এসপিওনাজ জগৎ নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, তাদের অনেকেই রিচার্ড সোর্গে, ইসহাক আখমেরভ, কিম ফিলবি কিংবা রুডলফ অ্যাবেলের মতো বিশ্ববিখ্যাত গুপ্তচর এবং ফেলিক্স জেরজিনস্কি, লাভ্রেন্তি বেরিয়া, পাভেল সুদোপ্লাতভ বা ইউরি আন্দ্রোপভের মতো খ্যাতিমান স্পাইমাস্টারদের নাম শুনেছেন। এরা ছিলেন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা ও গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর সদস্য, এবং নিজেদের কার্যকলাপের জন্য তারা এসপিওনাজের ইতিহাসে এক একজন কিংবদন্তী হিসেবে বিবেচিত।
কিন্তু সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ও গুপ্ত পুলিশ বাহিনীগুলোর নাম প্রায়ই পাঠকদের বিভ্রান্ত করে। চেকা, এনকেভিডি, স্মের্শ, কেজিবি – কয়টা গোয়েন্দা সংস্থা আর গুপ্ত পুলিশ বাহিনী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে? এগুলো কি সব একই সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন নাম, নাকি ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার নাম? সংস্থাগুলোর নামের অর্থই বা কী ছিল? চলুন, আর দেরি না করে সংক্ষেপে একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ও গুপ্ত পুলিশ বাহিনীগুলোর নামের বিবর্তনের ইতিহাস দেখে নেয়া যাক!
(১) চেকা: ‘প্রতিবিপ্লব ও অন্তর্ঘাতবিরোধী নিখিল রুশ বিশেষ কমিশন’ (Всероссийская чрезвычайная комиссия по борьбе с контрреволюцией и саботажем, ‘ভেসেরোসিস্কায়া চ্রেজভিচায়নায়া কমিসিয়া পো বোর্বে এস কন্ত্ররেভোলিউৎসিয়েই ই সাবোতাঝেম’) – এটিই ছিল সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রথম গোয়েন্দা সংস্থা ও গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম। সংক্ষেপে এটি ‘নিখিল রুশ বিশেষ কমিশন’ (Всероссийская чрезвычайная комиссия) নামে পরিচিত ছিল। সংস্থাটির সংক্ষিপ্ত রুশ নামের শব্দ তিনটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী এটিকে ‘ভেচেকা’ (ВЧК) নামে অভিহিত করা হতো। পরবর্তীতে এটি আরো সংক্ষিপ্ত রূপে ‘চেকা’ (ЧК) নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর নবগঠিত সোভিয়েত রুশ সরকার ‘ভেচেকা’/’চেকা’ গঠন করে। সংস্থাটি সরাসরি সোভিয়েত ‘জনকমিশার পরিষদ’–এর অধীনস্থ ছিল। উল্লেখ্য, সেসময় সোভিয়েত মন্ত্রিপরিষদ ‘জনকমিশার পরিষদ’ নামে পরিচিত ছিল। ফেলিক্স জেরজিনস্কি ছিলেন সংস্থাটির প্রথম সভাপতি এবং তাকে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯১৮ সালের জেরজিনস্কির অনুপস্থিতিতে চেকার উপসভাপতি জেকাবস পিটার্স স্বল্প সময়ের জন্য সংস্থাটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
বলশেভিক বিপ্লবের পর সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত সরকারের অবস্থান সুদৃঢ়করণ এবং বলশেভিকদের অভ্যন্তরীণ শত্রুদের নির্মূল করার ক্ষেত্রে চেকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলশেভিক সরকারকে উৎখাত করার জন্য অন্তত ১৪টি রাষ্ট্র (যেগুলোর মধ্যে ছিল ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, পোল্যান্ড ও ইতালি) রাশিয়ায় আক্রমণ চালিয়েছিল এবং বিদেশি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও চেকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ শত্রুদের দমনের ক্ষেত্রে চেকা ব্যাপক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছিল এবং বলশেভিকবিরোধীদের দমনের এই প্রক্রিয়া ‘লাল সন্ত্রাস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
(২) জিপিইউ: ১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি চেকার নাম পরিবর্তন করা হয় এবং সংস্থাটির নতুন নাম রাখা হয় ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক প্রশাসন’ (Государственное политическое управление, ‘গোসুদার্স্তভেন্নোয়ে পলিতিচেস্কোয়ে উপ্রাভ্লেনিয়ে’)। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ তিনটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী একে ‘গেপেউ’ (ГПУ) নামে অভিহিত করা হত। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘জিপিইউ’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
জিপিইউ সোভিয়েত ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলি সংক্রান্ত জনকমিশারিয়াত’–এর (Народный комиссариат внутренних дел, ‘নারোদনি কমিসারিয়াৎ ভেনুত্রেন্নিখ দেল’) অধীনস্থ ছিল। এই জনকমিশারিয়াতটিকে তার রুশ নামের শব্দ চারটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী ‘এনকেভেদে’ (НКВД) নামে অভিহিত করা হত এবং ইংরেজি ভাষায় এটি ‘এনকেভিডি’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। কার্যত এনকেভিডি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জেরজিনস্কি ছিলেন জিপিইউয়ের একমাত্র সভাপতি।
(৩) ওজিপিইউ: ১৯২৩ সালের ১৫ নভেম্বর জিপিইউকে এনকেভিডি থেকে পৃথক করা হয় এবং সংস্থাটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘সংযুক্ত রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক প্রশাসন’ (Объединённое государственное политическое управление, ‘ওবেদিনিয়োন্নোয়ে গোসুদার্স্তভেন্নোয়ে পলিতিচেস্কোয়ে উপ্রাভ্লেনিয়ে’)। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ চারটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী এটিকে ‘ওগেপেউ’ (ОГПУ) নামে অভিহিত করা হত। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘ওজিপিইউ’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
ওজিপিইউ প্রায় সাড়ে ১১ বছর ধরে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ও গুপ্ত পুলিশ বাহিনী হিসেবে বিরাজ করে। সংস্থাটি সরাসরি সোভিয়েত ‘জনকমিশার পরিষদ’ (অর্থাৎ, মন্ত্রিপরিষদ)–এর অধীনস্থ ছিল। প্রথমে জেরজিনস্কি এবং পরবর্তীতে ভিয়েস্লাভ মেজিনস্কি সংস্থাটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নবগঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্র কার্যত শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল এবং সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোর সিংহভাগ তো বটেই, কার্যত বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই সেসময় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল। এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ওজিপিইউ বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। এছাড়া বিদেশে অবস্থানরত বলশেভিকবিরোধী ‘শ্বেত রুশ’ নেতাদের নির্মূল করার ক্ষেত্রেও ওজিপিইউ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
(৪) জিইউজিবি: ১৯৩৪ সালের ১০ জুলাই ওজিপিইউকে ‘জনকমিশার পরিষদ’–এর কর্তৃত্ব থেকে ‘এনকেভিডি’র অধীনস্থ করা হয় এবং সংস্থাটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘মূল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রশাসন’ (Главное управление государственной безопасности, ‘গ্লাভনোয়ে উপ্রাভ্লেনিয়ে গোসুদার্স্তভেন্নোয় বেজোপাস্নোস্তি’)। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ চারটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী এটিকে ‘গেউগেবে’ (ГУГБ) নামে অভিহিত করা হত। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘জিইউজিবি’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
জিইউজিবি এনকেভিডির অধীনস্থ ছিল। গেনরিখ ইয়াগোদা, ইয়াকভ আগ্রানভ, মিখাইল ফ্রিনোভস্কি, লাভ্রেন্তি বেরিয়া এবং ভেসেভলোদ মের্কুলভ পর্যায়ক্রমে সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জিইউজিবি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ইউরোপ জুড়ে ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ও সমরবাদের জয়জয়কার এবং একই সঙ্গে জাপানের সঙ্গেও সোভিয়েত ইউনিয়ন তীব্র দ্বন্দ্বে লিপ্ত। তদুপরি, পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘শীতল লড়াই’ অব্যাহত ছিল। এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কার্যত বিদেশি গুপ্তচরে ছেয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় জিইউজিবি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে বিদেশি গুপ্তচরদের নির্মূলকরণ এবং শত্রু রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু ১৯৩৭–১৯৩৮ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব জোসেফ স্তালিনের অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে যে নির্মম শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়, জিইউজিবি এর ভুক্তভোগী হয় এবং বেশকিছু জিইউজিবি সদস্য এই শুদ্ধি অভিযানের ফলে প্রাণ হারান।
(৫) এনকেজিবি: ১৯৪১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি জিইউজিবিকে এনকেভিডি থেকে পৃথক করা হয় এবং নতুন একটি জনকমিশারিয়াতে (কার্যত মন্ত্রণালয়) রূপান্তরিত করা হয়। নতুন মন্ত্রণালয়টির নামকরণ করা হয় ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা জনকমিশারিয়াত’ (Народный комиссариат государственной безопасности, ‘নারোদনি কমিসারিয়াৎ গোসুদার্স্তভেন্নোয় বেজোপাস্নোস্তি’)। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ চারটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী একে ‘এনকেগেবে’ (НКГБ) নামে অভিহিত করা হত। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘এনকেজিবি’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
এনকেজিবি অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময় স্থায়ী ছিল এবং এই স্বল্প সময়ে জিইউজিবির পূর্ববর্তী প্রধান ভেসেভলোদ মের্কুলভ সংস্থাটির জনকমিশার (কার্যত মন্ত্রী) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
(৬) এনকেভিডি: ১৯৪১ সালের ২০ জুলাই এনকেজিবিকে পুনরায় এনকেভিডির অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কিন্তু জিইউজিবি হিসেবে নয়, বরং বিভিন্ন শাখা হিসেবে। এর ফলে এনকেভিডি–ই কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব পালন করতে থাকে। এ সময় লাভ্রেন্তি বেরিয়া এনকেভিডির জনকমিশার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
(৭) এনকেজিবি: ১৯৪৩ সালের ১৪ এপ্রিল প্রাক্তন এনকেজিবির শাখাগুলোকে পুনরায় এনকেভিডি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং পৃথক একটি জনকমিশারিয়াতে রূপান্তরিত করা হয়। এসময় ভেসেভলোদ মের্কুলভ এনকেজিবির জনকমিশার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
(৮) এমজিবি: ১৯৪৬ সালের ১৮ মার্চ এনকেজিবির নাম পরিবর্তন করা হয় এবং সংস্থাটির নতুন নাম রাখা হয় ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়’ (Министерство государственной безопасности, ‘মিনিস্তেরস্তভো গোসুদার্স্তভেন্নোয় বেজোপাস্নোস্তি’)। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ তিনটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী একে ‘এমগেবে’ (МГБ) নামে অভিহিত করা হত। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘এমজিবি’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
এমজিবি প্রায় সাত বছর ধরে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ও গুপ্ত পুলিশ বাহিনী হিসেবে বিরাজ করে। ভিক্তর আবাকুমভ, সের্গেই ওগোলৎসভ এবং সেমিয়ন ইগ্নাতিয়েভ পর্যায়ক্রমে সংস্থাটির মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছিল এবং উভয় পক্ষ একটি ‘স্নায়ুযুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়েছিল। স্বভাবতই এসময় উভয় পক্ষে একে অপরের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতার মাত্রা বৃদ্ধি করে। পূর্ব ইউরোপের সদ্য স্থাপিত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর ওপর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং শত্রু রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর ক্ষেত্রে এমজিবি বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন পরমাণু বোমা প্রকল্পে এমজিবি নিজেদের গুপ্তচর অনুপ্রবেশ করাতে সক্ষম হয় এবং তাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে দ্রুত পরমাণু বোমা তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়তা করে।
(৯) এমভিডি: ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ এমজিবিকে ‘এমভিডি’র সঙ্গে অঙ্গীভূত করা হয়। এমভিডি–এর পূর্ণরূপ ছিল ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলি সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়’ (Министерство внутренних дел, ‘মিনিস্তেরস্তভো ভেনুত্রেন্নিখ দেল’) এবং এটি ছিল কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ তিনটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী এটিকে ‘এমভেদে’ (МВД) নামে অভিহিত করা হত। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘এমভিডি’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
এমভিডিতে এমজিবির অন্তর্ভুক্তির ফলে এমভিডি–ই কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থায় পরিণত হয়। অবশ্য গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে এমভিডির কার্যকাল ছিল স্বল্পস্থায়ী। এ সময় প্রথমে লাভ্রেন্তি বেরিয়া এবং পরবর্তীতে সের্গেই ক্রুগলভ সংস্থাটির মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
(১০) কেজিবি: ১৯৫৪ সালের ১৩ মার্চ এমভিডি থেকে গোয়েন্দা ও গুপ্ত পুলিশ কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং নতুন একটি গোয়েন্দা সংস্থা গঠন করা হয়। নতুন এই সংস্থাটির নাম ছিল ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কমিটি’ (Комитет государственной безопасности, ‘কমিতেৎ গোসুদার্স্তভেন্নোয় বেজোপাস্নোস্তি’)। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ তিনটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী এটিকে ‘কেগেবে’ (КГБ) নামে অভিহিত করা হত। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘কেজিবি’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ববর্তী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তুলনায় কেজিবি ছিল দীর্ঘস্থায়ী। প্রায় ৩৭ বছর ধরে এটি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ও গুপ্ত পুলিশ বাহিনী হিসেবে বিরাজ করে। সংস্থাটি সরাসরি সোভিয়েত মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। ইভান সেরভ, আলেক্সান্দর শেপেলিন, পিওতর ইভাশুতিন, ভ্লাদিমির সেমিচাস্তনি, ইউরি আন্দ্রোপভ, ভিতালি ফেদোরচুক, ভিক্তর চেব্রিকভ, ভ্লাদিমির ক্রিউচকভ, লিওনিদ শেবারশিন এবং ভাদিম বাকাতিন পর্যায়ক্রমে সংস্থাটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালের ৩ ডিসেম্বর কেজিবিকে বিলুপ্ত করা হয়।
কেজিবি এমন একসময়ে সক্রিয় ছিল, যেসময় স্নায়ুযুদ্ধ ছিল একেবারে তুঙ্গে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের বিরুদ্ধে তীব্র গোয়েন্দা তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সক্রিয় বামপন্থী দলগুলোকে সমর্থন প্রদান, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সোভিয়েতপন্থী সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখা, সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থবিরোধী নেতাদের নির্মূল করা, সোভিয়েতপন্থী রাষ্ট্রগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সর্বোপরি, তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পশ্চিমা বিশ্বের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো, কোনোক্ষেত্রেই কেজিবি পিছিয়ে ছিল না। একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে কমিউনিজমবিরোধীদের দমন ও বিদেশি গুপ্তচরদের নির্মূলকরণের ক্ষেত্রেও তাদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।
(১১) টিএসএসআর: ১৯৯১ সালের ২২ অক্টোবর বৈদেশিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেজিবির শাখাগুলোকে সংস্থাটি থেকে পৃথক করা হয় এবং একটি নতুন গোয়েন্দা সংস্থার সৃষ্টি করা হয়। সংস্থাটির নামকরণ করা হয় ‘কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা’ (Центральная служба разведки, ‘ৎসেন্ত্রালনায়া স্লুঝবা রাজভেদকি’)। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ তিনটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী একে ‘ৎসেএসএর’ (ЦСР) নামে অভিহিত করা হতো। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘টিএসএসআর’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
সংস্থাটি অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি এবং ১৯৯১ সালের ১৮ ডিসেম্বর এটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সংস্থাটির একমাত্র প্রধান ছিলেন ইয়েভগেনি প্রিমাকভ।
(১২) এমএসবি: ১৯৯১ সালের ২২ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলোর গোয়েন্দা কার্যক্রম সমন্বয় ও প্রতিপক্ষের গোয়েন্দা কার্যক্রম রোধের উদ্দেশ্যে নতুন একটি সংস্থা গঠিত হয়। সংস্থাটির নামকরণ করা হয় ‘আন্ত:প্রজাতান্ত্রিক নিরাপত্তা সংস্থা’ (Межреспубликанская служба безопасности, ‘মেঝরেস্পুবলিকানস্কায়া স্লুঝবা বেজোপাস্নোস্তি’)। সংস্থাটির রুশ নামের শব্দ তিনটির আদ্যক্ষর অনুযায়ী এটিকে ‘এমএসবে’ (МСБ) নামে অভিহিত করা হত। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘এমএসবি’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির পরেও সংস্থাটি কিছুদিন সক্রিয় থাকে। অবশেষে ১৯৯২ সালের ১ জুলাই সংস্থাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করা হয়। সংস্থার একমাত্র প্রধান ছিলেন ভাদিম বাকাতিন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উপরে বর্ণিত সংস্থাগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের একমাত্র গোয়েন্দা সংস্থা ছিল না। সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর নিজস্ব সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ছিল, যাদের সঙ্গে উপরে বর্ণিত সংস্থাগুলোর সম্পর্ক ছিল প্রতিযোগিতামূলক। অবশ্য সোভিয়েত আইন অনুযায়ী, সশস্ত্রবাহিনীর মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ছিল এক ধরনের সামরিক বাহিনী।
আরো উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেবল গোয়েন্দা সংক্রান্ত কার্যকলাপেই জড়িত ছিল না। একইসঙ্গে তারা গুপ্ত পুলিশ বাহিনী হিসেবে কাজ করত এবং সোভিয়েত নাগরিকদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক আনুগত্য নিশ্চিত করা ছিল এদের দায়িত্ব। কার্যত অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এগুলো ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির একচ্ছত্র ক্ষমতা ধরে রাখার অন্যতম হাতিয়ার। এজন্য এই সংস্থাগুলো ছিল একই সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থা ও গুপ্ত পুলিশ বাহিনী।
সবশেষে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সময়ানুক্রমিকভাবে সাজালে সেটি এরকম হবে:
চেকা — জিপিইউ — ওজিপিইউ — জিইউজিবি — এনকেজিবি — এনকেভিডি — এনকেজিবি — এমজিবি — এমভিডি — কেজিবি — টিএসএসআর + এমএসবি