২০১২ সালের ৫ জুলাই, কলকাতা থেকে ট্রেনে করে গোবরডাঙ্গা স্টেশনে নামলেন একজন শিক্ষক। সন্ধ্যা নেমেছে, কাল আবার অরুণোদয়ে আলোকিত হবে চারপাশ, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে এই শিক্ষককে পেছন থেকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যার পর যে আঁধার নেমে আসবে, তা দূর করার সাধ্য হয়তো সূর্যালোকেরও নেই।
এর এক যুগ আগে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার সুঁটিয়া ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে তাণ্ডব চলতো এক দল মানুষরূপী পিশাচের। তাদের অপকর্মে সুঁটিয়া পরিচিত হয়েছিলো ধর্ষণ গ্রাম নামে। একের পর এক গণধর্ষণ করা হতো, যৌন নির্যাতনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিলো। আতঙ্ক সৃষ্টি করে সবাইকে চুপ করিয়ে রেখে হতো লুটপাট। চাঁদাবাজি, লুটপাটের প্রতিবাদ করতে এলে তার পরিবারের প্রত্যেক নারীর ওপর নেমে আসতো ধর্ষণের বিষাক্ত ছোবল। পরিবারের সদস্যদের সামনেই চলতো যৌন নিপীড়ন। এমনকি অনেককে বারবার ধরে নিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে। স্থানীয় ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তির ছায়াতলে থাকা সুশান্ত চৌধুরী, বীরেশ্বর ঢালীর নেতৃত্বে বিশ-পঁচিশজনের এই পিশাচদল এলাকাতে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের তালিকা করতো, ধর্ষণ করার জন্য!
এরকম বিভীষিকাময়, থমথমে অবস্থা দিনের পর দিন মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছিলো সাধারণ মানুষ, ক্ষোভে-অপমানে ভেতরে ভেতরে ফুঁসলেও সবার মনেই চাপা ভয়, আইন-শৃংখলাবাহিনীর আওতাধীন হয়েও সাহস নেই অভিযোগের। এমনই যখন অবস্থা, তখন ২০০২ সালের ১ আগস্ট সুঁটিয়া বাজারে ডাক দেওয়া হলো প্রথম প্রকাশ্য এক প্রতিবাদসভার। অনেকেই এসেছে, তবুও বক্তৃতা করার সাহস কেউ পাচ্ছে না। এগিয়ে এলেন এক যুবক, মাইকটা তুলে নিয়ে বললেন,
“যদি এখনও মা-বোনেদের সম্মান রক্ষা করতে না পারি, তা হলে আমরা সভ্য সমাজে থাকার যোগ্য নই। আমাদের যদি ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস না থাকে, তাহলে আমাদের তাদের থেকেও বেশি শাস্তি পাওয়া উচিত…তাই আসুন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের নারীদের সম্মান রক্ষা করুন।”
সুঁটিয়াবাসীর ভেতরটা নড়ে উঠলো, এতদিনের চাপা ক্ষোভ বেরিয়ে এলো প্রতিবাদ হয়ে, পরদিনই সুঁটিয়ার হাটচালায় সভা করে তৈরি হলো ‘সুঁটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ’, এ প্রতিবাদী মঞ্চের নেতৃত্ব দিলেন এগিয়ে এসে বক্তৃতা করা যুবকটি, নাম বরুণ বিশ্বাস। শুরু হলো আন্দোলন, এতদিনের নৃশংসতার প্রতিবাদ। তালিকা করে শাস্তির দাবি করা হলো নরপিশাচদের। সকলের দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে সাহস দেওয়া হলো এদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে। ১৬ আগস্ট ১৮টি গাড়ির কনভয় সাজিয়ে এসডিও, এসডিপিও, ওসি’র কাছে ডেপুটেশন দিলো সুঁটিয়ার মানুষ। সেদিন সাহস করে রাস্তায় নেমেছিলেন নারীরাও। এলাকায় নিয়ে আসা হলো রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্যদের। ধর্ষিতাদের সঙ্গে কথা বলে আর এলাকার পরিস্থিতি ঘুরে দেখে স্তম্ভিত হলেন সদস্যরা, খবর গেলো পুলিশের উঁচু মহলে।
এসব কিছুতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সেই যুবকটিই, ততদিনে তিনি সুঁটিয়ার সাধারণ মানুষের সাহসের প্রতীক, বরুণ বিশ্বাস। নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার যারা, তাদের স্বাভাবিক জীবনে আসার জন্য উৎসাহিত করতেন তিনি, কয়েকজনের বিয়ের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। বিচার পাওয়ার আশায় অনেকে থানায় অভিযোগ দায়ের করার শক্তি পান বরুণের চেষ্টাতেই। যার ফলে ধরা পড়ে বীরেশ্বরসহ পাঁচজন। শাস্তি হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০০-২০০২ সালের মধ্যে ৩৩টি ধর্ষণ এবং ১২টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে সুঁটিয়া ও তার আশপাশে। যদিও আশঙ্কা করা হয়, ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যাটি আরো ভয়াবহ। এমনকি কয়েক গুণ বেশি!
বরুণ বিশ্বাস তাঁর ইস্পাতসম দৃঢ়তায় প্রতিনিয়ত চলতে থাকা সুঁটিয়ার মানুষের দুঃস্বপ্ন শেষ করার সাহস করেছিলেন, দাঁড়িয়েছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীকতার ঢাল হয়ে। নিজ যোগ্যতায় করতে পারতেন রাজ্য সরকারের সিভিল সার্ভিসের ‘নিশ্চিন্ত ভবিষ্যত’ এর চাকরি। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও সেদিকে না গিয়ে নিজের জন্মস্থান সুঁটিয়ার জন্য কাজ করতে সময় পাবেন, এই ভেবে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন শিক্ষকতাকে। বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশনে। নদী-খাল সংস্কারের আন্দোলনে নেমে এলাকার ইটভাটার মালিকদের একাংশের চক্ষুশূল হয়ে ছিলেন তিনি, গণধর্ষণের প্রতিবাদ করে শত্রু হয়ে উঠলেন আরো অনেকের। জানতেন, নিজ জন্মস্থানে থাকলে জীবনের নিরাপত্তা নেই। আরো জানতেন, তিনি চলে গেলে সুঁটিয়ার নিরীহ মানুষগুলোর ভরসার কেউ থাকবে না।
বরুণের বাবা জগদীশ বিশ্বাস ও মা গীতা বিশ্বাস; আদি বাসস্থান ছিলো বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়, পরে তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পাঁচপোতার আচারিপাড়ায় চলে আসেন। সেখানে তাদের কনিষ্ঠ পুত্র বরুণের জন্ম হয় ১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। অভাবেই বড় হয়েছিলেন বরুণ ও তাঁর ভাইবোনেরা। সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য বাবা দিন মজুরের কাজ করে ও রাতে স্থানীয় যাত্রাদলে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমন অর্থাভাবের মধ্যে থেকেও পেরিয়েছিলেন জ্ঞানার্জনের একের পর এক প্রাতিষ্ঠানিক ধাপ। পাঁচপোতা ভরাডাঙা হাই স্কুল ও খাতরা বয়েজ হাই স্কুল হয়ে গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ থেকে অর্জন করেন বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও নিউ ব্যারাকপুরের বি. টি. কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন বরুণ বিশ্বাস। পরিবারের সদস্যদের অনুরোধেও বিয়ের জন্য ভাবেননি, তাঁর জীবনের সাথে জড়িয়ে নিয়ে সে মানুষটির জন্য অনর্থক বিপদের ঝুঁকি বাড়াতে চাননি।
ছাত্রদের কাছে প্রিয় ছিলেন ‘মাস্টারমশাই’ সম্বোধনে, আস্থা ছিলেন গরীব-দুঃখী মানুষেরও। বেতনের যতটুকু পেতেন তার সবই খরচ করতেন এসব মানুষের জন্য। বিশ্বাস বাড়ির পেছনের দিকে একটা কাঁচা রাস্তা তৈরি করতে হয়েছিলো, কারণ বাড়িতে রোজ সকালে মাস্টারমশাইয়ের কাছে সাহায্যপ্রার্থীদের আনাগোনায় রাস্তায় ভিড় জমে যেত। তাঁর নিজের ঘরে শুধু একখানা খাটই ছিলো, এক গরীব বুড়ি মহিলার আবদারে তাও দিয়ে দিয়েছিলেন, এরপর থেকে মেঝেতে প্লাস্টিক বিছিয়ে ঘুমাতেন। স্নাতক পাস বেকার তরুণদের একত্র করে সহায়তা করতেন চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য।
আসামী সুশান্ত চৌধুরীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন হিন্দুধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, বলেছিলেন, “জেলে বসে পড়িস”। তবে সুশান্ত হয়তো ছুঁয়েও দেখেনি সে বই, বরং জেলে বসে কষতে থাকেন বরুণ বিশ্বাসকে চিরতরে সরিয়ে ফেলার অঙ্ক। ভাড়াটে খুনি সুমন্ত দেবনাথ ওরফে ফটকে, দেবাশিষ সরকার, বিশ্বজিৎ বিশ্বাস ও রাজু সরকার পুলিশের কাছে ধরা পড়ে স্বীকার করে যে জেলে থাকা সুশান্তের নির্দেশেই বরুণকে খুন করে তারা।
বরুণ জানতেন, মৃত্যু তাঁর আশেপাশে ছায়া হয়ে আছে, সুযোগ পেলে সশরীরে হাজির হবে। শেষমেষ সুযোগ এসে গিয়েছিলো সেদিন সন্ধ্যায়। কলকাতা থেকে ফেরার পর মাস্টারমশাইকে একা চলাফেরা করতে দিতো না সাথের তরুণ অনুজেরা, কিন্তু সেদিনই পাড়ায় গরিব একজনের বিয়ের আয়োজন করেছিলেন বরুণ তাঁর স্বজন-বন্ধুদের সাহায্যে, এজন্য স্টেশন থেকে যে দু’জন থাকতেন, বরুণের আদেশেই তাকে না নিতে এসে কাজ করছিলেন সে আয়োজনে। খুনিরা এতদিন তক্কে-তক্কে থেকে আজ আর দেরি করলো না, বরুণ বিশ্বাস ঠিক কোনজন সেটা নিশ্চিত হয়ে নিলো তারা। নিশ্চিত হবার জন্য খুনিরা যাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, সে-ও নাকি গত সপ্তাহে চাল-ডালের জন্য হাত পেতেছিল মাস্টারমশাইয়ের কাছে!
কাপুরুষের মতো পেছন থেকে চালানো হলো গুলি। হয়তো বরুণ বিশ্বাসের সামনে দাঁড়ানোর সাহস তাদের ছিলো না। হত্যাকারীরাই শুধু কাপুরুষ ছিলেন তা নয়, আহত বরুণ প্রায় আধঘণ্টা স্টেশনে পড়ে রইলেন আরো অনেকগুলো ভীতু-কাপুরুষেরই সামনে, যারা ‘পুলিশ কেস’ হবে বলে হত্যাকারীদের চোখ রাঙ্গানিকে উপেক্ষা করতে সাহস করেনি। রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো ক্রমাগত, ঠিক সময়ে হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচতে পারতেন। কিন্তু যতক্ষণে বরুণ বিশ্বাসকে সেখানে নেওয়া হলো, ততক্ষণে তাঁর আর কিছু দেবার নেই। অনেক রক্ত ঝরে গেছে তাঁর জন্মভূমিতে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তিনি।
বরুণ বিশ্বাসকে হারিয়ে সুঁটিয়াবাসী আবারও ফুঁসে উঠেছিলো, শ’খানেক নারী ক্ষুব্ধ হয়ে আক্রমণ চালিয়েছিলো পুলিশ ফাঁড়িতে, ভাংচুর আর প্রধান সড়ক বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো প্রায় ১০ ঘণ্টা। ৪০ হাজার লোক এসেছিলো তাঁর অন্তিম যাত্রায়, শব ছুঁয়ে শপথও নিয়েছিলো অনেকে, তারা পণ করেছিলো বরুণ হত্যার জন্য দায়ী সকলের শাস্তি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার। সময়ের সাথে তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। তাঁর হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট নন পরিবারের সদস্যরা। ভাড়াটে খুনিরা ধরা পড়লেও কার বা কাদের অর্থে ও নির্দেশে এ খুন, তার আলোকপাত নেই সিআইডি’র চার্জশিটে, সাক্ষী তালিকাতেই রাখা হয় নি যারা মূল ঘটনা জানে, তাদের। এমনকি সাক্ষ্য দিতে ডাক পাননি বরুণ বিশ্বাসের বাবাও।
মৃত্যুর এক বছর পর বরুণ বিশ্বাসের জীবন-সংগ্রাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘প্রলয়’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও একই বছরে পাঁচপোতার দূর্গাপূজা মণ্ডপের নাম দেওয়া হয়েছিলো বরুণ মঞ্চ এবং মণ্ডপসজ্জা করা হয়েছিলো তাঁর জীবনালোকে।
মাত্র ৩৯ বছরের জীবনে যে সাহসিকতার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন, তা ধারণ করে অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে উঠুক অসংখ্য ‘বরুণ বিশ্বাস’।
মাস্টারমশাইও হয়তো তা-ই চাইতেন!