রবীন্দ্রনাথ তখনও বিশ্বকবি নন, নন বড় মাপের কোনো ব্যক্তিও। পরিচয়ের মধ্যে একটা পরিচয়ই হয়তো ‘বড়’ করে বলা যায়- তিনি একজন ‘জমিদার পুত্র’। সে হলে কী হবে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় তার মন নেই। জমিদার পুত্র যদি লেখাপড়া না করে, তবে প্রজারা শিখবে কী? তাছাড়া, জমিদারিটা ঠিকভাবে টিকিয়ে রাখতে গেলেও তো পড়াশোনা করে নিজেকে যোগ্য-দক্ষ করে তুলতে হবে। সে লক্ষ্যেই উচ্চশিক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথকে পারিবারিক সিদ্ধান্তে পাঠানো হয় বিলেতে। এই প্রথম শুরু হয় তার বিশ্ব-যাত্রা। আর এ সফর রবীন্দ্রনাথের মেধা-মনন-চেতনায় এত গভীর রেখাপাত করে যে, রবীন্দ্রনাথ উত্তরকালে হয়ে ওঠেন একজন বিশ্বমানের সাহিত্যিক; যা তার অপরাপর অন্যান্য বিশ্ব-সফরের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
আজকের এই লেখায় আমরা কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথের সাথে পথ চলবো বিলেতের পথে; আর তাঁর চোখে দেখব বিলেত জীবনের নানান দিক।
রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ড যাত্রা
রবীন্দ্রনাথ দু’বার ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। একবার ১৭ বছর বয়সে, উচ্চশিক্ষা হেতু। আর দ্বিতীয়বার ১৯১২ সালে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেত ভ্রমণে তিনি পাশ্চাত্য জগতের নানা দিক প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধি করে বিস্মিত হন, শিহরিত হন।
এই সময় পাশ্চাত্যের সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, কলা নিয়ে অধ্যয়ন করেন এবং এখান থেকে উপাদান সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যেও নতুন নতুন রস ও শাখার সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয়বার ভ্রমণের সময় কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্য উপাদানের প্রতি এতটা আকৃষ্ট হতে দেখা যায় না। সে যা-ই হোক, আমরা এখানে মূলত রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে, মানে তাঁর কিশোরকালীন জীবনে বিলেত যাবার অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করবো।
বিলেত গমনের প্রেক্ষাপট
ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের স্কুল-কলেজ বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি অনীহা ছিলো। জমিদার পরিবারের ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে তাই বাড়িতেই গৃহ শিক্ষক রেখে প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি দেয়া হয়।
কৈশোর জীবনের শেষ দিকে তাঁর ভালো পড়াশোনার জন্য দাদা সত্যেন্দ্রনাথ প্রস্তাব করেন রবীন্দ্রনাথকে বিলেত পাঠিয়ে দেয়া হোক। সেখানকার লেখাপড়া হয়তো তাঁর ভালো লাগবে। যেই ভাবা সেই কাজ। মাত্র ১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ যাত্রা করেন বিলেত পানে। শুরু হলো তাঁর বিশ্বযাত্রা।
এ যাত্রার আদ্যোপান্ত অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি’, ‘জীবনস্মৃতি’ প্রভৃতি গ্রন্থে। এসব লেখা এতটাই সুখপাঠ্য যে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণকাহিনীগুলোর অন্যতম হয়ে থাকবে রবীন্দ্রনাথের এসব ভ্রমণকাহিনী।
সমুদ্র পথে যাত্রা
বিলেতের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে রবীন্দ্রনাথ জাহাজে চড়ার কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। জাহাজের যাত্রা, পরিবেশ, আবহাওয়ার সাথে তখনও খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি তিনি। কেতাবি ভাষায়, এই অসুস্থতাকে অবশ্য ‘Sea Sickness’ নামে অভিহিত করা হয়। এই ‘সমুদ্র ব্যাধি’তে আক্রান্ত হয়ে কিশোর কবি একেবারে ছ’ ছ’টি দিন বিছানায়। মাথাটিও তুলবার জো ছিলো না। সে সময় জাহাজের জনৈক ‘স্টুঅর্ড’ তাঁকে পরম মমতায় খাইয়ে দিতেন। সেকথা ভুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ,
আমাদের যে স্টুঅর্ড ছিল … আমার উপর তার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি ছিল। দিনের মধ্যে যখন–তখন সে আমার জন্য খাবার নিয়ে উপস্থিত করত; … বলত না খেলে আমি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়ব (weak as a rat)
ছ’দিন পর যখন কবি শয্যা ছেড়ে উঠলেন, তখন দেখলেন, আসলেই তিনি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আমার কথা ছেড়ে কিশোর রবির ভাষাতেই শুনুন,
উঠে দেখি যে সত্যিই ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি। মাথা যেন ধার করা, কাঁধের সাথে তার ভালোরকম বনে না; চুরি করা কাপড়ের মতো শরীরটা আমার যেন ঠিক গায়ে লাগছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম। অনেকদিন পর বাতাস পেয়ে বাঁচলেম।
ভ্রমণকালীন নানান অভিজ্ঞতা
জাহাজে যাত্রাকালে তিনি নানা রুপের নানা চরিত্রের বিদেশিদের দেখলেন, সেখানে নিতান্ত ভদ্র-সভ্য-বিনয়ী ইংরেজ যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন কর্কশ-ভাষী অসৌম্য ব্যক্তিদেরও। মার্জিত রুচির ইংরেজদের ব্যবহারে কবি যেমন পুলকিত হয়েছেন, তেমনি রূঢ় স্বভাবের ইংরেজদের অমার্জিত আচরণে তিনি ব্যথিত হয়েছেন। এমন কত ঘটনা দেখেছেন তিনি, আশ্চর্য হয়েছেন। আর আমরা আশ্চর্য হই তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের ছোঁয়ায় লেখা এসব ভ্রমণ কাহিনী পাঠ করে!
এডেন থেকে জাহাজে করে সুয়েজ যেতে তাঁদের পাঁচ দিন লেগেছিল। সুয়েজে নেমে নৌকোয় করে খানিকটা পথ এগিয়ে ট্রেনে করে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে পৌঁছে সেখান থেকে স্টিমারে চেপে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি পৌঁছান কবি। কবি জানতেন যে, আফ্রিকা এক অনুর্বর মরুভূমির নাম; অন্তত বই-পুস্তকে তো তেমনটিই পড়েছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখলেন উল্টো। রাস্তার দু’পাশে তিনি বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত দেখেছেন, দেখেছেন থোকায় থোকায় খেজুরশুদ্ধ গাছ, আরো কত কী!
হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ধূলোবালি মেখে মলিন বদনে পৌঁছলেন আলেকজান্দ্রিয়া। বন্দরে তাদের জন্য অপেক্ষমাণ ‘মঙ্গোলিয়া’ জাহাজে চেপে তাঁরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন।
আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি সমৃদ্ধিশালী, তাতে বড় বড় বাড়ি, বড় বড় দোকান, বিভিন্ন দেশের মানুষ, হরেক রকমের দোকানপসার আছে। বেশিরভাগ দোকানের সাইনবোর্ড ফরাসি ভাষায় লেখা। এখানের বিশাল বন্দরে ইউরোপীয়, মুসলমান সব ধরনের জাতির জাহাজ আছে, শুধুমাত্র হিন্দুদের কোনো জাহাজ নেই। এই ঘটনা তাকে বিষণ্ণ করেছিল।
জাহাজে করে ইতালিতে পৌঁছতে লাগলো পাঁচদিন; তখন রাত দুটো বা তিনটে। নানা ঝামেলায় রাতে ব্রিন্দিসির হোটেলে থাকতে হলো। পরদিন একটি আধভাঙা গাড়ি করে শহর দেখতে বেরোলেন।
ব্রিন্দিসি শহরটা খুব একটা বড় নয়, ভিক্ষুক ভিক্ষা করছে, রাস্তায় মানুষ গল্পগুজব করছে, ঢিলেঢালা শহর, মানুষজন। তাঁরা ফলের বাগানে সাদা-কালো আঙুর, পিচ, আপেল নানা জাতীয় ফল দেখতে পান।
কিশোর কবি রসবোধের কিন্তু ঘাটতি ছিলো না। দেখুন না, সেখানে একজন বুড়ি ফল বিক্রেতা রবীন্দ্রনাথদেরকে অনুনয় করলেও তাঁর ফল কেনার ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখে আর ওকে উপেক্ষা করলেন না। ভ্রমণকাহিনীর এ পর্যায়ে ইতালির মেয়েদের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে ভুল হলো না কিশোর কবির। তাঁর দৃষ্টিতে, ইতালির মেয়েরা সুন্দরী, তাদের চোখ, চুল, ভ্রু কালো অনেকটা আমাদের দেশের মতো।
ব্রিন্দিসি শহর থেকে ট্রেনে করে প্যারিস শহরের দিকে যাত্রা করেন কবি। পথে মাঝরাতে নানান বিপত্তিতে পড়তে হয়, সেসব বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে অবশেষে তিনি প্যারিস পৌঁছান।
অবশেষে ইংল্যান্ড
রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ইংল্যান্ডে যান। ব্রাইটন শহরে ঠাকুর বাড়িতে থাকেন কিছু দিন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে (অনেকের মতে, ব্রাইটন কলেজে) ভর্তি হন। কিছু দিন পর, আরো ভালো লেখাপড়ার উদ্দেশে তিনি বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর সাথে লন্ডন চলে যান। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে, আইনবিভাগে। কিন্তু থাকা-খাওয়া নিয়ে বাঁধলো বিপত্তি।
অনেক খোঁজ-খবরের পর একজন ডক্টরের বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন বলে ঠিক হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ ছিলেন না; তাই যে পরিবারে তিনি থাকবেন, সে পরিবারের প্রত্যেকের ছিলো ঘোর আপত্তি।
তাদের ভারি ভয় হয়েছিল। যেদিন আমার আসবার কথা সেইদিন মেজ ও ছোট মেয়ে, তাদের এক আত্নীয়দের বাড়ীতে পালিয়ে গিয়েছিলন। প্রায় এক হপ্তা বাড়িতে আসেনি। তারপর হয়তো যখন তারা শুনলেন যে, মুখে ও সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোঁট বিঁধিয়ে অলংকার পরে নি, তখন তারা বাড়িতে ফিরে এলেন।
কিশোর রবির চোখে ইংল্যান্ডের প্রকৃতি ও এখানকার অধিবাসীদের আচার-প্রথা
প্রথম প্রথম রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের আবহাওয়া ও এখানকার মানুষদের আচার-প্রথা নিয়ে খুবই বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। তাঁর ভাষায়,
এ দেশের জমিতে আঁচড় কাটলেই শস্য হয় না, তাতে শীতের সঙ্গে মারামারি করতে হয়– শীতের উপদ্রবে এদের কত কাপড় দরকার হয় তার ঠিক নেই, তার পরে কম খেলে এ দেশে বাঁচবার জো নেই, শরীরে তাপ জন্মাবার জন্য অনেক খাওয়া চাই
এমনকি রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের মানুষদের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কড়া মন্তব্যও করে বসেছেন,
এখানকার লোকেরা অপরিষ্কার নয়, আমাদের দেশে যাকে ‘নোংরা’ বলে তাই।
তাঁর এই লেখনীগুলো ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ নামে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
ইংল্যান্ডের মানুষের জীবনযাত্রা এত ব্যস্ত যে রবীন্দ্রনাথের তা মোটেও ভালো লাগেনি। এ প্রসংগে তিনি লিখছেন,
ইংল্যান্ডে … রাস্তা দিয়ে যারা চলে …বগলে ছাতি নিয়ে হুস হুস করে চলছে পাশের লোকদের উপর ভ্রুক্ষেপ নেই, মুখে যেন মহা উদবেগ, সময় তাদের ফাঁকি না দিয়ে পালায় এই তাদের প্রাণপণ চেষ্টা। সমস্ত লন্ডনময় রেলওয়ে। প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর ট্রেন চলছে। লন্ডন থেকে ব্রাইটনে আসবার পথে দেখি উপর দিয়ে একটা, নীচ দিয়ে একটা, পাশ দিয়ে একটা … ট্রেন ছুটছে। সে ট্রেনগুলোর চেহারা লন্ডনের লোকদেরই মতো … মহা ব্যস্তভাবে হাঁসফাঁস করতে চলছে। দেশ তো এই একরত্তি, দু’পা চললেই ভয় হয় সমুদ্রে গিয়ে পড়ি, এখানে এত ট্রেন যে কেন ভেবে পাই নে।
ইংল্যান্ডের প্রকৃতিও কেমন যেন, সব সময় কেবল মেঘলা মেঘলা অবস্থা, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে নির্মোহ বর্ণনা দিতে সচেষ্ট হলেও তাঁর খেদোক্তি ঢাকা থাকেনি,
আজ ব্রাইটনে অনেক তপস্যার ফলে সূর্য উঠেছেন। এ দেশে রবি যেদিন মেঘের অন্তঃপুর থেকে বের হন সেদিন একটি লোকও কেউ ঘরে থাকেন না সেদিন সমুদ্রের ধারে বেড়াবার রাস্তায় লোক কিলবিল করতে থাকে। এ দেশে যদিও বাড়ির ভিতর নেই তবু এ দেশের মেয়েরা অসূর্যম্পশ্যরূপা এমন আমাদের দেশে নয়। …দিনে দিনে শীত খুব ঘনিয়ে আসছে; লোকে বলছে কাল পরশুর মধ্যে আমরা বরফ পড়া দেখতে পাব। তাপমান যন্ত্র ত্রিশ ডিগ্রি অবধি নেমে গেছে … রাস্তার মাঝে কাঁচের টুকরোর মতো শিশির খুব শক্ত হয়ে জমেছে … সকালে লেপ থেকে বেরোতে ভাবনা হয়।
অশ্বেতাঙ্গ রবীন্দ্রনাথের বিড়ম্বনা
রবীন্দ্রনাথ যথেষ্টই ফর্সা ছিলেন। তবে, ইউরোপীয়দের সংজ্ঞানুযায়ী তো তিনি আর ‘শ্বেতাঙ্গ’ ছিলেন না। সেজন্যে তাঁকে প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো। ইংল্যান্ডবাসীরা অশ্বেতাঙ্গ নন-ইউরোপীয়দের নিতান্তই সেকেলে মনে করে, তা জানতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তারা যে নন-ইউরোপীয় বা ভারতবর্ষের লোকেদের এতটাই অবুঝ মনে করে, তা কবি ভাবতেই পারেন না। তাদের কিছু কিছু আচরণে কবি আসলেই হতভম্ব হয়ে যান। একটি বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে প্রথম দিকে যে বিড়ম্বনার মুখে পড়েছিলেন তিনি, সে তো বলেছিই। এরকম আরো কিছু ঘটনা রবীন্দ্রনাথ তাঁর জবানিতে আমাদেরকে জানিয়েছেন,
এখানকার লোকেরা আমাকে নিতান্ত অবুঝের মতো মনে করে। একদিন Dr – এর ভাইয়ের সাথে বেরিয়েছিলেম। একটা দোকানের সম্মুখে কতকগুলো ফটোগ্রাফ ছিল… আমাকে বুঝিয়ে দিলে যে একরকম যন্ত্র দিয়ে ঐ ছবিগুলো তৈরি হয়, মানুষ হাতে করে আঁকে না। আমার চারিদিকে লোক দাঁড়িয়ে গেল। ঘড়ির দোকানের …ঘড়িটা যে খুব আশ্চর্য যন্ত্র তাই আমার মনে সংস্কার জন্মাবার চেষ্টা করতে লাগল …আমাদের দিশি কাপড় দেখে রাস্তার এক একজন সত্যিই হেসে ওঠে … কত লোক হয়ত আমাদের জন্য গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছে । প্যারিসে আমাদের গাড়ির একদল ইস্কুলের ছোকরা চিৎকার করতে করতে ছুটছিল … এক একজন চেঁচাতে থাকে – “ Jack , look at the blackies”.
ভারতবর্ষে থাকাকালীন ইংল্যান্ডের মহান কবি, লেখক, দার্শনিকদের লেখা পড়ে পড়ে ইংল্যান্ড সম্পর্কে কবির উচ্চমার্গীয় ধারণা হয়েছিল- ইংরেজ সমাজ বুঝি পুরোদস্তুর জ্ঞানপিপাসু। কিন্তু বাস্তব ইংরেজ সমাজে কিছুদিন বসবাস করে কবি খানিকটা হতাশ হন। কবির মন্তব্য,
এই ক্ষুদ্র দ্বীপের …সর্বত্রই গ্ল্যাডস্টোনের বাগ্মিতা, ম্যাক্সমুলারের বেদব্যাখ্যা, টিন্ডালের বিজ্ঞানতত্ত্ব, কার্লাইলের গভীর চিন্তা, বেনের দর্শনশাস্ত্রে মুখরিত। সৌভাগ্যক্রমে তাতে আমি নিরাশ হয়েছি।
লন্ডনের ‘হাউস অব কমন্স’ পরিদর্শন
ইংল্যান্ড হচ্ছে গণতন্ত্রের সূতিকাগার। লন্ডনে বসে হাউস অব কমন্সের অধিবেশন।
সেখানে এক অধিবেশনের কার্যক্রম দেখার সুযোগ হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের। তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর এই অভিজ্ঞতার তাতে আপনি যেমন বিনোদিত হবেন, তেমনি আবার খেয়াল করলে দেখবেন এতো আগের লেখা বর্ণনার সাথে আমাদের বর্তমান সংসদের কার্যক্রমের কোন কোন দিনের চিত্রও কী অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে!
আমরা যখন গেলেম, তখন ও’ডোনেল বলে একজন আইরিশ সভ্য ভারতবর্ষ সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, প্রেস অ্যাক্টের বিরুদ্ধে ও অন্যান্য নানা বিষয় নিয়ে তিনি আন্দোলন করছিলেন। তার প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়ে গেল। হাউসের ভাবগতিক দেখে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। যখন কেউ বক্তৃতা করছে, তখন হয়ত অনেক মেম্বার মিলে ইয়া ইয়া করে চিৎকার করছে, হাসছে। আমাদের দেশের স্কুলের ছাত্ররাও এরকম করে না। অনেক সময় বক্তৃতা হচ্ছে আর মেম্বাররা কপালের উপর দিয়ে টুপি টেনে দিয়ে অকাতরে নিদ্রা যাচ্ছেন।
পেয়িং গেস্ট রবীন্দ্রনাথ
পেয়িং গেস্ট মানে অনেকটা সাবলেট থাকার মতো। কোনো একটা পরিবারের সাথে থাকবে, খাবে; বিনিময়ে টাকা পে করবে। পেয়িং গেস্ট হিসেবে রবীন্দ্রনাথের একটি অম্লমধুর অভিজ্ঞতার কথা আমরা আগে একটি জায়গায় বলেছি।
আসলে, রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে দুটি বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে ছিলেন। প্রথম বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন, সেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা ছিলো না, তাই বলে যে ঝগড়া ছিলো তা-ও না। যা-ই হোক, রবীন্দ্রনাথ পরে আরেক বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে অবস্থান করেন; সেখানে দুটো ছোট বাচ্চা ছিলো- যাদের সাথে কিশোর কবির বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো-
ছেলেদের সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গেছে। তারা আমাকে আর্থার খুড়ো বলে ডাকে। এথেল ছোটো মেয়েটির ইচ্ছে যে আমি কেবল একলা তারই আঙ্কল হই। তার ভাই টম যদি আমাকে দাবি করে তবেই তার দুঃখ। একদিন টম তার ছোটো বোনকে রাগাবার জন্য একটু বিশেষ জোর দিয়ে বলেছিল আমারই আঙ্কল আর্থার। তখনই এথেল আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট দুটি ফুলিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। টম ভারি ছেলেমানুষ … একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,”আচ্ছা আঙ্কল আর্থার ইঁদুরেরা কি করে?” আঙ্কল বললেন,” তারা রান্নাঘর থেকে চুরি করে খায়।“ সে একটু ভেবে বললে,“ চুরি করে? আচ্ছা চুরি করে কেন?” আঙ্কল বললেন, “তাদের খিদে পায় বলে।“ শুনে টমের ভালো লাগল না। সে বরাবর শুনে এসেছে যে জিজ্ঞাসা না করে পরের জিনিস নেওয়া অন্যায় … যা হোক , এই পরিবারে সুখে আছি। সন্ধ্যে বেলা আমোদে কেটে যায় – গান বাজনা বই পড়া। আর এথেল তার আঙ্কল আর্থারকে ছেড়ে এক মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে চায় না।
ইংল্যান্ডে থাকাকালীন একবার এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সবাই মিলে ধরলো তাঁকে, একটা গান শোনাবার জন্যে। রবীন্দ্রনাথ গাইলেন, ‘প্রেমের কথা আর বলো না’। গানটি শুনে এক ভদ্রমহিলা তাঁর কাছে এর অর্থ জানতে চাইলেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে গানটি অনুবাদ করে দিলে ভদ্রমহিলা অমনি বলে বসেন, ‘তোমাদের দেশে প্রেমের স্বাধীনতা আছে নাকি!’
ভদ্রমহিলার এই উক্তি থেকে আসলে বোঝা যায় যে, উন্নত সভ্যতার ইউরোপীয় সমাজ তখনকার ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কী রকম ধারণা পোষণ করতো।
ইংল্যান্ডের প্রশস্তিতে রবীন্দ্রনাথ
প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ বিলেতের প্রতি আকর্ষণ অনুভব না করলেও ধীরে ধীরে তিনি বিলেতের মানুষদের উন্নত সভ্যতা, মার্জিত ও ভদ্রোচিত আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ হতে থাকেন। বিশেষত তিনি যে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতেন, সে বাড়ির গৃহকর্তাদের অমায়িক ব্যবহারে তিনি প্রসন্ন হন এবং দীর্ঘসময় তিনি সেই স্মৃতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। সময়ের সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোতে ইংল্যান্ডবাসীদের প্রশস্তি গাওয়া হতে থাকলো। একদিকে ইংল্যান্ডের প্রশংসা কীর্তন, আর অন্যদিকে সখেদে ভারতবর্ষবাসীদের আলস্য, অজ্ঞানতার সমালোচনা!
এতে করে, রবীন্দ্রনাথের পিতা-মাতা ভাবলেন, পুত্র আমার কবি মানুষ, ইংল্যান্ডের মোহে পড়ে যদি আবার কবি মাইকেল মধুসূদনের মতো স্বদেশ-স্বধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে যায়, তাহলে সমস্যায়ই পড়তে হবে বটে। শোনা যায়, এসব কারণেই তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টারি সমাপ্ত না করেই মাঝ পথেই ভারতবর্ষে ফিরিয়ে আনেন। ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয় কিশোর কবির এই দেড় বছরের বিলেত যাত্রা।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের এই বিলেত যাত্রা তাঁর সাহিত্য রচনার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সাহিত্য রচনায় তাঁর যে আধুনিকতার ছাপ দেখা যায়, তাতে এই বিলেত ভ্রমণ প্রধান ভূমিকা রেখেছে।তিনি বেশ কিছু গান রচনা করেছেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ভাব, বাণী ও সুর অবলম্বনে। বিলেত ভ্রমণের পর পরই তিনি রচনা করেন কয়েকটি গীতিনাট্য, যেখানে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব স্পষ্টত লক্ষণীয়। বিলেত সফরের আগেকার রবীন্দ্রনাথ আর বিলেত সফরের পরের রবীন্দ্রনাথ- এই দুই সত্তা অভিন্ন নয়। যে ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা, সে ডিগ্রি তিনি লাভ করতে না পারলেন না; তবে যা লাভ করলেন, নিঃসন্দেহে তা তাঁর পরবর্তীকালের সাহিত্যিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
nosolocine.net