যুগে যুগে কিছু প্রাণ হয়ে থাকে প্রেরণার বাতিঘর । আঁধারে সাহস জোগায় আলো খুঁজতে। অতি সাধারণকেও মন্ত্রমুগ্ধ করে পরাধীনতার শেকল ভেঙে ফেলতে। ভীতুকেও সাহস জোগায় অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে, সাহসী করে তোলে মানুষের মত বাঁচতে। রংপুরের কৃষক বিদ্রোহে প্রাণ দেওয়া কৃষকরা তেমনই এক দল প্রাণ। তেমনই একটি প্রাণ সে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া নূরলদীন, একজন স্বাধীনতাকামী নূরলদীন, একজন কৃষক এবং কৃষকদের নবাব নূরলদীন।
হাহাকারময় সময়
বাংলা অঞ্চল তখন পার করছিল একটি হাহাকারময় সময়। কিছুকাল আগেই কোম্পানির কুশাসনের ফলে ১১৭৬ বঙ্গাব্দে সৃষ্ট ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে’ কোটি মানুষ মারা গেছে না খেয়ে। তারপরেও অত্যাচার, নিপীড়ন আর লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত টাকায় কোম্পানির অবস্থা তখন খুবই রমরমা। রাজস্ব ক্ষমতা হাতে পেয়ে ইংরেজরা তখন চালু করেছিল ইজারাদারি প্রথা। আর এই ইজারাদারি ব্যবস্থায় রংপুর, দিনাজপুরের ইজারাদারি লাভ করে একজন অত্যাচারী জমিদার দেবী সিংহ।
দেবী সিংহকে চরিত্র নিয়ে নিখিলনাথ রায় তার মুর্শিদাবাদ কাহিনীতে লিখেছেন,
“বাঙ্গলাদেশে যে মূর্তিমতী অরাজকতা দেখা যায়, দেবী সিংহের অত্যাচার তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ-স্থান লাভ করে। অর্থলোলুপ কোম্পানীর কর্মচারিগণের বিশ্বগ্রাসিনী লালসার নিবৃত্তির জন্য এবং নিজের রাক্ষসী বৃত্তির পরিতুষ্টির জন্য, দেবীসিংহ মনুষ্যনামে কলঙ্ক প্রদান করিয়াছে।”
কে সেই দেবী সিংহ ?
দেবী সিংহ মুর্শিদাবাদ এসেছিলেন সূদুর পানিপথ থেকে। মুর্শিদাবাদে এসে ডাকাতির মাধ্যমে প্রভূত সম্পদের মালিক হয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। পলাশীর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। একারণে ছিলেন ব্রিটিশদের সুনজরে। পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের দেওয়ান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করার পর তার কঠোরতায় প্রজাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল। এরপর তিনি লাভ করেন পূর্ণিয়ার শাসন ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা। এখানেও তার অত্যাচার আর নিপীড়নে কৃষকরা একরকম বনে-জঙ্গলে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। যার ফলে হেস্টিংস নিজেই তাকে পদচ্যুত করেন। কিন্তু দেবীসিংহ ছিলেন খুবই ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ। প্রচুর অর্থ উপঢৌকনের বিনিমেয়ে হেস্টিংসকে বাগে আনেন সহজেই। এবার তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদের প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ডের সহকারী কার্যাধক্ষ্যের পদে। এখানেও তিনি প্রজাদের উপর নিপীড়ন অব্যাহত রাখেন। একসময় প্রচুর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। হেস্টিংস বাধ্য হন সেই রেভিনিউ বোর্ড ভেঙে দিতে।
দিনাজপুরে দেবী সিংহ ও অত্যাচারের নতুন অধ্যায়
দেবী সিংহের সাথে হেস্টিংসের সখ্যতা ছিল অনেক গভীরে। তাই এবার হেস্টিংস দেবী সিংহকে মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে এক হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দিলেন দিনাজপুরের নাবালক রাজার দেওয়ান হিসেবে। দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলে শুরু হলো ইতিহাসের মর্মান্তিক দেবী সিংহ অধ্যায়। দেবী সিংহ দেওয়ানী লাভ করার পরের বছরই দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগণার ইজারা নিজের নামে করিয়ে নেন, যদিও কোনো দেওয়ান সেসময় ইজারা নিতে পারবে না, এমন বিধান ছিল। কিন্তু ইংরেজ কালেক্টর গুডল্যান্ডের সাথে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক থাকায় এসব বিধি বিধান পাত্তা পায়নি। যা-ই হোক, নিত্যনতুন করারোপ আর তা আদায়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনে দেবী সিংহের জুড়ি ছিল না। হরেরাম নামক আরেকজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিল তার সহযোগী। এর মাধ্যমে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে কৃষকদের সামনে নেমে এল ঘোরতর অন্ধকার।
নিখিলনাথ রায় তার মুর্শিদাবাদ কাহিনীতে দেবী সিংহের অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরে বলেছেন,
“যদি কেহ অত্যাচারের বিভীষিকাময়ী মূর্ত্তি দেখিতে ইচ্ছা করেন, যদি কেহ মানবপ্রকৃতির মধ্যে সয়তানবৃত্তির পাপ অভিনয় দেখিতে চাহেন, তাহা হইলে একবার দেবী সিংহের বিবরণ অনুশীলন করিবেন। দেখিবেন, সেই ভীষণ অত্যাচারে কত কত জনপদ অরণ্যে পরিণত হইয়াছে। কত কত দরিদ্র প্রজা অন্নাভাবে জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছে। কত কত জমীদার ভিখারীরও অধম হইয়া দিন কাটাইয়াছে।…দেবী সিংহের নাম শুনিলে, আজিও উত্তরবঙ্গ প্রদেশের অধিবাসিগণ শিহরিয়া উঠে! আজিও অনেক কোমলহৃদয়া মহিলা মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়েন। শিশুসন্তানগণ ভীত হইয়া, জননীর ক্রোড়ে আশ্রয় লয়!”
এসব অত্যাচারের বিবরণ দিতে গিয়ে নিখিলনাথ রায় এডমন্ড বার্কের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন,
“শত বৎসরের পর সেই সমস্ত অত্যাচার পড়িতে গেলে, উপন্যাস বলিয়া বোধ হয় …মনুষ্য প্রকৃতিতে এরুপ পিশাচপ্রকৃতির সমাবেশ আর কোথাও আছে কি না জানি না । দেবী সিংহের পাইকবর্গ সেই নিরীহ প্রজাগণের অঙ্গুলিতে রজ্জু বন্ধন করিয়া, ক্রমাগত পাক দিতে দিতে অঙ্গুলিগুলির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিত এবং তাহারা যখন যন্ত্রনায় কাতর হইয়া, আর্তনাদ করিয়া উঠিত, সেই সময়ে হাতুড়িরর দ্বারা তাহা চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া, একেবারে অকর্মণ্য করিয়া দিত। ..স্ত্রীলোকদিগকে সাধারনের সমক্ষে উলঙ্গিনী করিয়া, অবিরত বেত্রাঘাত করা হইত ! লজ্জায়, যন্ত্রনায়, তাহারা ক্রমাগত বসুন্ধরাকে দ্বিধা হইয়া স্থানদানের জন্য অনুনয় করিত ! …পরে তাহাদের সেই সমস্ত ক্ষতস্থান গুল ও মশালের আগুনে দগ্ধ করিয়া, যন্ত্রনার সীমা ক্রমেই বৃদ্ধি করা হইত !”
নির্যাতন, নিপীড়ন আর অন্তহীন লুণ্ঠনে তখন সর্বশ্রান্ত উত্তরবঙ্গের কৃষককূল। প্রাণ যখন একেবারেই ওষ্ঠাগত, তখন এ মৃত্যুপুরী থেকে মুক্তির স্বপ্ন তাদের এগিয়ে নিলো একটি পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহের দিকে। নিজের মাটি, ইজ্জত ও অস্তিত্ব রক্ষায় তারা ঘুরে দাঁড়ালেন একটি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। আর তখনই আবির্ভাব একজন নূরলদীনের।
নূরলদীন কে ছিলেন?
নূরলদীন একজন মানুষ ছিলেন । একজন কৃষক ছিলেন। একজন মহৎপ্রাণ কৃষক, যার নেতৃত্বে হাজারো কৃষক বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বিদ্রোহী হয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়। এর বেশি ইতিহাসে নূরলদীনের আর কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। তিনি কোন গ্রামে জন্মেছিলেন, কেমন কেটেছে তার শৈশব কিংবা কীইবা ছিল তার বংশ পরিচয়? এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিহাস দেয়নি।
বিদ্রোহের শুরু
১৭৮২ সালের শেষদিক থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কৃষকদের কণ্ঠ সোচ্চার হতে থাকে। যা দ্রুতই এগিয়ে যায় বিদ্রোহের দিকে। কাজিরহাট, কাকিনা, টেপা ও ফতেপুর চাকলা অঞ্চলে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ শুরু করলে কুচবিহার ও দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকরাও এই বিদ্রোহে শামিল হন। কৃষকগণ নূরলদীনকে তাদের ‘নবাব’ হিসেবে ঘোষণা দেন। দয়াশীল নামে আরেকজনকে নিযুক্ত করা হয় তার দেওয়ান হিসেবে। নবাব নূরলদীন কৃষকদের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর করে তোলেন। কৃষকরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় নূরলদীনকে স্বতঃফূর্তভাবে সহায়তা করতে থাকেন। প্রথমদিকে নূরলদীন ও উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ। তারা ভেবেছিলেন, ইংরেজ সরকার হয়েতো দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এ লক্ষ্যে তারা কৃষকদের উপর অত্যাচারের বিবরণ তাদের সই সহ গুডল্যান্ডের নিকট পাঠান। এবং ব্যবস্থা নিতে নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু গুডল্যান্ড নিজেই দেবী সিংহের সুবিধাভোগী ছিলেন। দেবী সিংহের লুটের টাকার বড় অংশ আসতো তার পকেটে। কাজেই তিনি এদিকে ভ্রূক্ষেপও করলেন না।
এ বিষয়ে সুপ্রকাশ রায় ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বইয়ে লিখেছেন,
“কিন্তু কালেক্টর দাবি পূরণের জন্য কোন চেষ্টাই করিলেন না, ইহার পর কৃষকগণ সশস্ত্র বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল। তাহারা কালেক্টরকে জানাইয়া দিল, তাহারা আর খাজনা দিবে না এবং এই শাসন মানিয়া চলিতেও প্রস্তুত নহে।’
অত্যাচারীর ভিত কাঁপলো
শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে ব্যর্থ হয়ে কৃষকগণ এবার প্রতিরোধের ডাক দিলেন। ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাসেই নূরলদীনের নেতৃত্বে কৃষকরা নেমে যান চূড়ান্ত বিদ্রোহে। এবার তাদের বিদ্রোহের লক্ষ্য শুধু দেবী সিংহের উৎখাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না, বরং তারা ঘোষণা দিলেন, তারা আর ইংরেজদের শাসনও মেনে চলবেন না।
নূরলদীনের নির্দেশে কৃষকরা সকল প্রকার খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন। বিদ্রোহের খরচ মেটানোর জন্য ‘ডিং খরচ’ নামে তারা অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন। কৃষকরা আগে থেকেই তাদের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধের জন্য মুখিয়ে ছিলেন। নূরলদীনের আহ্বানে রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার বিভিন্ন জায়গা থেকে কৃষকরা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দিতে লাগলেন ।
বিদ্রোহী কৃষকগণ দেবী সিংহের সকল কর্মচারীদের রংপুর থেকে বিতাড়িত করেন। খাঁন চৌধুরী আমানতুল্লা আহমেদ তার কোচবিহারের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন,
“ইহার পর কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা, কাজিরহাট এবং টেপা পরগনায় বিদ্রোহীরা দলবদ্ধ হইয়া কর-সংগ্রাহক নায়েব এবং গোমস্তা প্রভৃতিকে যত্র তত্র বধ করিতে আরম্ভ করে। ডিমলার জমিদার গৌরমোহন চৌধুরী বিদ্রোহীগণকে বাধা দিতে অগ্রসর হইলে তাঁহারও জীবনান্ত ঘটে ”
রক্তের স্রোতে ভেঙে গেলো শেকল ভাঙার স্বপ্ন
বিদ্রোহের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে কৃষকদের প্রতিরোধে টিকতে না পেরে অত্যাচারী দেবী সিংহ ভয়ে পালালেন। জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিলেন রংপুরের ইংরেজ কালেক্টর গুডল্যান্ডের নিকট। গুডল্যান্ড এই বিদ্রোহ সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকলেও ঝামেলায় জড়াতে চাননি । কিন্তু দেবী সিংহ ভালো করেই জানতেন, ইংরেজদের কীভাবে বশে আনতে হয়। প্রচুর উপঢৌকন গুডল্যান্ড সাহেবকে অগত্যা নড়েচড়ে উঠতে বাধ্য করলো।
গুডল্যান্ড তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট নূরলদিনকে দমনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হলেন। তার আবেদনে নূরলদীনকে দমনে রংপুরে পাঠানো হলো এক দল কামান সজ্জিত সেনাবাহিনী। যার নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোন্যাল্ড। কালেক্টর গুডল্যান্ডের নিজস্ব বাহিনীও যোগ দিলো তাদের সাথে। ইংরেজ সৈন্যরা পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে অগ্রসর হতে থাকলো। পথিমধ্যে নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে, নির্বিচারে চালালো হত্যাযজ্ঞ। বিদ্রোহী কৃষকরাও তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। কোথাও বিদ্রোহীরা, আবার কোথাও ইংরেজরা জয় পেলেও চূড়ান্ত লড়াই তখনো বাকি ছিল।
নূরলদীনের অনুগত বিদ্রোহী কৃষকরা লাঠি-সোঁটা আর দা-কাস্তে নিয়ে একত্র হলেন পাটগ্রামে। উদ্দেশ্য- ইংরেজদের শক্ত ঘাঁটি মোগলহাট আক্রমণ করে তাদের পরাস্ত করা। যদিও কৃষকদের লাঠি কিংবা দা-কাস্তে ব্যতীত অন্য কোনো অস্ত্র ছিল না, তারপরেও অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করার দুর্বার প্রতিজ্ঞা তাদের ছিল।
অপরদিকে, লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড অবশ্য নূরলদীনের সাথে সম্মুখ সমরের দিকে গেলেন না। তিনি আশ্রয় নিলেন কূটকৌশলের। ছদ্মবেশ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে কৌশলে রাতের আধাঁরে ঘিরে ফেললেন বিদ্রোহীদের ঘাঁটি পাটগ্রাম। দিনটি ১৭৮৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি। অতি ভোরে ঘুমন্ত মুক্তিকামী কৃষকদের উপর ভারি অস্ত্রসহ হামলে পড়লেন লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড ও তার বাহিনী।
বিদ্রোহী কৃষকদের কাছে ছিল না কোনো উন্নত সমরাস্ত্র, ছিল না কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ কিংবা যুদ্ধের কলাকৌশল। ইংরেজদের অতর্কিত আক্রমণে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে দলে দলে মারা পড়তে থাকেন। ব্যর্থ হন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। নিহত হন নূরলদীনের বিশ্বস্ত দেওয়ান দয়াশীল। যুদ্ধে নূরলদীন গুরুতর আহত হয়ে বন্দী হলে কৃষকদের ভাগ্যে নেমে আসে পরাজয়। নিপীড়িত, নির্যাতিত কৃষকদের দুর্দান্ত লড়াইটি রূপ নেয় ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায়ে।
বিদ্রোহের ফলাফল
যুদ্ধে পরাজয় ও নূরলদীনের মৃত্যু কৃষকদের হতোদ্যম করলেও লড়াই থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বিচ্ছিন্নভাবে তাদের প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে। মৃত নবাব নূরলদীনের আদেশকে মান্য করে তারা বন্ধ করে দেয় সকল প্রকার খাজনা প্রদান। প্রচুর টাকা খাজনা বাকি পড়লে ইংরেজ শাসকদের টনক নড়ে। ঘটনা তদন্তে আসেন পিটারসন নামক ইংরেজ ভদ্রলোক। তিনি অবশ্য রেভিনিউ কমিটির কাছে নির্মোহভাবে কৃষকদের উপর নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন। অতঃপর দেবী সিংহকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় আর কালেক্টর গুডল্যান্ডকে ডাকা হয় কলকাতায়।
দেবী সিংহ ভালো করেই জানতেন, তার কী করণীয়। তিনি অর্ধকোটির বেশি অর্থকড়ি নিয়ে ছুটে যান কলকাতায়। ভাগ করে দেন বিচারকমণ্ডলীর মধ্যে। তারপর যা ঘটে, তা সুপ্রকাশ রায় তার ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বইতে লিখেছেন,
“গভর্নর-জেনারেল হেস্টিংস ষড়যন্ত্র পাকাইয়া গুডল্যান্ডের কোন দোষ নাই বলিয়া তাহাকে অব্যাহতি দেন। দেবী সিংহ তাঁহার সঞ্চিত বিপুল অর্থ দ্বারা বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বশীভূত করিয়া রাখিয়াছিল। হেস্টিংস তাহাদের লইয়া দেবী সিংহের বিচারের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি বিচার করিয়া রায় দেয় যে, দেবী সিংহ সম্পুর্ণ নির্দোষ, পিটার্সনই তাঁহার নামে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়াছেন। হেস্টিংস ইংলণ্ডে যে রিপোর্ট প্রেরণ করেন তাহাতেও তিনি এই রায় সমর্থন করেন।”
বিচারে দেবী সিংহ ছাড়া পেলেও তার সহকারী হরেরামকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাকে রংপুর থেকে বের করে দিয়ে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। এতে গুটিকয়েক কৃষক নামমাত্র ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন।
তবে বিচারের রায়ে দেবী সিংহ নির্দোষ প্রমাণিত হলেও কৃষকরা তাকে মানতে রাজি ছিলেন না। এসময় জেনারেল হেস্টিংস দেশে ফেরত গেলে তার স্থলাভিষিক্ত হন লর্ড কর্ণওয়ালিস। দেবী সিংহ কিছুদিন চেষ্টা করে কর্ণওয়ালিসকে বাগে আনতে না পেরে অবশেষে তার সারাজীবনের লুণ্ঠনের সম্পদ নিয়ে মুর্শিদাবাদের নসীপুরে রাজপ্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বসবাস করতে থাকেন। নসীপুরে দেবী সিংহের প্রাসাদ আজো কালের স্বাক্ষী হয়ে জানান দিচ্ছে ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়ের। দেবী সিংহ নিঃসন্তান থাকায় ১৮০৫ সালে তার মৃত্যুর সাথে তার তার বংশের নিষ্পত্তি ঘটে ।
লর্ড কর্ণওয়ালিস রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারা প্রথা বন্ধ করে ১৭৯০ সালে উত্তর বঙ্গ ও বিহারের জমিদারগোষ্ঠীর সাথে দশশালা বন্দোবস্ত করেন। দশশালা বন্দোবস্ত শোষণ-নিপীড়নের নতুন দরজা খুলে দেয়।
নূরলদীন হয়তো পরাজিত হয়েছিলেন। তার একটি মুক্ত, অনাচার, অত্যাচারমুক্ত ভূখণ্ডের স্বপ্ন ছুঁতে পারেননি জীবন দিয়েও। কিন্তু একজন নূরলদীন কিংবা একদল বিদ্রোহী কৃষক হয়ে আছেন এ অঞ্চলের অগণিত মানুষের প্রেরণার উৎস, সাহসের বাতিঘর। আজো উত্তরাঞ্চলের লোকজন তাদের সন্তানের নাম রাখে নূরলদীন। নূরলদীনের নামে আজো আপ্লুত হয় অগণিত প্রাণ।
সে কৃষক বিদ্রোহ ছিল মাটির মানুষের। সেই অতি সাধারণ কৃষকেরাই আমাদের নায়ক, আমাদের গল্পের নায়ক, আমাদের প্রেরণার নায়ক। তবু আমরা হয়তো ভুলে যাই নূরলদীনের মত মানুষদেরকে। কিন্তু নূরলদীনরা আসে মানুষের জন্য, মানবতার বিজয়ের লড়াইকে সমুন্নত রাখতে। কবি সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন-
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।