দুর্বোধ্য বার্তা থেকে বৃটিশ ইন্টারসেপ্টররা যেভাবে তথ্য উদ্ধার করতেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা। ততদিনে মানুষের কণ্ঠস্বর দূর দূরান্তে পাঠানোর প্রযুক্তি এসে গেছে। তবে সামরিক বার্তা পাঠাতে তখনো মোর্স কোড ব্যবহৃত হতো। কারণ সিগন্যাল হিসেবে মানুষের কণ্ঠস্বর জটিল। তাই এটি বাঁধার সম্মূখীনও হয় বেশি। অন্যদিকে শুধুমাত্র ডট ও ড্যাশের সমন্বয়ে গঠিত মোর্স কোড সিগন্যালের সবচেয়ে সরল রূপ, তাই এটি পাঠাতে প্রযুক্তিগত জটিলতা কম, নিশ্চয়তাও বেশি। তাছাড়া বিভিন্ন সাংকেতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে মোর্স কোডে পাঠানো বার্তাকে নিরাপদ করাও ছিল সহজতর।

শত্রুপক্ষের কথোপকথনে আড়ি পেতে তাদের হাঁড়ির খবর জানার চেষ্টা করা একটি বহু পুরনো যুদ্ধকৌশল। আধুনিক যুগে এসে কথোপকথন যখন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হয় তখন আড়ি পাতা হয়ে গেছে আরো সহজ। কেউ এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবে কেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দু’পক্ষই এ কৌশল অবলম্বন করেছিল । বৃটিশরা এ কাজের জন্য অনেককে নিয়োগ করেছিল। তারা পরিচিত ছিল ‘ইন্টারসেপ্টর’ নামে।

ইন্টারসেপ্টরদের কাজ ছিল রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা জার্মান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ডিভিশনের বেতারে টিউন করে থাকা। কিন্তু জার্মানদেরও বোকা ভাবার কারণ নেই। আড়ি পাতার সম্ভাবনা আছে জেনে তারা বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষায় তথ্য আদান-প্রদান করতো, যা সহজে অন্য কারো পক্ষে বুঝা সম্ভব ছিল না। তবে মজার বিষয় হচ্ছে দুর্বোধ্য জার্মান টেলিগ্রামগুলোর কোনো অর্থ বের না করেও বৃটিশরা গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য পেয়ে যেতো। কী বলা হচ্ছে তা বুঝতে না পারলেও কীভাবে তথ্য পেত তা নিয়েই আজকের আলোচনা। 

মোর্স কোডের ছক; Image Source: fineartamerica.com

এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে মোর্স কোড সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া দরকার। মোর্স কোড হলো এক বিশেষ সাংকেতিক ভাষা। এতে দু’টি সাংকেতিক চিহ্ন আছে। ডট(.) ও ড্যাশ(-)। ডট ও ড্যাশের বিভিন্ন রকম বিন্যাসের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন অক্ষর নির্দেশ করা হয়। বিভিন্ন ইংরেজি অক্ষরের জন্য মোর্স কোডের একটি টেবিল উপরের ছবিতে দেখানো হয়েছে। 

ডট-ড্যাশ হচ্ছে মোর্স কোডের লিখিত রূপ। সবসময় ডট-ড্যাশ ব্যবহার করে মোর্স কোড পাঠানো হয় না। টেলিগ্রাফের ক্ষেত্রে মোর্স কোড পাঠানো হতো ‘বিপ’ শব্দ ব্যবহার করে। ডটের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত বিপ, আর ড্যাশের জন্য তুলনামূলক দীর্ঘ বিপ। এরকম এক বা একাধিক ছোট ও দীর্ঘ বিপ মিলে একটি অক্ষর গঠন করতো। ছোট ও দীর্ঘ বিপ ছাড়াও এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বিরতি। দু’টি অক্ষরের মধ্যকার বিরতি সামান্য দীর্ঘ, দু’টি শব্দের মধ্যকার বিরতি আরেকটু দীর্ঘ।

এ মোর্স কোড পাঠানোর জন্য নির্দিষ্ট টেলিগ্রাফ অপারেটর থাকতো। তারা একটি সুইচের মতো ডিভাইসের মাধ্যমে এই ডট, ড্যাশ তথা বিপ কোড পাঠাতো। এ ডট, ড্যাশ ও বিরতি সব কিছুর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সময়ের নির্দেশনা দেওয়া ছিল। যেমন ধরুন- ডটের জন্য এক সেকেন্ড ধরে সুইচ অন রাখলে ড্যাশের জন্য তিন সেকেন্ড। 

মোর্স কোড পাঠানোর সুইচ; Image Source: qrznow.com

কিন্তু বাস্তবে মোর্স কোড পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো অপারেটরের পক্ষেই এ নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেনে চলা সম্ভব হতো না। বরং প্রত্যেক অপারেটরের একটি নিজস্ব ছন্দ বা প্যাটার্ন গড়ে উঠতো। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে একজন অপারেটরের কোড শুনেই তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব হতো। এ বিষয়টি অনেকটা আমাদের হাতের লেখার মতো। হাতের লেখায় যেমন আমাদের স্বাতন্ত্রের প্রকাশ ঘটে তেমনই মোর্স কোডের ক্ষেত্রেও ঘটে। মোর্স কোড পাঠানোর এ স্বতন্ত্র প্যাটার্নকে ফিস্ট বলা হয়। আর এ ফিস্টই বৃটিশদের সাহায্য করেছে জার্মান শিবিরের তথ্য যোগাড় করতে।

বৃটিশরা জার্মানদের টেলিগ্রাফে আড়ি পেতে অনেক ক্ষেত্রে তাদের কথাবার্তার অর্থ না বুঝলেও, ভিন্ন ভিন্ন অপারেটরকে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। অনেক দিন ধরে লাগাতার কোনো ইউনিটের রেডিওতে আড়ি পাতলে কোডের ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্ন দেখে বোঝা যেত, ঐ ইউনিটে কয়জন অপারেটর আছে, কে কখন কাজ করে ইত্যাদি। তাদের কথোপকথনে মূল বার্তা ছাড়া সাধারণ আলাপ আলচনাও থাকতো। যেমন ‘কেমন আছ?’, ‘বান্ধবী কেমন আছে?’ অথবা ‘মিউনিখে আজকে আবহাওয়া কেমন?’ ইত্যাদি। 

এ ধরনের আলাপ আলোচনা পর্যবেক্ষণ করে সে রেডিও অপারেটর সম্পর্কে একটি মোটামুটি ধারণা নিয়ে ফেলা কঠিন কিছু না। বৃটিশ ইন্টারসেপ্টররা এটিই করতেন। তারা কোডের প্যাটার্ন দেখে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতেন। তাদের ফিস্টের ধরন ও বিস্তারিত বর্ণনা লিখে রাখতেন। এরপর তাদের আরো কথোপকথন পর্যবেক্ষণ করে তাদের একটি বিস্তারিত প্রোফাইল তৈরি করতেন। তাদের ভিন্ন ভিন্ন নামও দিতেন।

সামরিক রেডিও অপারেটর; Image Source: pinterest.com

এরপর কোনো মেসেজ শুনলেই বৃটিশরা সেই অপারেটরকে তার প্রোফাইলের সাথে মিলিয়ে চিহ্নিত করতেন। অপারেটরকে চিহ্নিত করার পর, তারা কোন জায়গা থেকে বার্তা পাঠানো হচ্ছে তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করতেন। এভাবে তাদের হাতে দু’টি তথ্য চলে আসত- কে মেসেজটি পাঠাচ্ছে এবং কোথা থেকে পাঠাচ্ছে? 

এ বিষয়টি বৃটিশ সেনাবাহিনীর কাছে মূল্যবান হয়ে উঠে। এর মাধ্যমে তারা জানতে পারে, কোন ইউনিট কখন কোন জায়গায় অবস্থান করছে। এটি তাদের যুদ্ধের নকশা সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা দিতে সক্ষম হয়। যেমন আজকে কোনো অপারেটরকে দেখা যেত ফ্লোরেন্স থেকে মেসেজ পাঠাচ্ছে, কয়েক সপ্তাহ পর সেই একই অপারেটরের মেসেজ ধরা পড়তো লিঞ্জ থেকে। এখান থেকে ধারণা করা যেত যে, সেনাবাহিনীর ঐ ইউনিটটি ইতালির উত্তর প্রান্ত থেকে সরে পূর্বপ্রান্তে অবস্থান নিয়েছে।

এছাড়া কোনো ইউনিটের কাজের গতি সম্পর্কেও একটি ভালো ধারণা পাওয়া যায় এ ফিস্ট অনুসরণ করে। ধরুন কোনো অপারেটরের সম্পর্কে জানা যেত যে, সে একটি ট্যাঙ্ক মেরামত ইউনিটের সাথে আছে এবং প্রতিদিন বারোটার দিকে বার্তা পাঠায়। এরপর একটি বড়সড় যুদ্ধের পর দেখা গেল সে একই অপারেটর বারোটায় একবার, বিকাল চারটায় একবার, সন্ধ্যা সাতটায় আবার বার্তা পাঠাচ্ছে।  এখান থেকে সহজেই বোঝা যায়, ঐ ইউনিটের কাজের গতি তখন অনেকটাই বেড়ে গেছে।

কাজে ব্যস্ত ইন্টারসেপ্টররা; Image Source: pinterest.com

কিংবা কোনো সংকটময় মুহূর্তে হয়তো কেউ জিজ্ঞেস করতো, তুমি কী নিশ্চিত করে বলতে পারো যে ‘লুফতওয়াফে ফ্লাইগারকর্পস’ (জার্মানির বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন) এখন ইতালির বাইরে আছে কিনা? তখন হয়তো ইন্টারসেপ্টররা নিশ্চয়তার সাথে জবাব দিতে পারতো হ্যাঁ অস্কার ছিল তাদের অপারেটর, আজকেই তার মেসেজ অন্যস্থান থেকে ধরা পড়ছে। তাই বলা যায় সে এখন নিশ্চিতভাবে ইতালিতে নেই।

ইন্টারসেপ্টরদের এ নিশ্চয়তার কারণ ছিল ফিস্টের নির্দিষ্ট প্যাটার্নটি কখনো বদলাতো না। এটি স্বাভাবিকভাবেই চলে আসতো। অপারেটররা কেউ নিজেকে আলাদা করতে ইচ্ছা করে এটি করতো না। তারা স্বাভাবিকভাবে পাঠাতে গিয়েই আলাদা হয়ে উঠতো। কারণ তাদের ব্যক্তিত্বের একটি অংশ স্বয়ংক্রিয় ও অসচেতনভাবেই তাদের মোর্স কোড পাঠানোর ক্ষেত্রে ছাপ রেখে যেত, আমাদের হাতের লেখাতেও যেমনটা হয়।

এ ফিস্টের আরেকটা বিষয় হচ্ছে এটি মেসেজের অল্প একটু অংশের মাঝেও প্রকাশ পেত। কাউকে চিহ্নিত করার জন্য তার পাঠানো অনেক দীর্ঘ মেসেজের দরকার পড়তো না। একবার কাউকে চিনে ফেললে তার পাঠানো একটি ক্ষূদ্র মেসেজ দেখেও কেউ বলে দিতে পারতো এটি কে। আর এর জন্য খুব বেশি প্রযুক্তিগত দক্ষতারও প্রয়োজন ছিল না। অনেক বৃটিশ ছেলে মেয়ে যারা শখের বসে রেডিও নিয়ে কাজ করতো কিংবা সাধারণ কোনো স্বেচ্ছাসেবক স্বল্প প্রশিক্ষণের পরই এটি করতে পারতো। অল্পতেই তারা হয়ে উঠতে পারতো সেনাবাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যের যোগানদাতা।

তথ্যসূত্র

Blink: The Power of Thinking Without Thinking (2005) by Malcolm gladwell

ফিচার ইমেজ- smithsonianmag.com

Related Articles

Exit mobile version