ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ। ১৯৮২ সালের এই দিনে এরশাদ সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বুকের লাল রক্তে রাজপথ ভিজিয়ে দাবী আদায়ের পথ বেছে নিয়েছিলেন বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা। তৎকালীন এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ‘মজিদ খানের শিক্ষানীতি’র বিরুদ্ধেই দানা বেঁধেছিল এই আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঘিরে এরশাদ সরকারের স্বৈরাচার আন্দোলনের ঝড়কে থামাতেই নিয়মের বেড়াজালে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার পঞ্চাশ ভাগ ব্যয় শিক্ষার্থীর পরিবারকে বহন করতে হবে এমন নিয়ম করে শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান শিক্ষানীতি পাশ করে। এই শিক্ষানীতি পাশ করলে হাজারো মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস উঠবে এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করেই শিক্ষানীতিতে এমন পরিবর্তন আনার চিন্তা করছিলো তৎকালীন এরশাদ সরকারের প্রশাসন। মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিয়ে কেনা বাংলাদেশে জনবিরোধী এই প্রস্তাবে ফুঁসে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যার অনুরণন ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে। রাজপথের মিছিলে কেঁপে ওঠে এরশাদের রাজগদিতে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরের অস্থির সময়ের রাজনীতিতে ঘূর্ণাবর্তে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সামরিক অভুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক শাসনের এই বিষয়টি বাংলাদেশের স্বাধীনবতা পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা সোনালী ছাত্রসমাজ মেনে নেয়নি। বরং সেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিজেদের সবটুকু দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাতিঘরের মতো সেই আন্দোলনকে রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। ক্ষমতা দখলের দিনই অর্থাৎ চব্বিশ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে রক্তচক্ষুর কবলে পড়েন ছাত্রনেতা শিবলী কাইয়ুম, হাবিব ও আ. আলী। বন্দী করে সামরিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তাদের। তড়িঘড়ি করে তাদেরকে সাত বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করে সামরিক সরকার ছাত্র আন্দোলনকে শৃংখল দিয়ে বাঁধতে উদ্যত হয়। কিন্তু ন্যায়ের দাবীতে দুর্মর ছাত্রসমাজের আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তখন ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে পুরো দেশে।
ছাব্বিশে মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধেও সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেন ছাত্রনেতারা। সেখানেও ছাত্রদের উপর চলে সেনাবাহিনীর নিপীড়ন। সরকার যতই দমন পীড়নের রাস্তা বেছে নেয় ছাত্রসমাজ ততই সংগ্রামী হয়ে উঠতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং আশপাশের ভবনের দেওয়ালগুলোও সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জীবন্ত হয়ে উঠে।
আন্দোলন দমাতে এবং ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করা জরুরী সেটি বুঝতে বাকী ছিলো না এরশাদের প্রশাসনের। তাই তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের নেতৃত্বে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ‘শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার’, ‘মৌলিক অধিকারের তোয়াক্কা না করে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ’ এবং ‘উচ্চশিক্ষার সংকোচন’ মূলত এই তিনটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে ছাত্রসমাজ।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ক্ষমতা হ্রাস করার চিন্তাভাবনা এরশাদ সরকারের শুরু থেকেই ছিলো। সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার প্রস্তাবটিও অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই শিক্ষানীতিতে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এই শিক্ষানীতি বাতিলের পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলোকে সংগঠিত করে যৌথ আন্দোলন শুরু করা হবে। সংগঠিত করার লক্ষ্যে ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে একটি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাড়া দেশজুড়ে এই দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করার অভিযান শুরু হয়। এরশাদ প্রশাসন এই আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য আবারো গ্রেপ্তার শুরু করে। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুককে সহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার করা হয়। আন্দোলন না দমে বরং আরো বেগবান হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবিতে ২৭ এবং ২৮ জানুয়ারি সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সেই ধর্মঘট থেকেই এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী নেওয়া হয়। বেছে নেওয়া ১৪ ফেব্রুয়ারিকে। হয়তো তখনো সারা দেশের মানুষের জানার বাকী যে, ঢাকার রাজপথ সেই বসন্তে গোলাপের পাপড়িতে নয় বরং ছাত্রজনতার রক্তে রঙিন হবে।
১৪ তারিখ সকালেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। মজিদ খানের প্রস্তাবিত গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাহার সহ ছাত্রবন্দীদের মুক্তি এবং স্বৈরতন্ত্রের নাগপাশ ছিড়ে বেরিয়ে আসার ডাক দিয়ে এদিন সচিবালয় মুখে মিছিল নিয়ে যাত্রা শুরু করে ছাত্রজনতা।
হাজারো শিক্ষার্থীর মিছিলটি হাইকোর্টের সামনে পৌঁছালে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। ব্যারিকেডের সামনে অবস্থান নেয় সাধারণ ছাত্ররা, সেখানে দাঁড়িয়েই সম্মিলিত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেওয়া শুরু করে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সেই সমাবেশকে বানচাল করে দেওয়ার লক্ষ্যে রায়ট কার থেকে রঙিন গরম পানি ছিটানো হয়।
গরম পানি ছিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পরে ছাত্রজনতার উপরে বেপরোয়া গুলি ছুঁড়তে থাকে পুলিশ। পুলিশের নির্বিচার বুলেট আঘাত হানে জয়নালকে। শুধু জয়নাল নয়, দিপালী সহ আরো নাম না জানা অনেকেই সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, যাদের লাশ সরাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রশাসন।
পুলিশের নির্মমতার শিকার হওয়া জয়নালকে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করে হয়। তার মৃত্যু সংবাদে ফুঁসে উঠে সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বটতলায় জয়নালের জানাজায় ঢল নামে হাজারো মানুষের।
সরকারের বর্বরতার শিকার হয়ে রাজপথে রক্ত দিতে হয়েছিলো হয়েছিলো জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ নাম না জানা আরো অনেককে। সরকারের দেওয়া হিসাবানুযায়ী সেদিনের জমায়েত থেকে গ্রেফতার করা হয় ১,৩৩১ জনকে। সমসাময়িক পত্রিকাগুলোর দাবি অনুযায়ী বাস্তবে হয়তো সেই সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি ছিলো। সরকার তাদের কুকর্মকে ঢাকা দেওয়ার লক্ষ্যেই লাশ গুম করে দেয় অনেকের।
সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে শত সহস্র তরুণ প্রাণ ঝরা গোলাপের পাতার মতো ঝরে যায় সেদিন ঢাকার রাজপথে। তিন দফা ন্যায্য দাবী নিয়ে ছাত্রজনতার আন্দোলন যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ ছিলো তা-ই নয়, ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা দেশে।
চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, রংপুর সহ সারা দেশে এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শত শত ছাত্র ছাড়াও সাধারণ মানুষ। ক্রমান্বয়ে এই আন্দোলনের ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছিলো উনসত্তরের সেই গণআন্দোলনের মতই। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মতো এরশাদ প্রশাসনের গদিতেও টান পড়ছে একটু একটু করে।
রাজপথ আর কারাগারে অসংখ্য ছাত্রজনতার তাজা রক্তে এই আন্দোলন দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। আন্দোলনের সামনে স্বৈরাচারের মাথানত করার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে বাংলাদেশের মাটিতে। তুমুল আন্দোলনের মুখে ১৭ ফেব্রুয়ারি এক হাজার ২১ জনকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সামরিক সরকার, বাকী ৩১০ জনকে বিভিন্ন মামলায় আটকে রাখে। তবে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৮ ফেব্রুয়ারি মজিদ খানের প্রস্তাবিত সেই শিক্ষানীতি স্থগিত করে সামরিক জান্তা। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির সেই আন্দোলনেই বীজ বোনা হয়েছিল স্বৈরাচার এরশাদের পতনের। হাজারো তরুণের রক্তের সেঁচে সেই বীজ থেকে ঢাকার রাজপথে জন্ম নিয়েছিলো স্বৈরাচারবিরোধী বৃক্ষ, সেই বৃক্ষের শিকড় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের স্বৈরাচারের কঠিন দেয়াল ভেঙে জন্ম দেয় এক নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে ১৪ ফেব্রুয়ারির নাম লেখা হয়েছে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে। স্বৈরসাশকের কাছ থেকে রক্তে দিয়ে কেনা গৌরবের এই ইতিহাস ভালোবাসা দিবসের আড়ালে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না গিয়ে বরং বাতিঘরের মতো আমাদের পথ দেখিয়ে যাক যুগ যুগান্তর ধরে।
Feature image: Pinterest