স্কুল
এপ্রিল – ডিসেম্বর ১৯৪৬
সাচিকোকে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে বাবা তার কথা রেখেছিলেন। প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে তিনি ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করে ফেলেছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে বেশ উৎফুল্ল ছিলো সাচিকো। স্কুলটাও তার কাছে চকলেটের মতোই হবে বলে মনে হচ্ছিলো! সে-ও দ্বিতীয় শ্রেণীর আরো অনেক শিক্ষার্থীর সাথে পরিচিত হবে; পড়তে, লিখতে এবং যোগ-বিয়োগ করতে শিখবে। যুদ্ধের কারণে সে হয়তো প্রথম শ্রেণীতে পড়াশোনা করতে পারেনি, এটা সত্য, কিন্তু এটা তেমন একটা ঝামেলা করবে না বলেই বিশ্বাস ছিলো সাচিকোর। মনে মনে সে ইচিরোকে সবকিছু জানাবে বলে ঠিক করলো।
এপ্রিলের মৃদুমন্দ হাওয়া সাচিকোর গাল ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। বাবার হাত ধরে সাচিকো কোয়াগির স্কুলের আঙিনায় প্রবেশ করলো। দিনটি ছিলো সেই বছরে স্কুলেরও প্রথমদিন। বাবা আবারও পুরনো কথাই মনে করিয়ে দিলেন, “স্যার-ম্যাডামদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে সাচিকো। তারাই তোমাকে সবকিছু শিখিয়ে দেবেন।”
প্রথমেই তারা গেলো স্কুলের অফিস রুমে। প্রিন্সিপাল স্যার তাকে আগাগোড়া ভালোভাবে দেখে নিলেন। কিন্তু সাচিকোর মনে হচ্ছিলো, স্যার তার মাথার চুল না ওঠা অংশ, ভগ্নস্বাস্থ্য, পুরনো ও ছোট হয়ে যাওয়া জামাকাপড় এবং সেকেন্ডহ্যান্ড জুতো জোড়া খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন।
বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন প্রিন্সিপাল স্যার, তারপর সাচিকোর দিকে ফিরে কথা বলতে শুরু করলেন, “তোমাকে বেশ ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ভালো হয় যদি তুমি আবার প্রথম শ্রেণী থেকেই শুরু করো।”
প্রথম শ্রেণী?
প্রিন্সিপাল স্যারের কথা শুনে সাচিকোর মনে হলো, কেউ তার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে।
আপনাআপনিই সাচিকোর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো “না” শব্দটি। সেই সাথে রাগে মাটিতে পা ঠুকতে লাগলো সে। “কেন দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে না?”
সাচিকোর এমন ব্যবহারে বাবা পুরোই তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন। “সাচিকো, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন মা?”
বাবার দিকে তাকিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার ফিসফিস করে বললেন, “এটা তো কোনোভাবেই সম্ভব না। আমার তো মনে হয় মেয়েটা ওর নিজের নামও লিখতে পারে না।”
“না,” বলে আবারও প্রতিবাদ করে উঠলো সাচিকো। তার গলার স্বরটা এবার বেশ চড়েই গিয়েছিলো। যদি সে হার মেনে নেয়, তাহলে স্বপ্নে ইচিরো তাকে কী বলবে? তাকে অবশ্যই সামনে এগিয়ে যেতেই হবে।
“না। আমাকে যদি প্রথম শ্রেণী থেকেই শুরু করা লাগে, তাহলে আমি স্কুলেই যাবো না।”
সাচিকোর কথাটা শুনে খানিকটা সময় চিন্তাভাবনা করলেন স্যার। এরপর তিনি জবাবে জানালেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে। সাচিকোকে আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতেই ভর্তি হতে দেবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।” এটুকু বলেই বাবার দিকে তাকালেন তিনি, “যদি সে তাদের সাথে তাল মেলাতে না পারে, তাহলে তাকে আবার প্রথম শ্রেণী থেকেই শুরু করতে হবে।”
… … … …
টিফিন বক্সটা কাছে নিয়ে ক্লাসে বসে ছিলো সাচিকো। কর্ন পাউডার আর মিষ্টি আলু দিয়ে মা তার জন্য রুটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। পুরো রুমটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো সে। কাচের জানালা, কাঠের টেবিল, চেয়ার, বই- সব মিলিয়ে তাদের নতুন বাসার তুলনায় ক্লাস রুমটাকেই একটি প্রাসাদের মতো ঠেকছিলো তার কাছে।
দ্বিতীয় শ্রেণীর নতুন বইগুলো তার সামনেই রাখা ছিলো। মার্কিন সেনারা তাদের দেশ দখল করে নেয়ায় স্কুলগুলোতে নতুন আইন জারি করা হয়েছিলো। প্রতিটি স্কুল কর্তৃপক্ষকেই বলা হয়েছিল যেন সম্রাট হিরোহিতোর ছবি দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেলা হয়। শিক্ষকদের বলা হয়েছিল, যদি পুরনো বইগুলোতে সম্রাট এবং জাপানী সেনাবাহিনী নিয়ে সামান্যতম লেখালেখিও থাকে, তবে তারা যেন তাদের শিক্ষার্থীদের সেসব কলম দিয়ে দাগ টেনে কেটে দিতে বলেন। শিক্ষার্থীরাও নতুন কিছু শব্দ শিখলো। তাদেরকে শেখানো হলো, তিনটি শব্দ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং শান্তি। কিন্তু শান্তি আর স্বাধীনতা যে কেবল পাঠ্যবইয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ কিছু শব্দ না!
পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে যারা বেঁচে আসতে পেরেছিলো, খেলার মাঠে নিয়মিতই তাদের নিয়ে হাসি-তামাশা করা হতো। তাদের নাম বিকৃত করে অন্যরা মজা নিতো। “টাকলা”, “ভূত”, “টেম্পুরা” বলে গালি দেয়া হতো। উল্লেখ্য, টেম্পুরা বলতে সবজি, মাছ এবং অন্য আরো বেশ কিছু জিনিস কড়া করে ভেজে প্রস্তুতকৃত একপ্রকার জাপানী খাবারকে বোঝায়।
মাথাভর্তি চুল, পায়ে জুতা-মোজা পরা সাচিকোর অন্যান্য বন্ধুবান্ধব তার দিকে অদ্ভুতভাবে চেয়ে থাকতো।
“তুমি প্রতিদিন কেন একই রকম বিশ্রী পোশাক পরে আসো?”
“তোমার গলায় এত ময়লা কেন?”
“তুমি কি কখনো চুল পরিষ্কার করো না?”
“তুমি কেন পড়তে পারো না?”
“তুমি কেন ২+৩ সমান কত হয় সেটাও বলতে পারো না?”
“তুমি কি বোকার হদ্দ? আলসে?”
একজন তো সাচিকোর টিফিনই চুরি করে বসলো। আস্তে আস্তে স্কুলের প্রতি সাচিকোর ঘৃণা জন্মাতে লাগলো।
রাতের বেলা স্বপ্নে ইচিরো দেখা করতে আসতো সাচিকোর সাথে। “সবার খেয়াল রেখো,” ইচিরোর বলা এই শেষ কথাগুলোই কানে বাজতো তার।
কিন্তু সে কীভাবে করবে এটা?
প্রতিদিন স্কুল শেষে মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতো। বন্ধুবান্ধবদের এই ঝামেলা সম্পর্কে সে যে মাকে কী বলবে তা সে নিজেই বুঝতে পারতো না। তার ভেতরের কষ্টটা সে খুলে বলতে পারতো না।
নিজের এই মানসিকভাবে বিহ্বল অবস্থা সে কীভাবে বোঝাবে? অ্যাসেম্বলির সময় ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে না পারা, কোনোকিছুতে মন বসাতে না পারা, একাকিত্ব, অন্যদের হাসি দেখলে তীব্র ঈর্ষা- এমন নানা ধরনের মানসিক যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করার মতো অবস্থাই তার ছিলো না।
মা নিজেও তার কাজকারবার নিয়ে কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সাথে বাবা এবং মিসাও।
“আমাকে বলো যে, তুমি কেন একটা জিনিসও বুঝতে পারছো না?” সাচিকোর টেবিলে আঙুল ঠেকিয়ে সরাসরি তার দিকেই কড়া ভাষায় প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন তার শিক্ষক। “আমাকে বলো, কেন?” এমনকি শিক্ষকও সাচিকোর আচার-আচরণকে কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
সত্যি বলতে, সাচিকো যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তা তারা কীভাবে বুঝবেন? মার্কিন দখলদারদের অধীনে সবকিছুই বেশ কড়া নজরদারিতে রাখা হচ্ছিলো। মানবদেহের উপর পারমাণবিক বোমার বিকিরণ থেকে সৃষ্ট ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণের উপায় ছিলো না। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সিনেমা, বই, বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র- সবকিছুই সেন্সরশিপ এজেন্টরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো। পারমাণবিক বোমা হামলার সাথে সম্পর্কিত কোনোরুপ সমালোচনা, তথ্য কিংবা এর প্রভাব নিয়ে থাকা যাবতীয় ছবি হয় মুছে ফেলা হতো, নতুবা কালি দিয়ে কেটে দেয়া হতো। এমনকি জাপানী শব্দ ‘গেনশি বাকুদান’ (পারমাণবিক বোম) ছাপানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিলো।
কাঁদতে কাঁদতে তাই আকাশের দিকে চেয়ে ভাইকে খুঁজতো সাচিকো, “ইচিরো, আমাকে সাহায্য করো।”
… … … …
“প্রতিদিন যদি স্কুল থেকে আসার পর কান্নাকাটি করার শক্তি থাকে, তাহলে নিজের মনের কথা প্রকাশের শক্তিও তোমার আছে,” একদিন হঠাৎ করেই সাচিকোকে এই কথাগুলো বলে উঠলেন মা। তিনি সাচিকোর হাতে একটি রড ধরিয়ে দিলেন। এরপর দুজনে মিলে বাইরে গিয়ে মাটির উপর বসলো।
মায়ের সাহায্য নিয়ে রড দিয়ে সে মাটিতে দাগ কাটতে লাগলো। একটি খাড়া রেখা, একটি বক্ররেখা, একটি অনুভূমিক রেখা। প্রতিটি অক্ষরের প্রতিটি অংশই খুব সতর্কভাবে আঁকতে হচ্ছিলো। একসাথে মিলে তারা তার নামটিই লিখলো- ‘সাচিকো’।
পা দিয়ে অক্ষরগুলো মুছে ফেললেন মা। তিনি বলে উঠলেন, “সাচিকো, আবার।”
প্রতিদিনই সাচিকো মাটিতে তার লেখালেখির চর্চা চালাতে লাগলো। সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত একনাগাড়ে কাজটি করে যেত সে। অন্ধকার নেমে আসার আগপর্যন্ত তার চর্চা অব্যহত থাকতো। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস সে এই কাজই করে গেলো।
স্কুলে সেই বছরের শেষে প্রিন্সিপাল স্যার সাচিকোকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সাচিকো তার মাথা নোয়ালো। নিজের টেবিলে রাখা একটি কাগজ হাতে নিয়ে তিনি বললেন, “তোমার বাবা-মাকে এটা দেখিও।” তিনি তার হাতে কাগজটা দিলেন। সেখানে খুব সুন্দর হরফে কিছু কথা লেখা ছিলো। আসলে দ্বিতীয় শ্রেণীয় পড়াশোনা সাফল্যের সাথে শেষ করাতেই সাচিকোকে এই সনদপত্রটি দিয়েছিলেন তিনি।
সাচিকো ছুটে গেলো বাসায়। মনটা তার আনন্দে ভরে উঠেছিলো। মেয়ের এমন সাফল্যে মায়ের মুখেও হাসি দেখা গেলো। বোমা হামলার পর এই প্রথম মাকে হাসতে দেখলো সাচিকো। একসাথে তারা আকি, ইচিরো আর মামার ছাই রাখা, কাপড়ে মোড়ানো সেই বড় বাক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাঝের বাক্সটির সামনে মা সাচিকোর সনদপত্রটি রাখলেন।
হাতে হাত জড়ো করে সাচিকো প্রার্থনার উদ্দেশ্যে মাথা নত করে ফেললো।
“ইচিরো, এই যে আমি, তোমার সাচান। দেখ ভাইয়া, আমি পেরেছি।”
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
১) পর্ব – ১ || ২) পর্ব – ২ || ৩) পর্ব – ৩ || ৪) পর্ব – ৪ || ৫) পর্ব – ৫ || ৬) পর্ব – ৬ || ৭) পর্ব ৭ || ৮) পর্ব ৮ || ৯) পর্ব ৯