(প্রথম পর্বের পর)
৬.
২০ মার্চ ইরাক আক্রমণের পর থেকেই, সম্মিলিত বাহিনী সাদ্দামের ডজন ডজন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলছিল। উদাহরণস্বরূপ, ২৯ মার্চ, ব্রিটিশ বাহিনী বসরায় সাদ্দামের একটি লোহার ভাস্কর্য উড়িয়ে দেয়। এর নেপথ্যের যুক্তি হিসেবে এক সামরিক মুখপাত্র বলেন, “এই কাজের উদ্দেশ্য মনস্তাত্ত্বিক। জনগণকে দেখানো যে তার (সাদ্দামের) কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই, এবং তাকে প্রতিনিধিত্বশীল যেকোনো চিহ্নেই আমরা আঘাত হানব, তার প্রভাব লীন করে দেয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে।” তবে কেউই ওই নির্দিষ্ট ঘটনা ভিডিও করে রাখেনি। তাই বিবিসিসহ আরো কিছু সংবাদ সংস্থায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হলেও, এ ঘটনা বসরার বাইরে আর কোথাও তেমন কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি।
৭ এপ্রিল, অর্থাৎ যেদিন বাগদাদের পতন শুরু হয়, মার্কিন সৈন্যরা রিপাবলিকান প্যালেস দখল করে নেয়। তাদের কমান্ডার নির্দেশ দেন যেন সৈন্যরা এমন একটি ভাস্কর্য খুঁজে বের করে, যেটি ধ্বংস করা সম্ভব। তবে সঙ্গে সঙ্গেই যে ভাস্কর্য ধ্বংস করতে হবে, তা কিন্তু নয়। সৈন্যদেরকে অপেক্ষা করতে হবে ফক্স নিউজের গাড়ি এসে পৌঁছানো অবধি। এ নির্দেশ পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সৈন্যরা সাদ্দামের একটি ভাস্কর্যের হদিশ পায়। টেলিভিশন ক্রুও চলে আসে, এবং ধ্বংসযজ্ঞ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। তবে সেই ঘটনা খুব একটা উত্তেজনাকর ছিল না– স্রেফ এটুকুই যে আমেরিকানরা কিছু একটা ধ্বংস করছে, অথচ আশেপাশে কোথাও কোনো কৃতজ্ঞ ইরাকি দাঁড়িয়ে নেই – ফলে সেই ঘটনার ভিডিও-ও আহামরি কিছু নয়। ওই একই দিনে, যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন বাহিনী এবং ইরাকি জনতা সম্মিলিত প্রয়াসে কারবালায় সাদ্দামের আরেকটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে। এর পরদিন, ব্রিটিশ সৈন্যরা বসরায় আরেকটি ভাস্কর্য ভাঙে। আসলে গোটা ইরাকজুড়ে সাদ্দামের এত বিপুল পরিমাণ ভাস্কর্য ছিল যে, প্রত্যেকদিনই কয়েকটি করে ভাঙা হতে থাকে।
এদিকে ইরাক আক্রমণের সংবাদ কভার করতে থাকা কয়েকজন আন্তর্জাতিক সাংবাদিক চলে আসেন ফিরদোস স্কয়ারের প্যালেস্টাইন হোটেলে, যেখানে মোহাম্মদ সাঈদ আল-সাহাফ সেই হাস্যকর প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন। এর আগে ওই বিদেশী সাংবাদিকরা ছিলেন শহরের রাজনৈতিক কেন্দ্রের নিকটস্থ, আল রাশিদ হোটেলে। কিন্তু বোমা হামলায় ওই হোটেলের অনেকটা অংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আর প্যালেস্টাইন হোটেল যদিও পরিচিত ছিল গণমাধ্যমের আশ্রয়স্থল হিসেবে, তারপরও একটি আমেরিকান ট্যাংক ৮ এপ্রিল একে লক্ষ্য করে শেল নিক্ষেপ করে। তারা হোটেলের ব্যালকনিতে রাখা ক্যামেরাকে ইরাকিদের স্পটিং ডিভাইস ভেবেছিল। এই হামলায় দুজন সাংবাদিক নিহত হন, তিনজন আহত হন, এবং বাকিরাও ঘটনা জানতে পেরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
তবে ‘সৌভাগ্যক্রমে’, এর পরদিনই এমন একটি ঘটনা ঘটে, তা-ও ঠিক ফিরদোস স্কয়ারেই, যার ফলে পেন্টাগনে সাংবাদিকরা খুব বেশি হম্বিতম্বি করতে পারেনি। যে ঘটনার কথা বলছি, সেটির পরিকল্পনা কিন্তু পেন্টাগন নিজে করেনি। ঘটনাটি রণক্ষেত্রে অবস্থানকারী আমেরিকান সৈন্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম দেয়। এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সেটি খুব দ্রুতই ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়, পরিণত হয় একটি পুরোদস্তুর বৈশ্বিক উন্মাদনায়।
৭.
২০০৩ সালের ৯ এপ্রিল, তৃতীয় ব্যাটালিয়ন ৪র্থ মেরিনের দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্রায়ান ম্যাককয়কে প্যালেস্টাইন হোটেলে অবস্থানরত এক সাংবাদিক জানান, ফিরদোস স্কয়ারে কোনো ইরাকি বাহিনী নেই।
সিমন রবিনসন নামের টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনের বয়ান থেকে জানা যায়, ম্যাককয় জানতেন ওই স্থানে সাংবাদিকরা থাকবেন, ফলে “কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পাওয়া যাবে”।
ম্যাককয়ের ট্যাংক কোম্পানির নেতা, ক্যাপটেন ব্রায়ান লুইস স্কয়ারগামী রাস্তা বন্ধ করে দেন। গানারি লিওঁ ল্যামবার্ট, একটি এম-৮৮ আর্মার্ড রিকভারি ভেহিকল (এক ধরনের শক্তিশালী ট্যাংক) থেকে তাকে রেডিও করে বুদ্ধি দেন : তাদের কি সাদ্দামের ভাস্কর্য ভাঙা উচিত হবে? লুইস জবাবে বলেন, “কোনোমতেই না।”
ম্যাককয় প্যালেস্টাইন হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করেন রিপোর্টারদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে। বিকেল পাঁচটার কিছু পরেই, ল্যামবার্ট আবারো রেডিও করেন লুইসকে। বলেন, স্থানীয় ইরাকিরা নিজেরাই ভাস্কর্য ভাঙতে চাইছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন স্কয়ারে অবস্থান করছে, এবং সেখানে প্রচুর সাংবাদিকও রয়েছেন।
ল্যামবার্ট যে দাবি করেছিলেন ইরাকিরা ভাস্কর্য ভাঙতে ইচ্ছুক, তার খানিকটা সত্যতা পাওয়া গেছে কাধিম শরিফ হাসান আল-জাবৌরি নামের এক স্থানীয় মেকানিকের কথায়। কাধিমের দাবি অনুযায়ী, তিনি একবার সাদ্দাম ও তার ছেলে উদের মোটরসাইকেল সারিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তাদের সঙ্গে তার অর্থ নিয়ে বিরোধ বাধে। উদে তাকে জেলবন্দি করেন। বিবিসিকে কাধিম বলেন, “আমার নিজের পরিবারের ১৫ জনের মধ্যে চৌদ্দজনকে মেরে ফেলেছেন সাদ্দাম।” তাই যখন তিনি শুনলেন আমেরিকান বাহিনী আসছে, তিনি খুশি হন। তিনি হাতে একটি হাতুড়ি তুলে নেন, এবং গ্যারেজ ছেড়ে ফিরদোস স্কয়ারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
এদিকে ল্যামবার্ট লুইসকে জিজ্ঞেস করেন, “৮৮ থেকে যদি একটি হাতুড়ি ও দড়ি পড়ে যায়, তাহলে কি আপনি কিছু মনে করবেন?”
“না, আমি কিছু মনে করব না,” লুইস জবাব দেন। “কিন্তু ৮৮-টাকে ব্যবহার করবেন না।”
ল্যামবার্ট জানান, তিনি তার হাতুড়ি তুলে দেন ইরাকিদের হাতে। অবশ্য কাধিমের দাবি, তিনি সেদিন তার নিজের হাতুড়িই নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই এ ব্যাপারে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে যে ভাস্কর্যে আক্রমণের বুদ্ধিটা কি একজন অপেক্ষাকৃত নিম্নপদস্থ মার্কিন সৈন্যের কাছ থেকে এসেছিল, নাকি একজন ইরাকি নাগরিকের থেকে। আবার এ-ও হতে পারে যে তারা দুজনে মিলেই বুদ্ধিটা বের করেছিলেন।
তো যা-ই হোক, কাধিম ভাস্কর্যে বাড়ি মারতে শুরু করেন। তবে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেন না তিনি। কেবল ভাস্কর্যের বেদী থেকে কয়েকটি ফলক ভাঙতে সক্ষম হন। এছাড়া ল্যামবার্টের দেয়া দড়ি ছুড়ে মারা হয় ভাস্কর্যের ঘাড় লক্ষ্য করে। কিন্তু এত বিশাল ব্রোঞ্জের তৈরি একটি ভাস্কর্য মাত্র কয়েকজন মানুষ মিলে নামিয়ে আনবে, সে সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ।
এভাবে এক ঘণ্টা কেটে যায়। কিন্তু সাদ্দামের ভাস্কর্য তো নড়ে না। ল্যামবার্ট বেশ বুঝতে পারেন, এভাবে সফলতা অর্জন করা যাবে না। তবে তিনি এ-ও দেখতে পান যে ইরাকি নাগরিকদের মধ্যে কয়েকজন হাল ছাড়তে নারাজ। যে করেই হোক তারা সাদ্দামের ভাস্কর্যকে ভূলুণ্ঠিত করবেই। এমন সময় ম্যাককয় বেরিয়ে আসেন হোটেল থেকে। একনজর দেখেই তিনি উপলব্ধি করেন, বড় কিছু ঘটতে চলেছে। গণমাধ্যমকর্মীরা সকলে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্যকে মাটিতে নামিয়ে আনার সাক্ষী হতে। সুতরাং, তাদেরকে নিরাশ করা যাবে না।
ম্যাককয় তৎক্ষণাৎ রেডিও করেন তার এক সিনিয়র অফিসারকে। সেই অফিসার তাকে অনুমতি দেন ভাস্কর্য ভাঙার কাজে সৈন্যদের নিয়োজিত করতে। ম্যাককয় তাই তার সৈন্যদের বলেন এম-৮৮ ব্যবহার করতে, তবে কেউ হতাহত যেন না হয়।
৬.৫০ এর দিকে এম-৮৮ ভাস্কর্যের পাশ থেকে সরে যেতে থাকে, সেই সঙ্গে টেনে নিতে থাকে গলার সঙ্গে চেইন-বাঁধা ভাস্কর্যটিকে। ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যটি সামনের দিকে ঝুকে পড়ে, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদ্দামের বিশালকায় শরীর নিচে নেমে আসতে থাকে। উপস্থিত ইরাকি জনতা শিস বাজাতে ও হর্ষধ্বনি দিতে থাকে। এরপর ভাস্কর্যটির পা বাদে বাকি অংশ বেদী থেকে পুরোপুরি স্থানচ্যুত হলে, ইরাকিরা দৌড়ে যায়, সেটির উপর উঠে নাচতে ও লাফাতে থাকে। এভাবেই ভাস্কর্যটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
৮.
ওইদিন সকালে, প্যাট্রিক বাজ নামের একজন ফটোসাংবাদিক ছিলেন সাদ্দাম সিটিতে (বাগদাদের একটি এলাকা, যেটিকে পরে নামকরণ করা হয় সদর সিটি হিসেবে)। সেখানে তিনি দেখতে পান এক ইরাকি ব্যক্তিকে, যিনি সাদ্দামের আরেক ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেছেন। ভাস্কর্যটি একটি তার দিয়ে বাঁধা ছিল তার গাড়ির সঙ্গে।
যখনই লোকটি বেশ কয়েকজন মানুষের জটলা দেখতে পাচ্ছিলেন, তখনই দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। এরপর সেই জটলার সকলে মিলে তাদের জুতো দিয়ে সাদ্দামের ভাস্কর্যকে মারছিল। (মধ্যপ্রাচ্যে জুতোকে নোংরা হিসেবে গণ্য করা হয়, কাউকে নিজের জুতোর সোল দেখানো মানে তার প্রতি রূঢ় আচরণ করা, এবং কাউকে জুতো দিয়ে আঘাত করা হলো তাকে চূড়ান্ত রকমের অপমান করা। ২০০৮ সালে একজন ইরাকি সাংবাদিক জর্জ ডব্লিউ বুশের দিকে জুতো ছুড়ে সংবাদ হয়েছিলেন)।
“ওই ছবিটি ছিল আরো বেশি শক্তিশালী, কারণ ওখানে আশেপাশে কোনো আমেরিকান সৈন্য ছিল না। ওখানে কেবলই ছিল স্থানীয় জনগণ, যারা তাদের দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বৈরশাসকের প্রতি নিজেদের অকৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করছিল,” পরবর্তীতে বাজ লেখেন।
বাজ সেদিন দ্রুত প্যালেস্টাইন হোটেলে নিজের রুমে ফিরে আসেন তার সম্পাদকদের কাছে ওই ছবিটি পাঠাতে। ঠিক তখনই তিনি বাইরে শোরগোলের আওয়াজ শুনতে পান, এবং বেরিয়ে দেখেন ফিরদোস স্কয়ারে সাদ্দামের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
পরদিন সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় সাদ্দামের কেবল একটি ভাস্কর্য ভাঙার ছবিই স্থান পায়, এবং সেই ভাস্কর্যটি সেটি নয়, যেটি ইরাকিরা সম্পূর্ণ নিজেরাই ভেঙেছিল। সাদ্দাম সিটিতে ইরাকিদের ভাস্কর্য ভাঙার একটি সত্যি ঘটনাই ঘটেছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ফিরদোস স্কয়ারের ওই ভাস্কর্য ভাঙার ভানকেই বেশি উপস্থাপনযোগ্য হিসেবে বেছে নেয়।
সেদিন রাতে টানা দুই ঘণ্টা যাবত বিশ্বব্যাপী ফিরদোস স্কয়ারের ভাস্কর্য ভাঙার সরাসরি চিত্র প্রচারিত হয়। তবে নিউজ নেটওয়ার্কগুলো শুধু ঘটনার চিত্র দেখিয়েই সন্তুষ্ট হয় না। তারা এই ঘটনার অর্থও খোঁজার চেষ্টা করে।
সিএনএন-এর উলফ বিটজার ওই ফুটেজের বিবরণ দেন এভাবে, “এই দৃশ্যগুলো আজকের দিনের, কিংবা নানাভাবে, এই গোটা যুদ্ধেরই, সারসংক্ষেপ আমাদের সামনে তুলে ধরে।” ফক্সের উপস্থাপকরাও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। ব্রিট হিউম বলেন, “আমি এতদিন যা দেখেছি, তার সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় আজকের এই দৃশ্য।” তার সহকর্মীরা বলেন, “আজকের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো এই ঐতিহাসিক দৃশ্যটি, যেটি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে সাদ্দামের গলায় ফাঁস বেঁধে দিয়েছে বাগদাদের জনগণ।” কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ওই দড়িটি ছিল আমেরিকান, এবং ফাঁসটিও দিয়েছিল আমেরিকান সৈন্যরাই।
৯ এপ্রিল আমেরিকান সময় সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত, ফক্স নিউজ সাদ্দামের ভাস্কর্য ভূপাতিত হওয়ার দৃশ্যটি প্রচার করে প্রতি ৪.৪ মিনিটে একবার করে। সিএনএন সেটি দেখায় প্রতি ৭.৫ মিনিটে একবার করে। ফিরদোস স্কয়ারের কাভারেজে বারবার বলা হয় যে ভাস্কর্যটি বিপুল পরিমাণ উল্লসিত ইরাকি জনতাই মাটিতে নামিয়ে এনেছে। এর মাধ্যমে এটিই বোঝানো হতে থাকে যে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হওয়ার সঙ্গে এক সমান্তরালেই যেন এক ঘৃণিত স্বৈরশাসকের প্রতীকী বিনাশ ঘটে।
অথচ বাস্তবে, সবকিছু তখনই শেষ হয়ে যায়নি। যুদ্ধ তখনো পুরোদমে চলছে। ফিরদোস স্কয়ারে যখন এক নাটকীয় দৃশ্য মঞ্চস্থ হচ্ছে, বাগদাদসহ ইরাকের উত্তরাঞ্চলে তখনো সশস্ত্র যুদ্ধ চলছে।
এরপরও সাত মাস সাদ্দাম মুক্ত অবস্থায় থাকেন। এমন প্রচুর খবর তৈরি হয় যে সাদ্দামের নাকি ‘বডি ডাবল’ রয়েছে: ২০০২ সালে একটি জার্মান টিভি শো-তে তো বলা হয়েছিল, সাদ্দামের মতো নাকি অন্তত তিনজন রয়েছেন! এছাড়া এক ইরাকি ডাক্তার দাবি করেন, আসল সাদ্দাম নাকি ১৯৯৯ সালেই মারা গেছেন। এরপর থেকে ডাবলরাই তার ভূমিকায় অভিনয় করছেন।
ডাচ গবেষক ফ্লোরিয়ান গোৎকে লেখেন,
“সাদ্দাম ইতোমধ্যেই তার শরীরের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলেন, এবং সারাদেশে ভাস্কর্য নির্মাণের মাধ্যমে নিজের উপস্থিতিরও বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। এবং একইভাবে, তার একাধিক ডপেলগ্যাঙ্গারদের (হুবহু একই রকম দেখতে) জীবিত শরীরে বাস করার মাধ্যমে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানুষের চেয়েও বেশি কিছু। তিনি নিজের সত্ত্বাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পৌরাণিক জগতে – যার ফলে তিনি এমনকি নিজের হত্যাকাণ্ড থেকেও রক্ষা পেতে পারতেন।”
সাদ্দামকে যে অসীম ক্ষমতাধর বলে মনে করা হতো, সেটিও ছিল একটি বিভ্রম। যখন প্রকৃত সাদ্দামকে বের করে আনা হয় সেই গর্ত থেকে, যেখানে তিনি লুকিয়ে ছিলেন, সেটিকে মনে হচ্ছিল যেন ‘দ্য উইজার্ড অভ ওজ’-এর সেই পর্দা খুলে যাওয়ার মুহূর্ত। হঠাৎ করেই সবার সামনে প্রতীয়মান হয় যে এতদিন দেবতুল্য ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হচ্ছিল যে মানুষকে, তিনি নিছকই একজন ক্ষুদ্রাকার মানবসন্তান, যিনি এতদিন নিজের ব্যাপারে হাজারটা মিথ তৈরি করে রেখেছিলেন। বিশ্ববাসী সেদিন যে প্রকৃত সাদ্দামকে দেখেছিল – নোংরা, উষ্কখুষ্ক ও লোমশ – যার সঙ্গে ভাস্কর্যে উপস্থাপিত অহংকারী, উদ্ধত সাদ্দামের যোজন যোজন দূরত্ব।
৯.
ওই সময়ে, ফিরদোস স্কয়ারের ভাস্কর্যের ভাঙনকে উপস্থাপিত করা হয়েছিল ইরাক আক্রমণের একটি সন্তোষজনক পরিসমাপ্তি হিসেবে। এর পরের কয়েক সপ্তাহে ফক্স নিউজ ও সিএনএন-এ ইরাক যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদের পরিমাণ ৭০ শতাংশ হ্রাস পায়।
২০০৩ সালের ১ মে বুশ ইউএসএস আব্রাহাম লিঙ্কনের ডেকে দাঁড়ান। অবশ্য জাহাজটি ইরাকের ধারেকাছে কোথাও ছিল না। সেটি নিরাপদে অবস্থান করছিল স্যান ডিয়েগোর উপকূলে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দেন, ইরাকে বড় অপারেশনগুলো বন্ধ করা হয়েছে। তার সামনেই ছিল ‘স্টার্স অ্যান্ড স্ট্রাইপস’-এর বিশাল ব্যানার, যেখানে বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটছিল একই বার্তা: “মিশন অ্যাকমপ্লিশড”।
(এই ছবির সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক সাদৃশ্য পাওয়া যায় জো রোসেনথালের ১৯৪৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তোলা সেই বিখ্যাত ছবির, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন মেরিনকে দেখা যাচ্ছিল ইয়ো জিমায় আমেরিকার পতাকা ওড়াতে। ওই ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, অনেকেই ওই ছবিটি দেখে অনুমান করেছিল প্রশান্ত মহাসাগরে সন্নিকটে। অথচ ‘ব্যাটল অভ ইয়ো জিমা’ এরপরও একমাস ধরে চলেছিল, এবং ছবিতে উপস্থিত ছয়জন মেরিনের মধ্যে তিনজনের মৃত্যুও ঘটেছিল ওই যুদ্ধেই। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরের আগে প্রশান্ত মহাসাগরের যুদ্ধ থামেনি।)
বদ্রিলার্দ যে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ আসলে ঘটেনি, তা ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের ক্ষেত্রে পুরোপুরি খাটে না। কিন্তু যুদ্ধ সমাপ্তির নিদর্শন হিসেবে ফিরদোস স্কয়ারে সাদ্দামের ভাস্কর্য ভূপাতিত করার যে চিত্রটি স্বীকৃতি পেয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি যথাযথ ‘বদ্রিলার্দিয়ান সিমুলেশন’। গণমাধ্যম সেখানে গুটিকয়েক আমেরিকান সৈন্যের প্রস্তুতিহীন পারফরম্যান্সকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছিল, যেন তা কোনো টেলিভিশন সিরিজের খুবই বিশ্বাসযোগ্য ও সন্তোষজনক ফিনালে, যেখানে ইরাকি জনগণ তাদের শোষককে পরাস্ত করেছে। বিশ্বব্যাপী সম্প্রচার মাধ্যম ও ছাপার কাগজে বারবার এই ঘটনা ফিরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এটি সত্যি ছিল না।
যে সৈন্যরা যুদ্ধে লড়াই করছিল, এবং যে নাগরিকরা ওই পরিবেশে বাস করছিল, তাদের জন্য যুদ্ধ সবে শুরু হয়েছিল। সম্মিলিত বাহিনীর কাছে তখনো কোনো পরিকল্পনা ছিল না যে তারা কীভাবে যুদ্ধটি শেষ করবে। তারা এ-ও জানত না যে ভবিষ্যতে কেমন ইরাক তারা দেখতে চায়। এবং সাদ্দামের বিচার শেষে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্যও অপেক্ষা করতে হয় ২০০৬ সালের শেষ পর্যন্ত।
আমেরিকান সৈন্যদের বাগদাদে অবস্থানের সমাপ্তি ঘটে ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর, অর্থাৎ ফিরদোস স্কয়ার নাটকেরও সাড়ে আট বছর পর। এবং মাঝখানের এই সময়ে মারা যায় সম্মিলিত বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য, এবং লক্ষ লক্ষ ইরাকি।
সৈন্যরা ইরাক ত্যাগ করলেও, দেশটি দ্বিধাবিভক্তই রয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত, অস্থিতিশীল। ২০১৪ সালে আমেরিকান সৈন্যরা আবারো সেখানে ফিরে যায় আইসিসের হুমকি মোকাবেলা করতে। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদিত এই আইসিস এসে দেশটির অবস্থা করে তুলেছে আরো শোচনীয়।
“এখন, যখন আমি ওই ভাস্কর্যের পাশ দিয়ে যাই, আমার কষ্ট হয়, আমি লজ্জিত অনুভব করি,” ২০১৬ সালে বলেন কাধিম আল-জাবৌরি। “আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি : কেন আমি ভাস্কর্যটি ভাঙলাম?”
তিনি এখন সাদ্দাম সরকারের পতন নিয়েও আক্ষেপ প্রকাশ করেন। কেননা এরপর যে পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটেছে, তা রীতিমতো বিপর্যয়। “সাদ্দাম হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু তার বদলে এখন আমাদের রয়েছে হাজারো সাদ্দাম।”
কাধিম এমনকি ভাস্কর্যটি স্বস্থানে ফেরতও চেয়েছেন। “আমি চাই ভাস্কর্যটি তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে, নতুন করে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করতে। কিন্তু আমি ভয় পাই, সেটি করতে গেলে হয়তো আমাকে মেরে ফেলা হবে।”
হাইপাররিয়ালিটির অবস্থায়, কোনটা বাস্তবতা আর কোনটা বাস্তবতার ভান, তা বলা মুশকিল। তবে বাস্তবতার একটি গুণ হলো, এর ক্রমবিকাশ ঘটে। কিন্তু আগে হোক বা পরে, বাস্তবতার ভানে মরচে পড়তে বাধ্য, এবং একসময়, এটি মুখ থুবড়ে পড়ে।
(মূল রচয়িতা: অ্যালেক্স ফন টুনজেলম্যান। তিনি একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, চিত্রনাট্যকার ও লেখক। এই লেখাটি তার ২০২১ সালের ৮ জুলাই প্রকাশিত “Fallen Idols: Twelve Statues That Made History” বইয়ের অংশবিশেষ, যা দ্য গার্ডিয়ানে সম্পাদিত রূপে প্রকাশিত হয়েছে।)