১৬৭৪ সালের ১৭ জুলাই, শুক্রবার; টাওয়ার অফ লন্ডনের এক অংশে নির্মাণকাজে নিয়োজিত ছিল বেশ কয়েকজন শ্রমিক। হঠাৎ করে তারা এমন এক জিনিসের মুখোমুখি হলো, যা ছিলো তাদের কল্পনাতীত। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজা দ্বিতীয় চার্লসের চিফ সার্জন জন নাইট। হোয়াইট টাওয়ারের পাশে কিছু সিঁড়ির সন্ধান পেয়ে সেখানে খুঁড়তে গিয়ে শ্রমিকেরা একটি কাঠের সিন্দুক খুঁজে পায়, যার ভেতরে রাখা ছিলো দুটো বাচ্চার কঙ্কাল, যাদের বয়স ছিলো আনুমানিক ১১ ও ১৩ বছর।
জন নাইটসহ উপস্থিত সকলেই একমত হলেন, কঙ্কালগুলো শত বছর আগে এই টাওয়ার থেকেই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া দুই রাজপুত্রের। নিখোঁজের দু’শো বছর পরে এসে সমাধানের মুখ দেখলো ব্রিটিশ রাজপরিবারের ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় ধাঁধাগুলোর একটির। এই হত্যারহস্যের আদ্যোপান্ত নিয়েই সাজানো হয়েছে রোর বাংলার আজকের এই লেখা।
দুর্ভাগা এই দুই রাজপুত্র রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ড ও তার স্ত্রী এলিজাবেথ উডভিলের সন্তান; নাম পঞ্চম এডওয়ার্ড এবং রিচার্ড। ওয়্যার অফ রোজেস চলাকালে হাউজ অফ ইয়র্ক থেকে আগত চতুর্থ এডওয়ার্ড সিংহাসন দখল করেন। কিন্তু, তার ২২ বছরের রাজত্বকালের একটা বড় অংশই চলে যায় বিদ্রোহ দমন করতে। সে যা-ই হোক, ১৪৮৩ সালের ৯ এপ্রিল রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ড যখন মারা যান, ততদিনে রাজ্যে ভালোই স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। বড় ছেলে এডওয়ার্ডকে ছোট থেকেই ভবিষ্যত রাজা হবার যাবতীয় প্রশিক্ষণ দিয়েই গড়ে তোলা হচ্ছিলো। অন্যদিকে ছোট ছেলে রিচার্ডকে প্রস্তুত করা হচ্ছিলো লর্ড হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য।
রাজার মৃত্যু সবকিছু ওলটপালট করে দিলো। ক্ষমতার দখল নিয়ে শুরু হয়ে গেলো দ্বন্দ্ব। সিংহাসনের দাবিদার তখন সদ্যমৃত রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের ১২ বছর বয়সী বড় ছেলে পঞ্চম এডওয়ার্ড। কিন্তু, অল্পবয়স্ক হওয়ায় রাজ্যের অনেক ব্যাপারেই কিশোর এডওয়ার্ডের তেমন অভিজ্ঞতা ছিলো না বললেই চলে। ফলে তাকে ভুলভাল জিনিস বুঝিয়ে ভুল পথে পরিচালিত করা অসম্ভব কিছু ছিলো না। আর রাজাকে পরিচালনা মানে তো রাজ্যই পরিচালনা করা। এজন্য এবার হবু কিশোর রাজার অভিভাবকত্ব নিয়ে দুটো দলের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। এক দলের নেতৃত্বে ছিলেন রানী এলিজাবেথ উডভিল এবং অন্য দলের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের ভাই, ডিউক অফ গ্লৌচেস্টার, রিচার্ড।
একটি পারিবারিক বিরোধ
শুরুতে মনে হচ্ছিলো, এই বিরোধে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে রানী উডভিলের পক্ষই। কারণ, একদিকে তার কাছে ছিলো ছোট ছেলে রিচার্ড। অন্যদিকে তার ভাই অ্যান্থনি উডভিলের কাছে লুডলতে নিরাপদেই ছিলেন পঞ্চম এডওয়ার্ড।
১৪৮৩ সালের ৩০ এপ্রিল; ডিউক অফ গ্লৌচেস্টার রিচার্ড এবং তার মিত্র ডিউক অফ বাকিংহামের সম্মিলিত বাহিনী অ্যান্থনি উডভিলকে গ্রেফতার করে পঞ্চম এডওয়ার্ডকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয়। এই দুঃসংবাদ রানীর কাছে পৌঁছতে সময় লাগলো না। সাথে সাথেই রিচার্ড এবং বাকি পাঁচ মেয়েকে নিয়ে তিনি ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আশ্রয় নিলেন। দেখতে দেখতে সময় চলে গেলো, বসন্ত পেরিয়ে এলো গ্রীষ্ম, কিন্তু এলিজাবেথ তখনও সেখানেই অবস্থান করছিলেন। দুই ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কোনো শেষ ছিলো না।
চাচা রিচার্ড হবু রাজা এডওয়ার্ডকে নিয়ে গিয়েছিলেন টাওয়ার অফ লন্ডনে। ব্রিটিশ ঐতিহ্য অনুযায়ী রাজ্যাভিষেকের আগে কোনো রাজাকে সাধারণত সেখানেই রাখা হতো। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এডওয়ার্ডের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান বারবার পেছানো হচ্ছিলো। এর মাঝেই ১৩ জুন রাজ পরিষদের তড়িঘড়ি করে ডাকা এক মিটিংয়ে রিচার্ড বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত থাকার অভিযোগ আনেন। অভিযুক্ত সকলকেই গ্রেফতার করা হয়। তাদের মাঝে চতুর্থ এডওয়ার্ডের চেম্বারলেইন উইলিয়াম লর্ড হেস্টিংসের শিরোচ্ছেদ করা হয়।
হঠাৎ করে উদ্ভূত এমন পরিস্থিতিতে পুরো লন্ডন জুড়েই অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ে, গুজব রটে যায় যে, হবু রাজা এবং তার চাচা দুজনের জীবনই নাকি বিপদাপন্ন। লর্ড প্রটেক্টর রিচার্ড তাই দেশের উত্তর থাকা তার মিত্রদের কাছে অস্ত্র ও সেনাসাহায্য চেয়ে জরুরি বার্তা পাঠালেন।
১৬ জুন আবার দৃশ্যপট বদলে গেলো। ক্যান্টারবারির আর্চবিশপের আশ্বাসবাণী পেয়ে এলিজাবেথ তার ছোট ছেলে রিচার্ডকে চাচা রিচার্ডের হাতে তুলে দেন। দুই সহোদরের মিলন হলো টাওয়ার অফ লন্ডনে। পরদিনই ছিলো পঞ্চম এডওয়ার্ডের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান। কিন্তু এবারও সেটা পেছানো হলো। পরবর্তী সময় নির্ধারণ করা হলো শীতকালে। লর্ড প্রটেক্টর রিচার্ডের নির্দেশে ২৫ জুন অ্যান্থনি উডভিলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এভাবেই একে একে পথের কাঁটা সরাচ্ছিলেন রিচার্ড।
আসল ধাক্কাটা তখনও কিন্তু আসেনি। দুই রাজপুত্রের টাওয়ার অফ লন্ডনে মিলিত হবার এক সপ্তাহ পরেই সেইন্ট পল’স ক্রসে লন্ডনবাসীকে বিস্ময়ের সাগরে ভাসানো ঘোষণাটি আসে- পঞ্চম এডওয়ার্ড কিংবা রিচার্ড কারোরই ব্রিটিশ সিংহাসনের উপর কোনো অধিকার নেই! ঘোষক রালফ শা বলে যেতে লাগলেন, এই দুই ভাই-ই সাবেক রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের অবৈধ সন্তান। এলিজাবেথ উডভিলের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকাকালেই এলিনর বাটলার নামক আরেক নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সাবেক রাজা। তাদের সেই অবৈধ ভালোবাসার ফসল হিসেবেই জন্ম নেয় পঞ্চম এডওয়ার্ড ও রিচার্ড!
এর মানে কী দাঁড়ালো? যদি সাবেক রাজার দুই ছেলেই অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে সিংহাসনের যোগ্য দাবিদার হবেন তাদের চাচা, ডিউক অফ গ্লৌচেস্টার, লর্ড প্রটেক্টর রিচার্ড!
অবৈধ রাজা
কলঙ্কমাখা এই খবরটি বেশ দ্রুত সবদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। গিল্ডহলে রিচার্ডের মিত্র ডিউক অফ বাকিংহামও সমবেত লন্ডনবাসীর সামনে একই কথা বললেন। মেয়রসহ সমবেত অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের কাছে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে তিনি উডভিল পরিবারের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ আনেন এবং রিচার্ডকেই ইংল্যান্ডের সিংহাসনের যোগ্য দাবিদার হিসেবে উপস্থাপন করেন।
একদিকে দেশজুড়ে আতঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, অন্যদিকে উত্তর থেকে সেনাসদস্যরা আসছিলো রিচার্ডের সমর্থনে। ফলে ইংল্যান্ডের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, গির্জার যাজকমণ্ডলী এবং সাধারণ জনগণ- সবাই-ই রিচার্ডকে তাদের নতুন রাজা হিসেবে মেনে নিলো। ২৬ জুন তারা সিংহাসনে উপবিষ্ট হতে রিচার্ডকে (চতুর্থ এডওয়ার্ডের ভাই) অনুরোধ করেন, সেই সাথে পঞ্চম এডওয়ার্ড এবং রিচার্ডকে (চতুর্থ এডওয়ার্ডের ছোট ছেলে) অবৈধ হিসেবেও তারা ঘোষণা করেন। ফলে এতদিন ধরে সিংহাসনের দাবিদার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া পঞ্চম এডওয়ার্ডকে সবাই ডাকতে লাগলো ‘এডওয়ার্ড বাস্টার্ড’ বলে। পরের মাসে, অর্থাৎ ১৪৮৩ সালের ৬ই জুলাই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন রিচার্ড, নামধারণ করেন ‘রাজা তৃতীয় রিচার্ড’।
সেই গ্রীষ্মেই ডোমিনিক মানচিনি নামক এক ইতালীয় যাজক লন্ডনে গিয়েছিলেন। রাজা তৃতীয় রিচার্ডের সিংহাসন আরোহনের অল্প কিছুদিনের মাঝেই তিনি ফ্রান্সে ফিরে যান। ‘তৃতীয় রিচার্ডের অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল’ নামে সেই শরতে একটি রিপোর্টও লেখেন তিনি। সেখানে টাওয়ার অফ লন্ডনে দুই রাজপুত্রকে ঘিরে ঘটা নানা ঘটনারই বিবরণ ছিলো। জুন মাসেই তাদের সেবকদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। তাদেরকে টাওয়ারের ভেতরের দিকের কক্ষগুলোতে স্থানান্তর করা হয়েছিলো। আস্তে আস্তে তাদেরকে খুব কমই দেখা যেতে লাগলো। আর এভাবে একটা সময় তারা একেবারেই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়।
রাজপুত্রদের অন্তর্ধান
এডওয়ার্ড আর রিচার্ডের হঠাৎ এই অন্তর্ধানে চারদিকে নানা রকম গুজব ছড়াতে লাগলো। সবাই ধারণা করছিলো যে, দুই ভাইকেই মেরে ফেলা হয়েছে; বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে কিংবা বিষপ্রয়োগ করে।
মানচিনির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রাজা তৃতীয় রিচার্ড ক্ষমতালাভের আগেই পঞ্চম এডওয়ার্ডের কথা শুনলে অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। কারণ, ততদিনে সবাই ধারণা করছিলেন যে, তাকে বোধহয় ইতোমধ্যে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। টাওয়ারে এডওয়ার্ডের সাথে সাক্ষাৎ করা এক চিকিৎসকের বক্তব্যও তুলে ধরেছিলেন মানচিনি। তিনি বলেছিলেন, “কিশোর রাজা নিয়মিতই অনুশোচনার মাধ্যমে পাপ থেকে মুক্তি কামনা করতেন, কারণ তিনি ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন যে, তার মৃত্যু সন্নিকটে।“
১৪৮৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রিস্টলের অধিবাসী রবার্ট রিকার্ডও লিখেছিলেন, “রাজা এডওয়ার্ডের দুই ছেলেকেই টাওয়ার অফ লন্ডনে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ করে দেয়া হয়েছে।” দুই রাজপুত্রের মৃত্যুর গুজব ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে পোল্যান্ড থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। সব জায়গাতেই ঘাতক হিসেবে তাদের চাচা এবং অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলকারী রাজা তৃতীয় রিচার্ডের নামই উঠে আসতে লাগলো। এই গুজবই ১৪৮৩ সালের অক্টোবরে তার বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের সূচনা ঘটায়।
বিদ্রোহে দূরবর্তী বিভিন্ন রাজ্যের রাজারাও অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মাঝে ছিলেন সাবেক রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের বিভিন্ন অনুসারী, রানী এলিজাবেথ, ল্যাঙ্কাস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত মার্গারেট বিউফোর্ট ও তার নির্বাসিত পুত্র হেনরি টিউডর। এমনকি এককালে তৃতীয় রিচার্ডের দৃঢ় সমর্থক ডিউক অফ বাকিংহামও বিদ্রোহীদের দলে নাম লেখান। দুই রাজপুত্রকে যে টাওয়ার অফ লন্ডনেই হত্যা করা হয়েছে- এই বিষয়ে বিদ্রোহীদের কোনো সন্দেহই ছিলো না। তৃতীয় রিচার্ডকে উৎখাত করে তাই সিংহাসনের দূরতম দাবীদার হেনরি টিউডরকেই সেখানে বসাতে একতাবদ্ধ হয়েছিল তারা। বিদ্রোহটি ব্যর্থ হয়, কিন্তু রাজার হাত থেকে পাপের কালিমা মুছলো না। ১৪৮৫ সালের আগস্ট মাসে বসওয়ার্থের যুদ্ধক্ষেত্রে এই হেনরি টিউডরের হাতেই রাজা তৃতীয় রিচার্ড পরাজিত ও নিহত হন।
এরপর ‘রাজা সপ্তম হেনরি’ নামধারণ করে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন হেনরি টিউডর। নিহত দুই রাজপুত্র রিচার্ড ও পঞ্চম এডওয়ার্ডের বড় বোন এলিজাবেথ অফ ইয়র্ককে বিয়ে করে হেনরি দুই পরিবারের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে চলা আসা বিবাদেরও সমাপ্তি টানতে উদ্যোগী হন।
হেনরি রাজা হবার সাথে সাথে দুই রাজপুত্রকে নিয়ে উড়ে বেড়ানো যাবতীয় গুজবেরও পরিসমাপ্তি ঘটতে পারতো। তিনিও চাইলে টাওয়ার অফ লন্ডন থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে সেগুলোর রাজকীয় সমাহিতকরণের মধ্য দিয়ে বিষয়টির সুন্দর আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি টানতে পারতেন। কিংবা রাজ্যজুড়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানোর মাধ্যমে তাদেরকে খুঁজে বের করার পদক্ষেপও নিতে পারতেন।
অদ্ভুত কথা হলো, হেনরি এর কিছুই করেননি। তিনি কি করতে পারেননি, নাকি ইচ্ছা করেই করেননি? পূর্ববর্তী রাজা তৃতীয় রিচার্ডের মতো সপ্তম হেনরির সময়েও সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় ছিল নিখোঁজ দুই রাজপুত্রই। হেনরির নামের পাশে হয়তো তাদেরকে হত্যার কালিমাটুকু ছিল না। কিন্তু তবুও প্রশ্ন ছিলো, হঠাৎ করে দুই রাজপুত্র ফিরে এসে যদি সিংহাসনের দাবি করে বসে, তাহলে তিনি কী করবেন। হেনরির শত্রুরা ঠিক এই ধোঁয়াশাময় পরিস্থিতিরই সদ্ব্যবহার করতে চাইলো। ১৪৮৭ সালের শুরুর দিকে ল্যাম্বার্ট সিম্নেল নামে অক্সফোর্ডশায়ারের এক কিশোর নিজেকে রাজপুত্র রিচার্ড বলে দাবি করে বসে। সিম্নেলের সমর্থকদের হেনরি যুদ্ধে পরাজিত করেন।
১৪৯১ সালে নিজেকে রাজপুত্র রিচার্ড বলে দাবি করে বসে আরেকজন। তার আসল নাম ছিলো পার্কিন ওয়্যারবেক। সে দাবি করেছিলো, ক্ষমতাধর এক লর্ডের সহযোগিতায় সে টাওয়ার অফ লন্ডন থেকে পালাতে সক্ষম হয়। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসককেও সে পাশে পেয়েছিল, যাদের মাঝে ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাজা এবং রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের বোন মার্গারেটও (ডাচেস অফ বার্গান্ডি)। এবারের বিদ্রোহ দমন করতে হেনরিকে ভালোই বেগ পেতে হয়েছিল। ১৪৯৭ সালের অক্টোবরে এসে তিনি বিদ্রোহীদের পুরোপুরি নির্মূলে সক্ষম হন। ধরা পড়ে ওয়্যারবেকও স্বীকার করে নেয় যে, সে আসলে প্রাদেশিক এক কর্মকর্তার ছেলে। জনতার সামনে নিজের আসল পরিচয় ও কুকর্মের কথা স্বীকার করবার পর বিদ্রোহের অভিযোগ এনে ১৪৯৯ সালে ফাঁসির মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
পরিসমাপ্তি
বারবার নিখোঁজ রাজপুত্রদের নিয়ে এমন বিড়ম্বনা হেনরিকেও অতিষ্ট করে তুলেছিল। তাই তো শাস্তিপ্রাপ্ত বিদ্রোহী স্যার জেমস টাইরেলের কাছ থেকে তিনি জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করেন যে, তৃতীয় রিচার্ডের নির্দেশেই তিনি দুই রাজপুত্রকে হত্যা করেছিলেন। এরপর এই স্বীকারোক্তি হেনরি ফলাও করে প্রচারও করেন। ১৫০২ সালে গৃহীত এই স্বীকারোক্তিই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তৎকালীন লেখক থমাস মোর তার বই ‘History of King Richard III’ বইতে আরো একধাপ এগিয়ে লেখেন, খুন করার পর মৃতদেহগুলো একটি সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে তিনি আরও বলেন, টাওয়ারের একজন কনস্টেবলের পরিচিত এক যাজক পরবর্তী সময়ে মৃতদেহগুলো সেখান থেকে তুলে নিয়ে অজানা এক জায়গায় মাটিচাপা দিয়ে আসেন।
অবশেষে ১৬৭৪ সালে এসে যেন এই রহস্যের জট খুলতে শুরু করে। হোয়াইট টাওয়ারের পাশে নির্মাণকাজ চলার সময় একটি সিড়ির নিচে, মাটির ৩ মিটার গভীরে দুটো কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়। থমাস মোরের তত্ত্ব যেন ভিত্তি পেতে শুরু করলো। সবাই সেগুলোকে পঞ্চম এডওয়ার্ড আর রিচার্ডের কঙ্কাল বলেই ধরে নিলো। ১৬৭৮ সালে অবশেষে সেই কঙ্কাল দুটোকে রাজকীয় মর্যাদায় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাধিস্থ করা হয়।
শেষ হইয়াও হইলো না শেষ…
প্রিয় পাঠক, লেখার এই পর্যায়ে এসে আপনার মনে হতেই পারে, “যাক বাবা, অবশেষে তো নিষ্পাপ ছেলে দুটোর কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেলো”! কিন্তু… আসলেই কি তা-ই? রহস্যের এখনও আরো অনেক রঙই দেখা বাকি আছে। ১৬৭৪ সালে সেই দুটো কঙ্কাল পাবার পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে আরো বেশকিছু কঙ্কালই টাওয়ার অফ লন্ডনে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যা নিখোঁজ দুই রাজপুত্রের রহস্যকে আরো ঘনীভূতই করেছে।
সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে টাওয়ারে আবদ্ধ বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ খুঁজে পাওয়ার কথা জানা যায়, যার ভেতরে নাকি মানবকঙ্কাল রাখা ছিল। স্যার ওয়াল্টার র্যালে যখন টাওয়ারে বন্দী ছিলেন, তখনকার সময়ে একজনের কাছ থেকে একটি গোপন, বন্ধ কক্ষের কথা জানা যায়, যার ভেতরে একটি টেবিলের উপর নাকি দুটো বাচ্চার কঙ্কাল রাখা ছিল। আরেক কাহিনীতে আরেকটি চেম্বারের ব্যাপারে বলা হয়, যার ভেতরে একটি বিছানার ওপর দুটো শিশুর মৃতদেহ পড়ে ছিল। তাদের গলার কাছে দড়ি পেচানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। দুই জায়গাতেই বলা হয়, কক্ষগুলো পরবর্তীতে বন্ধ করে দেয়া হয় যেন এই সংক্রান্ত আর কোনো বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে।
১৯৭৭ সালে টাওয়ারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এক তরুণের কঙ্কাল খুঁজে পান। তারা ধারণা করতে শুরু করেন, এটা সেই রাজপুত্রদের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু হলেও হতে পারে। কিন্তু রেডিও কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে জানা যায়, এটি ৭০ খ্রিস্টাব্দের দিককার।
১৬৭৪ সালে পাওয়া কঙ্কালগুলোর উপর আধুনিক রেডিও কার্বন ডেটিংয়ের মতো পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়নি। ১৯৩৩ সালে একজন আর্কাইভিস্ট, একজন অ্যানাটমিস্ট এবং ব্রিটিশ ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে সেগুলোর উপর পরীক্ষা চালানো হয়। তখন তারা সেগুলোকে পঞ্চম এডওয়ার্ড এবং রিচার্ডের বলেই রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানকালে অনেকেই তাদের সেই ফলাফলের বিরোধীতা করেন। কারণ, সেই দুটো কঙ্কাল থেকে প্রাপ্ত নমুনাগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত কি না সেটা নিয়ে কোনো পরীক্ষাই করা হয়নি। ফলে আধুনিককালে অতীতের গবেষকদের সিদ্ধান্তটি অনেকটাই বিতর্কিত।
ফরেনসিক সায়েন্সের প্রভূত উন্নতির ফলে রেডিও কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে যেমন কঙ্কাল থেকেই এর মৃত্যুকাল নির্ণয় করা সম্ভব, তেমনই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ থেকে তাদের পরিচয় খুঁজে বের করাও সম্ভব। কিন্তু এজন্য ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে থেকে কঙ্কালগুলো আবারও তোলা দরকার। আর এখন পর্যন্ত ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে কিংবা বাকিংহাম প্যালেসের কোনো পক্ষ থেকেই সেই অনুমতি মেলেনি।
ফলে সবকিছু একেবারে হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও বলতেই হচ্ছে, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। হয়তো দুর্ভাগা দুই রাজপুত্রের প্রকৃত কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও; শাসকবর্গ তাদের কথার ফুলঝুরিতে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন দুই ভাইয়ের মৃত্যুর সত্যতা, লেখকেরা তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে বারবার চেষ্টা করেছেন অমীমাংসিত এই রহস্যের ইতি টানতে। কিন্তু প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই হত্যারহস্য আজও রহস্য হয়েই থেকে গেলো।