কালিদাস পণ্ডিতের সেই ধাঁধাটার কথা মনে আছে?
নাই দেখে খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে
কালিদাস পণ্ডিতে কয় পথে যেতে যেতে।
এই ধাঁধার উত্তরে বলা হয়, কালিদাস পণ্ডিত একবার পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন রাস্তার ধারে এক গরু বাঁধা আছে। গরুর লেজটি কাটা গেছে, সেই কাটা ঘায়ে মাছি বসেছে। কালিদাস মাছিদের উদ্দেশে তার এই চুটকিটি ছাড়েন। লেজ নেই বলেই তো মাছিরা ঘা খেতে পারছিল, থাকলে কি আর পারতো? প্যারাডক্স বটে একখানা!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এরকম একটা কূটাভাসপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। কোনো রোগ বা সিনড্রোমের কারণে মানুষের মৃত্যুমুখে পতিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমন একটা ‘রোগের প্রাদুর্ভাব’ হয়েছিল, যার কৃপায় বেঁচে গিয়েছিল অনেকগুলো নিরীহ ইহুদি প্রাণ। অর্থাৎ, এ রোগের প্রসঙ্গ এলেও যেন কালিদাস পণ্ডিতের চুটকির মতোই মনে হয়, ভাগ্যিস রোগটা হয়েছিল, নইলে কি আর মানুষগুলো নাৎসিদের করাল থাবা হতে বাঁচতে পারতো! আসুন জেনে নেয়া যাক প্রাণবাঁচানো এই অসামান্য রোগ সিনড্রোম কে-কে নিয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ইতালীয় ইহুদী
১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চার বছর পেরিয়ে গেছে। ইতালিতে তখন জার্মান সেনারা ঘাঁটি গেঁড়েছে। ইহুদিদের নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না ইতালির সরকারের। জার্মান বা পোলিশ ইহুদিদের মতো মানবেতর দশায় ইতালীয় ইহুদিদের পড়তে হয়নি, যতদিন না বেনিতো মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট সরকার ইতালির প্রত্যক্ষ ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ইহুদিমুক্ত দুনিয়া গড়বার চোয়ালবদ্ধ পণ করে বসা জার্মানি, একটা সময় ইতালিকেও চাপ দিতে থাকল।
এসবের দরুন ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো ইহুদি সম্প্রদায়- ইতালীয় ইহুদিরাও কিছুটা বেকায়দায় পড়লো। তাদের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করলো সরকার। এই আইনে বলা হলো, সরকারি চাকরি, সশস্ত্র বাহিনী, গণমাধ্যম ইত্যাদিতে ইহুদিরা কাজ করতে পারবে না। আগে ইহুদি-অইহুদির মধ্যে বিয়ে করার রেওয়াজ ছিল, নতুন আইনে সেটাও রহিত করা হলো।
ইহুদিদের প্রতি এরকম নিবর্তনমূলক আইন জার্মানির ইচ্ছায় জারি করা হয়েছিল বটে, কিন্তু ঘরে ঘরে গিয়ে এসব আইন প্রয়োগ করবার মতো বাড়তি তাগিদ ইতালি সরকারের মধ্যে কখনো ছিল না। এমনকি ১৯৩৮ সাল পর্যন্তও ইহুদিরা ফ্যাসিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে পারতো। ইতালির ইহুদি শিবিরগুলোতে ছিল পড়ালেখার ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে পরিবারগুলোও সেখানে একত্রে বাস করতে পারতো।
কিন্তু যেদিন থেকে গ্র্যান্ড সোশাল রিপাবলিক-এর আওতায় জার্মান সেনারা ইতালিতে প্রবেশ করলো, সেদিন থেকেই এখানকার ইহুদিদের আসল দুর্দিন শুরু। ইহুদিদের দলে দলে নাৎসি বন্দিশিবিরে পাঠানো শুরু হলো। মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকার তখন পুরোপুরি জার্মানির আজ্ঞাবহ, ইতালির ভাগ্য-নিয়ন্তার ভূমিকায় তখন জার্মান সেনারা।
যে রোগে জীবন বাঁচে
প্রায় দশ হাজার ইহুদিকে ততদিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বন্দিশিবিরে। সেই দুর্দিনে কোনো ‘ঈশ্বর’ আসেননি ঐ হতভাগা মানুষগুলোকে বাঁচাতে! মানবতার ত্রাতা হয়ে কয়েকজন দেবতুল্য মানুষই তখন এগিয়ে এলেন। ইহুদিদের আবাসস্থলের ঠিক বিপরীত দিকে টাইবার নদীর বুকে জেগে ওঠা ২৭০ মিটার লম্বা এক দ্বীপে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে একটি ক্যাথলিক হাসপাতাল। প্রায় সাড়ে চারশো’ বছর পুরনো এই ফাতিব্রেনেফ্রাতাইল্লি হাসপাতালটিই আমাদের গল্পের রঙ্গমঞ্চ।
এই হাসপাতালটিতেই মঞ্চস্থ হয়েছিল জীবন বাঁচানোর এক অভূতপূর্ব নাটক। সেখানকার তিন চিকিৎক মিলে তৈরি করেছিলেন এক ভুয়া রোগ- ‘সিনড্রোম কে’। উদ্দেশ্য- নাৎসিদের চোখে ধুলো দিয়ে, চিকিৎসার নাম করে ইহুদিদের জীবন বাঁচানো।
গল্পের সেই তিন নায়কের নাম জোভান্নি বরোমিও, আদ্রিয়ানো অসিচিনি ও ভিত্তোরিও সাচেরদোতি। শুধু কি মেধার জোরে সম্ভব ছিল এই কাজ? বরং মেধার সঙ্গে ঘটেছিল অপরিমেয় সাহসের মেলবন্ধন। এ তো জীবন নিয়ে ছেলেখেলা রীতিমতো! এই চাতুরির খবর নাৎসিদের কানে পৌঁছুলে, ঐ হাসপাতালের বাকিসব কর্মকর্তা-কর্মচারীসমেত ঐ তিন চিকিৎসকের কপালে যে খুব একটা ‘সুখকর মৃত্যু’ জুটতো না, তা একেবারে হলফ করে বলা যায়।
১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে সিনড্রোম কে প্রথম প্রকাশ্যে আসে। নাৎসিরা যখন বন্দিশিবিরগুলোতে ইহুদিদের পাঠাতে শুরু করলো, তখন ফাতিব্রেনেফ্রাতাইল্লি হাসপাতালের এই তিন চিকিৎসক কে-সিনড্রোমের মিথ ছড়াতে থাকেন। প্রফেসর জোভান্নি বরোমিওর নেতৃত্বে এই রোগটি নিয়ে ‘কাজ করতে থাকেন’ বাকি দুই ডাক্তার আদ্রিয়ানো অসিচিনি ও ভিত্তোরিও সাচেরদোতি। সাচেরদোতি নিজেও ছিলেন একজন ইহুদি, যিনি পরিচয় গোপন করে ঐ হাসপাতালে কাজ করছিলেন।
১৬ অক্টোবর নাৎসিরা ইহুদি শিবিরগুলোতে আক্রমণ চালায়। তখন বাঁচার তাগিদে কিছু ইহুদি, হাসপাতালটিতে আশ্রয় নেন। বরোমিও জানতেন, নাৎসিরা অবশ্যই হাসপাতালটিতে তল্লাশি চালাবে। তাই তারা, তিন চিকিৎসক তখন আশ্রয়প্রার্থী সব ইহুদিকে কে-সিনড্রোমে আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করেন। হাসপাতালের সকল কর্মীই অবগত ছিলেন এ সম্পর্কে। আশ্রয়প্রার্থী ইহুদিদের কীভাবে কে-সিনড্রোম থেকে বাঁচানোর বাহানায় নাৎসিদের থেকে বাঁচানো যায়, সে ব্যবস্থাই করতেন তারা।
তিন চিকিৎসকের ‘গবেষণা’ মোতাবেক, এটি হচ্ছে দুরারোগ্য এবং খুবই সংক্রামক একটি রোগ। তাই তথাকথিত ছোঁয়াচে-রোগাক্রান্ত এই ইহুদিদের রাখা হলো হাসপাতালের আলাদা একটি কক্ষে। এই রোগের লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল- প্রচন্ড খিঁচুনি, পক্ষাঘাত, শরীর ভেঙে পড়া ও বেদম কাশি।
নাৎসি-সেনারা যখন হাসপাতালটি পরিদর্শন করতে আসতো, তখন তাদেরকে এই ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগটি সম্পর্কে বারবার সতর্ক করে দেওয়া হতো। ফলে দেখা গেলো, সেনারা সেই ঘরের পাশ দিয়েও হেঁটে যাওয়ার সাহস পেতো না। ওদিকে ইহুদি শিশুদেরও শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নাৎসিরা হাসপাতাল পরিদর্শনে এলে যেন ওরা দম ফাটানো কাশি শুরু করে, যাতে নাৎসিদের মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক না হয়।
ডা. সাচেরদোতির তুতো বোন লুসিয়ানা সাচেরদোতি-ও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কে-সিনড্রোমের বদৌলতেই। দশ বছর বয়সী লুসিকে ঐ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। লুসির ভাষায়,
যেদিন নাৎসিরা আমাদের হাসপাতালে এসেছিল, কেউ একজন আমাদের কক্ষের সামনে এসে বলল: “তোমাদেরকে কাশতে হবে। তোমরা প্রচুর কাশবে, কারণ তারা (নাৎসিরা) কাশিকে ভয় পায়, তারা এমন জঘন্য রোগের পাল্লায় পড়তে চায় না। সুতরাং তোমরা কাশলে তারা আর ঘরে প্রবেশ করবে না।”
কিন্তু এই রোগের নাম সিনড্রোম কে-ই বা হলো কেন?
সে সময় ইতালিতে নাৎসি কমান্ডার ছিলেন আলবার্ট ক্যাসেলরিং। আর শহরটির এসএস চিফ অব পুলিশ ছিলেন হার্বার্ট কেপলার। এই দু’জনের নামের আদ্যাক্ষর থেকেই কে সিনড্রোম নামটি বেছে নিয়েছিলেন ডা. আদ্রিয়ানো অসিচিনি।
এই বীরত্বপূর্ণ ঘটনাটি প্রায় ৬০ বছর পর জনসমক্ষে আসে, যখন ভিত্তোরিও সাচেরদোতি বিবিসিকে ২০০৪ সালে তার এই অসামান্য গল্পটি জানান। সাচেরদোতি যখন হাসপাতালটিতে কাজ করতেন, তখন তিনি ছিলেন আটাশ বছরের টগবগে তরুণ।
বিবিসির হিসেবমতে, সিনড্রোম কে-এর ভাঁওতা দিয়ে চিকিৎসকেরা প্রায় ৪৫ জন ইহুদিকে নাৎসিদের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে সাচেরদোতি বলেন,
নাৎসিরা ভেবেছিল, এটা ছিল ক্যান্সার বা যক্ষ্মার মতো কিছু, আর তাতেই তারা খরগোশের মতো পালিয়েছিল।
২০১৬ সালে ইতালির পত্রিকা লা স্তাম্পাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অসিচিনি জানিয়েছেন,
রোগীদের কাগজপত্রে ‘সিনড্রোম কে’ লেখা থাকার মানে ছিল- তারা আদতে রোগী নয়, বরং ইহুদী।… সিনড্রোম কে-এর অর্থ ছিল “আমি একজন ইহুদীকে ভর্তি করাচ্ছি”।…
তিন মানবতাবাদী চিকিৎসকের দুর্ধর্ষ এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর, তা প্রশংসিত হয়েছে সমগ্র বিশ্বে। যুদ্ধের পর ইতালির সরকার বরোমিওকে ‘অর্ডার অব মেরিট’ ও ‘সিলভার মেডেল অব ভ্যালর’ প্রদান করে। ইয়াড ভাসেম নামের একটি ইজরায়েলভিত্তিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড হলোকাস্ট রিমেমব্রেন্স সেন্টার ২০০৪ সালে বরোমিওকে মরণোত্তর (মারা যান ১৯৬১ সালে) ‘রাইচেয়াস অ্যামং দ্য নেশন্স’ খেতাবে ভূষিত করেছে। ফাতিব্রেনেফ্রাতাইল্লি হাসপাতালটি পরিচিতি পেয়েছে ‘হাউজ অব লাইফ’ হিসেবে।
আদ্রিয়ানো অসিচিনি পরবর্তীকালে জড়িয়ে গিয়েছিলেন রাজনীতিতে। ১৯৯৫-৯৬, এই এক বছরের জন্য ইতালির পরিবার ও সমাজ বিষয়ক মন্ত্রীও ছিলেন তিনি। এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৯৮ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই কৃতি।
মানবতার জয়
ভ্লাদিস্লোয়া স্পিলম্যানকে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন একজন নাৎসি অফিসার ভিম হোজেনফেদ। সাচেরদোতিদের সাহসিকতায় বেঁচেছিল কিছু নিরীহ প্রাণ। পৃথিবীতে যুগে যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো নারকীয়, ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অমানবিকতা ও নৃশংসতার ঘৃণাপূর্ণ এসব পরিস্থিতির মাঝেও মানবতা সবসময় তার ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রেখেছিল। এই মানবতাই আমাদের প্রাণশক্তি। জয় হোক মানবতার।