বিশ্বের দীর্ঘতম কিছু যানজট

যানজট, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা এক ভোগান্তির নাম। যানজটে পড়েনি এমন মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশের মোটামুটি প্রায় সব বড় বড় শহর ও মহাসড়কে (বিশেষত সংযোগস্থলে) অল্পবিস্তর যানজট লেগেই থাকে। অবশ্য বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এরকম দেখা যায়। কোথাও কোথাও এটা নৈমিত্তিক একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়; যেমন- ব্রাজিলের সাও পাওলো কিংবা চীনের বেইজিং শহর।

ব্যস্ততম সময়ে যানজটের রাজধানী বলে পরিচিত বেইজিং শহরের গুয়োমাও ব্রিজ; source: Reuters/scmp.com

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট; ছবিটি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পবিত্র ঈদ-উল আযহার আগে তোলা; source: daily-sun.com

বাংলাদেশে বড় পরিসরে যানজট লাগে মূলত দুই ঈদে। যখন সবাই শেকড়ের টানে, স্বজনসকাশে পাড়ি জমায় তার আপন ঠিকানায়। এছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতেও মাঝে মাঝে যানজট সৃষ্টি হয়। এদেশের যানজটের ব্যাপারে কম-বেশি আমরা সবাই জানি। এবার চলুন জেনে আসি বিশ্বের অন্যান্য দেশের কিছু ‘বিখ্যাত’ হয়ে ওঠা যানজট সম্পর্কে।

বেইজিংয়ের বারো দিনের স্থবিরতা

চিন্তা করুন তো একবার, ৬২ মাইল দীর্ঘ এক যানজটে আটকে আছেন পাক্কা ১২ দিন ধরে! শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও ২০১০ সালের আগস্ট মাসে চীনে এরকমই এক যানজটে নাকাল হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। আগস্টের ১৪ তারিখে শুরু হওয়া এই ‘মেগাজটে’ চীনের প্রধান প্রধান কিছু মহাসড়ক সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ছিল বেইজিং-তিব্বতের সংযোগকারী একটি এক্সপ্রেসওয়ে (G6)।

কী সড়ক, কী উড়াল সড়ক… সর্বত্রই স্থবিরতা; source: yahoo.com

এমনও হয়েছে যে, কোনো কোনো চালক দিনে মাত্র এক কিলোমিটার এগোতে পেরেছেন। আবার কেউ কেউ পাঁচদিন ধরে এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছেন গাড়ি নিয়ে!

মহাসড়কে আটকে আছে শত শত যানবাহন। ছবিটি ২৪ আগস্ট চীনের উত্তর হেবেই প্রদেশ থেকে তোলা; source: Alexander F. Yuan/AP Photo

মূলত এই যানজটটি লাগে একসাথে বেশ কয়েকটি সড়কের সংস্কার কাজ হাতে নেওয়ার কারণে। ফলে মহাসড়কগুলোর সক্ষমতা প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে আসে। এছাড়া সড়ক সংস্কারের কাজে ব্যবহৃত মালবাহী ট্রাকগুলো তো আছেই; ঠিক প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই ট্রাকগুলো।

কথায় আছে না, কারো পৌষ মাস আবার কারো সর্বনাশ। এই দীর্ঘ জট স্থানীয়দের জন্য শাপে বর হয়ে এসেছিল। দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকা চালক ও যাত্রীদের কাছে তারা চড়া মূল্যে পানি, ইন্সট্যান্ট নুডুলস, সিগারেট ও অন্যান্য নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিক্রি করতে লাগলো। নিরুপায় হয়ে আটকে থাকা মানুষদের ১ ইউয়ান (চীনের মুদ্রা) মূল্যের পানির বোতল ১৫ ইউয়ানে কিনতে হচ্ছিল।

বেইজিং-তিব্বত মহাসড়কে আটকে থাকা ট্রাকের নিচে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন এক ব্যক্তি; source: The Associated Press

এই শেষ নয়, ২০১৫ সালের অক্টোবরে চীনে মোটামুটি বিশাল আরেকটি জট লাগে ৫০ লেনের বেইজিং-হংকং-ম্যাকাউ এক্সপ্রেসওয়েতে। ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই উপলক্ষে ১ থেকে ৭ অক্টোবর চীনে পালন করা হয় Golden Week। ২০১৫ সালে Golden Week-এর ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার পথে একটি টোল প্লাজার সামনে এসে জটটি লাগে। মূলত ৫০ লেনের মহাসড়কটি টোল প্লাজার ওপাশে মাত্র (!) ২০ লেনে নেমে আসায় তৈরি হয় এই যানজট।

শত শত গাড়ি, সারি সারি লেনে; source: China Foto Press/Getty Images

জাপানের চুরাশি মাইলের দীর্ঘ জট

জাপানীরা সাধারণত আগস্ট মাসে ছুটিছাটা নিয়ে থাকে। ১৯৯০ সালেও নিয়েছিল তারা। কিন্তু সেবার তাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল জাপানের ইতিহাসের স্মরণাতীত ৮৪ মাইল দীর্ঘ জটের। রেকর্ড সৃষ্টিকারী এই যানজট লাগে কানসাই অঞ্চলের হিয়োগো ও শিগা শহরের সংযোগকারী মহাসড়কে। প্রায় পনেরো হাজার যানবাহন আটকা পড়ে ১২ আগস্টের মহা যানজটে।

৮৪ মাইল স্থবিরতার কিছু অংশ; source: alltop9.com

জাপানীরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার জন্য ‘ও-বোন’ নামের একটা উৎসব করে এ সময়। প্রায় সপ্তাহব্যাপী চলা এই উৎসবটি জাপানিজদের ‘The Festival of the Dead’ নামে পরিচিত। এই উৎসবের মাঝে জারি করা হয় এক শক্তিশালী টাইফুনের সতর্কবার্তা। টাইফুন উইনোনা ধেয়ে আসতে থাকে জাপানের দিকে। উৎসব আর আতংক- এই দুইয়ে ভর করে মানুষ বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। ব্যস, আর যায় কোথায়! লেগে গেলো প্রায় ১৩৫ কিলোমিটারের এক বিশাল যানজট।

যানজটে নাকাল জাপানিরা; source: ullstein bild/Getty Images

একীভূত দুই জার্মানির ত্রিশ মাইলের জট

বিভেদের জার্মান প্রাচীর ভেঙে গেছে ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর। স্বজনসকাশে মিলিত হবার অপেক্ষায় দীর্ঘকাল (প্রায় চল্লিশ বছর) বিভাজিত হয়ে থাকা জার্মানরা। ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে ইস্টারের চার দিনের ছুটিতে তারা পেল সেই সুযোগ। সবাই একসাথে বেরিয়ে এল রাস্তায়। সদ্য একীভূত হওয়া দুই জার্মানির সীমান্তে লেগে গেলো প্রায় ৪৮ কিলোমিটারের দীর্ঘ জট।

বার্লিনে অবস্থিত মিত্রপক্ষের (২য় মহাযুদ্ধের) একটি চেকপোস্টের সামনে দীর্ঘ জট; source: Rainer Klostermeier/AP Photo

যে সড়ক প্রায় ৫ লক্ষ গাড়ি ধারণ করতে সক্ষম, সেই সড়কে নেমে এলো প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ গাড়ি! এটি ছিল যানজটে আটকে থাকা সর্বাধিক গাড়ির গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড।

সাইন বোর্ডে জার্মান ভাষায় লেখা STAU মানে কী জানেন? ইংরেজিতে ‘Traffic Jam’; source’: forbes.com

৩০ মাইলের দীর্ঘ জটের একাংশ; source: ullstein bild/Getty Images

সাও পাওলোর যানজট

ব্রাজিলের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং একইসাথে সম্পদশালী আলফা ক্যাটাগরির শহর সাও পাওলো। এই শহরে যানজটের রেকর্ড হরহামেশাই হয়। ২০০৯ সালের জুন মাসে ১৮২ মাইল লম্বা এক যানজটে নাকাল হয় সাও পাওলোবাসী।

২০০৯ সালের জুন মাসে সংঘটিত হয় শত শত কিলোমিটারব্যাপী এক সুদীর্ঘ যানজট; source: alltop9.com

২০১৩ সালের নভেম্বরে বাধে আরো একটি দীর্ঘ জট। এটি (প্রায়) সাড়ে চার বছর আগেরটার থেকেও দীর্ঘ ছিল। প্রায় ৩০৯ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল গাড়ির সারি।

১৯২ মাইলেরও অধিক জটে আটকা পড়ে আছে ব্রাজিলবাসী; source: Levi Bianco/Flickr Vision/Getty Images

বেথেল উৎসবের যানজট

সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, ৫০ হাজার মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। কিন্তু Woodstock Music & Arts Festival-এ দলে দলে চলে আসে পাঁচ লক্ষাধিক আগ্রহী। একদিকে যেমন ছিল আগস্টের বৃষ্টি, তেমনি ছিল কর্দমাক্ত রাস্তা। তার উপর ছিল গাড়ির প্রচণ্ড চাপ। ফলে নিউইয়র্ক স্টেটের মহাসড়কে তৈরি হয় ২০ মাইল লম্বা এক জট। নিউইয়র্কের বেথেল শহর আটকে যায় হাজার হাজার গাড়ির উপস্থিতিতে।

গাড়ি জটে আটকা লাখ লাখ মানুষ; source: yahoo.com

উৎসব চলার পুরোটা সময় (১৫ থেকে ১৮ আগস্ট) জুড়ে এই যানজট লেগে ছিল। মানুষজন তাদের গাড়ি রেখে হেঁটে হেঁটে রওয়ানা হয়, কেউ আবার গাড়ির বনেটেই নিজেরা সঙ্গীত ‘আসর’ বসিয়ে দেয়।

বৃষ্টিস্নাত রাতের পর কাদামাখা রাস্তা ধরে ফিরছে সংগীত অনুরাগীরা; source: AP Photo

কী আর করা! নিজেরাই তাই গান করছেন বসে; হাঁটু মুড়ে গান শুনছে কেউ; source: pinterest.com

তবে একটা কথা ঠিক যে, এই উৎসবে আসা বেশিরভাগ মানুষ ছিল সে সময় চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও এতে আমেরিকার অংশগ্রহণের বিপক্ষে। উৎসবটিও ছিল যুদ্ধবিরোধী চেতনার স্বপক্ষে। ১৯৬৯ সালে সংগঠিত এই দীর্ঘ জটের কারণে উৎসবে আসা শিল্পী-কলাকুশলীদের যাতায়াতের বাহন ছিল আকাশপথের হেলিকপ্টার।

উৎসবটি আয়োজন করা হয় ম্যাক্স ইয়াসগুর নামের এক স্থানীয় গরুর খামারির জমিতে। এটি ছিল কনসার্টের প্রথম দিনের ছবি; source: pinterest.com

হিউস্টনের একশ মাইলের দীর্ঘ সারি

২০০৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হিউস্টনের বাসিন্দাদের বলা হল দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাবার জন্য। কারণ তাদের দিকে ধেয়ে আসছে এক শক্তিশালী ট্রপিক্যাল হারিকেন রিটা। ক্যাটাগরি পাঁচের এই হারিকেন প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতি করে ক্ষান্ত হয়েছিল।

মেক্সিকো উপসাগরে সৃষ্ট হারিকেন রিটা ছিল তীব্রতার দিক থেকে চতুর্থ ভয়ানক আটলান্টিক হারিকেন। এটি ২১ সেপ্টেম্বরে রিটার অবস্থানের ছবি source: nasa.gov

কর্তৃপক্ষের জোর প্রচারণার কারণে মানুষজন তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া শুরু করে। হিউস্টনের প্রায় ২৫ লক্ষ লোক নেমে আসে টেক্সাসের ইন্টারস্টেট ৪৫ মহাসড়কে। ফলে ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা আর ঘন্টায় ১৪০ মাইল গতিতে বয়ে যাওয়া বাতাসের মাঝে তৈরি হয় প্রায় ১০০ মাইল লম্বা গাড়ির জট।

গাড়িতে আটকা পড়া লক্ষ লক্ষ মানুষ; পেছনে ধেয়ে আসছে শক্তিশালী এক হারিকেন source: destinationtips.com

প্রায় ৪৮ ঘন্টা স্থায়ী হয়েছিল এই যানজটটি। হিউস্টনবাসীর ভাগ্য ভালো ছিল। কারণ হারিকেন রিটা তার গতিপথ পাল্টে উত্তর-পূর্ব দিকে চলে যায়। কী অবস্থা হত, যদি সে তার পূর্ণশক্তি নিয়ে আঘাত হানতো টেক্সাসের এই মহাসড়কে!

source: AP Photo/The Houston Chronicle, Johnny Hanson

লিয়োঁ-প্যারিসের শত মাইলের দীর্ঘতম জট

১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শীতের বন্ধে ভ্রমণপ্রিয় ফরাসীরা গেলো সুইস আল্পসে স্কি করার জন্য। কিন্তু যখন ফিরলো তাদের প্রাণের শহর প্যারিসে, বাঁধিয়ে দিলো ১০৯ মাইলের এক সুদীর্ঘ যানজট। শুধু তা-ই নয়, তৈরি করলো একটি বিশ্বরেকর্ডও। যানজটের ব্যাপ্তির দিক থেকে এটি ছিল একটি গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড।

সারি সারি গাড়ি আছে দাঁড়িয়ে source: forbes.com

লিয়োঁ থেকে প্যারিসের দিকে তৈরি হওয়া এই যানজট নিয়ে অনেকেই কৌতুক করে বলেন যে, যারা সুইস আল্পসে স্কি করতে গিয়েছিলেন তারা যদি স্কি করেই কোনোভাবে ফিরতে পারতেন, তাহলে বাড়ি ফিরতে সময় অনেক কম লাগতো তাদের!

source: Getty Images/mirror.co.uk

রাশিয়ার একশ পঁচিশ মাইলের ‘তুষারজট’

২০১২ সালের নভেম্বরের শেষে রাশিয়ায় প্রবল তুষারপাত হয়। ফলে সেইন্ট পিটার্সবার্গ ও মস্কোর মধ্যবর্তী এম-১০ মহাসড়কে লেগে যায় যানবাহনের এক বিশাল জট। প্রায় ১২৫ মাইল মহাসড়ক জুড়ে টানা তিনদিন হাজার হাজার মানুষ আটকে ছিল এই প্রবল তুষারপাতের ভেতর।

টানা তিনদিন এভাবেই আটকে ছিল প্রবল তুষারপাতের মধ্যে source: Rex/mirror.co.uk

রাশিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা রিয়া নভোস্তির তথ্যমতে, শুক্রবার শুরু হওয়া এই তুষারজট রবিবার অবধি বজায় ছিল। অবস্থা আস্তে আস্তে এতই খারাপের দিকে যেতে থাকে যে, রাশিয়ার সরকার রাস্তার পাশে তাবু খাঁটিয়ে আটকে পড়া চালক ও যাত্রীদের খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করে। এমনকি মানসিকভাবে পরিশ্রান্তদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল।

শিকাগোর বরফাচ্ছাদিত যানজট

২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রেকর্ড ২০ ইঞ্চি তুষারপাত হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। তুষারপাতের ভয়ানক প্রভাব পড়ে সন্ধ্যাবেলার ব্যস্ত সময়ে। চারিদিকে ধবধবে সাদা বরফের ধাঁধায় একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হয় অসংখ্য গাড়ি।

বরফের ‘কবরে’ শিকাগোর লেক শোর ড্রাইভ source: Kiichiro Sato/AP Photo

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয় লেক শোর ড্রাইভে। শিকাগোর বাণিজ্যিক  এলাকা থেকে এখানে আসা সব গাড়ি ছিল বরফে আচ্ছাদিত। ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় এভাবেই আটকে ছিল শত শত গাড়ি।

source: Scott Olson/Getty Images

ফিচার ইমেজ- The Daily Star

Related Articles

Exit mobile version