বেলারুশের সীমান্তবর্তী ইউক্রেনের এক ছোট্ট শহর পৃপিয়াত। বয়স খুব বেশি নয়, ১৯৭০ সালে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পৃপিয়াত নদীর নাম থেকে এই শহরের নামকরণ করা হয়। বিখ্যাত চেরনোবিল শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এবং ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ১০৪ কিলোমিটার উত্তরে এই শহরের অবস্থান।
সত্তরের দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নবম পারমাণবিক শহর হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি পায় পৃপিয়াত। এখানে চারটি রিঅ্যাকটার বিশিষ্ট একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে সোভিয়েত সরকার। যার নাম দেওয়া হয় ভি আই লেনিন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট। এটি চেরনোবিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নামে অধিক পরিচিত।
১৯৭২ সাল থেকে চেরনোবিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের নির্মাণ শুরু করে সোভিয়েত সরকার। এই পাওয়ার প্লান্টের সুবাদে পৃপিয়াতকেও গড়ে তোলা হয় আধুনিকতার ছাঁচে। বড় বড় অট্টালিকা থেকে শুরু করে চওড়া রাস্তাঘাট এবং আধুনিক সব স্থাপনায় ছেয়ে যেতে থাকে শহরটি।
এখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। এদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন যুবক। যাদের গড় বয়স ছিল ২৬ বছর। সেই সঙ্গে শহরের মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগের বয়স ছিল ১৮ বছরেরও কম। শহরের বসবাসকারীদের বড় একটি অংশ ছিল চেরনোবিল পাওয়ার প্লান্টের শ্রমিক। তারা কয়েক বছর ধরে সেখানে কাজ করে আসছিল। তাদের বিনোদনের জন্য খেলাধুলার পাশাপাশি আরো অনেক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। গড়ে তোলা হয় ১০টি জিম, ১০টি শ্যুটিং কমপ্লেক্স, তিনটি সুইমিং পুল এবং দুটি স্টেডিয়াম।
পুরোপুরি সোভিয়েত ও ইউক্রেনের ক্রীড়া ও সংস্কৃতির বড় এক প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে পৃপিয়াত। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে এফসি স্ট্রোইরেল পৃপিয়াতের যাত্রা শুরু হয়। ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেন শহরের পার্শ্ববর্তী চিস্তোগালোভকার ফুটবলাররা। তারা মূলত ছিলেন পাওয়ার প্লান্টের কর্মী। নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে তারা ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। সত্তরের দশক থেকে চিস্তোগালোভকা ছিল চেরনোবিল ও কিয়েভ অঞ্চলের সবচেয়ে বিখ্যাত ফুটবল দল। তাদের অধিনায়ক ভিক্টর পোনোমারেভ ছিলেন পৃপিয়াতের অন্যতম সেরা ফুটবলার। তার নেতৃত্বে এফসি স্ট্রোইরেল পৃপিয়াত প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে সোভিয়েত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা স্ট্রোইরেল পৃপিয়াত প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি হলেন ভাসিলি কিজিমা ট্রোফিমোভিচ। সোভিয়েত ইউনিয়নে তিনি বেশ সম্মানিত এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার কাজ ও আনুগত্যের জন্য সরকারের কাছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘অর্ডার অব লেনিন’ পান।
ট্রোফিভিচ বুঝতে পেরেছিলেন পাওয়ার প্লান্টের তরুণ শ্রমিকদের জন্য একটি ফুটবল দলের প্রয়োজন। এতে তারা কাজের পাশাপাশি খেলাধুলা করার সুযোগ পাবে। পরবর্তীতে ট্রোফিমোভিচ ফুটবল ক্লাব তৈরির নির্দেশ দেন। এবং তার নির্দেশনা অনুযায়ী ক্লাবের জন্য খেলোয়াড় খোঁজা শুরু হয়। এই ঘোষণার সাথে সাথে চিস্তোগালোভকার শ্রমিকরা নিজেদের ফুটবল দক্ষতার প্রদর্শন শুরু করেন। তাদের কয়েকজনের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে স্ট্রোইটেল পৃপিয়াত। ইউক্রেনের স্থানীয় ভাষায় ‘স্ট্রোইটেল’ শব্দের অর্থ হলো ‘বিল্ডার বা নির্মাণকারী’।
ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই তারা বিভিন্ন আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করা শুরু করে। শুরুতে স্ট্রোইটেল অপেশাদার ফুটবল দল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তাদের গণ্ডি ছিল শুধুমাত্র কিয়েভ ও তার আশেপাশের অঞ্চল। ১৯৮০-৮১ মৌসুমে স্ট্রোইটেলের নেতৃত্ব দেন ডায়নামো কিয়েভ ও চার্নোমোরেটসের সাবেক ফুটবলার আনাতোলি শেপেল। তার অধিনায়কত্বে আঞ্চলিক ফুটবলে নিজেদের অপ্রতিরোধ্য করে তোলে স্ট্রোইরেল। ১৯৮১ সালে তারা কিয়েভের অ্যামেচার ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয় এবং পরের বছর আরো দুটি শিরোপা জিতে নিজেদের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখে।
১৯৮১ সালে স্ট্রোইটেল প্রথমবারের মতো কেএফকে চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে। এই চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল ইউক্রেনের অপেশাদার দলগুলোর সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট। এখানে চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে পেশাদার ফুটবলে নাম লেখানোর সুযোগ দেওয়া হতো। কিন্তু প্রথমবারের অংশগ্রহণে ভালো ফলাফল করতে ব্যর্থ হয় স্ট্রোইটেল। প্রথমবার অষ্টম দল হিসেবে শেষ করলেও ১৯৮২ সালে তলানিতে থেকে চ্যাম্পিয়নশিপ শেষ করে।
এর বছর বাদে, অর্থাৎ ১৯৮৫ সালেই স্ট্রোইটেল অভাবনীয় সাফল্য পায়। চার পয়েন্টের ব্যবধানে তারা রানার্স-আপ হয়। সে বছর তারা অ্যামাচার ডিভিশনে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড গড়ে। লোকোমোটিভ জিনেমেনকার জালে মোট তেরো বার বল পাঠায়।
দলের উন্নতি দেখে ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য নতুন একটি স্টেডিয়াম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তাদের পুরনো স্টেডিয়ামে সুযোগ-সুবিধার কোনো কমতি ছিল না। এরপরও তাদের পুরস্কার হিসেবে এই স্টেডিয়াম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন স্টেডিয়ামের নাম দেওয়া হয় অ্যাভানহার্ড স্টেডিয়াম।
স্টেডিয়াম তৈরির সময় চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পঞ্চম রিঅ্যাকটার বসানোর কাজ চলছিল। তখন ভাসিলি ট্রোফিমোভিচ স্টেডিয়াম সম্পর্কে বলেন,
“জনগণের কাছে নতুন রিঅ্যাকটারের মতো নতুন এই স্টেডিয়ামটিও গুরুত্বপূর্ণ।”
পাঁচ হাজার আসন বিশিষ্ট স্টেডিয়ামটি উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৮৬ সালের মে মাসের প্রথম দিন। এই দিনটি বেছে নেওয়ার বিশেষ কারণ ছিল, সেদিন হলো আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমিকদের জন্য নির্মিত কোনো স্টেডিয়াম উদ্বোধন করার জন্য এর চেয়ে ভালো দিন আর কী-ই বা হতে পারে!
কিন্তু দুর্ভাগ্য ছিল স্ট্রোইটেল পৃপিয়াতের। দুর্ভাগা ছিলেন ক্লাবের ফুটবলাররা। তাদের জন্য নির্মিত নতুন স্টেডিয়ামে তাদের খেলার সুযোগ হয়নি। তার আগেই ঘটে ইতিহাসের অন্যতম বড় দুর্ঘটনা। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল রাতে চেরনোবিল পাওয়ার প্লান্টের চার নম্বর রিঅ্যাকটারের টেকনিশিয়ানরা একটি পরীক্ষা করার জন্য রিঅ্যাকটারের পাওয়ার রেগুলেটিং সিস্টেম এবং ইমার্জেন্সি সেফটি সিস্টেম বন্ধ করে দেন। সবগুলো কন্ট্রোল রড বের করে সাত শতাংশ বিদ্যুৎ চলাচল করান টেকনিশিয়ানরা।
এটাই ছিল তাদের অন্যতম বড় এক ভুল। রাত ১টা ২৩ মিনিটে রিঅ্যাকটারের চেইন বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বেশ কয়েক বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয় চার নম্বর রিঅ্যাকটার।
যেদিন চেরনোবিল পাওয়ার প্লান্টে দূর্ঘটনা ঘটে সেদিন ম্যাশিনোস্ট্রোইটেলি কাপে বোরোদিয়ানকাকে আতিথ্য দেওয়ার কথা ছিল স্ট্রোইটেলের। সফরকারীরা মাঠে অনুশীলন করার সময় একটি হেলিকপ্টার মাঠের মধ্যে নামে। হেলিকপ্টার থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তামূলক পোশাক ও মাস্ক পরে বের হন। ম্যাচটিকে বাতিল ঘোষিত হয়। একই দিন স্থানীয় যুব ফুটবলারদের জন্য একটি টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার কথা ছিল। সেটিও বাতিল করা হয়।
দুর্ঘটনার পরপরই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। ৩৬ ঘণ্টার মাথায় নিরাপত্তার জন্য পৃপিয়াত শহরের পঞ্চাশ হাজার অধিবাসীকে শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে স্লাভুতিকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর তারা আর কখনোই নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারেননি। ফিরতে পারেননি স্ট্রোইটেলের কোনো ফুটবলার। তবে ক্লাবের দুই সদস্য পোনোমারেভ এবং আলেকজান্দ্রার ভিশনেভস্কি উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য থেকে যান।
১৯৮৬ সালে কেএফকে চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয় স্ট্রোইটেল। এক বছরের মধ্যে তারা কোনো ফুটবল ম্যাচে অংশগ্রহণ করেনি। ১৯৮৭ সালে স্ট্রোইটেল আবারো মাঠে নামে। কিন্তু এবার নতুন নামে। এফসি স্ট্রোইটেল স্লাভুতিক। যেহেতু স্লাভুতিক শহরে পৃপিয়াতের অধিবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাই ক্লাবের নামেও পৃপিয়াতের বদলে জায়গা করে নেয় স্লাভুতিক। পৃপিয়াতের কয়েকজন সাবেক খেলোয়াড় মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নয়া নামের নয়া এই ক্লাব।
প্রতিষ্ঠার পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে স্ট্রোইটেল স্লাভুতিক কেএফকে চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় হয়। কিন্তু ১৯৮৮-তে অষ্টম দল হিসেবে টুর্নামেন্ট শেষ করায় ব্যর্থতাক্লিষ্ট খেলোয়াড়েরা ক্লাব ছেড়ে দিতে থাকেন। ফলাফলস্বরূপ, ভেঙে যায় স্লাভুতিক। ১৯৯৪ সালে সালে এফসি স্লাভুতিক নামে নতুন একটি ক্লাব গড়ে ওঠে। যার সাথে স্ট্রোইটেল পৃপিয়াতের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
চেরনোবিল দুর্ঘটনা শুধুমাত্র মানুষের জীবনহানি ও পরিবেশের বিপর্যয়ই ঘটায়নি। এই ঘটনায় করুণভাবে হারিয়ে গেছে একটি ফুটবল ক্লাব ও তাদের জন্য নির্মিত নতুন স্টেডিয়াম। ওদিকে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর পৃপিয়াত পরিণত হয়েছে এক ভুতুড়ে শহরে। সেখানে সবকিছু প্রায় আগের মতোই আছে, কিন্তু সেখানে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোই নেই। চেরনোবিল পাওয়ার প্লান্ট এখন জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। তার অন্যতম আকর্ষণ অ্যাভানহার্ড স্টেডিয়াম। যে স্টেডিয়ামে কখনো পা পড়েনি এফসি স্ট্রোইটেল পৃপিয়াতের ফুটবলারদের। অথচ এ আয়োজন কিন্তু উপভোগ করবার কথা ছিল তাদেরই!