২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া তেলেগু সিনেমা ‘মাগাধীরা’র কথা মনে আছে? সেই যে নির্ভীক যোদ্ধা কালভৈরব বীরত্বের সাথে একাই একশ সৈন্যকে মেরে তারপর নিজেও মৃত্যুবরণ করে। গায়ে কাঁটা দেয়া, চোখ ছলছল করানো এক ট্র্যাজিক দৃশ্য ছিল। ৫ বছর ধরে বক্স অফিসে সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ড ধরে ছিল এই সিনেমা।
সিনেমার এসব দৃশ্য অলৌকিক, ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তব, সে যে সিনেমার চাইতেও বেশি অদ্ভুত, বেশি লোমহর্ষক! এ তো গেল এক সিনেমার কথা, যেখানে স্পেশাল ইফেক্ট দিয়ে একশ’জনের বিরুদ্ধে একজনের লড়াইয়ের এমন দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু ধরুন একটি বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে ১০০ নয়, ৪৭৬ জন সৈন্যের বিপরীতে ১ জন লড়ছে, ভাবুন একবার! সাহায্য পাবার কোনো আশা নেই, পলায়ন ব্যতীত মৃত্যুই একমাত্র পথ, তবু নিশ্চিত নিয়তিকে উপেক্ষা করে বীরত্বের পথ বেছে নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এক অসম যুদ্ধ লড়ে যাওয়া, ভাবা যায়? এমনটাই হয়েছিল সারাগারহির যুদ্ধে। ইতিহাসের কোনো এক পৃষ্ঠার ভাঁজে চাপা পড়া বিস্মৃতপ্রায় এক যুদ্ধ, সারাগারহির যুদ্ধ।
এই যুদ্ধ ছিল ১০ হাজার আফগান সেনার বিরুদ্ধে তত্কালীন ব্রিটিশ আর্মির ৩৬ তম রেজিমেন্টের (বর্তমান ইন্ডিয়ান আর্মির ৪র্থ ব্যাটেলিয়ন) ২১ জন শিখ সৈনিকের। সংখ্যাটা ঠিকই পড়েছেন। এ যুদ্ধে শিখ ও আফগান সৈন্যের অনুপাত ছিল ১: ৪৭৬।
উনিশ শতকের শেষের দিকে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজ করছিল। ১৮৩০ সাল থেকে এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে শুরু হয় ‘দ্য গ্রেট গেম’। এই শতকের শেষের দিকে এসে এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী অটোমান সাম্রাজ্য ও পারস্যের কিয়দংশে আধিপত্য বিস্তার করে আফগানিস্তানের মাধ্যমে ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতবর্ষে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছিল রাশিয়া। দুই পক্ষের জন্যই তাই আফগানিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি ছিল। পুরো ভারত-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকাতেই সে সময় বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। এই সীমানাজুড়ে ব্রিটিশ সেনাদলের অরক্ষিত বেশকিছু সেনাঘাঁটি ছিল। এমনই এক ঘাঁটি ছিল সারাগারহি। বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের তিরাহ উপত্যকায় ছিল এই ঘাঁটি। লকহার্ট ও গুলিস্তান নামক দু’টি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান দুর্গের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় বজায় রেখেছিল এই সারাগারহির ঘাঁটি।
সাল ১৮৯৭, সারাগারহির ঘাঁটিতে তখন ২১ জন শিখ সৈনিক অবস্থান করছিলেন। সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ, সকাল ৯টার দিকে দলনেতা হাবিলদার ঈশার সিং ও সিগন্যালম্যান গুরুমুখ সিং আবিষ্কার করলেন হাজারে হাজারে ব্রিটিশবিরোধী আফ্রিদি ও ওরাকজাই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের এক বিশাল দল যুদ্ধের সাজে পাহাড়ে জমা হয়েছে। গুরুমুখ সিং তৎক্ষণাৎ তাদের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন হফটনকে টেলিগ্রাফে খবর পাঠালেন, “ENEMY APPROACHING THE MAIN GATE… NEED REINFORCEMENT”। কিন্তু ততক্ষণে শত্রুরা ছোট্ট ঘাঁটিটাকে ঘিরে ফেলেছে। হফটন হতাশ করে জবাব পাঠালেন, “UNABLE TO BREAKTHROUGH…HOLD POSITION”। হাবিলদার সিং অবস্থা বুঝলেন। উত্তর পাঠালেন, “UNDERSTOOD”।
বিভিন্ন তথ্যসূত্রে এই যুদ্ধে আফগান দলের সৈন্য সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজারের মতো ছিল। ইন্ডিয়ান আর্মির সাবেক মেজর জেনারেল ধ্রুব সি কাটোচ এর মতে এই যুদ্ধে বিপক্ষ দলে ১০ থেকে ১২ হাজার লোক ছিল।
কর্ণেল হফটন এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সাহায্য পাঠানোর জন্য তার সময় দরকার ছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ছোট্ট অরক্ষিত ঘাঁটিটার হাতে গোনা ক’জন শিখ সৈনিক নিহত হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। ঘাঁটিতে অবস্থানরত ২১ জন শিখ তা আরও ভালো করে বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু অকুতোভয় শিখরা পিছু হটতে শিখেননি কখনো। তারা শত্রুদের ব্যস্ত রেখে লকহার্ট ও গুলিস্তান দুর্গের সৈন্যদের তৈরি হবার সুযোগ দেয়ার মনস্থ করলেন। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা।
যুদ্ধ শুরু হলো। সবার আগে মৃত্যুবরণ করলেন সিপাহী ভগবান সিং। আহত লাল সিং ও জিভা সিং তার মৃতদেহটা টেনে নিয়ে গেলেন প্রাচীরের আড়ালে। কয়েক ঘন্টা যুদ্ধ করার পর শিখ সেনাদের গোলা-বারুদ ফুরিয়ে এলো। আফগানীরা এবার আশেপাশের গাছের ডালপালা জড়ো করে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া তৈরি করলো। সেই ধোঁয়ার সুযোগ নিয়ে শিখদের দৃষ্টি এড়িয়ে তারা ঘাঁটির একপাশের দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়লো। হাবিলদার ঈশার সিং শেষবারের মতো তার সাহসের পরিচয় দিলেন। দু’জন সিপাহীকে তার সাথে রেখে বাঁকিদের ঘাঁটির ভেতরের দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিতে বললেন তিনি। সেয়ানে সেয়ানে বন্দুক যুদ্ধ ছেড়ে এবার হাতাহাতি লড়াই শুরু হলো।
আফগানরা সারাগারহির ঘাঁটির পুরোপুরি দখল নেবার আগ পর্যন্ত পাঁচজন শিখ সেনা জীবিত ছিলেন। এর মধ্যে ৪ জনই হাতাহাতি যুদ্ধে রত ছিলেন। ৫ম জন, সিগন্যালম্যান গুরুমুখ সিং এর কাজ ছিল সিগন্যাল টাওয়ারে উপবিষ্ট থাকা ও হফটনের কাছে বার্তা পাঠানো। সহযোদ্ধাদের অবস্থা বুঝে এবার তার যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যহতির অনুমতি চাইলেন তিনি। বিকাল সাড়ে ৩টা, গুরুমুখ সিং শেষ বার্তা পাঠালেন হফটনকে, “…REQUEST PERMISSION TO DISMOUNT AND JOIN THE FIGHT”। ত্বরিত জবাব পেলেন, “PERMISSION GRANTED”। সারাগারহির ঘাঁটির সর্বকনিষ্ঠ সৈনিক, ১৯ বছর বয়সী গুরুমুখ সিং তার জিনিসপত্র একটা চামড়ার থলেতে বেঁধে, বেয়নেট বাগিয়ে নেমে এলেন টাওয়ার থেকে। এই সময়ের মধ্যে হফটন তার সৈন্যদল নিয়ে এগিয়ে আসতে সক্ষম হন।
তার ভাষ্যমতে, গুরুমুখ সিংকে জীবিত পুড়িয়ে মারে আফগানরা। মৃত্যুর আগ অবধি অন্তত ২০ জন শত্রু সেনাকে শেষ করেন গুরুমুখ। লড়াই করার সময় শিখদের গুরুমন্ত্র চিৎকার করে যাচ্ছিলেন তিনি, “জো বোলে সো নিহাল, সাত স্রি আকাল” (সময়হীন প্রভুর নাম যে জপে, সে সুখী ও অমর হয়)। দলের সর্ব কনিষ্ঠজনই যখন মরণপণ হাতাহাতি যুদ্ধে কুড়ি জনকে মেরে মরে, তখন অন্যান্য জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞজনরা মোট কতজন করে শত্রু ঘায়েল করেছিলেন, বলাই বাহুল্য। ধ্রুব সি কাটোচের মতে, ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের পর সেখানে ছড়ানো ছিটানো ৬০০ মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর যে একটা বিশাল সংখ্যক আফগানী সৈন্যদের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই নজিরবিহীন সাহসিকতার ঘটনা নাড়া দেয় গোটা বিশ্বকে। ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৭, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অধিবেশন চলাকালীন অধিবেশন থামিয়ে এই অখ্যাত বীরদের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এই ২১ জন সৈনিককে মরণোত্তর সম্মানসূচক ‘ইন্ডিয়ান অর্ডার অব মেরিট ক্লাস থ্রী’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটের প্রত্যেক সদস্য পুরষ্কৃত হন। রানী ভিক্টোরিয়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গর্ব করে বলেছিলেন, “এটি কখনোই বাড়িয়ে বলা হবে না যে, যেই সেনাবাহিনীতে দুঃসাহসী শিখরা রয়েছে, সেই সেনাবাহিনী কোনো যুদ্ধে হারবে না।”
কর্নেল হফটনও বলেছিলেন, “আমরা এই বীর সৈনিকদের আত্মত্যাগের জন্য দুঃখ পেতে পারি, কিন্তু যতদিন শিখ জাতি থাকবে, তারা কোনোদিন এই লড়াইয়ের গৌরব ভুলবে না।” এই বীরত্বগাঁথা আজ শুধু শিখদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আজ ১২০ বছর পরেও ইন্ডিয়ান আর্মির সবচেয়ে সুসজ্জিত রেজিমেন্ট, শিখ রেজিমেন্ট ১২ সেপ্টেম্বরকে সারাগারহি দিবস হিসেবে পালন করে। সারাগারহি, ফিরোজপুর ও অমৃতসরে তিনটি গুরুদুয়ারা নির্মিত হয়েছে এই নির্ভীক যোদ্ধাদের স্মরণে।
সারাগারহির এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ নিয়ে বলিউডেও সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। পরিচালক রাজকুমার সন্তোষী শুরু করেছেন ‘সারাগারহি’ নামেই একটি সিনেমার কাজ। এতে হাবিলদার ঈশার সিং এর ভূমিকায় আছেন দক্ষ অভিনেতা রনদীপ হুদা। ছবিটি আগামী বছরের মাঝামাঝি মুক্তি পাবে। ওদিকে অক্ষয় কুমার ও করন জোহরের যৌথ প্রযোজনায় ও অনুরাগ সিং এর পরিচালনায় একই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ‘কেসরি’ নামে একটি ছবির কাজ শুরু হবে আগামী বছর। এটি মুক্তি পাবে ২০১৯ সালের হোলি উৎসবে।
সারাগারহির এই যুদ্ধ একইসাথে শিক্ষা দেয় দায়িত্বজ্ঞান, আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও তেজস্বিতার। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের প্রতিটি সৈনিকের কাছে এক মহান দিক নির্দেশনা হয়ে থাকবে এই যুদ্ধ। কালের চক্রে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এলেও, মহাকালে অক্ষত থাকবে এই বীরত্বনামা।