২০০৬ সালের গল্প। সেবার সিনেমা জগতের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার অস্কারের মঞ্চে সবার চোখ ছিল অভিনেত্রী ফেলিসিটি হাফম্যানের দিকে। ‘তার দিকে’ না বলে যদি ‘তার গলার দিকে’ নজর ছিল বলি, তাহলে বরং কথাটি সঠিক হয়। প্রশ্ন করতে পারেন, হঠাৎ করে এই অভিনেত্রীর গলার দিকে কেন সবার নজর? সেবার কি ফেলিসিটি হাফম্যান অস্কারের মঞ্চে সবচেয়ে যোগ্য অভিনেত্রী ছিলেন নাকি?
উত্তরে বলবো, ফেলিসিটি হাফম্যান তার অভিনয়শৈলী এবং যোগ্যতার জন্য সেবার নজর কাড়েননি। বরং আসল ব্যাপার ছিল অন্য কোথাও। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেল, অস্কারের মঞ্চে ‘ট্রান্স-আমেরিকা’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন লাভ করা এই অভিনেত্রী তার গলায় একটি বিশেষ হীরার অলংকার পরিধান করবেন। তাই সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল সেই অভিনেত্রীর আগমনের। সময়মতো তার গাড়ি এসে অস্কারের লাল গালিচায় থামলো। কিন্তু সবার সামনে যখন তিনি হাজির হলেন, তখন সবাই হতাশ হয়ে দেখলো, সেই বিশেষ হীরার অলংকারটি তার গলায় নেই। এমনকি গলায় কোনো অলংকারই পরিধান করেননি ফেলিসিটি।
এবার ভাবতে পারেন, এমন কী অলংকার ছিল যার জন্য এত আগ্রহ নিয়ে সবাই অপেক্ষা করেছিল? পত্রিকা এবং সংবাদ মাধ্যমে সেবার গুঞ্জন উঠেছিল ফেলিসিটি হাফম্যান ঐতিহাসিক ব্ল্যাক অরলভ হীরার তৈরি একটি অলংকার পরিধান করবেন। ঐতিহাসিক এই হীরার সুখ্যাতির অন্যতম কারণ হচ্ছে, ধারণা করা হয় এটি একটি অভিশপ্ত হীরা। যারাই এর অধিকারী হয়েছেন, তারাই বিপদে পড়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবে সেবার এই হীরার অভিশাপের ভেলকি দেখতেই এত আগ্রহ জন্মেছিল। কিন্তু ফেলিসিটি শেষপর্যন্ত এই হীরা গলায় দেননি। কিন্তু কেন দেননি? তাহলে কি হীরার অভিশাপের কথা ভেবেই এই কাজ থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি?
ব্ল্যাক অরলভ পরিচিতি
পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত দামি পাথর এবং অলংকারের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে হীরা। আবার এই হীরাদের মধ্যে সবচেয়ে বিরল হচ্ছে ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ বা কৃষ্ণ বর্ণের হীরা। নজরকাড়া গঠন, নিম্ন কার্বন আইসোটোপ সংখ্যা, মোহনীয় সৌন্দর্যের কারণে ব্ল্যাক ডায়মন্ড যুগ যুগ ধরে মূল্যবান ধনরত্নের কাতারে সবার উপরের দিকে অবস্থান করছে। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে, ব্ল্যাক ডায়মন্ডের নমুনাগুলোর বয়স প্রায় ৩০০ কোটি বছর।
বিজ্ঞানী জোসেফ গ্যারাই এবং স্টিফেন হেগার্টির মতে, কোনো উল্কাপিণ্ড বা গ্রহাণু পতনের মাধ্যমে মহাকাশের অন্য প্রান্ত থেকে এই হীরা পৃথিবীতে এসেছে। সোজা বাংলায়, এই হীরা ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে গঠিত হয়নি। ধারণা করা হয়, মহাকাশে হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ কোনো অংশ থেকে এদের সৃষ্টি হয়েছে। আবার এই কৃষ্ণ হীরা ব্রাজিল এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের খনি ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এমনকি গবেষণাগারেও এদের কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এই বিরল প্রকারের হীরাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আমস্টারডাম ডায়মন্ড, স্পিরিট অফ গ্রিসঙ্গো, দ্য রেমব্রান্ড, ব্ল্যাক অরলভ, দ্য সার্জিও ইত্যাদি।
ব্ল্যাক ডায়মন্ডের তালিকায় আকারের হিসাবে অরলভের অবস্থান ৭ম। প্রায় ৬৭.৫০ ক্যারট ওজনের এই হীরার রঙ বন্দুকের ধাতুর মতো কালো। আলোর উপস্থিতিতে অনবদ্য দ্যোতি সৃষ্টিকারী এই হীরকখণ্ড নিয়ে বহু গুজব, রূপকথা এবং শ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। এর ইতিহাস কয়েকশত বছর পুরাতন হলেও বাণিজ্যিকভাবে প্রথম বিক্রয়ের জন্য নিলামের মঞ্চে আবির্ভূত হয় ১৯৬৯ সালে। বেশ কয়েকবার মালিকানা বদল হয়ে ২০০৬ সালে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি এই হীরাটি ৩,৫২,০০০ ডলারের বিনিময়ে ক্রয় করেন। অর্থাৎ, এর প্রতি ক্যারটের মূল্য প্রায় ৫,২১৪ ডলার। এই হীরার সুখ্যাতির পেছনে প্রধান কারণ অবশ্য এর সৌন্দর্য নয়। ধারণা করা হয়, এই হীরাকে ঘিরে এক অনিবার্য অভিশাপ বিরাজ করছে। কিন্তু কী সেই অভিশাপ? তা জানতে হলে আমাদের পিছন ফিরে তাকাতে হবে প্রাচীন ভারতে।
ব্রহ্মার চোখ
প্রাচীন ভারতের পুণ্ডিচেরি অঞ্চলে একটি ব্রহ্মার মূর্তি রক্ষিত ছিল। কথিত আছে, সেই মূর্তির চোখ খচিত হয়েছিল একটি হীরা দিয়ে। সেই হীরার ওজন ছিল ১৯৫ ক্যারট। একদিন এক অলুক্ষুণে মুহূর্তে সেই হীরাখানা চুরি হয়ে গেলো। কে যেন মূর্তির চোখ থেকে সেই হীরা বের করে দিব্যি কেটে পড়েছে। হীরা চুরির এই নিকৃষ্ট ঘটনায় পুরোহিতরা রেগে অগ্নিশর্মা। কে করতে পারে এমন গর্হিত কাজ, তা তাদের জানা নেই। কিন্তু যেই এই কাজ করে থাকুক, তার উচিত শাস্তি যেন সে পায় তা নিশ্চিত করতে তারা সেই হীরাকে অভিশাপ দিয়েছিল।
নিশ্চয় ধারণা করতে পারছেন, সেই ব্রহ্মার চোখের হীরাটিই ছিল আজকের ব্ল্যাক অরলভ। হীরার অভিশাপের সূচনা হিসেবে এই ঘটনা সমধিক প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে কিছু সন্দেহ থেকে যায়। যেমন, ব্রহ্মার চোখের সেই কৃষ্ণ হীরার উৎপত্তি হিসেবে ভারতবর্ষের নাম দেওয়া। কিন্তু মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং ব্রাজিল ব্যতীত অন্য কোথাও এধরনের হীরা পাওয়া যায় না। তবে এই সন্দেহ ছাপিয়ে অভিশাপের কাহিনীই বড় হয়ে উঠেছে যখন হীরার পরবর্তী মালিকদের অনেকেই অপঘাতে মৃত্যুবরণ করতে থাকেন।
রুশ রাজকন্যা রহস্য
কথিত পুণ্ডিচেরির অভিশপ্ত ব্ল্যাক অরলভ বিংশ শতাব্দীতে প্রথম নজরে আসে যখন রুশ রাজকন্যা লিওনিলা বারিয়াতিনস্কি এই হীরার মালিকানা লাভ করেন। তবে উনার পূর্বে হীরার মালিকানা কার অধীনে ছিল সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। রাজকন্যা লিওনিলা এই হীরাকে তার বংশের মধ্যে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। এই মর্মে তিনি আরেক রাজকন্যা নাদিয়া ভাইজিন অরলভকে হীরাটি উপহার দেন। মূলত, এই রাজকন্যার নামানুসারে পরবর্তীতে এই হীরার নাম হয়ে যায় ব্ল্যাক অরলভ। ১৯১৭ সালে রাশিয়াজুড়ে যখন বলশেভিক বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, তখন এই রাজকন্যা হীরা ফেলে রাশিয়া থেকে পালিয়ে যান।
ব্ল্যাক অরলভের অভিশাপ এর আগে কয়জনকে ঘায়েল করেছে জানা নেই। তবে রুশ রাজকন্যা এই হীরার অভিশাপের শিকার হন। ১৯৪৭ সালে তিনি তার বাসভবনের দালান থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। আর হীরার পূর্ব মালিক রাজকন্যা লিওনিলার মৃত্যু নিয়েও সন্দেহ আছে। ধারণা করা হয়, নাদিয়ার মৃত্যুর একমাস পূর্বে তিনিও আত্মহত্যা করেছেন। তবে এসব ঘটনাতেও কিছু ফাঁকি রয়েছে। প্রথমত, রুশ নথি অনুযায়ী রাজকন্যা লিওনিলা ১৯১৮ সালে ১০২ বছর বয়সে মারা গেছেন। দ্বিতীয়ত, রুশ রাজবংশের ইতিহাসে নাদিয়া ভাইজিন অরলভ নামের কোনো রাজকন্যার নথি পাওয়া যায়নি। তবে কিছু সূত্র থেকে কাছাকাছি নামের আরেক রাজকন্যার নাম পাওয়া যায়। আর তার নাম হচ্ছে নাদেজদা পেত্রোনভা অরলভ। এই রাজকন্যাও রুশ বিপ্লবে রাশিয়া ছেড়ে পালিয়ে যান। আশ্রয় নেন ফ্রান্সের একটি শহরে। তবে নাদেজদা আর নাদিয়া এক ব্যক্তি কি না, তা জানা যায়নি। রাজকন্যা নাদেজদা অবশ্য ১৯৮৮ সালে ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
মার্কিন মুলুকে অভিশাপ
হীরার প্রথম মালিক হিসেবে রুশ রাজকন্যা আত্মহত্যা করলেও এই হীরার প্রথম শিকার ছিলেন অন্য একজন। ১৯৩২ সালে ব্ল্যাক অরলভ হীরা রাশিয়া থেকে পাড়ি জমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। জে ডব্লিউ প্যারিস নামে একজন হীরক বণিক ব্ল্যাক অরলভের মালিকানা লাভ করেন। সেবছর তিনি চার্লস এফ উইনসন নামক এক সংগ্রাহকের নিকট হীরাটি বিক্রি করেছিলেন। হীরাটি বিক্রয়ের পরই শুরু হয় বিপত্তি। জে প্যারিস সেবছরই নিউ ইয়র্কের স্কাই স্ক্র্যাপার থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্কাই স্ক্র্যাপার থেকে আত্মহত্যা করা কোনো হীরা বণিকের নথি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এই পুরো ঘটনায় ধোঁয়াশা রয়ে যায়। তবে জে প্যারিসের আত্মহত্যা ছিল ব্ল্যাক অরলভ হীরার অভিশাপের প্রথম প্রচারিত তেলেসমাতি। এই ঘটনার ১৫ বছর পর রুশ রাজকন্যার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল।
হীরার অভিশাপে ভীত হয়ে এর নতুন মালিক জনাব উইনসন এক অভিনব ফন্দি বের করেন। তিনি নির্দেশ দেন হীরাটি কেটে নতুন রূপ দেওয়ার। তার নির্দেশে ১৯৫০ এর দিকে ১৯৫ ক্যারট হীরাটি কেটে ৩ টুকরা করা হয়। বর্তমান ৬৭.৫ ক্যারট আকারের হীরাটি সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় টুকরা। হীরা কেটে ফেললে অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এমন বিশ্বাস থেকেই এটি কাটা হয়েছিল। এই পদ্ধতি কাজে দিয়েছিল কি না জানা নেই, তবে হীরার পরবর্তী মালিকদের কেউই অপঘাতে মারা যাননি। ব্ল্যাক ডায়মন্ডের মতো কঠিন হীরা কাটতে প্রায় ২ বছর সময় লেগেছিল। সাধারণত ব্ল্যাক ডায়মন্ড বেশ ছিদ্রযুক্ত হয়ে থাকে। এ ধরনের পদার্থ প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে হালকা হয়ে যেতে পারে। তাই আসলেই হীরাটি কাটা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবে এক্ষেত্রে উইনসন সাহেবের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ নেই। তিনিই হীরাটির প্রথম স্বীকৃত মালিক। ১৯৫১ সালে হীরাটি প্রথম নিউ ইয়র্কের আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে প্রদর্শিত হয়। ১৯৬৭ সালে এটি দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গে প্রদর্শিত হয়েছিল।
মালিকানা বদল এবং বাজার দর
১৯৬৯ সালে চার্লস উইনসন হীরাটি একজন অজ্ঞাত ক্রেতার কাছে প্রায় ৩ লাখ ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। এরপর দীর্ঘদিন এই হীরা লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। এই হীরা পুনরায় আবির্ভূত হয় ১৯৯০ সালে এক নিলাম অনুষ্ঠানে। সথবি’র নিলামে হীরাটি মাত্র ৯০ হাজার ডলারে বিক্রি হয়ে যায়। তুলনামূলক সস্তায় এই হীরার মালিকানা পেলেও নতুন মালিক এর মূল্য বুঝতে দেরি করেননি। তাই ৫ বছর পর নিউ ইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউতে প্রায় দেড় মিলিয়ন ডলারে এক সংগ্রাহকের কাছে হীরাটি বিক্রি করে দেন। কয়েক দফা মালিকানা বদলের পর ২০০৬ সালে হীরাটি কিনে নেন ডেনিস পেতিমেজাস নামক একজন জহুরি এবং রত্ন সংগ্রাহক। হীরা ক্রয়ের জন্য দীর্ঘ ৬ মাস দাম কষাকষি করেছিলেন ডেনিস। দীর্ঘ ৩০ মাস মালিকানায় থাকা এই হীরা তার জীবনে কোনো দুঃসংবাদ বা অভিশাপ নিয়ে আসেনি বলে জানিয়েছেন তিনি। উল্টো বেশকিছু সুসংবাদ পেয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন। তিনি এই হীরার মালিক থাকা অবস্থায় তার প্রেয়সীকে বিয়ে করেন এবং একটি স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে সংসার শুরু করেন।
ডেনিস পেতিমেজাসের মতে, হীরার অভিশাপের তথ্য স্রেফ মিডিয়া প্রচারণা ছাড়া আর কিছু না। পরবর্তীতে মনরো হীরা নামক আরেকটি মূল্যবান রত্ন ক্রয়ের উদ্দেশ্যে তিনি এই হীরাটি একজন অজ্ঞাত সংগ্রাহকের কাছে বিক্রি করে দেন মাত্র ৩ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে। বর্তমান সংগ্রাহকের পুরো পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। তবে দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে হীরার সাথে সম্পৃক্ত কারও আত্মহত্যা বা অপঘাতে মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি বিধায় অনেকেই একে অমূলক দাবি করেছেন। তবে অভিশপ্ত তকমা একবার লেগে যাওয়ায় যতই অমূলক প্রচার করা হোক, ব্ল্যাক অরলভের সুখ্যাতির কারণ হিসেবে সেই অভিশাপকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়। তবে এর মানে এই নয় যে, ব্ল্যাক অরলভ হীরার অন্য কোন গুণ নেই। এই হীরাকে সামনে থেকে অবলোকন করলে যে কেউ এর সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে যাবে। অভিশপ্ত তকমা এর অসাধারণ চাকচিক্যকে বিন্দুমাত্র আড়াল করতে পারেনি।