প্রেক্ষাপট
ইউরোপের সব পরাশক্তিই তখন যুদ্ধ করতে ব্যস্ত। এই অবসরে বাণিজ্য চালু রেখে ডাচ অর্থনীতি ক্রমেই ফুলে ফেঁপে উঠছিল। ইংল্যান্ড তখন শাসিত হচ্ছে জেনারেল অলিভার ক্রমওয়েলের কমনওয়েলথ হিসেবে। সাগরে রয়্যাল নেভির দাপটের সাথে পাল্লা দেয়ার শক্তি আছে কেবল ডাচ ফ্লিটের। ক্রমওয়েল তাই ডাচদের নিয়ে কিছুটা চিন্তিত।
মায়ের সূত্রে ডাচ প্রিন্স অফ অরেঞ্জ স্টুয়ার্ট বংশীয়, যাদের উৎখাত করেই ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের কর্তা হয়ে বসেছেন। পালিয়ে যাওয়া রাজতন্ত্র সমর্থকদের অনেকেই নেদারল্যান্ডসে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। তদুপরি ব্রিটিশ নির্বাসিত রাজা দ্বিতীয় চার্লসও আস্তানা করেছেন নেদারল্যান্ডসের ব্রেডা শহরে, মতলব করছেন সিংহাসন ফিরিয়ে নেয়ার।
ক্রমওয়েল ডাচদের সাথে জোট করতে ইচ্ছুক ছিলেন, তবে তার চিন্তায় সেখানে ইংল্যান্ডেই হবে সর্বেসর্বা। ডাচদের অর্থনীতির উপর চাপ প্রয়োগ করতে ইংল্যান্ডের জলসীমায় মাছ শিকার এবং অন্যান্য কারণ দেখিয়ে বার্ষিক ৩০,০০০ পাউন্ড কর ক্রমওয়েল দাবি করে বসেন। সেই সাথে ইংল্যান্ড যুদ্ধাবস্থায় থাকাকালে ডাচসহ যেকোনো জাহাজ ইংল্যান্ডের জলসীমায় ঢুকলে তল্লাশি করবার অধিকার রয়্যাল নেভির আছে বলে জানিয়ে দেন
ডাচরা প্রতিবাদ করল। তাদের কথা ছিল- রীতি অনুযায়ী একটি দেশের পতাকাবাহী জাহাজে এভাবে তল্লাশি চালানো নিয়মবিরুদ্ধ। ডাচদের সাথে আলোচনা করতে ক্রমওয়েল ১৬৪৯ সালে তার দূত হিসেবে ডরিস্লাসকে পাঠালেন। কিন্তু সেখানে ওঁত পেতে থাকা ব্রিটিশ রাজতন্ত্র সমর্থকদের হাতে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন।
ক্রমওয়েল একে ছুতো দেখিয়ে যুদ্ধ শুরু করতে পারতেন। তবে তা না করে তিনি ১৬৫১ সালের মার্চে সেন্ট জন আর স্ট্রিকল্যান্ডকে নতুন দূত করে পাঠালেন। কিন্তু ইতোমধ্যে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র সমর্থকরা অরেঞ্জিস্টদের সাথে জোট পাকিয়ে নানাভাবে জনগণের মন ক্রমওয়েলের প্রতি বিষিয়ে তুলেছে। এস্টেট জেনারেলরা ক্রমওয়েলের দূতদের আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে নিলেও জনতার মনোভাব বুঝে খুব বেশি উৎসাহ দেখালেন না। তবে ডরিস্লাসের কথা মাথায় রেখে তাদের জন্য বিশেষ প্রহরার ব্যবস্থা নেয়া হলো।
ব্রিটিশ দূতরা অন্যান্য দাবির সাথে দ্বিতীয় চার্লসকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার দাবি করেন, কিন্তু অরেঞ্জিস্টদের বিরোধিতার মুখে তারা ব্যর্থ হন। দূতদের সাথে শীতল আচরণ করা হয়। তারা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দেশে ফিরে গেলে আগস্টের ৪ তারিখে নেভিগেশন আইন প্রবর্তন করা হল। এতে ইংল্যান্ডে ডাচ বানিজ্য বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি রয়্যাল নেভিকে বিদেশী জাহাজের বিষয়ে অভূতপূর্ব ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
ডাচ এস্টেট জেনারেলরা বুঝতে পারলেন ব্রিটিশদের সাথে সংঘাত এড়ানো যাবে না। তারা নৌবাহিনীর ৭৬টি জাহাজের সাথে নতুন আরো ১৫০টি জাহাজ যোগ করলেন।
ডোভারের নৌযুদ্ধ
১০ মে, ১৬৫২।
ডাচ নৌবাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট অ্যাডমিরাল (অন্যান্য দেশের অ্যাডমিরাল পদমর্যাদার সমমানের) মার্টেন ট্রম্পের কাছে এস্টেট জেনারেলদের নির্দেশ পৌঁছল। তিনি তখন ঝড়ের কবলে পড়ে ইংল্যান্ডের ডোভার উপসাগরে নোঙ্গর কবরেছেন। তার উপর আদেশ এলো ডাচ বানিজ্য জাহাজে তল্লাশির যেকোন চেষ্টা প্রতিহত করবার। মে’র ১৫ তারিখ ট্রম্প সব ক্যাপ্টেনদের এই আদেশ জানিয়ে দেন।১৯ মে ডোভার ত্যাগ করে ট্রম্প রওনা হলেন ফ্রান্সের ক্যালাইস বন্দরের দিকে। পথে তার কাছে খবর আসল ব্রিটিশরা নাকি ডাচ বানিজ্য জাহাজের উপর আক্রমণ করেছে। পরবর্তীতে প্রমাণ হয় এই সংবাদ ছিল অতিরঞ্জিত।
১৯ মে, ১৬৫২। ডোভারের উপকূল। গুডউইন স্যান্ডস সৈকতের নিকটবর্তী সাগর।
অ্যাডমিরাল ব্লেকের ব্রিটিশ নৌবহর টহল দিচ্ছিল সমুদ্রে। বিকাল চারটার দিকে ডাচ যুদ্ধজাহাজ দেখে তিনি তিনবার কামান দেগে ট্রম্পকে সতর্কবার্তা দিলেন তার পতাকা নামিয়ে নিতে। তৎকালীন ইংল্যান্ডের নিয়মই ছিল তাদের জলসীমায় কোনো জাহাজ ঢুকলে পতাকা নামিয়ে নিতে হবে। ট্রম্প লড়াইয়ের সংকেত হিসেবে লাল পতাকা তুলে ধরলেন। ব্লেকের জাহাজ জেমসে’র উপর সরাসরি কামান দাগলেন তিনি।এতে ছয়জন নাবিক নিহত আর ৩৫ জন গুরুতর আহত হয়। এই লড়াই পরিচিত ব্যাটল অফ ডোভার (Battle of Dover / Battle of Goodwin Sands) নামে।
চার ঘণ্টা লড়াইয়ের পর ট্রম্প একটি শত্রুজাহাজ দখল করেন আর একটি ডুবিয়ে দেন। ব্রিটিশরাও দুটি ডাচ জাহাজ ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়, তবে জাহাজগুলো তারা টেনে নিয়ে যেতে পারেনি। ২৫০ জন ডাচ নাবিককেও তারা বন্দি করে। শেষপর্যন্ত যুদ্ধ অনেকটা অমীমাংসিত থেকে যায়। তবে ব্লেক পিছিয়ে যাওয়ায় অনেকে একে ট্রম্পের বিজয় বলেও বর্ণনা করেন।
এই সংঘর্ষের সূত্র ধরেই আরম্ভ হলো ইংল্যান্ড আর গ্র্যান্ড পেনশনার ডি উইটের নেতৃত্বাধীন ডাচ প্রজাতন্ত্রের সংঘাত। লন্ডনে তখন আলোচনার জন্য অবস্থান করছিলেন ডি উইটের প্রতিনিধিরা। যুদ্ধ ঘোষিত হলে দ্রুত তারা শহর ত্যাগ করলেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ পরিচিত প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধ নামে।
ডাচ নৌবাহিনীর গতিবিধি
ডাচ দূতেরা পুরোপুরি খালি হাতে লন্ডন ত্যাগ করেননি। ব্রিটিশদের সমরপরিকল্পনার কিছু আভাস তাদের কানে এসেছিল। তারা জানতে পেরেছিলেন রয়্যাল নেভির কর্মকর্তা স্যার জর্জ আয়েস্কুকে ইংলিশ চ্যানেলে প্রবেশ করা যেকোনো ডাচ জাহাজের উপর আক্রমণের দায়িত্ব দেয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে। আয়েস্কু রাজতন্ত্রপন্থীদের হটিয়ে বারবাডোস ক্রমওয়েলের ইংল্যান্ডের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন। তাকে ২১টি জাহাজ দেয়া হলো ডাচদের মোকাবেলা করতে। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বে ডাউনস অঞ্চলের উপকূলে তিনি প্রস্ততি নিতে থাকলেন।
এদিকে অ্যাডমিরাল ব্লেকের উপর ২০ জুন নির্দেশ এলো উত্তর সাগরের দিকে পাল তোলার। ইস্ট ইন্ডিজ থেকে মাল বোঝাই ডাচ বাণিজ্য জাহাজ সেদিক দিয়েই নেদারল্যান্ডসের পথে যাচ্ছে। ব্লেকের কাজ হবে তাদের থেকে মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে ডাচদের অর্থনীতির উপর ধাক্কা দেয়া। এরপর বাল্টিক সাগর বরাবর অবরোধ আরোপ করে ডাচ জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে। তবে সব কিছুর সাথে ব্রিটিশ জলসীমায় ডাচ মাছধরা জাহাজের ব্যবস্থা করার নির্দেশও ছিল।
৬৬-৬৮টি জাহাজের বহর নিয়ে ব্লেক ২৪ জুন চললেন স্কটল্যান্ডের উত্তরে শেটল্যান্ড দ্বীপপপুঞ্জ বরাবর। সেখানে অবস্থান করছিল যুদ্ধজাহাজের পাহারায় ১০০ ডাচ মাছ ধরা জাহাজ। ব্লেক তার সৈনিকদের কড়া নির্দেশ দিলেন আক্রমণ যেন শুধু ডাচ যুদ্ধজাহাজের উপরেই সীমাবদ্ধ থাকে। জুলাই মাসেই তিনি শেটল্যান্ডের কাছে এসে পড়লেন।
ব্লেক আর আয়েস্কুর নেতৃত্বে নৌবহর দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় ইংল্যান্ডের আশেপাশের সাগরের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ট্রম্প এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলেন। ৭০টি জাহাজ নিয়ে তিনি আয়েস্কুর খোঁজ লাগান। ১৪ জুলাই ডাউনসের উপকূলে এসে শান্ত সাগর দেখে অনুকূল বাতাসের প্রতিক্ষায় থাকলেন ট্রম্প। কিন্তু বিধি বাম! প্রথমে উঠল ঝড়, তারপর ২২ জুলাই থেকে বাতাস বইতে লাগল ডাউনসের উল্টোদিকে। এর মধ্যে সংবাদ এলো ব্লেক শেটল্যান্ডে ডাচ বাণিজ্য জাহাজের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছেন। ফলে ট্রম্প বাধ্য হন তাকে অনুসরণ করতে। কিন্তু ব্লেক তার অনেক আগেই শেটল্যান্ডে পৌঁছে গেছেন। ডাচ সমস্ত জাহাজের ধরা মাছ বাজেয়াপ্ত করে তিনি তাদের তিনি বাড়ির পথ ধরিয়ে দিলেন।
শেটল্যান্ডে থাকাকালীনই ট্রম্পের বহরের সাথে ব্লেকের দেখা হয়ে গেল। আগস্টের ৫ তারিখে যখন তারা মুখোমুখি হন তখন বেরসিকের মতো বাগড়া দিল ঝড়। ব্লেকের বহর ছিল তীরের দিকে, ফলে তিনি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন। কিন্তু ডাচরা খোলা সাগরে, ফলে তাদের প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতি হলো। এর সাথে যোগ হয় অপ্রতুল রসদপত্র এবং নাবিকদের মাঝে স্কার্ভি রোগের প্রাদুর্ভাব। এসব কারণে ট্রম্প বাড়ির পথ ধরলেন। সেখানে তাকে কম্যান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা উঠল।
এদিকে স্পেনের কাদিজ বন্দরে রৌপ্য বহনকারী ডাচ জাহাজের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়ে ২৫ জুলাই এস্টেট জেনারেলদের কাছে আমস্টারডাম থেকে ডাচ নৌবাহিনীর পত্র এসে পৌঁছে। রৌপ্যের এই চালান ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর অর্থমূল্য ছিল তৎকালীন মুদ্রায় প্রায় পনের থেকে ষোল মিলিয়ন গিল্ডার (ডাচ মুদ্রা, ৮-৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ)। এই অর্থ যুদ্ধ চালাতে খুব কাজে দিত।
এস্টেট জেনারেলরা রৌপ্যবাহী জাহাজের প্রতিরক্ষার জন্য উপযুক্ত মনে করলেন মিখিয়েল ডি রুইটারকে। ডি রুইটার নিজেকে এই দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য মনে করতেন না। ফলে প্রথমে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তবে শেষাবধি ডি উইট এবং অন্যান্য এস্টেট জেনারেলদের চাপাচাপিতে তিনি রাজি হন। জিল্যান্ডের নৌবাহিনীর একটি বহর তার হাতে তুলে দেয়া হলো। এই বহরের নাম ছিল ডাইরেক্টর’স শিপ। কাদিজে থাকা ডাচ জাহাজগুলোকে আদেশ দেয়া হল ২৭ জুন রওনা দিয়ে ডি রুইটারের সাথে মাঝপথে মিলিত হতে।
২৯ জুন ডি রুইটারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ডাইরেক্টর শিপে’র কমান্ড হস্তান্তর করা হলো। কথা ছিল- নেদারল্যান্ডস থেকে বের হওয়া এক বাণিজ্য বহর পাহারা দিয়ে ডি রুইটার ইংলিশ চ্যানেল পার করে দেবেন। এরপর দুটি যুদ্ধজাহাজ সেই বহরের সাথে রেখে ফিরতি পথে এসে অপেক্ষায় থাকবেন কাদিজের বহরের জন্য। যদি কোনোভাবে কাদিজের বহরের দেখা তিনি ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে যাবার পথেই পেয়ে যান, তাহলে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়াই হবে তার মুখ্য কাজ। সেক্ষেত্রে অন্য বহরের সাথে আগের মতো দুটি যুদ্ধজাহাজ দিয়ে তিনি মূল বাহিনী নিয়ে রৌপ্যবাহী বহরকে সুরক্ষা দেবেন।
১০ আগস্ট, ১৬৫২।
নেপচুনাস জাহাজে পতাকা তুলে ডি রুইটার যাত্রা করলেন। মাত্র ২৮টি কামান আর ১৩৪ জন নাবিক নেপচুনাসের সম্বল। তার সাথে ধীরে ধীরে যোগ দেয় আরো ৩৬টি জাহাজ। এর মধ্যে ছয়টি ছিল ফায়ারশিপ, তার মানে নানারকম দাহ্য পদার্থ দিয়ে এই জাহাজগুলো ভর্তি করা। লড়াইয়ের সময় ফায়ারশিপে আগুন ধরিয়ে শত্রুর দিকে পাঠিয়ে দেয়া হতো। সেখানে ফায়ারশিপ বিস্ফোরিত হয়ে শত্রুবহরের ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম ছিল।
ডাউনসে থাকাকালীন আয়েস্কুর হাতে ছিল ৪০টি জাহাজ। ব্রিটিশ জাহাজ ছিল আকারে বড় এবং অস্ত্রশস্ত্রে ভারি। তাদের নাবিক ও সৈনিকেরাও পোড়খাওয়া। খোলা সাগরে ব্রিটিশ জাহাজের শক্তি ডাচ জাহাজের থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক। অন্যদিকে ডি রুইটারের বহরের অধিকাংশ জাহাজই তাড়াহুড়ো করে যুদ্ধের জন্য নামানো হয়েছে। ব্রিটিশদের থেকে এসব জাহাজ অনেক নিচুমানের, এবং তাদের রসদপত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামও পর্যাপ্ত নয়। এই নিয়েই ৩০টি বাণিজ্য জাহাজ পাহারা দিয়ে ডি রুইটার নেদারল্যান্ডস ত্যাগ করে ইংলিশ চ্যানেলের রাস্তা ধরলেন।
ব্যাটল অফ প্লাইমাউথ
২৬ আগস্ট, ১৬৫২ সাল। ইংলিশ চ্যানেলের তীর ধরে প্লাইমাউথ বন্দর।
ডাচ বাণিজ্য জাহাজ পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন ডি রুইটার। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। আয়েস্কু কাছেপিঠেই আছেন। দেখা হলে যে যুদ্ধ অনিবার্য তা বলে দিতে হবে না। ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়’ প্রবাদবাক্যের মতো ব্রিটিশ পতাকা ভেসে উঠল দিগন্তে।
এখানে একটা শব্দ চলে আসে, যা পালতোলা জাহাজের যুগে নৌযুদ্ধের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেটা হলো ওয়েদার গেজ (weather gage)। নৌযুদ্ধে কোনো পক্ষ ওয়েদার গেজ পাচ্ছে বলে বোঝানো হতো বাতাস তার অনুকূলে এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থাও তার জন্য সুবিধাজনক। কাজেই পালতোলা যুদ্ধজাহাজের কমান্ডাররা নিজেদের পক্ষে ওয়েদার গেজের জন্য অপেক্ষা করতেন। যে পক্ষ আগে ওয়েদার গেজ পেয়ে যেত তারাই সাধারণত আক্রমণ করত।
ডি রুইটার যখন আয়েস্কুকে দেখতে পেলেন তখন ওয়েদার গেজ ছিল ব্রিটিশদের অনুকূলে। ডি রুইটার দ্রুত নিজের রণকৌশল ঠিক করে নিলেন। নিজের ৩০টি যুদ্ধজাহাজ দশটি করে তিন ভাগে ভাগ করে দিলেন তিনি। ভ্যান ডেন ব্রোয়েককে দিলেন ভ্যান বা সম্মুখভাগের দায়িত্ব, আর ভারহ্যাফকে দিলেন রিয়ার বা পশ্চাৎঅংশের ভার। মধ্যভাগ বা সেন্টার থাকল ডি রুইটারের কম্যান্ডে। প্রতিটি ভাগের পেছনে ২০টি করে বাণিজ্য জাহাজ রাখা হলো। তাদের কয়েকটির মধ্যে কিছু কামানও ছিল। প্রত্যেক ভাগের সাথে দুটি করে ফায়ারশিপও যুক্ত করা হলো।
বিকাল চারটায় শুরু হলো লড়াই। ডি রুইটার দুবার নেপচুনাস নিয়ে ব্রিটিশ ব্যুহ ভেদ করেন। ফলে শত্রুদের কামানের গোলায় নেপচুনাস মোটামুটি ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ডাচ ক্যাপ্টেনরাও বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করছিল। জনশ্রুতি আছে ডাউ ইয়ুক্স নামে এক ক্যাপ্টেনের অধীনে ভগুল স্ত্রুইস জাহাজ দুটি ব্রিটিশ রণতরীর আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে এর নাবিকেরা আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দিতে থাকে। ইয়ুক্স তখন জ্বলন্ত মশাল হাতে গোলাবারুদের স্তূপে দাঁড়িয়ে হুমকি দেন আত্মসমর্পণের আগে তিনি জাহাজ উড়িয়ে দেবেন। নাবিকেরা তার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে নতুন উদ্যমে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রাত হয়ে গেলে আয়েস্কু পিছিয়ে যান। তার নিজের জাহাজও খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই পরদিন তিনি আর লড়াইয়ে নামেননি। ফলে ডাচরা একে তাদের বিজয় বলে দাবি করে। তাদের নথি অনুযায়ী তিনটি ব্রিটিশ জাহাজ আর প্রায় ১,৩০০ নাবিক তারা ডুবিয়ে দিয়েছে। একই রেকর্ডে তাদের ১০০ জন নাবিক ও অফিসার এই সংঘাতে হতাহত হয় বলে লেখা আছে।
অন্যদিকে, ব্রিটিশরা এই সংঘাত অমীমাংসিত বলে নথিবদ্ধ করে। তাদের রেকর্ডে বলা হয়- তিনটি ডাচ জাহাজ আয়েস্কু ডুবিয়ে দেন, আরো তিনটি খারাপভাবে বিধ্বস্ত হয়। সত্যিকার অর্থে প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধে দুই পক্ষের দিক থেকে যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে মতদ্বৈততার ঘটনা ছিল খুব সাধারণ।