বিশ্বজুড়ে নিয়মিত প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন আমাদের সামনে তুলে আনছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। মাটি খুঁড়ে যেমন শতাব্দী প্রাচীন শহরের সন্ধান মিলছে, তেমনি সমুদ্রের অতলেও খোঁজ মিলছে সভ্যতার নিদর্শন। এমন আবিস্কার পৃথিবীর সভ্যতাগুলোর ইতিহাস নিয়ে আবার ভাবার সুযোগ তৈরি করে দেয়। কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে পানির অতলে! যে রহস্যের টানে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেখানেও ডুব দিতে দুবার ভাবেন না। এগুলোর ফলাফলও মিলছে খুব দ্রুত। যার কারণে নতুন এক জগত সম্পর্কে জানার দুয়ার খুলে গেছে আমাদের সামনে। আজ এমন কিছু অবিশ্বাস্য আবিস্কার নিয়েই জানব, যেগুলো এতদিন সাগরের তলদেশে লুকায়িত ছিল পরম যত্নে!
১. প্রাচীনতম নৌযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ
২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সিসিলির উপকূলে একটি অনুসন্ধান কার্যক্রম চালান। সেখানে তারা অপ্রত্যাশিতভাবে এমন কিছু নমুনার খোঁজ পান, যেগুলো প্রাচীনকালে সংঘটিত কোনো একটি নৌযুদ্ধকে ইঙ্গিত করে। সৈনিকদের শিরস্ত্রাণ, বর্মসহ প্রাপ্ত অন্যান্য অস্ত্রের নমুনা থেকে আন্দাজ করা যায়, যুদ্ধটি অন্তত ২ হাজার বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৪১ সাল থেকে রোমান আর কার্থেজিনিয়ানদের মাঝে ২০ বছর ধরে চলমান এক নৌযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরের দখল নিয়ে সংঘটিত এই যুদ্ধ প্রথম পুনিক যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধের শেষদিকে এগাদি দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি এলাকায় কার্থেজিনিয়ানদের জাহাজডুবির পর সেগুলো পানির অতলে হারিয়ে যায়।
কার্থেজিনিয়ানদের নৌবাহিনী সেই সময় রোমানদের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। তবে রোমানদের কূটকৌশলের কাছে তারা অবশেষে হার মানতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের এই সময় ৫০টি পর্যন্ত কার্থেজিনিয়ান জাহাজ ডুবে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে জাহাজে অবস্থান করা ১০,০০০ যোদ্ধারও সলীল সমাধি হয়েছিল, যে পরাজয় রোমানদের ইউরোপে প্রবেশের পথ সুগম করে দেয়।
সহস্রাব্দের এই অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এতদিন সমুদ্রের ১০০ মিটার নিচে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় ছিল, যা ইতিহাসকে জানার নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছে।
২. মায়ানদের গুহায় মাথার খুলি
ঘটনাটি মেক্সিকোর একটি উপকূলীয় গ্রামের, সেখানে সমুদ্রের অগভীর অংশে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক কয়েকটি অদ্ভুত গুহার সন্ধান পান। গুহার ভেতর প্রবেশ করতেই গবেষকদল চমকে যান! সারি সারি মানুষের মাথার খুলি আর কঙ্কাল দেখে তারা সত্য অনুসন্ধানে নামেন। ততদিনে গ্রামবাসীর কাছে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে, ফলে তারা আতঙ্কিত হয়।
অদ্ভুত এই ডুবো গুহাটি আবিষ্কৃত হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে। মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপের কাছাকাছি সন্ধান পাওয়া এই গুহার নাম দেওয়া হয় ‘স্যাক উয়েয়াম’। মূলত এটি একটি প্রাকৃতিক গুহা, যেখানে চুনাপাথর দিয়ে তৈরি বেদিগুলো সময়ের পরিক্রমায় ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। ধারণা করা হয়, এখানে মায়ানরা নিজেদের উপাসনার অংশ হিসেবে বলিদান করত। স্থানীয় কিংবদন্তী মতে, রহস্যময় গুহাটিকে প্রাচীনকাল থেকে ভয়ঙ্করদর্শন এক সাপ পাহারা দিচ্ছে, যার শরীরভর্তি পালক আর গর্দানের উপরের অংশটি দেখতে ঠিক ঘোড়ার মাথার মতো! গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরাও তাই সুযোগ পেয়ে তরুণদের নিয়ে মেতেছেন তাদের গল্প শোনাতে! যে গল্পের বিষয়বস্তু একটি সাপকে ঘিরে; দেখতে ভয়ঙ্কর আর আকারে বিশাল যে সাপ বহু বছর আগে এই দ্বীপে বাস করত। সে সমুদ্রে ডুব দিত আবার ভেসে উঠত, কখনো বা দ্বীপের উপর এসে বিশ্রাম নিত!
প্রত্নতাত্ত্বিকরা কিংবদন্তীকে ঘিরে গড়ে ওঠা গ্রামবাসীদের ভয়কে আমলে নিলেন। এখানে হয়তো সত্যিই সাংঘাতিক কিছু ঘটে গিয়েছিল অতীতে। তবে প্রবীণরা যেভাবে সবার কাছে তুলে ধরেছে সেভাবে নয়। সত্যিকার গল্পগুলো হয়তো আরও মারাত্মক, যা শতাব্দী জুড়ে সবার আড়ালেই রয়ে গেছে।
গবেষকদল গুহাটিতে এক ডজনেরও বেশি মানুষের খুলি এবং কঙ্কাল শনাক্ত করেছেন। তবে সেগুলোতে বলি দেওয়ার মতো কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সবগুলো কঙ্কালকে সমাধিস্থ করার পূর্বে পিষে সমতল করে ফেলা হয়েছিল! এটা কি কোনো ধর্মীয় রীতি, যার জন্য এমন আকৃতি দেওয়া হয়েছিল? এর উত্তর এখনও অজানা।
৩. জাপানের ডুবন্ত শহর
১৯৯৫ সালে একজন ডুবুরী জাপানের ওকিনাওয়া উপকূল থেকে সাঁতরে বেশ খানিকটা দূরে চলে গিয়েছিল। সেখানে সে বিপদের সম্মুখীন হয় এবং খেই হারিয়ে পানির নিচে তলিয়ে যায়। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর সে উপরে ভেসে উঠতে সক্ষম হয়। তবে ভেসে ওঠার আগে পানির নিচে সে অদ্ভুত কিছু আকৃতি দেখতে পায়!
তারপর থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিকপাড়ায় বেশ একটা হইচই পড়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাপানের ইউনাগুনির দক্ষিণ উপকূলে পাওয়া এই পাথুরে স্থাপনাটি নিয়ে গবেষকরা দুভাগ হয়ে পড়েছিলেন। একদলের মতে, এটি মনুষ্যসৃষ্ট, যেখানে অন্যরা একে প্রাকৃতিক বলে দাবি করছেন। বিশাল এই স্থাপনার পুরো গঠনজুড়ে অনেকগুলো বড় পাথরের ব্লক রয়েছে। সেগুলোকে পর পর খুব নিখুঁতভাবে বসানো রয়েছে।
গবেষকদের মাঝে এর উৎপত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও একটি ব্যাপারে সবাই একমত। আর সেটা হলো পাথুরে গঠনটি প্রায় ১০,০০০ বছরের পুরোনো!
পাথরের উপরিভাগে পাকা রাস্তা, চৌরাস্তা, বাজারসহ একটি সমৃদ্ধ নগরের অসংখ্য চিহ্ন রয়েছে। এই থেকে আন্দাজ করা যায় স্থানটিতে একসময় মানুষের বসবাস ছিল। কালের পরিক্রমায় যা সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ রবার্ট সোচ গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ডুবে যাওয়া স্থানটিতে টেকটোনিক প্লেটের বেশ সক্রিয়তা রয়েছে। এদের স্থানচ্যুতির কারণেই হয়তো শহরটি তলিয়ে গেছে।
৪. প্রায় অক্ষত লায়ন সিটি
প্রাচীন এক নিমজ্জিত শহর লায়ন সিটি, চীনারা যাকে ‘শি চ্যাং’ নামে অভিহিত করে। এই শহরটি ‘উ শি’ পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত কিয়ানডাও হ্রদের নিচে প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে রয়েছে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবিষ্কৃত হওয়ার পর গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন, শহরটি কমপক্ষে ৫০ বছর পূর্বে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফলে এটি আদতে একটি ভার্চুয়াল টাইম ক্যাপসুলে রূপান্তরিত হয়েছে।
হানদের রাজত্বের সময় (২৫-২০০ খ্রিস্তাব্দ) শি চ্যাং শহরটি গড়ে উঠেছিল। একসময় পূর্ব ঝেজিয়াংয়ের প্রদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির কেন্দ্র ছিল শি চ্যাং। ১৯৫৯ সালে চীন সরকার একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করে। এভাবেই কিয়ানডাও হ্রদ তৈরি করা হয়, যার ফলে শি চ্যাং ৪০ মিটার পানির নিচে ডুবে যায়।
অবশেষে, শহরটি ডুবে যাওয়ার ৫৩ বছর পর সেই অঞ্চলের পর্যটন কর্মকর্তা কিউ ফ্যাংয়ের নজরে আসে ব্যাপারটি। তিনি সরেজমিনে ডুবন্ত শহরটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে নামেন। এই শহরে অমূল্য কিছু লুকিয়ে রয়েছে কি না সেটা জানাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তিনি ও তার দল যখন সেখানে পৌঁছান, অবাক হওয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না। তাদের সাদরে গ্রহণ করার জন্যই যেন ডুবন্ত শহরটি এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে! শহরের মন্দির, স্মারক তোরণ, খাঁজকাটা রাস্তা এবং ঘরগুলো প্রায় অক্ষত। যেন সেগুলো আদিমতম ব্যস্ত শহরের প্রমাণ মেলে ধরছে।
গবেষকদল এই আবিষ্কারকে আরেক ‘হারানো আটলান্টিস’ বলে উপমা দিয়েছেন। শীঘ্রই এটি চীনের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র হবে বলে তাদের বিশ্বাস। তবে ডুবন্ত শহরটিকে একেবারে হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখাও তাদের দায়িত্ব বলে মনে করেন পৃথিবীর তাবৎ প্রত্নতত্ত্ববিদ।
৫. হেরাক্লিওন-ক্লিওপেট্রার শহর
হেরাক্লিওন শহরটির কোনো এক মন্দিরে রানী ক্লিওপেট্রার অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল। যে শহর ১,২০০ বছর পূর্বে ভূমধ্যসাগরের মিসরীয় উপকূলে ডুবে গিয়েছিল। ডুবে যাওয়ার আগেও শহরটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
২০০১ সালে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক একটি ফরাসি যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে গিয়ে শহরটির খোঁজ পান। তারা মাটি এবং কাদার স্তর সরিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের মুখোমুখি হন। একটি পরিপূর্ণ সাজানো-গোছানো শহর! যার সবকিছু এত বছর পরও প্রায় অবিকৃত রয়েছে।
ফেরাউনদের দৈত্যাকার সব মূর্তি, নানা দেব-দেবীর মূর্তি, স্ফিংক্স, ৬৪টি জাহাজ এবং তাদের নোঙ্গর, প্রাচীন মিসরীয় শিলালিপি, সোনা-ব্রোঞ্জের মুদ্রাসহ অগণিত সম্পদের ভাণ্ডার।
গ্রীক ঐতিহাসিক হেরাডোটাস আমাদের প্রাচীন এক মন্দির সম্পর্কে বলেছিলেন। মন্দিরটি হেরাকলের মিশরে আগমন উপলক্ষে তৈরি করা হয়েছিল তারই নামানুসারে। মিশরে হেরাডোটাসের আগমনের ৪০০ বছর পর, ভূগোলবিদ স্ট্র্যাবো হেরাক্লিওন শহরকে নিয়ে একটি নতুন পর্যবেক্ষণ হাজির করেন। তিনি দেখান যে, হেরাক্লিওন শহরটি নীল নদের ক্যানোপিক শাখামুখে ক্যানোপাসের পূর্ব দিকে অবস্থিত। শহরটি আবিষ্কারের পূর্বে জাঁকজমকপূর্ণ হেরাক্লিওন কেবল কিংবদন্তীরই একটি অংশ হয়ে ছিল সহস্র বছর ধরে।