জাপানের সাথে কোরিয়ার রয়েছে রক্তক্ষয়ী তিক্ত এক ইতিহাস। বর্তমানে কোরিয়া উপদ্বীপ উত্তর ও দক্ষিণ অংশে বিভক্ত হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তারা অবিভক্ত অবস্থাতেই ছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগের ৩৫ বছর কোরিয়া উপদ্বীপ ছিল জাপানের উপনিবেশ। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে জাপানের উপনিবেশ থাকার সময়ে কোরিয়া উপদ্বীপকে জাপানিদের অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।
গত শতাব্দীর শুরুর দিকে সাম্রাজ্যবাদী জাপান বিশ্বজুড়ে তাদের কর্তৃত্ব বিকাশের লক্ষ্যে বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এশিয়ায় তাদের আগ্রাসী অবস্থান নেওয়ার সময় চীন ও রাশিয়াকে সামরিক দিক দিয়ে পরাজিত করে এবং পুরো কোরিয়া উপদ্বীপের দখল নিয়ে নেয়। ১৯১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দখল নিয়ে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পন করার আগপর্যন্ত কোরিয়া উপদ্বীপে চলে জাপানিদের নির্মম শাসন।
এ সময় কোরীয়দের জাপানি নামে পরিচিত হওয়া লাগত। স্কুলে কিংবা কর্মক্ষেত্রে জাপানি নাম ব্যবহার করতে হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কোরীয় পুরুষদের জাপানি ফ্যাক্টরি ও খনিতে কাজ করতে হতো। সাম্রাজ্যবাদী জাপানের সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে লড়তে হতো। নারীদের বাধ্য করা হতো জাপানি সৈনিকদের দাস হিসেবে কাজ করার জন্য, যাদের বলা হতো ‘কমফোর্ট উইমেন’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের পরাজয় হলে দুই কোরিয়া ভাগ হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যায়। তবে জাপানিদের অতীতের কীর্তি ভুলে যায়নি কোরীয়রা। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়া শুরু থেকেই তাদের নেতাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবী হিসেবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করে আসছে। জাপানবিরোধী ঘৃণার মনোভাব জনগণকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সাহায্য করছে। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় এখনো জাপানিদের প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবে দেখানো হয়। প্রায়ই হুমকি দেওয়া হয় তাদেরকে পারমাণবিক বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার।
তবে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা মেশিন যে বিষয়টা এড়িয়ে যায় তা হলো, বর্তমান নেতা কিম জং উনের সাথে জাপানের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। তার মায়ের জন্ম কিন্তু জাপানে। সত্তরের দশকে তার বাবা কিম জং ইল কো ইয়ং হুইকে বিয়ে করেন। জাপান নিয়ে তারা এত ঘৃণার চর্চা করে। অথচ স্বয়ং কিম জং উনের মা-ই কিনা জাপানি! আজ আমরা তার মায়ের পরিবার সম্পর্কেই জানব এই লেখায়।
১৯২৯ সাল। কোরিয়া উপদ্বীপ তখন জাপানের দখলে। কো কিওন তায়েক নামের ২৬ বছরের এক যুবক দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপ থেকে জাপানের ওসাকা শহরে চলে যান। তিনি ছিলেন এক মাঝির ছেলে। ওসাকায় তখন কোরীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তিনি মধ্য ওসাকার ইকুনো অঞ্চলে থাকা শুরু করেন। সেখানেও কোরীয়দের ভালোই আনাগোনা ছিল। সেখানে তিনি হিরোতা সাইহজো সিউয়িং প্ল্যান্ট নামে এক কারখানায় কাজ করা শুরু করেন। এখানে শার্ট বানানোর ব্যবসা বন্ধ হয়ে মিলিটারি ইউনিফর্ম আর তাবু বানানোর ব্যবসা শুরু করা হয়েছিল।
বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান যখন দ্রুত আধুনিক ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা শুরু করছিল, কো ও তার স্ত্রী তাদের পরিবার গঠন করলেন। প্রথমে তাদের এক ছেলে হয়। এরপর ১৯৫২ সালের ৬ জুন তাদের এক মেয়ে হয়, যার নাম রাখেন ইয়ং হুই।
ইয়ং হুই তখন ওসাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জাপানি নাম হাইম তাকাদা ব্যবহার করা শুরু করেন। তিনি গান গাইতে পছন্দ করতেন। প্রতি রবিবার চার্চে গায়কদলের সাথে কোরাস গাইতেন। চার বছর পর তার এক বোন হয়, যার নাম ইয়ং সুক।
যুদ্ধের পর তাদের বাবা পুলিশের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন। তার নামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি ওসাকার সাথে জেজু দ্বীপে অবৈধভাবে নৌকা দিয়ে চোরাচালান করছেন। তাকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ আসে। একইসাথে তার নামে নারীঘটিত কেলেঙ্কারির অভিযোগও আসে। বিভিন্ন জায়গায় তার অনেক স্ত্রী ও সন্তান থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে তিনি ঠিক করলেন জাপান ত্যাগ করবেন।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকের ঐ সময়ে উত্তর কোরিয়া আবার জাতিগত দিক দিয়ে কোরীয়দের জাপান থেকে উত্তর কোরিয়ায় চলে আসার আহ্বান জানায়। জাপানে থাকা কোরীয়দের প্রায় সবাই-ই ছিল দক্ষিণ কোরিয়া থেকে যাওয়া। জাপান সরকারও বিষয়টা সমর্থন দেয়, যেহেতু তাদের দেশে থাকা কোরীয়দের সংখ্যা কমবে এতে।
সম্ভাব্য অভিবাসীদের কাছে উত্তর কোরিয়া দেশটি সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করা হয় পৃথিবীর বুকে থাকা এক সমাজতান্ত্রিক স্বর্গ হিসেবে। দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয় তারা বিনামূল্যে বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেবে। কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তাও থাকবে। এখানে কোরীয়দের কোনো প্রকার ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকারও হতে হবে না, যা জাপানে তাদের সম্মুখীন হতে হচ্ছিল।
তখন উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিও দক্ষিণ কোরিয়ার থেকে উন্নত ছিল। কারণ উত্তর কোরিয়া ছিল প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতা ছিলেন সিংম্যান রি, যিনি ছিলেন ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসক। তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল হিসাবে বিবেচনা করা হতো।
অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্ব ছিল কিম জং উনের দাদা কিম ইল সাংয়ের হাতে। তার প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পড়ে ১৯৫৯-৬৫ সালের মধ্যে ৯৩ হাজারেরও বেশি কোরীয় জনগণ জাপান থেকে উত্তর কোরিয়ায় চলে আসে।
কো পরিবারও স্রোতে গা ভাসান। ইয়ং হুইয়ের বয়স যখন দশ বছর, তখন তারা জাহাজে করে ৫৬০ মাইল ভ্রমণ করে উত্তর কোরিয়ায় আসেন। তারা অবতরণ করেন পূর্ব উপকূলের বন্দর নগর চংজিন শহরে। এটা ছিল কোরিয়া উপদ্বীপে তাদের পৈতৃক নিবাস জেজু দ্বীপ থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী স্থান।
বেশিরভাগ কোরীয়দের জন্য যুদ্ধের পর দ্রুত উন্নতি করতে থাকা একটি দেশ থেকে তাদের ‘মাতৃভূমি’তে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা হয় অত্যন্ত হতাশাজনক। কেউ কেউ উত্তর কোরিয়ায় পৌঁছামাত্রই আত্মহত্যা করে, যখন বুঝতে পারে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।
তবে পিয়ংইয়ংয়ে যেসব প্রত্যাবর্তনকারীদের আনা হয়, তাদের জীবন ভিন্ন ছিল। উত্তর কোরিয়ার ম্যাগাজিন কোরিয়ান পিক্টরিয়াল ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় কো পরিবার নিয়ে একটা ফিচার প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল, “আমার সুখী পরিবার”।
ফিচারের লেখা হয়- কো কিওন তায়েক বলছেন, তিনি যখন ১৯২৯ সালে জাপানে যান, তাকে সেখানে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। অনেক বৈষম্যের শিকার হতে হয়। উত্তর কোরিয়ায় এসে তার দুর্দশার সমাপ্তি হয়। ম্যাগাজিনটি তাকে উদ্ধৃত করে বলে, “এখন আমার পরিবারের চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।” ফিচারে আরো বলা হয়, তাদের বড় মেয়ে কো ইয়ং হুই উত্তর কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী গানের দল মানশুদেতে যোগ দিয়েছেন। তিনি কিম ইল সাং এর কাছ থেকে একটা পদকও পেয়েছেন।
পরের বছর কো ইয়ং হুই আবার জাপানে ফিরে যান। তিনি ও তার সাথের আরো ৩৫ জন মানশুদের নৃত্যশিল্পী দুই মাসের লম্বা সফরে যান নাচার জন্য। তিনি সেখানে টোকিও, নাগোয়া, হিরোশিমা, ফুকোকা এবং তার জন্মস্থান ওসাকায় নৃত্য পরিবেশন করেন।
কিন্তু ওই সময় কোয়ের আসল পরিচয় লুকানো হয়। জাপানের সফরের সময় উত্তর কোরিয়ার পত্রিকা চোসন সিনবো তাকে রিউ ইল সাক নামে পরিচয় দিয়ে খবর প্রকাশ করে। সেখানে তাকে একটা গানের নৃত্য পরিবেশনার মূল নৃত্যশিল্পী বলা হয়।
উত্তর কোরিয়ায় মানশুদে নৃত্য দলের সুন্দরী নৃত্যশিল্পীদের প্রায়ই ডাক পড়ত কিম ইল সাংয়ের ছেলে ভবিষ্যৎ নেতা কিম জং ইলের বিভিন্ন মদের পার্টিতে। সেখানে কিম জং ইল ও তার সঙ্গীদের জন্য তাদের নাচ পরিবেশন করতে হতো।
কিম জং ইল কো ইয়ং হুইয়ের প্রেমে মশগুল ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পার্টিতে কো ইয়ং হুইকে তার পাশে বসতে বলতেন। তিনি প্রায়ই মহড়া কক্ষে চলে যেতেন কোয়ের নাচের অনুশীলন দেখার জন্য। কোকে প্রায়ই মহড়ায় অনুপস্থিত দেখা যেত। তখন অন্যান্য নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে কো কিম জং ইলের সাথে থাকা শুরু করেছেন অথবা তিনি কিম জং ইলের বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন।
কো ইয়ং হুই কিম জং ইলকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের বিয়ের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তাদের সম্পর্কের কারণে উত্তর কোরিয়ায় কো ইয়ং হুইয়ের পরিবারের মর্যাদা দ্রুতই অনেক বেড়ে যায়। তার বাবা পিয়ংইয়ংয়ের মানগিয়ংদাই স্যুভেনির ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পান। ১৯৯৯ সালে ৮৬ বছর বয়সে মারা যাওয়া পর্যন্ত রাজধানী শহরেই বাস করেন।
কিম জং ইলের সাথে কো ইয়ং হুইয়ের সংসারে জন্ম নেয় তিন সন্তান- কিম জং উন, কিম জং চোল এবং কিম ইয়ো জং। ১৯৯৮ সালে তার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি ফ্রান্সে চিকিৎসা নিতে থাকেন। কিন্তু দিন দিন তার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালে তিনি প্যারিসে মারা যান।
সন্তানদের পড়াশোনার খবর রাখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সিরিয়াস। তিনি প্রায়ই গভীর রাত পর্যন্ত কিম জং ইলের সাথে বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামতও ব্যক্ত করতেন। একবার এক দেহরক্ষী মাতাল হয়ে কিম জং ইলের দিকে বন্দুক তাক করে ধরে। তখন তিনি তাদের মাঝখানে এসে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। তার জন্ম জাপানে হতে পারে, কিন্তু তিনি উত্তর কোরিয়ার প্রতি প্রকৃত দেশপ্রেম ও আনুগত্যের প্রমাণ দেখিয়েছেন। শুধুমাত্র উত্তর কোরিয়ার প্রতিই নয়, তার ক্ষমতাধর স্বামীর প্রতিও।