দিলমুন কিংবা তেলমুন ছিল আরব উপদ্বীপের পূর্ব অংশে অবস্থিত সুপ্রাচীন এক সভ্যতা। বয়সের হিসেবে বেশ পুরনো সভ্যতা হলেও, এটি প্রাচীন বিশ্বের মেসোপটেমীয়, মিশরীয় কিংবা সিন্ধু সভ্যতার মতো এত বিশেষ খ্যাতি কুড়াতে পারেনি। ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরে দিলমুনের কাহিনি লিপিবদ্ধ থাকলেও ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করা মানুষজন ছাড়া এই সভ্যতার কথা অল্প মানুষই জানেন।
দিলমুন সভ্যতার অবস্থান
মেসোপটেমীয়, মিশরীয়, এবং সিন্ধু সভ্যতা নদীর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও দিলমুন সভ্যতার পত্তন ঘটেছিল বৃহৎ এক দ্বীপে, যা আজকের দিনের বাহরাইনে অবস্থিত। আরব উপসাগরে কৌশলগত অবস্থানের সুবিধা নিয়ে দিলমুন সভ্যতা নিজেকে বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে পেরেছিল। মেসোপটেমীয় এবং সিন্ধু- এই দুই সভ্যতার সাথে দীর্ঘকাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল দিলমুন সভ্যতা।
উপকথায় দিলমুন
মেসোপটেমীয় উপকথার আনাচেকানাচে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে দিলমুন সভ্যতা। পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্যকর্ম গিলগামেশ মহাকাব্যের দ্বিতীয় অংশে প্রথিতযশা বীর গিলগামেশ তার প্রিয় বন্ধু এনকিদুর মৃত্যুতে অমরত্বের খোঁজে বের হন। এজন্য গিলগামেশকে প্রথমেই একমাত্র মানুষ হিসেবে অমরত্ব লাভ করা সাধু উত-নাপিশতিমকে খুঁজে বের করতে হয়। এই উত-নাপিশতিম হলেন মেসোপটেমীয় মহাপ্লাবন উপাখ্যানে দেবতা এনকি নির্বাচিত নিষ্পাপ এক প্রতিনিধি। তিনি বিশাল এক নৌকা বানিয়ে মহাপ্লাবনের সময় পৃথিবীর প্রাণীকুলকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।
যা-ই হোক, এই উত-নাপিশতিম গিলগামেশকে জানালেন, অমরত্ব লাভ করতে হলে বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এক পবিত্র স্থানে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, সূর্যদেবতা উতু শামাশ বাদে শত-চেষ্টার পরেও আর কেউ এই সমুদ্রের ওপারে যেতে পারেননি। সমুদ্রের অপর পাশে অবস্থিত ওই পবিত্র স্থানের নামই হলো দিলমুন। যেখানে কোনো শিকারি জন্তু, দুঃখ-দুর্দশা কিংবা জরা-ব্যাধির অস্তিত্ব নেই। বার্ধক্যও কাউকে ছুঁতে পারে না।
দেবতা এনকি এবং দেবী নিনহুরসাগের কিংবদন্তিতেও সরাসরি উঠে এসেছে দিলমুনের আখ্যান। একে উল্লেখ করা হয়েছে পৃথিবীর স্বর্গভূমি হিসেবে। প্রাচীন সুমেরীয় কাব্যে পাওয়া যায়,
শহরগুলো পবিত্র,
আপনাকে দেওয়া হয়েছে সেই শহরগুলো।
পবিত্র দিলমুনের ভূমি।
পবিত্র সুমেরের ভূমি,
আপনাকে দেওয়া হয়েছে সুমেরের পবিত্র ভূমি।
পবিত্র দিলমুনের ভূমি।
পবিত্র দিলমুনের ভূমি।
দিলমুনের ভূমি কুমারীর ন্যায় পবিত্র।
দিলমুনের ভূমি কুমারীর ন্যায় পবিত্র।
পৃথিবীর আদিতে সৃষ্ট ভূমি হলো দিলমুন….
ব্যাবিলনীয় সৃষ্টিতত্ত্ব এনুমা এলিশে বলা আছে, সৃষ্টির শুরুটাই হয়েছিল নোনা জল এবং মিষ্টি জলের মিশ্রণে। দিলমুন অবস্থিত বাহরাইনে। আরবি শব্দ বাহরাইন এর অর্থ হলো ‘সমরূপ জল’। যেখানে আরবের মিষ্টি জল পারস্য উপসাগরের নোনা জলের সাথে মিশ খায়, সে জায়গাটি আরবি ভাষায় বাহরাইন নামে পরিচিত। অনেকের ধারণা, সুমেরের দিলমুন উপাখ্যান থেকেই ইডেন অভ গার্ডেন কাহিনির জন্ম।
বাস্তবে দিলমুন
লোককথায় বর্ণিত গল্পগাথার বাইরেও বাস্তবে অস্তিত্ব ছিল দিলমুনের। সুমেরীয় এবং ব্যাবিলনীয় কিউনিফর্ম নথিতেও খোঁজ পাওয়া যায় এই স্থানের। প্রাচীন এক মেসোপটেমীয় শিলালিপি থেকে জানা যায়, প্রথম রাজবংশের প্রথম সম্রাট উর-নানশিকে ভিনদেশ দিলমুন থেকে কাঠবোঝাই জাহাজ উপহার দেওয়া হয়েছিল। সার্গন দ্য গ্রেটের আমলের এক শিলালিপিতে বর্ণিত আছে, আগাদ নগরীর বন্দরঘাটে দিলমুনের জাহাজ সমূহ নোঙর করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী, দিলমুনের এই জাহাজসমূহ দিয়ে দিলমুনবাসী সুদূর মেসোপটেমিয়া এবং সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করত।
মেসোপটেমিয়ার প্রত্নস্থলে যেমন সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন মোহর বা সিল পাওয়া গেছে, তেমনি পারস্য উপসাগরের বৃত্তাকার মোহরের অস্তিত্ব মিলেছে সিন্ধু সভ্যতা এবং মেসোপটেমীয় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে। এই সিলগুলোই দিলমুনের সাথে মেসোপটেমিয়া এবং সিন্ধু সভ্যতার আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক সম্পর্কের জ্বলন্ত প্রমাণ।
এই ব্যবসা-বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য এক পণ্য ছিল তামা, যা ওমানের খনি থেকে আহরণ করা হতো। মূল্যবান এই ধাতু দিলমুন থেকে জাহাজবোঝাই করে মেসোপটেমীয় সভ্যতার শহর সমূহে নিয়ে যাওয়া হতো। ধারণা অনুযায়ী, ঐসময় তামার একচেটিয়া ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল দিলমুনের বণিকদের দখলে।
ভাষা ও লিখনপদ্ধতি
দিলমুনবাসী লিখার জন্য ব্যবহার করত কিউনিফর্ম লিখন পদ্ধতি। পূর্ব সেমিটিক ভাষায় কথা বলত তারা, যা আক্কাদীয় ভাষার উপভাষা হিসেবে পরিগণিত। দেবতা ইনজাক এবং তার স্ত্রী পানিপা ছিল দিলমুনের প্রধান দেব-দেবী।
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ
দিলমুনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হাজির করতে হলে সবার প্রথমে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তা হলো দিলমুনের অবস্থান সম্পর্কে।বিশ্লেষকদের তথ্যানুযায়ী, বাহরাইন ছাড়াও দিলমুন কুয়েত, উত্তরপূর্ব সৌদি আরব, ইরাকের আল-কারনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এমনকি একজন ইতিহাসবিৎ মনে করতেন, প্রাচীনকালে দিলমুন দিয়ে মূলত সিন্ধু সভ্যতাকেই বোঝানো হতো। ১৯৫০ এর দশকে কাল’আত আল-বাহরাইনে আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে খননকার্য চালানো হতে অবসান ঘটে সকল জল্পনা-কল্পনা এবং বিতর্কের। বর্তমানে এই স্থানকে প্রাচীন দিলমুনের পোতাশ্রয় এবং রাজধানী হিসেবে ধরা হয়। এর বর্তমান অবস্থান দ্বীপের উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত সার গ্রামে।
খ্রি.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম তিনশ’ বছরে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিলমুন। খ্রি.পূ. ১৩৬৫ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ১০৫০ অব্দ পর্যন্ত মধ্য অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য দিলমুনের ভূমি শাসন করেছে। পারস্য উপসাগরে খ্রি.পূ. ১০০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ৮০০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে পারস্য উপসাগরে জলদস্যুদের দৌরাত্ম বেড়ে যাওয়ায় ভাটা পড়ে দিলমুনের বাণিজ্যিক গৌরবে। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম, সপ্তম এবং ষষ্ঠ সহস্রাব্দে যথাক্রমে নব্য-অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য, নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য এবং এরপর আকেমেনিড সাম্রাজ্য শাসন করেছে দিলমুনকে।
ইসিনে প্রাপ্ত এক শিলালিপি অনুসারে, দিলমুন ছিল মেসোপটেমীয় শাসনের বহির্ভূত এক রাজ্য। এখানে দিলমুনের রাজকীয় উপঢৌকনসমূহেরও উল্লেখ রয়েছে। উত্তর লেভান্তের আমোরাইট রাজ্য মারির সাথেও এর সুসম্পর্ক ছিল। খ্রি.পূ. ১৭৮০ অব্দের দিকে ইয়াগলি-এল এবং তার পিতা রিমুম নামে দুজন সম্রাটের অস্তিত্ব ছিল দিলমুনে।
এখানে মোট সাতটি ধাপে মানববসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। পঞ্জিকার হিসেবে তা প্রায় ২৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের। পুরনো এই বাসস্থান ছাড়াও কাল’আত আল-বাহরাইনে অসংখ্য সমাধির সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, এখানে প্রায় ৩০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে প্রায় ১৭০,০০০ সমাধি স্তূপ বিদ্যমান, যা দ্বীপের পুরো আয়তনের ৫%। এর মধ্য অধিকাংশ সমাধির স্তূপ খ্রি.পূ. তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের, এবং কোনো সন্দেহ ছাড়াই সেগুলো দিলমুন সভ্যতারই অংশ। তাই অনেকে বিশ্বাস করেন, এই দ্বীপকে প্রাচীন আরবের বাসিন্দারা গোরস্থান হিসেবে ব্যবহার করত।