১৫১৭ সাল। জার্মান ক্যাথলিক ধর্মগুরু মার্টিন লুথার যখন রোমান ক্যাথলিক চার্চের বাইরে এসে চার্চের দুর্নীতিগুলো একে একে তুলে ধরছিলেন, তখন পুরো ইউরোপ জুড়ে প্রোটেস্টাইনদের উদ্ভব শুরু হয়। চার্চের অনিময়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করে সংস্কারপন্থী খ্রিস্টানরা। গোঁড়া ক্যাথলিক ও সংস্কারপন্থী প্রোটেস্টানদের রেষারেষি শুরু তখন থেকেই। তবে এ রেষারেষিতে ভিন্নমাত্রা যোগ হয় যখন এ রেনেসাঁ আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ে ইংল্যান্ড রাজ পরিবার। ইউরোপ জুড়ে চলমান প্রোটেস্টাইনদের এ আন্দোলনের রেশ গিয়ে পড়ে ইংল্যান্ডেও। ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা হেনরি অষ্টম আরো তাতিয়ে দেন এ আন্দোলনকে। ক্যাথলিক পরিবারের একজন রাজা কেন যোগ দিলেন প্রোটেস্টাইনদের আন্দোলনে? কী স্বার্থ ছিলো তার?
অষ্টম হেনরির জন্ম হয় ১৪৯১ সালের ২৯ জুন। প্রথমে তিনি আয়ারল্যান্ডের লর্ড এবং পরবর্তীতে আয়ারল্যান্ডের রাজা হন। তার বাবা ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম হেনরি আর মা ছিলেন এলিজাবেথ অফ ন্যুইয়র্ক। বাবা সপ্তম হেনরির মৃত্যুর পর ১৫০৯ সালে তিনি ইংল্যান্ডের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ড শাসন করেন।
হেনরি অষ্টম তার জীবদ্দশায় মোট ছয়টি বিয়ে করেছিলেন। তার স্ত্রীরা হচ্ছেন ক্যাথারিন অফ আর্গন, এনিবোলিন, জেইন সাইমার, এনি ক্ল্যাভিস, ক্যাথারিন হাওয়ার্ড ও ক্যাথারিন পার। এত বিবাহের পরও মাত্র তিন সন্তানের পিতা ছিলেন তিনি। সন্তানরা হলেন এলিজাবেথ, এডওয়ার্ড ও মেরি। এই লেখায় ক্যাথারিন অফ আর্গন, এনিবোলিন ও হেনরির মাঝে সম্পর্ক ও তার ভবিষ্যৎ ফলাফল নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
ক্যাথারিন অফ আর্গন ছিলেন হেনরির প্রথম স্ত্রী। স্পেনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রানী ইসাবেলের কন্যা ছিলেন ক্যাথেরিন। ক্যাথেরিন ছিলেন হেনরির বড় ভাই আর্থারের স্ত্রী। আর্থার মাত্র ১৫ বছর বয়সে মারা যান। কিন্তু বিয়ের সময় স্পেন থেকে নেয়া অজস্র উপঢৌকন ফেরত দেয়ার কোনো উপায় ছিল না রাজা সপ্তম হেনরির। যে কারণে তিনি তার ছোট ছেলে অষ্টম হেনরির সাথে ক্যাথেরিনের বিয়ে দেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, হেনরি যে ৬টি বিয়ে করেছিলেন তাদের কারো গর্ভে কোনো সন্তানের জন্ম হয়নি। বিভিন্ন সময় সন্তান জন্ম নিলেও তারা শিশুকালেই কোনো না কোনো অপঘাত বা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতো। এ নিয়ে বেশ বিষন্ন থাকতেন রাজা হেনরি। সিংহাসনের উত্তরাধিকার কাকে করে যাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকতেন সব সময়।
বিয়ের পরে হেনরি ও ক্যাথেরিনের সন্তানের জন্ম হয়। হেনরি খুব করে চাচ্ছিলেন অন্তত একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হোক। কিন্তু এবারেও একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় মেরি, ইতিহাস যাকে ব্লাডি মেরি হিসেবে মনে রেখেছে। মুষড়ে পড়া হেনরি এক পর্যায়ে ক্যাথেরিনের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এক পর্যায়ে তার সাথে ক্যাথেরিনের এক সখীর সাথে প্রেম হয়। তার নামই ছিলো এনিবোলিন, যিনি ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের মা!
হেনরির সাথে প্রণয়ের এক পর্যায়ে এনিবোলিন সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। তখন হেনরি ভেবে দেখেন, এনিবোলিনের যে সন্তান হবে সে যদি ছেলে সন্তান হয় তবে তার সিংহাসন রক্ষা হবে। কিন্তু সেই সন্তানের চাই সামাজিক স্বীকৃতি, চাই হেনরি-এনিবোলিনের বৈবাহিক পরিচয়। সব দিক ভেবে হেনরি ঘোষণা দিলেন তিনি এনিবোলিনকে বিয়ে করবেন। পাশাপাশি তিনিও এও বলে দিলেন যে এনিবোলিনের সন্তান হবে ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকার!
কিন্তু হেনরির এ সিদ্ধান্তে বাদ সাধলো ইংল্যান্ডের চার্চের আর্চ-বিশপ। তখনকার সময়ে দেশগুলোতে রাজা ও আর্চ-বিশপদের মাঝে অনেকটা স্নায়ুযুদ্ধ লেগেই থাকতো। ক্ষমতার জোরে রাজারা দেশ পরিচালনা করলেও আজন্ম ধর্মভীরু মানুষেরা যুগ যুগ ধরেই ধর্মগুরুদের আলাদাভাবে সম্মানের চোখে দেখে আসতো। যে কারণে দেশগুলোর চার্চের আর্চ-বিশপদের মতামত ও সিদ্ধান্তের প্রভাবও ছিলো ব্যাপক। চার্চগুলো স্বাধীন ও কেন্দ্রীয়ভাবে রোমান ক্যাথলিক পোপের অধীনে থাকায় ও ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় রাজারা সরাসরিভাবে চার্চের সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব খাটাতে পারতেন না।
ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের নিয়ম মতে, স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য বিয়ে করা বাইবেল সম্মত নয়। সুতরাং, ধর্মীয় রীতি লঙ্ঘন হবে এই কারণ দেখিয়ে আর্চ বিশপ হেনরির এ বিয়ে অবৈধ ও এনিবোলিনের গর্ভে থাকা সন্তানকেও অবৈধ বলে ঘোষণা দেন। তবে, এ ঘোষণার পেছনে ধর্মীয় অনুশাসন যতটা না কার্যকর ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক প্ররোচনা।
হেনরির দ্বিতীয় বিয়ে ও এনিবোলিনের সন্তানের সিংহাসন গ্রহণ কোনোভাবেই ক্যাথেরিন মেনে নিতে পারেননি। তৎকালীন রোম ছিল স্পেনের অধীনে। ক্যাথলিক মূল ধর্মগুরু পোপ থাকতেন রোমে। আর স্পেনের রাজা তখন ক্যাথেরিনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, রাজা ফিলিপ দ্য ফিফথ। সুতরাং অনুমেয়ভাবেই পোপের উপর রাজা ফিলিপের প্রচ্ছন্ন একটি কর্তৃত্ব ছিল। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই পোপ এ বিয়েকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন।
আর্চ-বিশপের এমন সিদ্ধান্তে যারপরনাই রেগে যান হেনরি। তখন ইউরোপের প্রোটেস্টাইনদের রিফর্মেশন আন্দোলন আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। হেনরি এ সুযোগটিকে কাজে লাগালেন। তিনি সুযোগ বুঝে ইংল্যান্ডে থাকা ক্যাথলিক আর্চ-বিশপকে চার্চ থেকে বের করে দেন ও একইসাথে রোমান ক্যাথলিক চার্চের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন। নতুনভাবে তিনি চার্চে আর্চ-বিশপ নিয়োগ দেন।
এবার হেনরি নিজের নিয়োগ দেওয়া আর্চ-বিশপের কাছে জানতে চান তিনি এনিবোলিনকে বিয়ে করলে তা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হবে কিনা। খুব স্বাভাবিকভাবেই নতুন আর্চ-বিশপের রায় হেনরির পক্ষে যায়। অর্থাৎ নতুন আর্চ বিশপের সিদ্ধান্ত মতে, হেনরি চাইলে এখন এনিবোলিনকে বিয়ে করতে পারবেন এবং তাদের সন্তান ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারবে।
এবার দ্বন্দ্ব শুরু হয় ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টাইনদের মাঝে। প্রোটেস্টাইনরা দাবী করে, খ্রিস্টধর্মের কেনান আইন অনুযায়ী কোনো পুরুষ তার ভাবীকে বিয়ে করতে পারে না। সুতরাং, যেহেতু হেনরি ধর্ম মতে, নিজের বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারে না, সেহেতু ক্যাথেরিনের সাথে তার বিয়ে ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্যই না। অর্থাৎ ক্যাথেরিন আর হেনরির বিয়েই হয়নি।
এ যুক্তি দাঁড় করিয়ে হেনরির সমর্থকেরা তখন এনালমেন্টের দাবী তোলে। সুতরাং ধর্মীয় রীতি মেনে নতুন বিয়ে করতে গেলে তার ক্যাথেরিনের অনুমতির প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে, ক্যাথলিকরা দাবী তোলে, এনিবোলিন যেহেতু বিয়ের পূর্বেই সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েছেন, সুতরাং তার সন্তান ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক না কেন তা অবৈধ সন্তান হবে। অবৈধ সন্তান ইংল্যান্ডের রাজসিংহাসনের দাবীদার হতে পারে না।
কিন্তু হেনরির প্রভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত আর্চ বিশপের সম্মতিক্রমে দুটি আইন পাশ হয়। এক, হেনরি ও এনিবোলিনের বিয়ে খ্রিস্টধর্ম মতে বৈধ। দুই, ছেলে হোক বা মেয়ে, এনিবোলিনের গর্ভের সন্তানই হবে ইংল্যান্ডের পরবর্তী উত্তরাধিকার। সব জল্পনা কল্পনা শেষে হেনরি-এনিবোলিনের ঘরে জন্ম নেয় আবারো একটি কন্যা শিশু। যাকে ইংল্যান্ড মনে রেখেছে তাদের ইতিহাসের অন্যতম সফল রানী হিসেবে। হেনরি-এনিবোলিনের এ কন্যাসন্তান আমাদের কাছে রানী প্রথম এলিজাবেথ নামে পরিচিত! যিনি পরবর্তীতে দীর্ঘকাল ইংল্যান্ডকে একচ্ছত্রভাবে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে শাসন করেছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে রাজা হেনরি বেশ নিষ্ঠুর শাসক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ক্যাথেরিনের মৃত্যুর পর তিনি ইংল্যান্ডে আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেন। পাশাপাশি, তার ৬ স্ত্রীর মাঝে বেশ কয়েকজনকেই বিভিন্ন কারণে তিনি অপরাধী সাব্যস্ত করেন, শাস্তি প্রদান করেন, এমনকিও প্রাণদন্ডে দন্ডিতও করেন। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এ রাজা ১৫৪৭ সালের ২৮ জানুয়ারি হোয়াইটহলে মৃত্যুবরণ করেন। যতদূর জানা যায়, তিনি অতিরিক্ত স্থুলতার কারণে হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
রাজা অষ্টম হেনরি মূলত ইংরেজ রেনেসাঁ আন্দোলনের সময় নাটকীয় অবদান রাখার কারণে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ন একজন রাজা হিসেবেই স্থান করে নিয়েছেন। স্বার্থের জন্যে হোক আর ধর্ম সংস্কার, প্রোটেস্টাইনদের পক্ষে তার অবস্থান নেওয়া, রোমান চার্চের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের মত দুঃসাহস দেখানো, পোপের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের মতো করে আর্চ-বিশপ নিয়োগ, প্রতিটি ঘটনাই তাকে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে। ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনেও রহস্যময়তা ও নিষ্ঠুরতার জন্যে রাজা হেনরির জীবনী আজও গবেষণার বিষয় হয়ে আছেন।