হোয়াইট রোজ মুভমেন্ট: নাৎসি জার্মানির অভ্যন্তরে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর

কী চমৎকার একটি দিন, আর আজই আমাকে চলে যেতে হবে। কিন্তু প্রতিদিনই তো কত তাজা প্রাণ যুদ্ধক্ষেত্রে অকাতরে ঝরে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে আমার মৃত্যু আর কীভাবেই বা আলাদা হতে পারে, যদি না এর মাধ্যমে হাজারো জনতা উদ্দীপ্ত হয়। আর কিছু না হোক, সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়বে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

আজ থেকে ছিয়াত্তর বছর আগে সেলমেট এলসা গিবেলকে বলে যাওয়া এটাই ছিল জার্মান ছাত্রী সোফি শলের শেষ কথা। এর কিছু সময় পরেই ভাই হ্যান্স শল ও বন্ধু ক্রিস্টফ প্রবস্টের সাথে গিলোটিনে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাদের অপরাধ? নাৎসি বাহিনীর বর্বরতা ও হিটলারের উন্মত্ততার বিরুদ্ধে জার্মানদের সচেতন করার চেষ্টা করা। ইতিহাসের পাতায় তাদের এই নির্ভীক প্রয়াস ‘হোয়াইট রোজ মুভমেন্ট’ নামে সুপরিচিত।

শল পরিবার

সোফি শল; Source: spartacus-educational.com

সোফি শলের জন্ম ৯ মে, ১৯২১ সালে, জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমের ব্যাডেন-ওয়রটেনবার্গ প্রদেশের পাহাড়ের কোল ঘেষে গড়ে ওঠা ফ্রচটেনবার্গ শহরে। মা ম্যাগডালেন শল গৃহিণী, আর বাবা রবার্ট শল ছিলেন শহরের নির্বাচিত মেয়র। ছয় ভাই-বোন নিয়ে ছিল তাদের সুখী পরিবার।

রবার্ট শল ছিলেন উদারপন্থী ও প্রগতিবাদী। অন্যান্য জার্মান যখন নাৎসি পার্টি আর এর উদীয়মান নেতা অ্যাডলফ হিটলারে মোহাবিষ্ট হয়ে ছিল, তখন তিনি ও স্বল্প কিছু নাগরিক হিটলারের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন স্পষ্ট ধ্বংসের ছায়া। তার প্রগতিশীল মত গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে ১৯৩০ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন এবং ১৯৩২ সালে পরিবার নিয়ে দানিউব নদীর তীরবর্তী উলম শহরে চলে আসেন। এখানে তিনি ট্যাক্স ও ব্যবসা উপদেষ্টা হিসেবে অফিস খুলে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।হিটলারের কট্টর সমালোচক হলেও পরিবারে তিনি সবাইকে যার যার নিজস্ব মত প্রকাশ করতে উৎসাহ দিতেন এবং ছেলেমেয়েদের তাদের মত অনুযায়ী চলতে কখনো বাধা দেননি। এখানেই অন্যান্য জার্মান পরিবারের সাথে, যেখানে বাবাই ছিলেন হর্তাকর্তা, শল পরিবারের পার্থক্য ছিল।

নাৎসি পার্টির উত্থান ও জার্মান তরুণ প্রজন্ম

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও তার পথ ধরে জার্মানির উপর চাপিয়ে দেয়া অপমানজনক ভার্সাই চুক্তির ফলে জার্মান জনগণের মনে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নাৎসি পার্টি দিনকে দিন শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এর সাথে যুক্ত হয় অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা।

১৯২৯ সালের মহামন্দার পর জার্মান জনতা ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, যার পথ ধরে ১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় আসে। তখনকার সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ জার্মান বিশ্বাস করত হিটলারই পারবে তাদেরকে আবার একটি মহান ও ক্ষমতাধর জাতি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করতে। তরুণ প্রজন্ম হিটলার ও নাৎসি আদর্শে বুঁদ হয়ে ছিল। শল ভাই-বোনেরাও ব্যতিক্রম ছিল না। যদিও তাদের বাবা রবার্ট হিটলারের আসল রূপ সম্পর্কে তাদের সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু তারা তাদের বাবার সাথে একমত ছিল না, এবং হিটলারকে এক মহান নেতা হিসেবেই মনে করত। তৎকালীন অধিকাংশ জার্মান যুবকের মতো হ্যান্স যোগ দেয় নাৎসি পার্টির তরুণ দল হিটলার ইয়ুথে, আর তার বোন ইঙ্গে, এলিজাবেথ ও সোফি জার্মান লিগ অফ গার্লসে। নিজের যোগ্যতায় সোফি খুব দ্রুত লিগের একজন গ্রুপ লিডার হয়ে ওঠে।

নাৎসি আদর্শে মোহভঙ্গ

ধীরে ধীরে হলেও শল ভাইবোনেরা তাদের বাবার কথার যথার্থতা অনুধাবন করতে পারে। ছোটবেলা থেকেই তারা মুক্তমনা পরিবেশে বড় হয়েছে। পরিবার থেকে তারা সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার শিক্ষা পেয়েছিল। তারা নাৎসি বাহিনীর দমনমূলক মনোভাব এবং শুধুমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী ও ভিন্নধর্মী হওয়ার কারণে বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিকদের বইপত্র পুড়িয়ে দেয়াকে মেনে নিতে পারেনি।

হ্যান্স শল ১৯৩৬ সালে তার ইউনিটের পক্ষ থেকে নাৎসি পার্টির পতাকাবাহক হিসেবে নুরেমবার্গ র‍্যালিতে যোগ দেয়। কিন্তু সেখান থেকে সে হিটলারের স্বরূপ বুঝতে পারে। র‍্যালি থেকে ফিরে আসার পর তার ভাই-বোনেরা তার মনস্তত্ত্বে বিশাল পরিবর্তন দেখতে পায়। কিন্তু সময়টাই এমন ছিল যে, হিটলারের বিরুদ্ধে কিছু করা বা বলা ছিল এককথায় অসম্ভব।

হ্যান্সের ইচ্ছা ছিল ডাক্তারি পড়ার। সেই লক্ষ্যে সে মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। এর মধ্যে শুরু হয়  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হ্যান্সকে মেডিক হিসেবে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে ইস্টার্ন ফ্রন্টে পাঠানো হয়। তবে বছরখানেক পরে ফিরে এসে সে আবার তার পড়ালেখা শুরু করে। কিন্তু ফ্রন্টে থাকাকালে কাছ থেকে দেখা নাৎসি বাহিনীর বর্বরতা তার মনে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। বড় বোন ইঙ্গের কাছে সে ফ্রন্টে থাকা অবস্থায় এক ঘটনার কথা বর্ণনা করে। পোল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে ট্রেনে আসার সময় হ্যান্স ইহুদি পোলিশ যুদ্ধবন্দি নারীদের কাজ করতে দেখতে পেলে সে ট্রেন থেকে নেমে একজনকে তার রেশনের অংশ দিতে চেয়েছিল। পোলিশ মেয়েটি ঘৃণাভরে তার রেশন ছুঁড়ে ফেলে দেয়। “আমি শুধু তোমার কষ্ট লাঘব করার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম,” এ কথা বলে হ্যান্স একটি সাদা ডেইজি ফুল আর তার রেশন তার পায়ের কাছে রেখে চলে আসে। পরে ট্রেন থেকে তাকিয়ে সে দেখতে পায় পোলিশ মেয়েটি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, খোঁপায় গোঁজা হ্যান্সের দেয়া সাদা ডেইজি।

১৯৪১ সালে সোফি ব্লুমবার্গ শহরে একটি বাচ্চাদের স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেয়, তবে তার ইচ্ছা ছিল ভাই হ্যান্সের সাথে মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। এই সময় তার বন্ধু ফ্রিতয হার্টন্যাগেল জার্মান সেনাবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে তার সাথে দেখা করতে আসে। সে এক ভিন্ন সোফিকে আবিষ্কার করে, যে নাৎসি বাহিনীর গণহত্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং মনপ্রাণ দিয়ে এর বিরোধিতা করছে। ফ্রিতযের কাছ থেকেও সোফি যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে। নাৎসি সমর্থক হলেও তাদের কার্যকলাপে ফ্রিতয নিজেও বিচলিত হয়ে পড়ছিল, কিন্তু সরাসরি নাৎসি পার্টি বা ফুয়েরারের বিরোধিতা না করার জন্য সে সোফিকে অনুরোধ করে, কারণ ধরা পড়লে নিশ্চিত তাদের মেরে ফেলা হবে। কিন্তু কোনো কিছুই সোফিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

ফ্রিতয হার্টন্যাগেল; Source: spartacus-educational.com

১৯৪২ সালের দিকে সোফি মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে জীববিদ্যা ও দর্শনতত্ত্ব নিয়ে পড়া শুরু করে। এই সময় হ্যান্সও ফিরে এসে তার লেখাপড়া শুরু করেছিল। দুই ভাই-বোন অনুভব করে যে, দেশকে বাঁচাতে হলে তাদের কিছু একটা করতেই হবে।

হোয়াইট রোজ মুভমেন্টের জন্ম

হ্যান্স শল, সোফি শল এবং ক্রিস্টফ প্রবস্ট (জানুয়ারি ১৯৪৩);  Source: spartacus-educational.com

হ্যান্স ও তার বন্ধুরা, বিশেষ করে ক্রিস্টফ প্রবস্ট, আলেক্সান্দার শমরেল, উইল গ্যাফ ও জুগেন উইটেনস্টেইন জার্মান জনসাধারণকে নাৎসি বাহিনীর আসল উদ্দেশ্য ও যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানানোর প্রয়োজন অনুভব করে। জার্মান জনগণ তখন নাৎসি প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু জানতে পারত না। অবস্থার পরিবর্তন আনতে হ্যান্স ও তার বন্ধুরা লিফলেট লিখে তা সবার মধ্যে গোপনে বিলি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ কাজে সহযোগী হিসেবে তারা পায় হ্যান্সের বোন সোফি ও তার প্রফেসর কার্ট হুবারকে।

লিফলেট ছাপানর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ ও যন্ত্রপাতি কেনার জন্য সোফি ফ্রিতযের কাছ থেকে এক হাজার জার্মান মার্ক ধার করে, তবে তাকে সে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জানায়নি। সবকিছু প্রস্তুত হলে হ্যান্স, সোফি ও তাদের সমমনা কয়েকজন বন্ধু ‘হোয়াইট রোজ’ নামে নিজেদেরকে আখ্যায়িত করে লিফলেট লিখে ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে দিতে থাকে। ধরা পড়লে মরতে হবে- এ কথা জেনেও অকুতোভয় এই তরুণ জার্মান ছাত্রছাত্রীরা তাদের কাজ থেকে সরে আসেনি।

প্রাথমিকভাবে ডাকযোগে লিফলেট পাঠানো হয়, যার টার্গেট ছিল জার্মান বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক এবং অন্যান্য খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ, তবে অচিরেই তারা সাধারণ মানুষের কাছে লিফলেট ছড়িয়ে দিতে থাকে এবং লিফলেটের কপি অনেক পাবলিক প্লেসে রেখে আসে। পাঁচটি লিফলেট এভাবে প্রকাশের পর কুখ্যাত গেস্টাপো বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে এদের ধরার জন্য। কারণ এসব লিফলেটে ইহুদি গণহত্যা, নাৎসি বর্বরতা তুলে ধরে ফুয়েরারকে সরাসরিভাবে মিথ্যাবাদী বলে দাবি করা হয়েছিল এবং সমঅধিকার ভিত্তিক জার্মান প্রজাতন্ত্র গঠনের আহ্বান করা হয়, যা নাৎসি আদর্শের পরিপন্থি।

আটক ও স্বীকারোক্তি

১৯৪৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হ্যান্স ও সোফি মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে তাদের ষষ্ঠ লিফলেট বিলি করতে আসে। ক্লাস শেষ হওয়ার তখন কয়েক মিনিট বাকি, এ সময় তারা করিডোরে কিছু লিফলেট রেখে দেয় এবং বাকিগুলো ক্লাস শেষ হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীরা যখন বেরিয়ে আসছিল তখন সিঁড়ির উপর থেকে তাদের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়। তারা মনে করেছিল কেউ তাদের শনাক্ত করতে পারেনি। কিন্তু হ্যান্স ও সোফি জানত না ইউনিভার্সিটির একজন স্টাফ, জ্যাকব স্মিডট, যে কি না মনেপ্রাণে একজন নাৎসি, সে তাদের দেখে ফেলেছে।

মিউনিখ ইউনিভার্সিটির এই জায়গাটিতেই হোয়াইট রোজ তাদের লিফলেট বিলি করেছিল; Source: historyanswers.co.uk

অবিলম্বে ইউনিভার্সিটির সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়ে গেস্টাপোকে খবর দেয়া হয়। তারা এসে শল ভাই-বোনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাদের গেস্টাপো অফিসে আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে থাকে এবং তাদের ঘরে গেস্টাপো বাহিনী অনুসন্ধান চালায়। প্রথমদিকে হ্যান্স ও সোফি কোনো কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু গেস্টাপো অফিসাররা যখন তাদের বলে যে, তারাই যে এসব লিফলেটের পেছনে আছে তার অকাট্য প্রমাণ তারা সংগ্রহ করেছে, তখন মুভমেন্টের অন্যান্য সদস্যদের বাঁচানোর স্বার্থে হ্যান্স ও সোফি সমস্ত দোষ নিজেদের ঘাড়ে নেয়। তবে গেস্টাপো তাদের বিশ্বাস করেনি এবং তাদের অনেক বন্ধুবান্ধবকে হোয়াইট রোজ মুভমেন্টের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে, যাদের মধ্যে ক্রিস্টফ প্রবস্টও ছিল। এরই মধ্যে রবার্ট ও ম্যাগডালেন শল তাদের আটকের কথা জানতে পেরে দেখা করতে আসলেও তাদের দেখা করতে দেয়া হয়নি।

Source: spartacus-educational.com

বিচার

২২ ফেব্রুয়ারি, আটকের চারদিন পর শল ভাই-বোন ও ক্রিস্টফ প্রবস্টকে দেশদ্রোহের অভিযোগে এক প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করা হয়। তাদের ভাগ্য আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। মামলার বিচারক হিসেবে বার্লিন থেকে পাঠান হয় কুখ্যাত বিচারক রোল্যান্ড ফ্রেইসলারকে। এই কট্টর নাৎসি পরিচিত ছিলেন ‘হ্যাঙিং জাজ’ হিসেবে, এবং তার রায় কী হবে তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যাচ্ছিল।

রোল্যান্ড ফ্রেইসলার; Source: spartacus-educational.com

বিচারে আসামিদের উকিল নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হয়নি, বরং রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয় যে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম চেষ্টাও করেনি। এই পরিস্থিতিতে আসামিরাই তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করে। উপস্থিত নাৎসিদের হতবাক করে দিয়ে সোফি সরাসরি ফ্রেইসলারকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, “কাউকে না কাউকে কিছু একটা করে শুরু করতে হবে। আমরা যা লিখেছি জার্মান নাগরিকদের একটা বড় অংশ তা জানে ও বিশ্বাস করে, শুধুমাত্র প্রাণের ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না।” বিচারের আর একপর্যায়ে সোফি বলে, “যুদ্ধে এর মধ্যেই আমাদের পরাজয় ঘটে গেছে, এ কথা মেনে নেয়ার সাহস পাচ্ছেন না কেন?

বিচার চলাকালে রবার্ট শল জোর করে আদালতকক্ষে প্রবেশ করলে ফ্রেইসলার তাকে বহিষ্কার করেন। ঘণ্টাখানেক চলা এই সাজান বিচারের শেষে আসামীদের দেশদ্রোহের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাদের শাস্তি? গিলোটিনের মাধ্যমে মৃত্যু।

মৃত্যুদণ্ড

রায় ঘোষণার পর গেস্টাপো হ্যান্স, সোফি ও প্রবস্টকে মিউনিখের স্টাডেলহেইম কারাগারে, যেখানে তাদের রাখা হয়েছিল, ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেখানেই তাদের বাবা-মায়ের সাথে শেষবারের মতো দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়। হ্যান্স প্রথমে এবং তারপর সোফি দেখা করতে আসে। “আর কখনোই তুমি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকবে না,” মায়ের এই হাহাকারের জবাবে সোফি হাসিমুখে জবাব দেয় যে একসময় তো মরতে হতই, কয়েকবছর আগে-পরে কী এসে যায়।

মা-বাবার সামনে শক্ত থাকলেও পরে নিজের সেলে প্রথমবারের মতো সোফিকে কাঁদতে দেখেন রবার মুর নামে এক গেস্টাপো অফিসার। “আমি এইমাত্র চিরকালের মতো মা-বাবাকে শেষবার দেখে এসেছি,” কান্নার কারণ হিসেবে সোফি তাকে কৈফিয়ত দিয়েছিল। হ্যান্স, সোফি ও প্রবস্ট কেউই আসন্ন মৃত্যুর চিন্তায় ভেঙে পড়েনি, বরং হাসিমুখে নিজেদের পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের সাহসিকতায় কারাগারের রক্ষিরা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে নিয়মের বাইরে গিয়ে তাদের তিনজনকে দণ্ড কার্যকরের আগে শেষবারের মতো মিলিত হবার সুযোগ দিয়েছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেল পাঁচটার দিকে প্রথমে সোফি, তারপর প্রবস্ট এবং সবশেষে হ্যান্সকে নিয়ে যাওয়া হয়। গিলোটিনের ব্লেড দিয়ে মাথা বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে হ্যান্স শলের শেষ কথা ছিল, “স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক!” স্টাডেলহেইম কারাগারের পাশেই তাদের কবর দেয়া হয়।

Source: flickr.com

হোয়াইট রোজ মুভমেন্টের পরিণতি

গেস্টাপো অভিযানে পরবর্তীতে হোয়াইট রোজের আরও অনেক সদস্য ধরা পড়ে। এদের মধ্যে কার্ট হুবার, উইল গ্যাফ ও আলেক্সান্দার শমরেলকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আরও অনেক ছাত্রছাত্রীকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। যুদ্ধ চলাকালে নাৎসি পার্টির প্রতাপ এতটাই ছিল যে কেউই তাদের বিরুদ্ধে আর কিছু বলতে সাহস পায়নি। বরং জার্মানদের একটা বড় অংশ তখনো তাদের প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস করেছিল। এর জের ধরে শল পরিবারকে দীর্ঘদিন সমাজে একঘরের মতো থাকতে হয়েছে। ফ্রিতয হার্টন্যাগেল তাদের সাহায্য করায় তাকেও নিগৃহীত হতে হয়েছিল। তবে জার্মানির বাইরে হোয়াইট রোজ একটা বড় প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের অনেক লিফলেট মিত্রবাহিনীর হস্তগত হলে তারা সারা ইউরোপে বিমানের মাধ্যমে এগুলো ছড়িয়ে দিতে থাকে।

যুদ্ধপরবর্তী মূল্যায়ন

একটি পুলিশ স্টেটের বিরুদ্ধে তরুণ জনতার প্রতিবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হোয়াইট রোজ মুভমেন্ট, এবং নাৎসি জার্মানির সবচেয়ে বিখ্যাত সিভিলিয়ান রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্টও বটে। নাৎসি জার্মানির পতনের পর হ্যান্স, সোফি ও হোয়াইট রোজের সদস্যদের জাতীয়ভাবে বীর হিসেবে সম্মানিত করা হয়। জার্মানির অনেক রাস্তাঘাটের নামকরণ করা হয়েছে হ্যান্স, সোফি ও হোয়াইট রোজের সদস্যদের নামে। জার্মান সরকার শল ভাই-বোনের নামে স্ট্যাম্প চালু করেছে। হোয়াইট রোজ, বিশেষ করে সোফি শলের জীবনকে উপজীব্য করে রচনা করা হয়েছে বই, নির্মিত হয়েছে সিনেমা যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘সোফি শল: দ্য ফাইনাল ডেইস‘। সোফি শলের বড় বোন, এলিজাবেথ, এখনও জীবিত আছেন। যুদ্ধের পর তিনি ও ফ্রিতয হার্টন্যাগেল বিয়ে করেছিলেন এবং এই দম্পতির চারটি সন্তান রয়েছে।

Source: historyanswers.co.uk

হোয়াইট রোজ মুভমেন্টের সফলতা নিশ্চিত মৃত্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানবাত্মার বিজয়ের জয়গান গাওয়ার মধ্যে, নিজের ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে আপাত ক্ষমতাশালী অত্যাচারী একনায়কের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয়। ‘অ্যা নোবল ট্রেজন’ বইয়ের লেখক রিচার্ড হ্যানসনের কথা ধার করে বলতে হয়,

শল ও তাদের বন্ধুরা ছিল নাৎসি জার্মানির বিপরীতে অন্য এক জার্মানির প্রতিভূ। সেই জার্মানি কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের জার্মানি। তাদের অবদান দেশ, জাতি ও সময়ের সীমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে হয়ে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরন্তন বিশ্বজনীন লড়াইয়ের অনন্য উদাহরণ।

Related Articles

Exit mobile version