাবি করে। কোনো এক সকালে সে যখন নিত্যদিনের মতো পত্রিকা দিতে যায়, তখন দরজায় টোকা দিতেই ‘কাম ইন’ বলে একটি শব্দ শুনতে পায় এবং দরজাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়। তখন সে দেখলো সিঁড়ি বেঁয়ে এক রহস্যময় নারী নেমে আসে এবং একটি বন্ধ দরজার ভেতরে অদৃশ্য হয় যায়। এই দৃশ্য দেখে সে দৌড়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে এবং আর কোনোদিন সে বাড়িতে পত্রিকা দিতে যায়নি।
বর্তমান অবস্থা
২০১১ সালে কোনো এক ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী ফ্রাঙ্কলিন দুর্গের আগের মালিকের কাছ থেকে ২ লক্ষ ৬০ হাজার ডলারে কিনে নেন। এখন এই বাড়িতে কেউ না থাকলেও খুব শীঘ্রই এই বাড়িটিকে নতুন করে নির্মাণের কথা আছে। এ বছরের মার্চে রিয়েলিটি টেলিভিশন সিরিজ ‘প্যারানরমাল লকডাউন’-এর প্রথম সিজনের তৃতীয় পর্বে ফ্রাঙ্কলিন দুর্গে করা হয়।
ফ্রাঙ্কলিন দুর্গকে ঘিরে যে গল্প শোনা যায় তার পটভূমি সত্য। এই বাড়িতে আসলেই অনেকগুলো মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে সেগুলো কোনো অভিশাপে হয়েছিল কিংবা সেই মৃত্যুর কারণে বাড়িতে এখন ভূত ঘুড়ে বেড়াচ্ছে- এরকম বিশ্বাস করাটাও কষ্টসাধ্য। অনেকেই বিশ্বাস করেন, ফ্রাঙ্কলিন দুর্গ ঘিরে যা কিছু ঘটেছে সব কিছুই অত্যন্ত গোপনীয় ছিল বলেই গুজবগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বস্তুত, একুশ শতকে এসে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করবেন কিনা সেটা সম্পূর্ণই আপনার নিজস্ব ব্যাপার!