পূর্বাপর প্রসঙ্গ
মধ্যরাত। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধতা। অন্ধকার ওঁত পেতে আছে যেন চারদিক থেকে। এরই মধ্যে নদীর স্রোতের সঙ্গে নিজের শরীরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। নিঃশ্বাস নেবার জন্য নাকটা যথাসম্ভব পানি থেকে উঁচু করে ধরা। মাথার ঠিক ওপরেই সীমান্তরক্ষীদের গড়া একটি ওয়াচ টাওয়ার। ভেতরে এক কী দুজন সৈন্য আছে পাহারারত। ছেলেটা জানে- তারা যদি কোনোভাবে আঁচ করতে পারে যে নদীতে কোনো মানুষ আছে, তাহলে গুলিবর্ষণ করতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।
ওয়াচ টাওয়ার পেরিয়ে খানিকটা সামনে গিয়ে তীরে উঠলো ছেলেটা। উঠেই সটান হয়ে শুয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বুকের উপর ভর দিয়ে বিরতি নিয়ে নিয়ে চললো ক্ষেতের উপর দিয়ে। সূর্য উঠি উঠি করছে। অন্ধকারের রাজত্ব শেষ হয়ে আসছে। আলো আসছে অন্ধকারের রাজত্বকে হটিয়ে দিতে। নতুন দিনের সূচনা হবে। আর ছেলেটাও চাইছে নতুন দিনের কিরণ যেন তাকে নতুন একটা জীবন দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য উঠে চারদিক পরিষ্কার হয়ে গেল। ছেলেটা ভয়ে আর আতঙ্কে মাথা তুললো খানিকটা। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। দ্বিতীয় কোনো চিন্তা ছাড়াই এক লাফে দাঁড়িয়ে গেল সে।
এখন সে দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিম বার্লিনে। পেছনে ফেলে এসেছে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মান সরকারের পূর্ব বার্লিন শহর। ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র। নাম তার জোয়াকিম রুডলফ। নতুন জীবনের সন্ধানে পূর্ব জার্মান থেকে পালিয়ে এসেছে সে।
জোয়াকিম রুডলফ বিশ্বের অন্যতম নির্মম একনায়কতন্ত্র থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক মাস পর তিনি ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু কেন?
সমস্ত কিছুর শুরুটা হয়েছিল কোনো এক রাতে দরজার কড়া নাড়ার মধ্য দিয়ে। ঘটনার যখন শুরু তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। এক রাতে দুই ইতালিয়ান ছাত্র তার কাছে সাহায্যের আবদার নিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে খুব বেশি একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না জোয়াকিমের। তারা পূর্ব বার্লিন থেকে কয়েকজন বন্ধুকে বের করে নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু কীভাবে? এজন্য তারা এক টানেল বা সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পরিকল্পনা করছে।
১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসের কথা। সবে দুই মাস হয়েছে সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদের মধ্যকার দম্ভের দেয়াল গড়ার। পূর্ব জার্মান সরকারের সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রকে ত্যাগ করে বার্লিনাররা* পশ্চিমে পাড়ি জমাচ্ছিল। দেশান্তরি হওয়া এই বার্লিনারদের ঢল পূর্ব জার্মান সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। মানুষের এই ঢল থামাতেই পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যভাগে গড়ে উঠে দম্ভের দেয়াল- দ্য বার্লিন ওয়াল। অন্য আর ৮/১০টা দেয়ালের মতো হলেও এই প্রাচীরের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয় এর দ্রুতগতির নির্মাণ কৌশল। ১৯৬১ সালেই বার্লিন প্রাচীর গড়ে উঠেছিল পূর্ব জার্মান সেনাদের তত্ত্বাবধানে। এবং পশ্চিম বার্লিনে অবাধ যাতায়াতটা অনুমতি সাপেক্ষের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মধ্যরাতে পূর্ব জার্মান সরকার তার সৈন্যদের বার্লিনের সড়কে নামিয়ে দিয়েছিল। হাজারের কাতারে থাকা পূর্ব জার্মান সৈন্যরা ভোর হবার আগেই পূর্ব আর পশ্চিম বার্লিনের মাঝে কাঁটাতারের বেড়া তুলে ফেলেছিল। কাঁটাতারের পাশাপাশি, বেশ কিছু জায়গায় কংক্রিটের ব্লকও দিয়েছিল তারা। পরেরদিন সকালে এই কাঁটাতারের বেড়া শহরের বাড়িঘর, অলিগলি, পার্ক, খেলার মাঠ, কবরস্থান এবং পাবলিক স্কয়ারগুলোকে দু’ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিল। এতদিনের চিরচেনা বার্লিনকে দুই ভাগে বিভক্ত দেখে শুধু বার্লিনাররাই না; বরং বিশ্ববাসী ব্যাপক অবাক হয়েছিল।
এক রাতের ব্যবধানে গড়ে ওঠা কাঁটাতারের এই বেড়া রাতারাতি পুরো শহরটাকেই বদলে দিয়েছিল। পিতার কাছ থেকে সন্তান, স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী, ভাইয়ের কাছ থেকে বোন এবং এমনকি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর কাছ থেকে তার মাকে আলাদা করে দিয়েছিল এই প্রাচীর। ১৯৬১ সালের ১৩ আগস্ট বার্লিনবাসী ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল যেকোনো একপাশে; হয় সেটা ছিল পূর্ব, আর নয় পশ্চিম। নিজেদের চিরচেনা শহরটার এমন অদ্ভুত আচরণে স্বাভাবিকতই ব্যথিত হয়ে উঠেছিল বার্লিনবাসীর নরম মন।
প্রাচীর গড়ার পূর্বের জীবন আর পরের জীবনের মধ্যে বার্লিনাররা আকাশ-পাতাল তফাত খুঁজে পেয়েছিল। এই প্রাচীর নির্মাণের পূর্বে বার্লিনাররা নির্দ্বিধায় শহরের দুই অংশে ঘোরাঘুরি করতে পারতো- কাজকর্মে, কেনাকাটা, থিয়েটার বা সিনেমা হল, অথবা কনসার্ট বা মিউজিক নাইটে অংশগ্রহণ করতে পারতো। কোনো ধরনের বাধা নিষেধ ছিল না। যদিও সড়কের মোড়ে মোড়ে সোভিয়েত আর মার্কিন সেনাবাহিনীর দেখা মিলতো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, জীবনযাপন অনেকটা সহজ ছিল। মোটেও তা ছিল না। বরং বলা চলে অনেকটাই কঠিন ছিল। লোকেরা দুই আদর্শবাদীদের যাঁতাকলে পড়ে দরিদ্র জীবনযাপন করছিল। বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক তথা পূর্ব বার্লিনের জনগণ। তাই যখনই রাস্তায় সোভিয়েত ট্যাংক দেখা যেত লোকজন ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করতো।
প্রাচীর গড়ে ওঠার পর সোভিয়েত তথা পূর্ব জার্মানি পশ্চিমা এবং নিজের জনগণকে এটাই দেখাতে চেয়েছিল যে, তাদের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম তারা। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। যেদিন বাধা দেয়া হলো সেদিন থেকেই আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলো পূর্ব বার্লিনাররা। বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে পালাতে শুরু করলো তারা। কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে ঝাপিয়ে; জোরে গাড়ি চালিয়ে; ছাদ বা জানালা থেকে বেড়ার ওপারে লাফ দিয়ে; এমনকি এক দম্পতি তাদের তিন বছরের শিশুকে বাথটাবে রেখে সাঁতরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পালিয়ে গিয়েছিল। শুধু জনগণই নয়, বরং পূর্ব জার্মান সৈন্য এবং সীমান্তরক্ষীরাও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।
লোকেরা যেন বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়েছিল। পালানোটাই জীবনের একটা অংশ- এমনটাই গণ্য হতে লাগলো। যেন পালিয়ে ওপাড়ে গেলেই মুক্তি, এপাড়ে নির্ঘাত মৃত্যু। তাই তো প্রাচীরের পাশঘেষা বাড়ির জানালা, বা ছাদ থেকেও তারা লাফিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। কেননা, ওপাড়ে আছে দমকল বাহিনী যারা তাদের বাঁচিয়ে তুলবে বলেই আশা রাখতো তারা। জোয়াকিম রুডলফ নিজেও এক মধ্যরাতে মাঠের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ওপাড়ে চলে গিয়েছিল। পশ্চিমে দাঁড়িয়ে নতুন দিনের সূর্য উঠা উপভোগ করেছিল জোয়াকিম। সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন,
আমি এই নতুন বিশ্বের বাসিন্দা হতে চাইনি; কেননা, এটা এমন এক বিশ্ব যেখানে আপনি কিছুই বলতে পারবেন না। এমনকি আপনি ভাবতেও পারবেন না।
ইতিমধ্যেই জোয়াকিম পশ্চিম জার্মানি চলে এসেছিল। পূর্বের জীবনযাপনকে ত্যাগ করে নতুন জীবনের জন্য সবেমাত্র প্রস্তুত করছে নিজেকে। এমতাবস্থায় দুজন শিক্ষার্থী এলো তার কাছে সাহায্যের আবেদন নিয়ে; সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এপাড় থেকে ওপাড়ে পালিয়ে যাবার জন্যে। অনেক ঝুঁকির একটা কাজ। ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। ধরতে পারলে জেলে পুরে দিতে পারে পূর্ব জার্মান সরকার। এমনকি তার মৃত্যুও হতে পারে এই কাজে নামলে। এতকিছু সত্ত্বেও জোয়াকিম রাজি হয়ে গেল।
খনন হলো শুরু
খননের সময় ঘনিয়ে এলো। কিন্তু এতে যুক্ত হলো এমন একদল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী যারা কখনো কোনো সুড়ঙ্গ খননের কাজ করেনি। তাই শুরুটা কী করে করবে, তা নিয়ে ভাবতেই কয়েকটা দিন চলে গেল। কিন্তু ইতিহাস বলে, বিশ্বের যত দুঃসাহসিক অভিযান কিংবা দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা আছে, তার সবক’টার সূত্রপাত ঘটেছিল সেই জায়গার মানচিত্র জোগাড়ের মধ্য দিয়ে। একইভাবে তারাও একটা মানচিত্র জোগাড় করলো। তাদের মধ্যেই কারো বন্ধু সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্তব্যরত ছিল। তার মাধ্যমেই শহরের একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র জোগাড় করলো তারা।
মানচিত্রটি একদম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সকলে মিলে। সুড়ঙ্গের জন্য একটা সঠিক রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করলো সবাই। তাদের এমন একটা সড়ক খুঁজে বের করা দরকার ছিল, যেখান দিয়ে অনায়াসেই গর্ত খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করা যাবে। একইসঙ্গে যেন শহরের পানি সরবরাহ এবং নিষ্কাশনের ব্যবস্থাতেও কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি না হয়। অবশেষে তারা বার্নোয়ার স্ট্রাসে বা বার্নোয়ার সড়ককেই বেছে নিল। তাদের জন্য যেটা ছিল একটা সাহসী পদক্ষেপ। তারপর ঠিক কোথায় থেকে সুড়ঙ্গ শুরু আর কোথায় গিয়ে শেষ তা বার্লিনের মানচিত্রে দাগ কাটার মধ্য দিয়ে শুরু হলো তাদের কার্যক্রম।
তখনকার দিনে মানে ষাটের দশকে এই বার্নোয়ার স্ট্রিট বিশ্বখ্যাত এবং ব্যস্ততম একটি সড়ক ছিল। কেননা, এই সড়কের মাঝ বরাবর গড়ে উঠেছিল বার্লিন প্রাচীর। বার্লিনাররা চেয়ার বা টুল নিয়ে প্রাচীরের উপর দিয়ে অন্য পাশে দেখতো কিংবা কথা বলার চেষ্টা করতো। পর্যটকরা সব এই সড়কে আসতো ছবি তোলার জন্য। তাই এই সড়কটা সবসময়ই ব্যস্ত থাকতো। তখনকার প্রেক্ষাপটে বার্নোয়ার স্ট্রিটের নীচে সুড়ঙ্গ খনন করা অনেকটা আজকের দিনের নিউ ইয়র্ক টাইমসের নীচে সুড়ঙ্গ খননের সমতুল্য বলা যেতেই পারে।
খননকাজ শুরু করার জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গা বেছে নেয়ার দরকার ছিল এবার। ওখানেই মূল সড়ক থেকে খানিকটা দূরে, ককটেইল স্ট্র বানানোর একটা কারখানা ছিল। তারা সেখানে গেল একদিন সকালে। কারখানার মালিককে নিজেদের পরিচয় দিল। তারপর খুব সুন্দর করে গুছিয়ে একটা মিথ্যা গল্প শোনালো তাকে। তারা জ্যাজ মিউজিশিয়ান, যাদের রিহার্সাল করার জন্য একটা জায়গার বিশেষ দরকার- এমন গল্পই বানিয়েছিল তারা। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গল্পটা লোকটির মনঃপুত হলো না। কেননা, তিনি নিজেও পূর্বপাশ থেকে পালিয়েই এসেছিলেন। তাই শেষমেশ তিনি সমস্তটা বুঝে-শুনে নিজের কারখানার সেলার* ব্যবহারের অনুমতি দিলেন তাদের।
শুরুতেই তারা যেটা পেয়ে গেল, পশ্চিমের সুড়ঙ্গের প্রান্ত বা মুখ। কিন্তু এখন তাদের দরকার পূর্ব দিকের একটা নির্দিষ্ট জায়গা; যেটা পূর্ব দিকের প্রান্ত বা মুখ। পশ্চিমের মতোই পূর্বেও একটা বেইজমেন্ট বা সেলারের সন্ধানে ছিল তারা। কিন্তু পশ্চিমে ব্যাপারটা যতটা সহজ ছিল, পূর্বে ততটাও ছিল না। তাই তারা তাদেরই এক বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টকে বাছাই করলো। কিন্তু সরাসরি তাকে না বলে তার অ্যাপার্টমেন্টের চাবি চুরি করে কপি বানিয়ে নিল। এরপর তারা সুড়ঙ্গ খননের কাজে যুক্ত হতে আরো লোকের সন্ধানে নামলো।
লোক খুঁজে বের করাটাও কোনো সহজ কাজ ছিল না। কেননা, পশ্চিম বার্লিনে স্ট্যাসির গুপ্তচর দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। স্ট্যাসি ছিল পূর্ব জার্মানের নগর নিরাপত্তা বাহিনী। পূর্ব জার্মান সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী এক অংশ ছিল এই স্ট্যাসি বিভাগ। গোয়েন্দা পুলিশ আর গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল এই সংস্থা। এই সংস্থার প্রধান কাজ ছিল সমস্ত কিছু জানা। আপনি এই মুহূর্তে কী ভাবছেন, আপনি কার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন, আপনি গতকাল রাতে কার বিছানায় শুয়েছেন- সকল কিছু জানাই ছিল তাদের একমাত্র মিশন। স্ট্যাসিদের নিয়ে একটা কৌতুক ছিল এমন যে-
“আপনি জানেন কি, স্ট্যাসি অফিসাররা কেন এত ভালো ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়? কারণ, আপনি তার ট্যাক্সিতে পা রাখামাত্রই সে জেনে গেছে আপনি কে আর কোথায় থাকেন?”
শতক ছাড়িয়ে হাজারের কাতারে ছিল গুপ্তচরদের সংখ্যা। পশ্চিমের স্কুল থেকে শুরু করে, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মিল-কারখানা, এবং এমনকি সরকারি বিভিন্ন খাতেও গুপ্তচরদের নির্দ্বিধায় আনাগোনা ছিল।
অবশেষে, টানেলাররা/সুড়ঙ্গ খননকারীরা আরো তিনজন ছাত্রের সন্ধান পেল যাদেরকে তারা বিশ্বাস করতে পারে। তাদের প্রত্যেকেই দিন কতেকের মধ্যেই পূর্ব পাশ থেকে পালিয়ে এসেছে। ওল্ফ শ্রয়েডটার (লম্বা আর আকর্ষনীয় গড়ন), হাসো হার্শেল (কাস্ত্রোপ্রেমী এক তরুণ বিপ্লবী) এবং উলি ফাইফার (স্ট্যাসির কাছে প্রেমিকার ধরা পড়াটা তাকে বন্য আর পাগল করেছে)। জানার বিষয় হচ্ছে, এদের সবাই-ই আসলে প্রকৌশলবিদ্যার ছাত্র। যেজন্য প্রত্যেকেরই কম-বেশি ধারণা ছিল কীভাবে একটা সুড়ঙ্গ খনন করা যেতে পারে।
সবশেষে এবার তাদের দরকার ছিল সরঞ্জামের। এক রাতে তারা এক কবরস্থানের প্রাচীর টপকে ভেতরে নামে। সেখান থেকে এক চাকার ঠেলাগাড়ি, হাতুড়ি, কোদাল এবং ঝুড়ি চুরি করে। এবার সবকিছুই ঠিকঠাক। কেবল কাজ শুরু করার পালা। অবশেষে ১৯৬২ সালের ৯ মে, মধ্যরাতের খানিক পূর্বে কারখানার সেলারের মেঝে খননের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ খননের কাজ শুরু করে তারা।
কোথা থেকে খনন শুরু করবো আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। আমরা এর আগে কেউই বাস্তবে একটা সুড়ঙ্গ দেখিনি। তবে টিভিতে অনেক সুড়ঙ্গের ফুটেজ দেখেছিলাম আমরা; যেগুলো সফল হতে পারেনি। মূলত ওগুলো থেকেই আমরা ধারণা নিয়েছিলাম।
– জোয়াকিম রুডলফ
পরের কয়েক রাত একটানা কাজ করে তারা ১.৩ মিটারের সমপরিমাণ গর্ত খনন করে ফেলেছিল। এবার তারা পূর্বাভিমুখে সমতলভাবে খোঁড়ার কাজ শুরু করে দিল। ঠিক তখন থেকেই তাদের প্রত্যেকেই বুঝতে পারলো যে, ব্যাপারটা কতটা কঠিন থেকে কঠিনতরতে রূপ নিচ্ছে।
যখন আপনি কোনো টানেলের মধ্যে থাকবেন, তখন আপনাকে একতরফাভাবেই একটানা কাজ করতে হবে। হয় পেছনে ভর দিয়ে বসে, কিংবা চিৎ হয়ে শুয়ে, অথবা উপুড় হয়ে বসে। আপনার পা-জোড়া যেদিকে থাকবে সেদিকেই আপনাকে খনন কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কেবল দু’হাতে শক্ত করে কোদালটা ধরবেন আর পা দিয়ে কোদালটাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিবেন মাটির যত গভীরে সম্ভব।
– জোয়াকিম রুডলফ
মাটির ছোট ছোট স্তূপ বের করে আনতেই তাদের কয়েক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যেত। ছোট ছোট স্তূপীকৃত মাটি দলা করে এক চাকার ঠেলাগাড়িতে রাখা হতো। সেগুলো পূর্ণ হয়ে গেলে কারখানার সেলারে থাকা লোকজনদের খবর দেয়া হতো একটা টেলিফোনের সাহায্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত একটা টেলিফোন জোগাড় করেছিল জোয়াকিম। সেটা দিয়ে খবর পাঠানো হতো। আর তারপর সেটা তুলে আনা হতো দড়ির সাহায্যে।
খুব শীঘ্রই তারা কাজের মধ্যে একটা ছন্দ পেল। একটানা কয়েক ঘণ্টা কারখানায় কাটানো, সুড়ঙ্গ খনন করা এবং এক চাকার ঠেলাগাড়িটা টেনে বের করে আনা। এভাবেই চললো সপ্তাহখানেক। তারপর অতিশয় ক্লান্ত হয়ে পড়লো তারা। তাদের হাতজুড়ে অগনিত ফোস্কা দেখা দিল, পিঠ আর কোমড় ব্যথায় কুঁকড়ে যেতে চাইলো। কিন্তু এসব তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পেল না। খননের একটা নেশা পেয়েছিল তাদের সবাইকে। খুঁড়েই যাচ্ছে কিন্তু এখন অবধি খুব বেশি একটা খুঁড়তেও পারেনি তারা। সীমান্ত তো অনেক দূরে এখনও। তাই দুটো জিনিস তাদের দরকার হয়ে পড়লো- আরো মানুষ এবং অর্থ। লোকবল আর অর্থ তহবিলের সন্ধানে নামলো তারা।
প্রযোজকের সন্ধান
হাজার মাইল দূরে নিউ ইয়র্ক শহরে অফিসের ডেস্কে বসে রিউভেন ফ্রাঙ্ক নামক এক সাংবাদিক ভাবছিলেন, বার্লিনের এই ঘটনাকে কী করে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা যায়। প্রাচীর গড়ার আগ থেকেই ফ্রাঙ্ক স্নায়যুদ্ধের এই চাপা উত্তেজনাময় মুহূর্তের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এমনকি তিনি এই সম্পর্কেও অবগত ছিলেন যে, আসলে মিডিয়াতে যে খবর আসে তার পেছনে আরো অনেক খবরই অতলে হারিয়ে যায়। তাই তিনি চাচ্ছিলেন এমন একটা কিছুতে নিজের সময়, শ্রম, অর্থ আর মেধা খরচ করতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনবিসির (NBC) অন্যতম শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন রিউভেন ফ্রাঙ্ক। এরকমই ভাবতে ভাবতে আর বার্লিন প্রাচীরের পালানোর ঘটনা শুনতে শুনতে, এক সকালে আচমকাই তার মাথায় এই ধারণাটা উঁকি দেয়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে পালিয়ে যাওয়ার দুর্ধর্ষ আর রোমহর্ষক একটা ঘটনা যদি কভার করা যায়, তাহলে একদম বাজিমাত। যে-ই ভাবনা সে-ই কাজ। ফ্রাঙ্ক তখন প্রস্তুত।
টিভিতে লাইভ অ্যাকশন সিনেমা যেমন দেখায়, ফ্রাঙ্কের ইচ্ছে ছিল তেমনই লাইভ সুড়ঙ্গ খুঁড়ার দৃশ্য যদি ধারণ করা যায়। সুড়ঙ্গ খননকারীদের প্রতিটি বাধা, প্রতিটি উল্লাস যদি ফ্রেমে বন্দী করা যায়; যদি সম্পূর্ণটাই বিশ্ববাসী জানতে পারে যে, কীভাবে এর শুরু হয়েছিল আর কীভাবে তারা এটা শেষ করেছিল; যদি এটা তিনি করতে পারেন তাহলে এটা টিভি সংবাদের ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে- এমনটাই ভাবনা ছিল ফ্রাঙ্কের।
তখন এনবিসি সংবাদদাতা হিসেবে বার্লিনে নিযুক্ত ছিলেন পিয়ার্স অ্যান্ডারটন। ফ্রাঙ্কের আইডিয়াটা ব্যাপক ভালো লেগে যায় পিয়ার্সের কাছেও। কোনো কথা না বাড়িয়েই পিয়ার্স লেগে পড়েন নিজের কাজে। ইতিমধ্যেই নিজে ছাড়াও লোক লাগিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দেন পিয়ার্স। সন্ধান করার খুব বেশি দিন হয়নি, এরই মধ্যে পরিচয় হয়ে যায় ওল্ফ শ্রয়েডটারের সঙ্গে। ওল্ফ তখন সুড়ঙ্গের জন্যে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে দাতা বা তহবিল খুঁজছেন। দুজনই সন্ধানী। তাই খুব বেশি একটা দেরি হয়নি তাদের মধ্যে কথাবার্তা এগিয়ে যেতে।
শুরুতেই আমরা তাকে সুড়ঙ্গটা দেখাতে নিয়ে আসি। সে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। তারপর আমাদের জানায় যে, তারা এর দৃশ্য ধারণ করতে চায়। আর ঠিক তখনই আমরা আমাদের শর্তের কথা শোনাই তাকে। যদি এনবিসি এর দৃশ্য ধারণ করতে চায়, তাহলে বিনিময়ে আমাদেরকে অর্থের যোগান দিতে হবে তাদের।
– ওল্ফ শ্রয়েডটার
বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা না করেই ফ্রাঙ্ক রাজি হয়ে যান। কেননা, তিনি অপেক্ষায় ছিলেন এমন একটা সুযোগের জন্যই। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দেন, সব ধরনের উপকরণ আর সরঞ্জাম সরবরাহ করবে এনবিসি, “এবং বিনিময়ে সম্পূর্ণ কার্যকলাপের দৃশ্য ধারণের অনুমতি দিতে হবে।”
টিভি সাংবাদিকতার জগতে রিউভেন ফ্রাঙ্ক সবচেয়ে বিতর্কিত এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন বলেই অভিজ্ঞরা বর্তমানে মতামত দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম এক প্রধান সংবাদমাধ্যম বার্লিন প্রাচীরের নীচে সুড়ঙ্গ খননের কাজে সাহায্য করছে; তাদেরকে অর্থ তহবিল দিচ্ছে; ব্যাপারটা সত্যিকার অর্থেই অবিশ্বাস্য ছিল। সেই কাজটাই করে দেখিয়েছিলেন রিউভেন ফ্রাঙ্ক।
টীকা:
* বার্লিন শহরে বসবাসরত অধিবাসীদের সাধারণত বার্লিনার বলা হয়ে থাকে।
* সেলার হচ্ছে বাড়ির বেইজমেন্ট বা ভূগর্ভস্থ একটা কক্ষ।