প্রাচীনকালের মানুষদের জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে আমাদের আগ্রহের কোনো শেষ নেই। যতই জানা যায়, ততই আশ্চর্য হতে হয় আমাদের। আর এ লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ যাদের শ্রমের বিনিময়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের জ্ঞানভান্ডার। প্রাচীন রোমের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হয়েছে আগের বিভিন্ন লেখায়। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা জানবো তখনকার দিনের পারিবারিক জীবন কেমন ছিলো সেই সম্পর্কে।
প্যাটার ফ্যামিলিয়াস
প্রাচীন রোমে পরিবারের সর্বময় কর্তা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন ‘প্যাটার ফ্যামিলিয়াস (Pater Familias)’। রোমের আইনও পরিবারের কর্তা হিসেবে তাকেই স্বীকৃতি দিতো। পরিবারে কেবলমাত্র তারই জমির উপর অধিকার থাকতো। এছাড়া বিভিন্ন পারিবারিক, ব্যবসায়িক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে পরিবারের প্রতিনিধিও ছিলেন তিনিই।
যদিও শব্দগতভাবে ‘প্যাটার ফ্যামিলিয়াস’ কথাটির অর্থ ‘পরিবারের পিতা’, তবে কেবলমাত্র পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষ সদস্যই এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি মারা গেলে বংশানুক্রমে এ দায়িত্ব গিয়ে পড়তো তার বড় ছেলেটির উপর। এ কারণে প্রাচীন রোমে সাধারণত সন্তান হিসেবে ছেলেরাই পিতা-মাতার কাছে অধিক কাম্য ছিলো। একই কারণে তাদের মাঝে ছেলেদের দত্তক নেয়ার হারও ছিলো বেশি।
পরিবারে নতুন জন্ম নেয়া একটি শিশুকে ধাত্রী প্যাটার ফ্যামিলিয়াসের পায়ের কাছে রাখতো। যদি তিনি তাকে উপরে তুলে নিতেন, কেবলমাত্র তাহলেই সদ্যজাত সেই শিশুটি পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পেত। যদি কোনো কারণে শিশুটি তাকে রাগিয়ে দিতো, তবে বাবা চাইলে তাকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা কিংবা বাজারে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রিও করে দিতে পারতেন!
বুল্লা
তৎকালীন সময়ে শিশুমৃত্যুর হার ছিলো অনেক বেশি। তাই জন্মের পরপরই শিশুদের নাম রাখা হতো না প্রাচীন রোমে, বরং এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতো তারা। এরপর Dies Lustricus (বিশুদ্ধিকরণের দিন) নামক উৎসবের মাধ্যমে সেই শিশুটির নাম রাখা হতো। আজকের দিনের জন্মদিনের মতো তখনও আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবেরা উপহার নিয়ে আসতো সেই অনুষ্ঠানে।
সেই অনুষ্ঠানে ছেলে শিশুকে বুল্লা (Bulla) নামক এক ধরনের বাহুবন্ধনী পরানো হতো। তারা বিশ্বাস করতো যে, এর মাধ্যমে অশুভ আত্মার প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে ছেলেটি। এই বুল্লা একই সাথে ছেলেটিকে রোমের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করতো। অবশ্য মেয়ে শিশুরাও কি বুল্লা পরতো নাকি লুনুলা নামক মন্ত্রপূত কবচ পরতো, তা নিয়ে পন্ডিতদের মাঝে আছে মতভেদ। ছেলেরা কৈশোরে উপনীত হবার আগ পর্যন্ত আর মেয়েরা বিয়ের দিন পর্যন্ত এগুলো তাদের গায়ে ঝুলিয়ে রাখতো।
শিশুদের জীবনের বিভিন্ন ধাপ
জীবনের বিভিন্ন ধাপ একেবারে আইন করে নির্দিষ্ট করে দেয়া ছিলো তৎকালের শিশুদের জন্য।
(ক) জন্ম থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে ও মেয়ে উভয়েই ছিলো Infantia। এ সময় তারা মূলত বাড়িতেই সময় কাটাতো। তাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকতো তাদের বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, বড় ভাই-বোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। এ সময়ের মধ্যবর্তী সব শিশুকেই Doli Incapax হিসেবে বিবেচনা করা হতো, অর্থাৎ আইনের চোখে কোনো অপরাধে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হতো না।
(খ) ইনফ্যান্টিয়ার পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে মেয়েদের জন্য ১২ ও ছেলেদের জন্য ১৪ বছর পর্যন্ত সময়টিকে বলা হতো Impuberes বা Pubertati Proximus। এ সময় থেকেই বাইরের দুনিয়া তাদের কাছে উন্মুক্ত হতে শুরু করতো। বাইরে ঘোরাঘুরি, লোকজনের সাথে মিলেমিশে জীবনকে চেনার চেষ্টা করা এবং পরিবারের সামর্থ্য থাকলে সন্তানকে পড়াশোনার জন্য দূরে কোথাও পাঠানোর প্রক্রিয়াও এ বয়সেই শুরু হতো।
(গ) ১২ বছরের অধিক বয়সী মেয়েদের বিয়ের যোগ্য বলে ধরে নেয়া হতো। অন্যদিকে ১৫ বছর হলে একটি ছেলে যৌবনে পা রেখেছে মনে করা হতো। সামাজিক নানা সুযোগ-সুবিধা যেমন তখন তারা ভোগ করতে পারতো, তেমনি বিভিন্ন বিষয়ে দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়াটাও শুরু হতো এ বয়স থেকে।
শিক্ষাব্যবস্থা
অতীতের অনেক সমাজ ব্যবস্থার মতোই প্রাচীন রোমে শিক্ষার সুযোগ মূলত ধনীরাই পেতো। বাবা-মায়েরা জীবনযাপনের জন্য দরকারি বিষয়ে শিক্ষা দিতেন তাদের ছেলে-মেয়েদের। এভাবেই চলে আসছিলো অনেকদিন ধরে।
১৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমানদের হাতে গ্রীক বিজয়ের পর এ চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। গ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আলিঙ্গন করে নেয় প্রাচীন রোমানরা। জাতীয় জীবনের উন্নতিতে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করে তারা। সেই সাথে শিক্ষকদের অনেকেই ক্রীতদাস থাকায় ধীরে ধীরে শিক্ষাও সহজলভ্য হয়ে উঠতে থাকে।
সাত বছর বয়স থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করতো বাচ্চারা। তাদের শিক্ষককে বলা হতো লিটারেটর (Litterator)। পড়া, লেখা, গণিতের প্রাথমিক ধারণা ও কিছুটা গ্রীক সাহিত্যের সাথে তখন পরিচয় ঘটতো তাদের। সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তানেরা ১২-১৩ বছর বয়সের দিকে গ্রামার স্কুলে যাওয়া শুরু করতো। তখন তাদের শিক্ষককে বলা হতো গ্রামাটিকাস (Grammaticus)। তখন দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা শিক্ষালাভ করতো। সেই সাথে শিখতো চারুকলা ও কাব্যসাহিত্য সম্পর্কেও। আরো উচ্চতর শিক্ষার মাঝে ছিলো বিভিন্ন বিখ্যাত বক্তার কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়াশোনা।
খেলাধুলা
পড়াশোনার পর এবার আসা যাক খেলাধুলার কথায়। তখনকার দিনের বাচ্চাকাচ্চাদের খেলনাগুলোর সাথে মিল আছে আজকের দিনের খেলনাগুলোর।
বাচ্চারা কাঠ অথবা ধাতব পদার্থের তৈরি এক ধরনের ঝুনঝুনি দিয়ে খেলতো যার নাম ছিলো ক্রেপিটাকুলাম (Crepitaculum)। কখনো কখনো এতে ঘন্টাও লাগানো থাকতো।
পুতুল খেলা তখনও ছিলো বাচ্চা মেয়েদের অবসর বিনোদের প্রধান মাধ্যম। পোড়ামাটি, মোম, কাঠ, কাদামাটি, পাথর কিংবা ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি হতো সেসব পুতুল।
বাচ্চা ছেলেরা আবার পছন্দ করতো চালানো যায় এমন খেলনা। তাই চাকা লাগানো খেলনা ঘোড়া কিংবা ঘোড়ার গাড়ি ছিলো তাদের বেশ পছন্দের। কাঠের তলোয়ার, ঘুড়ি, লাটিম, বল জনপ্রিয় ছিলো সব বয়সী শিশুদের মাঝেই।
বোর্ড গেমগুলো জনপ্রিয় ছিলো তরুণ ও বৃদ্ধদের মাঝে। সেগুলোতে ব্যবহার করা হতো ডাইস, প্রাণীর হাড় ও পাথরের টুকরা। এছাড়া লুকোচুরি, ব্যাং লাফ ও টিক-ট্যাক-টো’র মতো খেলাগুলোও আকর্ষণ করতো সবাইকে।
পোষা প্রাণী
বিভিন্ন বাড়িতে পোষা প্রাণীর দেখা মিলতো সেই সময়েও। এখনের মতো তখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় পোষা প্রাণী ছিলো কুকুর। সাহিত্য, মৃৎশিল্প, চিত্রকর্মের মতো বিষয়গুলোতে কুকুরের অধিক উপস্থিতি সেই কথারই জানান দেয়। শিকার করা ও পাহারা দেয়ার কাজে লাগানো হতো কুকুরদের। এছাড়া আজকের দিনের ‘কুকুর হতে সাবধান’-এর মতো বাণী পাওয়া যেত তৎকালীন রোমান ঘরবাড়িতেও।
এরপরই আসবে বিড়ালের কথা। অনেক ঘড়বাড়িতে এর পাশাপাশি থাকতো বানরও। এমনকি সাপও পুষতো কেউ কেউ। তবে সাপ মূলত ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হতো বিধায় পোষা প্রাণী হিসেবে এর দেখা মিলতো কম। আবার নিজেদের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা জানান দিতে পাখি পুষতো সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোকেরা। কারণ পাখির ভরণপোষণের ব্যয় বহন করা সাধারণ রোমান পরিবারগুলোর জন্য ছিলো কষ্টসাধ্য।
চাকরি
পড়াশোনা করে নিজেকে যোগ্য করে তোলা আর খেলাধুলার মাধ্যমে নিজের শরীরকে সুস্থ-সবল তো করে নেয়া গেলো। এবার তাহলে চাকরির সন্ধানে নামা যাক। তখনকার রোমে একটি ছেলের পারিবারিক অবস্থাই ঠিক করে দিতো সে কোন রকমের চাকরি করবে।
সবচেয়ে সম্মানজক পেশা ছিলো রাজনীতি করা। তবে এজন্য একজনের পরিবারকে যেমন অভিজাত হতে হতো, তেমনি তাকেও হওয়া লাগতো উচ্চশিক্ষিত। কর সংগ্রাহক, নোটারি, শিক্ষকতা, আইনজীবী, কেরানিদের অবস্থান ছিল এর ঠিক পরেই। শিক্ষিত তরুণেরা এসব পেশায় অংশ নিতো।
রাজ্যের প্রতিরক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য সৈন্যের দরকার পড়তো সবসময়ই। আর তাই সেনাবাহিনীতেই যোগ দিতো সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ। এর মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা ভালোই অর্থোপার্জন করতে পারতো। ২৫ বছরের চাকরি শেষে ছিলো একখন্ড জমি পাবার নিশ্চয়তাও।
বিয়ে
চাকরিবাকরি যখন পাওয়া গেলো, এবার তো তাহলে বিয়ের দিকেও নজর দেয়া লাগে, তাই না?
প্রাচীন রোমের সমাজব্যবস্থায় বিয়ে নিয়ে ছেলেদের অতটা চিন্তা-ভাবনা করা লাগতো না। কারণ পঁচিশ বছর বয়সের আগে সাধারণত কোনো ছেলে বিয়ে করতো না। তবে বারো বছরে পদার্পন করা মাত্রই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে যেতো। আর মেয়েদের যেহেতু ছেলেদের মতো এত বেশী পড়াশোনার চল ছিলো না, তাই বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছাবার পর তাদেরকে আর বাবা-মা নিজেদের ঘরে না রাখাই উত্তম মনে করতেন।
নিম্নবিত্ত পরিবারের তুলনায় উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতো কিছুটা আগেই। অনেকে আবার মেয়েদের বিয়ে দেয়াকে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবেও দেখতো। নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেবার ব্যাপারে অবশ্য মেয়েদের কোনো স্বাধীনতা ছিলো না। এ ব্যাপারে পুরো দায়দায়িত্ব ছিলো প্যাটার ফ্যামিলিয়াসের। ছেলে খোঁজা থেকে শুরু করে বিয়ের যাবতীয় আয়োজনে তার সিদ্ধান্তই ছিলো মুখ্য।
বসতবাড়ি
দাম্পত্য জীবন শুরু হয়ে গেলো। এবার তো নতুন বউকে নিয়ে থাকা লাগবে। এখন তাই রোমের বাড়িঘর নিয়েই কিছু কথা বলা যাক।
তৎকালীন রোমে মূলত দু’ধরনের বাড়ি দেখা যেত। ধনী পরিবারের সদস্যরা যেসব বাড়িতে থাকতো, সেগুলোকে বলা হতো ডোমাস। এসব বাড়িতে থাকতো অনেকগুলো রুম, ভেতরে থাকতো উঠান। আবার বাড়ির বাইরের দিকে কখনো কখনো থাকতো দোকান যেগুলোকে বলা হতো ট্যাবার্নি (Tabernae)। অতিমাত্রায় ধনীরা আবার শহরের কোলাহল এড়িয়ে কিছুটা বাইরের দিকে বিশাল বিশাল বাড়ি বানিয়ে থাকতেন।
সাধারণ মানুষজন অবশ্য থাকতো ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্টে যেগুলোকে বলা হতো ইনসুলি (Insulae)। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সাথে বাড়তে থাকে এসব ইনসুলির উচ্চতাও। কোনো কোনো ইনসুলি আট-নয় তলা পর্যন্ত উঁচুও হতো। তৃতীয় শতকে রোমে প্রায় ৪৪,০০০ ইনসুলি ছিলো বলে জানা গেছে।
অবশ্য একজনের সামাজিক মর্যাদার সাথে তার বসবাসরত ফ্লোরের নাম্বার ছিলো বিপরীতমুখী। একেবারে নিচতলায় সাধারণত থাকতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এরপর কিছু ফ্লোরে থাকতো বেশ বড় আকারের রুম যেগুলোতে থাকা ছিলো বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। এরপর যত উঁচুতে যাওয়া যেতো, গাদাগাদি করে থাকা মধ্য ও নিম্নবিত্ত লোকেদের সংখ্যাও ততই বাড়তো। উঁচুতলার সেসব অ্যাপার্টমেন্টে থাকাও ছিলো বেশ ঝুঁকির ব্যাপার। প্রায় সময়ই সেখানে আগুন লাগতো। এত লোক একসাথে সেখানে থাকায় আগুন লাগলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণটাও হতো বেশি।
তথ্যসূত্র
১) pbs.org/empires/romans/empire/family.html
২) archaeologicalmuseum.jhu.edu/the-collection/object-stories/archaeology-of-daily-life/jewelry/gold-bulla/
৩) listverse.com/2017/03/01/10-harsh-realities-of-growing-up-in-ancient-rome/
৪)penelope.uchicago.edu/Thayer/E/Roman/Texts/secondary/SMIGRA*/Infans.html
৫) perseus.tufts.edu/hopper/text?doc=Perseus:text:1999.04.0062:entry=ludus-litterarius-harpers
৬) ancient.eu/article/184/
৭) legendsandchronicles.com/ancient-civilizations/ancient-rome/ancient-roman-jobs/
৮) pbs.org/empires/romans/empire/weddings.html