ভিক্টোরিয়ান যুগে নারীদের অবস্থা নিয়ে এর আগের লেখায় আলোচনা করা হয়েছিলো। সেখানে দেখা গিয়েছে যে, সভ্যতার উন্নতির দিকে ধাপে ধাপে ব্রিটেন এগিয়ে গেলেও নারীদের অবদান সেখানে ছিল সামান্য এবং তার মূল কারণ ছিল তাদের প্রতি আস্থা না রাখা। আমাদের দেশে মেয়েদের যে অবস্থা ছিল, সেখানেও একইরকম অবস্থা বিরাজ করছিল। সেটা শিক্ষাখাতে হোক, চাকরির ক্ষেত্রে হোক, কিংবা সমাজে পদমর্যাদার ক্ষেত্রে হোক, সবসময় নারীদেরকে পিছিয়ে রাখা হতো। সেজন্য সেসময় নারীরা নিজেরাই National Union of Women’s Suffrage Societies (NUWSS) এবং Women’s Social and Political Union (WSPU) এর মতো সংস্থা তৈরি করে তাদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সফলভাবে আওয়াজ তুলতে পেরেছিল। ভোটাধিকার আদায়ের জন্য নিজেদেরকে Suffragettes এবং Suffragist হিসেবে গড়ে তুলেছিল তারা। এসব সংঘের বেশিরভাগ সদস্য ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর তাদের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, তখনকার সরকার বাধ্য হয় নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে। এই যুদ্ধের ফলে অনেকগুলো খারাপের মধ্যে ভালো একটি উদাহরণ ছিল যে নারীরা তাদের যোগ্যতা এবং কর্মক্ষমতা দেখাতে পেরেছিলো এবং প্রমাণ করতে পেরেছিলো, তারাও পুরুষদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। যুদ্ধের সময়কার এবং তার পরবর্তী ঘটনা নিয়েই আজকের এই লেখা।
নারী-পুরুষ, উভয় শ্রেণির মানুষকে এই যুদ্ধ নাড়া দিয়েছিলো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই ভোটাধিকার আদায় করার জন্য নারীরা যে কঠোর আন্দোলন শুরু করেছিলো, সেটা থেকে তারা সরে আসে। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে তারা তখন আর্মিতে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করে। এখানে উল্লেখ করা ভালো যে, অনেকের মতো তখনকার তরুণ সমাজের কাছে মনে হয়েছিলো এই যুদ্ধ বেশিদিন হবে না। তাদের কাছে এই যুদ্ধ আকাঙ্ক্ষিত ছিল এবং তারা চাচ্ছিলো এমন একটি যুদ্ধে যোগ দিতে। কারণ তাদের কাছে মনে হয়েছিলো এই যুদ্ধের ফলে নিজেদের সমাজ, দেশ, এমনকি বাইরের দেশেও প্রচুর সম্মান এবং সুনাম পাওয়া যাবে। কিন্তু আদতে যে এরকমটি হয়নি, পরে ইতিহাস সাক্ষী হয়েছে।
যা-ই হোক, নারীদের এরকম আন্দোলনের ফলে তারা কিছু কাজ পায়, যেমন নিজ দেশ থেকে এমন কিছু জিনিস এবং পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ করা, যেগুলো যুদ্ধ যাওয়ার সময় ট্রুপ নিয়ে যেতে পারে। যেমন- সমীক্ষা করে দেখে গিয়েছে, ১৯১৪ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৩২ মিলিয়ন সিগারেট, ১৬ মিলিয়ন বই এবং ৪ মিলিয়ন জোড়া মোজা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো।
উপরোল্লিখিত এই কাজগুলোর কিছু অংশ নারীদের দিয়ে করানো হয়েছিলো। তারা তাদের দেশের জন্য কিছু করতে চাচ্ছিলো এবং তাদের দাবি ছিল তাদেরকে যেন এই সুযোগটি দেয়া হয়। তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছিলো, কিন্তু তারা আরও সক্রিয়ভাবে দেশের কাজে নিয়োজিত করতে চাচ্ছিলো। কাজের জন্য কিছু নারী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে Women’s Auxiliary Army Corps (WAAC)-এ যোগদান করে। এই সংস্থাটির কাজ ছিল তখন ফ্রান্সে অবস্থিত তাদের যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর কাছে রান্না করার লোক, সহকারী এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার লোক পাঠানো। সেখানে আরও ভালো ভালো কাজের সুযোগ ছিল, যেমন- নার্স হিসেবে আহত সৈন্যদের সেবা দান করা, যা Voluntary Aid Detachment (VAD) হিসেবে পরিচিত ছিল। নারীরা এসব কাজের সাথে যুক্ত থেকে দেশের জন্য নিজেদেরকে পুরোপুরি নিয়োজিত রেখেছিলেন।
সেসময় নারীদের সবচেয়ে বেশি কাজের সুযোগ ছিল যুদ্ধ উপকরণ, সামরিক রসদ তৈরির শিল্প কারখানাগুলোতে (Munitions Industry)। সামরিকবাহিনীর প্রধানের বিশ্বাস ছিল যদি যুদ্ধের ময়দানে তাদের কাছে বেশি বন্দুক এবং গোলাবারুদ থাকে, তাহলে যুদ্ধে জয়লাভ সহজ হবে। সামরিক রসদ সরবরাহের এই কারখানাগুলোতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় প্রায় ২,১২,০০০ নারী কর্মচারী ছিল, কিন্তু ১৯১৮ সালের মধ্যে সেখানে এই সংখ্যা বেড়ে ৯,৪৭,০০০ এ গিয়ে দাঁড়ায়। এই কারখানাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা কিন্তু খুব বেশি সুখকর ছিল না নারী কর্মচারীদের জন্য। অমানুষিক পরিশ্রমের ভিতর দিয়ে যেতে হতো তাদেরকে। প্রায় ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে একটানা কাজ করতে হতো। কারণ সেখানে মারাত্মক সব বিস্ফোরক রাখা ছিল এবং এসব নিয়ে কাজ করতে হতো, বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মজুদ করে রাখা হতো বিস্ফোরক বানানোর জন্য। সেগুলোর সংস্পর্শে কাজ করতে করতে নারীদের মুখমণ্ডল হলুদ রঙে পরিবর্তিত হতো এবং প্রায়ই সেখানে এমনসব দুর্ঘটনা ঘটে যেত, যা তাদেরকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিলো। তাদেরকে তখন বলা হতো ‘The Girls with Yellow Hands’।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় সাথে সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আসা শুরু করে। সামরিক রসদ কারখানা ছাড়াও পরিবহন খাতে, বাণিজ্যে, কৃষিকাজে, সরকারি পর্যায়ে, শিক্ষিকা হিসেবে, বিভিন্ন হোটেলে, বাসার কাজে– ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কাজ শুরু করে। সবচেয়ে বেশি কাজের সুযোগ হয় শিল্পকারখানাগুলোতে। ১৯১৮ সালের মধ্যে সেখানে প্রায় ২৯,৭০,৬০০ জন নারী কর্মচারী ছিল। এরপরেই ছিল বাসাবাড়ির কাজে নিয়োজিত নারীরা, যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২,৫০,০০০ জন। এছাড়া বাণিজ্য ক্ষেত্রে এবং সৈন্যদের সেবাদান করার জন্য নার্সিং এর কাজে নিয়োজিত নারীদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে প্রায় ৯,৩৪,০০০ এবং ৬,৫২,০০০। এই সংখ্যাগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে বিশ্বযুদ্ধ তাদের জন্য শাপেবর হয়ে কাজ করেছে। অন্তত তারা দেশের কাজে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করতে পারছে এবং নিজেদেরকে প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে, যেটা ছিল তাদের জন্য অনেক বড় সম্মানের ব্যাপার।
একটি কথা এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে, নারীদের এত বেশি কাজের সুযোগ পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সৈন্যরা। তারা যুদ্ধে চলে যাওয়ার কারনে ব্রিটেনে কর্মচারীর সংকট দেখা যায়। দেখা যাচ্ছিলো যে বেশিরভাগ কর্মসংস্থানে কর্মচারীর পদ খালি হয়ে পড়ে আছে, শিল্পকারখানাগুলোতে শ্রমিকের অভাব। তখন সেখানকার মালিক পক্ষ এবং ট্রেড ইউনিয়ন তাদের কাজ করার নিয়মাবলীতে শিথিলতা আনে এবং নারীদের কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়।
তবে এই সুযোগটি তখনকার প্রত্যেক কর্মজীবী নারীই কাজে লাগায়। যুদ্ধের কারণে যখন পুরো দেশে জাতীয় সংকট দেখা দিচ্ছিলো, তখন এই নারীরাই সেখান থেকে দেশকে উদ্ধার করে। নারীদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। তাদের কাছে মনে হয় যে দেশের কল্যাণ এবং উন্নতির জন্য হলেও নারীদের পুরুষদের পাশাপাশি কাজের সুযোগ দেয়া উচিত। যদিও যুদ্ধের পর অনেক নারী তাদের চাকরি হারায়, কারণ যুদ্ধ থেকে অনেকেই ফিরে আসে এবং আগের কাজে যোগদান করে। কিন্তু নারীদের মধ্যে অনেকেই ভোটাধিকার পায়, যেটা নিয়ে তারা বিপ্লব করেছিলো। নারীদের মধ্যে যাদের বয়স ৩০ এর উপরে অথবা যারা সরকারি কাজে নিয়োজিত বা সরকারি কোনো কর্মকর্তার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ, তাদেরকে এই ভোটাধিকারের সুযোগ দেয়া হয়।
পুরুষ কর্মচারীদের থেকে তাদেরকে অনেক কম টাকা দেয়া হলেও নারীরা তাদের কাজে আনন্দ পাচ্ছিলো। একধরনের স্বাধীনতার সুখ পাচ্ছিলো তারা, কারোর উপর নির্ভর করে নয় বরং পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলো নারীরা, যেটা তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মনোভাবকে প্রবলভাবে জাগিয়ে তুলেছিলো। ১৯২০ সালের পর তাদের অবস্থার আরও পরিবর্তন হয়। নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও অনেক পরিবর্তন আসে। এবং যুদ্ধের আগের সময়ে তাদের অবস্থান এবং ১৯২০ সালের পরে সমাজে তাদের অবস্থানে অনেক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছিলো যে নারী-পুরুষের মধ্যকার যে ব্যবধান এবং বৈষম্য ছিল, তা আর কখনও সেভাবে সেখানে ফিরে আসেনি।
তথ্যসূত্র:
[১] Making History – World History from 1914 to the Present – Christopher Culpin
ফিচার ইমেজ সোর্স: weebly.com