যুদ্ধের ময়দান। রণহুংকারের চেয়ে আধুনিক অস্ত্রের গর্জন বেশি শোনা যাচ্ছে। বিপদ হলো, এসব আধুনিক অস্ত্রের বেশিরভাগই প্রতিপক্ষের। সেসবের তোড়ে এ দলের সেনারা প্রতি মুহূর্তে পিছু হঠছে। প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করছে কেবল একজন। দু’হাতে তলোয়ার ধরে একের পর এক প্রতিপক্ষের সেনাকে ঘায়েল করে চলেছে। সাদা জামা আর পাজামা পরা সেই যোদ্ধা শুধু নিজে যুদ্ধ করছে, তা-ই নয়। মনোবল হারানো সৈন্যদের অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। কিন্তু এ কী! তার পিঠে কী বাঁধা? তার পিঠের সাথে বাঁধা আছে ছোট্ট এক শিশু। এসব গল্প চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো শোনালেও এগুলো ঐতিহাসিক সত্য। তা-ও আবার প্রতিপক্ষের বর্ণনা। বীর এই যোদ্ধার নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাছে আসতেই বর্ণনাকারী দেখতে পেয়েছিলেন, এই যোদ্ধা আর কেউ নন, স্বয়ং ঝাঁসির রানী লক্ষীবাঈ।
মণিকর্ণিকার কথা
লক্ষ্মীবাঈ হয়ে ওঠার আগে তিনি ছিলেন মণিকর্ণিকা, মানু। তার জন্মতারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। একদল ঐতিহাসিক ধারণা করেন, তার জন্ম ১৯ নভেম্বর, ১৮৩৫ সালে। ফলে মৃত্যুকালে তার বয়স দাঁড়ায় ২২ বছর। এই জন্মতারিখ গোয়ালিয়রে তার স্মৃতিসৌধেও লেখা আছে। আবার আরেক দলের ধারণা, তিনি জন্মেছিলেন আরও কয়েক বছর আগে, ১৮২৭-২৮ সালের দিকে। ১৮৩২ সালে তার পরিবার বিথুরে চলে যায়।
১৮৪২ সালে তার বিয়ে হয় মে মাসে। ওদিকে মণিকর্ণিকার বাবা এত ছোট মেয়েকে বিয়ে না দেওয়ার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি ৭ বছরের মেয়েকে বিয়ে দেবেন কি না, সেটা নিয়ে জন্মতারিখ বিতর্কের শুরু হয়। তাছাড়া বলা হয়ে থাকে, মণিকর্ণিকা বড় হয়েছেন তাঁত্য তোপে, নানা সাহেব, রাও সাহেবের সাথে খেলাধুলা করে। সুতরাং তাদের সাথেও বয়সের সামঞ্জস্য করতে গেলে মণিকর্ণিকাকে জন্মাতে হয় ১৮২৭ বা ১৮২৮ সালে। বিথুর যাওয়ার সময়েই তার বয়স ছিল ৪ বছর।
জন্মের পর মাকে হারিয়েছিলেন তিনি। বিথুরের পেশোয়ার দরবারে খেলাধুলা করেই বড় হয়েছেন। পেশোয়া তার চঞ্চল স্বভাবের জন্য তার নাম দিয়েছিলেন ‘ছাবেলি’। সমবয়সী অন্য মেয়েদের তুলনায় মণিকর্ণিকা ছিলেন স্বাধীনচেতা ও দৃঢ়। লেখাপড়ার পাশাপাশি মারাঠা মার্শাল আর্ট, অশ্বারোহণ, তলোয়ার চালানো আর তীরন্দাজির দীক্ষা নিচ্ছিলেন।
লক্ষ্মীবাঈ
বিথুরে লোকেরা আজও আওড়ায় মণিকর্ণিকা আর নানা সাহেবের প্রেমের কথা। বাজিরাও এই সম্পর্ক মানতে নারাজ ছিলেন বলে সম্পর্ক আর এগোয়নি। যদিও এসবের সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।
মণিকর্ণিকা ১৮৪২ সালে ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও নেওয়ালকারকে বিয়ে করে ঝাঁসিতে চলে যান। সেখানে তার নামকরণ করা হয় লক্ষ্মীবাঈ। গঙ্গাধরের আগেও একজন স্ত্রী ছিলেন, যিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। গঙ্গাধর-লক্ষ্মীবাঈয়ের রসায়নকে উপন্যাসের পাতায় অথবা রূপালি পর্দায় যতটাই মধুর করে দেখানো হোক না কেন, তা তৎকালীন দুজন রাজা-রানীর সম্পর্কের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।
গঙ্গাধর এই সম্পর্ক থেকে সবচেয়ে বেশি চেয়েছিলেন একটি সন্তান, তাদের উত্তরাধিকারী। ১৮৫১ সালে লক্ষ্মীবাঈয়ের সন্তান জন্ম নেয়। নাম রাখা হয় দামোদর রাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে মাত্র ৩ মাস বেঁচেছিল। গঙ্গাধরেরও বয়স হচ্ছিল। তারা এক আত্মীয়ের সন্তানকে দত্তক হিসেবে নিয়ে নাম পরিবর্তন করে দামোদর রাও রাখলেন।
‘ডক্ট্রিন অভ ল্যাপ্স’ ও মাতৃভূমি রক্ষার লড়াই
১৮৫৩ সালে রাজা গঙ্গাধর মারা গেলেন। লর্ড ডালহৌসির নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘ডক্ট্রিন অভ ল্যাপস’ এর মতে রাজার দত্তক ছেলে দামোদর রাওকে উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানালো।
ডক্ট্রিন অভ ল্যাপস হলো ডালহৌসির করা ‘বিরাট’ কিছু পদক্ষেপের একটি, যা ভারতবর্ষের ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে। এ নিয়ম অনু্যায়ী, কোনো রাজ্যের রাজা তার নিজের রক্তের কাউকে উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে না গেলে সেই রাজ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের বিদ্রোহকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসার পেছনে ‘ডক্ট্রিন অব ল্যাপ্স’ এর ভূমিকা ছিল। লক্ষ্মীবাঈ এর বিরুদ্ধে আপিল করলেন, ফল হলো না। তাকে পেনশন ও প্রাসাদে থাকতে দেওয়ার বিনিময়ে ঝাঁসির প্রতি কোম্পানির অধিকার বহাল রাখলো।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের দাবানল ছুঁয়ে গিয়েছিল ঝাঁসিকেও। সেখানকার বিদ্রোহীরা ৬০ জনের মতো ইংরেজকে হত্যা করে। রানী তখন তার প্রাসাদে। ক্ষমতাহীন লক্ষ্মীবাঈ, যতদূর প্রমাণ পাওয়া যায়, এই হত্যার সাথে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না।
ইংরেজ সরকার নড়েচড়ে বসল। সিপাহী বিদ্রোহকে শক্ত হাতে দমনের সাথেই ঝাঁসির বিদ্রোহীদের কঠোর সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। শাসনকর্তা প্রভুর পায়ের নিচ থেকে তার জাতভাইকে মেরে ফেলবে, এমন সাহস যেন আর কোনো ভারতীয়ের না হয় এমন উদ্যোগ নেওয়া হতে থাকলো।
১৮৫৮ সালে জেনারেল হিউজ রস তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ঝাঁসি পৌঁছালেন। তাদের যুদ্ধ রানীর বিরুদ্ধে ছিল কি না, অথবা রানী চুপচাপ ঘরে বসে থাকলেও তার সাথে ইংরেজদের বিরোধ বাঁধতো কি না, তার প্রাণসংশয় হতো কি না, তা বলা মুশকিল।
তবে রানী বসে থাকেননি। তিনি নিজেই ঝুঁকি নিলেন। বললেন, “আমি আমার ঝাঁসি কাউকে দেব না!” বলা হয়ে থাকে, রানী বেঁচে গিয়েছিলেন ইংরেজদের সতীদাহ বিলোপ নীতির কারণেই, কিন্তু একসময়ে এসে সেই ইংরেজদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র তোলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই সময়ে সতীদাহ বিলোপ আইন করে হলেও ভারতীয় সমাজ তা মেনে নেয়নি। চাইলেই লক্ষ্মীবাঈকে চিতায় উঠিয়ে দেওয়া যেতো।
কিন্তু গঙ্গাধরও চেয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর লক্ষ্মীবাঈ দামোদরের অভিভাবক হয়ে ঝাঁসি পরিচালনা করার দায়িত্ব নেবে। স্বামীর মৃত্যুতে নিয়মানুযায়ী মাথা না কামিয়ে ফেলে লক্ষ্মীবাঈ প্রতীজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন না তিনি ইংরেজদের অবিচারের প্রতিশোধ নেবেন, ততদিন চুল যেমন আছে, থাকবে।
১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো একটা সময়ে গিয়ে লক্ষ্মীবাঈ উপদেষ্টাদের সাথে মতবিনিময় শেষে ঠিক করেছিলেন ঝাঁসিকে রক্ষা করতে তিনি যুদ্ধ করবেন। কোম্পানির সৈন্যরা দুর্গ দখল করার পথে থাকলেও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। মার্চ পর্যন্ত তিনি বার বার কোম্পানির সেনাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন, যতদিন না দুর্গের পতন হয়। পরাজিত হওয়ার আগমুহূর্তে তার অনুসারীরা যখন দুর্গ ছেড়ে পালাচ্ছিল, তিনি কাঁধে সন্তানকে বেঁধে যুদ্ধ করছিলেন। তার এই সাহসের নিদর্শনকেই বন্দী করা হয়েছে ভাস্কর্যে, চিত্রকলায় ও রূপালি পর্দাতে।
পরাজিত রানী ছেলেকে নিয়েই পালাতে বাধ্য হন। যোগ দেন বিপ্লবীদের সাথে। গোয়ালিয়র ও কালপিতে আবার তার সাথে যুদ্ধ হয় ইংরেজ সেনার।
জুন মাসের ১৭ তারিখ, সেদিন সূর্য কতটা উত্তপ্ত ছিল, ইতিহাস তা মনে রাখেনি। ইংরেজ বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের গর্জনে ভারতীয় যোদ্ধারা লড়াইয়ের উত্তাপ হারাচ্ছিল। তাদের মাঝে উদ্যম ফেরাতে ক্রমাগত সাহস যুগিয়ে যাচ্ছিলেন এক নারী। তার সময় আজ শেষ।
কথিত আছে, রানীকে গোয়ালিয়রের এক তেঁতুল গাছের নিচে সমাহিত করা হয়। আবার এরকম গল্পও প্রচলিত আছে যে, ভীষণরকম আহত রানী ভয় পাচ্ছিলেন, তার মৃতদেহের অসম্মান করবে ইংরেজ সেনারা। তিনি এক সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করেন, মৃত্যুর পর তার দেহ পুড়িয়ে ফেলতে।
প্রশ্ন করা যেতে পারে লক্ষ্মীবাঈয়ের সিদ্ধান্তকে। অবশ্যই তিনি আত্মসমর্পণ করতে পারতেন, তাতে করে বেঁচে যেতে পারত কিছু জীবন, কমে যেতে পারত কিছু ধ্বসস্তুপের সংখ্যা। কিন্তু এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে ইংরেজরা বিপ্লবী সিপাহীদের খুঁজে খুঁজে শাস্তি দিতো না।
রানী সিপাহী বিপ্লবের শুরুতেই গোয়ালিয়র চলে যেতে পারতেন। কিন্তু এর অর্থ হতো ঝাঁসীর বাসিন্দাদেরকে নিজের মুক্তিপণ হিসেবে বলি দেওয়া। একমাত্র লক্ষ্মীবাঈয়ের অধিকার ছিল ঝাঁসি শাসন করার, আর তিনিই শুধু পারতেন তার বিশাল দায়িত্বে অবহেলা করতে। কিন্তু তার উপর আরোপিত অভিযোগ ছিল, যে তিনি সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের নকশা করছেন। তিনি পালিয়ে গেলে তা তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগকে আরো শক্তিশালী করতে পারতো। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো আপোষ তিনি ইংরেজদের সাথে করতে চাননি। তেজস্বী এই রানী নিজের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।