প্রথম মেসিডোনিয়ান যুদ্ধ পঞ্চম ফিলিপের হাতকে শক্তিশালী করেছিল। রোম যখন কার্থেজের মোকাবেলা করছে, তখন ফিলিপ গ্রিসে ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাতে তার প্রভাব বর্ধনের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এর সূত্র ধরে ইজিয়ান সাগরে মিশরের অধীনস্থ অঞ্চলের দিকে তার চোখ পড়ল। ২০৩/২০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চতুর্থ টলেমির মৃত্যুর পর তার চার বছরের সন্তান পঞ্চম টলেমি হিসেবে সিংহাসনে অভিষিক্ত হলে ফিলিপের সামনে সুবর্ণ সুযোগ ধরা দিল।
সিরিয়ার সম্রাট তৃতীয় অ্যান্টিওকাসের সাথে জোট বাঁধলেন তিনি। চুক্তি হলো যে, ইজিয়ান সাগরের তীরবর্তী অঞ্চল যাবে ফিলিপের দখলে, আর অ্যান্টিওকাস নেবেন ফিনিশিয়া ও প্যালেস্টাইন। টলেমির উপদেষ্টারা ফিলিপ ও অ্যান্টিওকাসের পরিকল্পনার আঁচ পেয়ে রোমের কাছে বন্ধু হিসেবে সাহায্যের বার্তা পাঠালেন।
এদিকে অ্যান্টিওকাসের সাথে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ফিলিপ তার নৌশক্তি বৃদ্ধি করতে লাগলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, পূর্বে হেলেস্পন্ট (বর্তমান দারদানেল্লিস, ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগকারী প্রনালি) পর্যন্ত নিজের ক্ষমতা বিস্তার করা। সে উদ্দেশ্যে মধ্য ইজিয়ান সাগরে ঘাঁটি স্থাপন করতে তিনি কিওস দ্বীপ অবরোধ করলেন।
কিওস ও ল্যাডার নৌযুদ্ধ (২০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): ফিলিপকে বাধা দিতে পার্গামনের রাজা অ্যাটালাস আর রোডিয়ান নৌবাহিনী রওনা হলো। ছোটবড় মিলিয়ে ফিলিপের জাহাজ ছিল প্রায় ২০০, অন্যদিকে তার প্রতিপক্ষের জাহাজ মাত্র ৬৫ টির মতো।
অ্যাটালাস ও রোডিয়ানরা মিলে তাকে পেছন দিক থেকে চেপে ধরল। ফিলিপের পতাকাবাহি জাহাজ শত্রুপক্ষের জাহাজে আঘাত করে আটকে গেলে পার্গামনের জাহাজ সেটা ধ্বংস করে দেয়, ফলে ফিলিপের অ্যাডমিরালসহ অনেক যোদ্ধার সলিল সমাধি ঘটে। মেসিডোনিয়ান বহরের অন্য অংশে রোডিয়ানরা আক্রমণ করে। তাদের নাবিকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা মেসিডোনিয়ানদের তুলনায় বেশি ছিল, ফলে তারা ফিলিপের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।
ফিলিপ পালিয়ে যান এবং পড়ে স্থলযুদ্ধে অ্যাটলাস ও রোডিয়ানদের পরাস্ত করে রোডসের দিকে অগ্রসর হন। এখানে ল্যাডার কাছে আরেকটি নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। তবে এই যুদ্ধে কে জয় পেয়েছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে।তবে সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ফিলিপের পূরণ হয়নি। ২০১-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শীতে বার্গলিয়া উপসাগরে অ্যাটালাস ও রোডিয়ানরা আবার তাকে ঘিরে ধরে। কোনমতে ফিলিপ পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেন।এরপর তিনি নৌশক্তি হিসেবে মেসিডনিয়াকে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।
অ্যাবিডোস দখল ও রোমের আল্টিমেটামঃ ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তে ফিলিপের বাহিনী থ্রেসের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অ্যাবিডোস অবরোধ করলেন। হেলেস্পন্ট নিয়ন্ত্রন করতে এই শহর তার দরকার। তুমুল যুদ্ধের পর তার সেনারা শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে। শহরের সকল পুরুষ নাগরিককে হত্যা করা হয়, নারী ও শিশুরা হয় বন্দি।
প্রায় একই সময় ইজিপ্ট, অ্যাটলাস ও রোডিয়ানদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোমান সিনেটের দূত হিসেবে মার্কাস অ্যামেলিয়াস লেপিডাস ফিলিপের কাছে বার্তা নিয়ে আসেন। তাকে শর্ত দেয়া হয়, অবিলম্বে গ্রিসে সকল সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করার, ইজিপ্টে ও তার অধীনস্থ অঞ্চলে পঞ্চম টলেমির কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়ার এবং অ্যাটলাস ও রোডিয়ানদের সাথে বিবাদের মীমাংসা করতে রোমান সিনেটের মধ্যস্ততা মেনে নেয়া। সিনেট ভাল করেই জানত, ফিলিপ এসব মানবেন না। সুতরাং তিনি স্বাভাবিকভাবেই যখন রোমের শর্ত অগ্রাহ্য করলেন, তখন রোম মেসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিল।
দ্বিতীয় মেসিডোনিয়ান যুদ্ধ (২০০-১৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
শরৎকাল, ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
রোমান কন্সাল সাল্পিসিয়াস গ্যালবাসের অধীনে রোমান সেনাদল অ্যাড্রিয়াটিক পাড়ি দিয়ে অ্যাপোলনিয়াতে এসে অবতরণ করে। এখানে শীত কাটিয়ে ১৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি মেসিডোনিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করলেন। ফিলিপের সেনাবাহিনী কাছাকাছি এসে তাঁবু ফেলল। দু পক্ষের সেনাপ্রধান কিছু অশ্বারোহী যোদ্ধা প্রেরণ করেন প্রতিপক্ষের অবস্থা বোঝার জন্য। তাদের মধ্যে সংঘর্ষে ৪০ জন মেসিডোনিয়ান ও ৩৫ জন রোমান হতাহত হয়।
ফিলিপ ঘাঁটি করেছিলেন পাহাড়ের ওপর। তার সাথে ২০,০০০ পদাতিক ও ২,০০০ অশ্বারোহী। সাল্পিসিয়াস সেনাসমাবেশ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন, কিন্তু ফিলিপ পাহাড় থেকে নামলেন না। আসলে রোমের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করার ইচ্ছা তার ছিল না। তাই তিনি তার অশ্বারোহী ও হাল্কা অস্ত্রে সজ্জিত যোদ্ধাদের পাঠালেন অতর্কিত রোমান সেনাদের আক্রমণ করতে। তারা ব্যর্থ হলে ফিলিপ পরদিন তার অশ্বারোহী যোদ্ধাদের পাঠালেন, উদ্দেশ্য ছিল- এরা রোমানদের থেকে পালিয়ে যাওয়ার ছল করে তাদের অ্যামবুশের ভেতর টেনে আনবে। এ কৌশলও ব্যর্থ হল। কাজেই শেষ পর্যন্ত ফিলিপ ক্যাম্প গুটিয়ে থেসালির দিকে চলে গেলেন, যেখানে ইটালিয়ান লিগ উৎপাত করছিল। এদিকে শীত চলে আসতে থাকলে সাল্পিসিয়াস আবার অ্যাপোলনিয়াতে ফিরে গেলেন।
পরবর্তী বছরও কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়াই কেটে গেল। ফিলিপ ঘাঁটি করেছিলেন এয়ুস নদীর কাছে এক পাহাড়ের ঢালে, যেখান থেকে এপিরাস ও থেসালির দিকে রোমান সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা বিঘ্নিত করা যাবে। এই সময় রোমান সেনানায়ক ছিলেন ভিলাস, তিনি ফিলিপের ১৩ কিলমিটার দূরে শিবির করে বসে থাকলেন।তখন নতুন রোমান কন্সাল টাইটাস ফ্ল্যামিনিনাস বাড়তি ৮,০০০ পদাতিক আর ৮০০ অশ্বারোহী নিয়ে এসে পৌঁছলেন।
এয়ুসের যুদ্ধ (১৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
ফিলিপের অবস্থান যথেষ্ট দুর্ভেদ্য ছিল। কাজেই কয়েকবার আক্রমণ করেও ফ্ল্যামিনিনাস কিছু করতে পারলেন না। এমন সময় স্থানীয় এক রাখাল রোমানদের সহায়তা করল। সে ফিলিপের অগোচরে মেসিডোনিয়ান বাহিনীর পেছন দিকে যাবার এক রাস্তা দেখিয়ে দিল। ফ্ল্যামিনিনাস ৪০০০ পদাতিক ও ৪০০ অশ্বারোহীকে সেই পথে পাঠিয়ে ফিলিপের দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে বাকি সৈন্য নিয়ে সামনে থেকে আবার আক্রমণ করলেন। মেসিডোনিয়ান সেনারা তার আক্রমণ সহজেই ঠেকিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু তাদের পেছনে রোমান বাহিনীর উপস্থিতি তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে তারা পালিয়ে যেতে থাকে।
ফিলিপ মেসিডোনিয়ার দিকে চলে গেলেন। ফ্ল্যামিনিনাস তখন থেসালির শহরগুলোতে আক্রমণ চালান। তবে শীত চলে আসলে তিনি পিছিয়ে আসেন। পড়ে ১৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম ও মেসিডোনিয়া নিজ নিজ মিত্র নিয়ে শান্তিচুক্তির আলোচনায় বসে। কিন্তু রোমান সিনেট চাইছিল ফিলিপকে সামরিকভাবে পদানত করতে। তাই তারা জেনেশুনে এমন সব শর্ত দেয়, যা ফিলিপের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। আলোচনা ভেঙে গেল।
ব্যাটল অফ সাইনোসসেফালি (১৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
রোমের সাথে চূড়ান্ত সংঘর্ষের লক্ষে ফিলিপ তার বাহিনী থেসালিতে একত্র করলেন। তার সাথে ছিল ২৫,০০০ এর মতো সৈনিক। অন্যদিকে ফ্ল্যামিনিনাসের সাথে ছিল প্রায় ৩০,০০০ সেনা।
ফিলিপ সাইনোসসেফালি পাহাড়ের উপর পাহারা বসিয়ে কাছাকাছি শিবির করলেন। এদিকে রোমানরা তাকে খুজতে খুজতে পাহাড়ের প্রহরীদের কাছে চলে আসলে দু পক্ষের মধ্যে ছোট সংঘর্ষ হয়। ফিলিপ ও ফ্ল্যামিনিনাস তখন পূর্ণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিলেন।
মেসিডোনিয়ান বাহিনীর মূল শক্তি তার ফ্যালানক্স। সারিবদ্ধ যোদ্ধারা যখন একসাথে বর্শা হাতে অগ্রসর হয় তখন তারা অজেয়। কিন্তু ফ্যালানক্সের পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে সমতল ভুমি দরকার,যা এই পাহাড়ের ঢালে পাওয়া কঠিন। তদুপরি ফ্যালানক্সের মূল শক্তিই ছিল তার দুর্বলতা। সারিবদ্ধ যোদ্ধারা প্রয়োজন হলে দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করতে পারত না, এবং শত্রুসেনারা যদি কোনোভাবে ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ত, তাহলে তারা ফ্যালানক্স অসহায় হয়ে পড়ত, কারণ ক্লোজ কোয়ার্টার কমব্যাটের জন্য তাদের লম্বা বর্শা উপযোগী নয়। রোমান লিজিওনের সে সমস্যা নেই, তারা অত্যন্ত নমনীয় এবং যেকোনো ভূমিতে যুদ্ধ করার দক্ষতা সম্পন্ন। তাদের তরবারিও সম্মুখযুদ্ধের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর অস্ত্র।
ফিলিপ পাহাড়ের উপর থেকে তার বাহিনীর ডান বাহুর নেতৃত্ব দিয়ে নিচের ঢালে থাকা রোমান সেনাদলের দিকে এগিয়ে এলেন। তার নির্দেশে জেনারেল নিকানর বাম বাহুর দায়িত্ব নেন। ফ্ল্যামিনিনাস তার ডান বাহু রিজার্ভে রেখে বাম বাহুর সেনাদের সাজিয়ে ফিলিপের মুখোমুখি হলেন।
রোমান সেনারা মেসিডোনিয়ানদের থেকে নিচুতে থাকায় তাদের এমনিতেই অসুবিধা হচ্ছিল, এর মধ্যে ফিলিপের ফ্যালানক্সের চাপে তারা পিছু হটে যেতে থাকে। তখন ফ্ল্যামিনিনাস তার ডানবাহুকে নিয়ে ফিলিপের বাম বাহুতে নিকানরের উপর হামলা করে বসলেন। নিকানর তখন পর্যন্ত সেনাদের সাজাতেই পারেননি। তাই ফ্ল্যামিনিনাসের আক্রমণে তার বাহুর পতন ঘটে। সৈন্যরা বিশৃঙ্খলভাবে পালাতে থাকে।
নিকানর ব্যর্থ হওয়ায় ফিলিপের ডান বাহু, যা রোমানদের বিরুদ্ধে সফল হচ্ছিল, তারা বিপদে পড়ে যায়। কারণ, রোমান যে সেনারা নিকানরকে পরাস্ত করেছে, তারা এখন ফিলিপের থেকে উচ্চভূমিতে আছে। ফ্যালানক্সের পেছনে কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা ছিল না, রোমান সেনারা সেদিক দিয়ে ঢুকে তাদের কচুকাটা করতে থাকে। প্রায় ৮,০০০ মেসিডোনিয়ান সেনা নিহত হয়, আরো ৫,০০০ রোমানদের হাতে বন্দি হয়। রোমানদের হতাহত ছিল ৭০০।
ফিলিপ সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে রোমের শর্তে তিনি শান্তিচুক্তি করেন। মেসিডোনিয়া ছাড়া তার অধীনস্থ সকল অঞ্চল তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়, গ্রিসের কোনো ব্যাপারে তার হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা হয় এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০০০ ট্যালেন্ট (১,২০০,০০০ মার্কিন ডলারের সমমূল্য) দিতে সিনেট তাকে বাধ্য করে। ফিলিপের গ্রিক শত্রুরা তার পরিপূর্ণ ধ্বংস চাইলেও ফ্ল্যামিনিনাস রাজি হননি। তিনি বহিঃশত্রু, বিশেষ করে দানিউবের ধারের কেল্টিক জাতির বিরুদ্ধে গ্রিসের সুরক্ষায় মেসিডোনিয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন।
পরবর্তী বছর ইস্থমাস গেমসে ফ্ল্যামিনিনাস মেসিডোনিয়ার আগ্রাসন থেকে গ্রিসের মুক্তি ঘোষণা করেন এবং রোমের সমস্ত সৈন্য গ্রিস থেকে সরিয়ে নেবার অঙ্গীকার করেন। এরপর ১৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফ্ল্যামিনিনাস ও রোমান সেনাদল গ্রিস ত্যাগ করে।