প্রাচীন গ্রীসে যতগুলো নগররাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল, তার মধ্যে সামরিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল স্পার্টা। বর্তমানে হলিউডের মুভি থেকে শুরু করে ইতিহাসের পাতা– সবখানে স্পার্টানদের প্রচন্ড যুদ্ধপ্রিয় জাতি হিসেবে দেখানো হয়, যেটি আদতে সত্যও। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি বোধহয় স্পার্টানদের মতো তাদের সমাজকে এত বেশি সামরিকীকরণ করতে পারেনি, হয়তো পারবেও না।
স্পার্টান সমাজে একেবারে জন্মের পর থেকেই একজন মানুষকে যেভাবে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত দুধর্ষ সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল, তা পড়তে গেলে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে যায়। প্রাচীন স্পার্টায় দুই রাজা ও ত্রিশজন সিনেট সদস্যের ভারসাম্যমূলক শাসন কিংবা নারীদের সমসাময়িক অনেক বেশি অধিকার ভোগের মতো ঘটনাগুলো এখনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আগ্রহের বিষয়। ইতিহাসে স্পার্টার পরিচয় মূলত একটি প্রচন্ড যুদ্ধপ্রিয় জাতি হিসেবে, যারা তাদের যুদ্ধপ্রিয়তাকে ভিত্তি বানিয়ে নিজেদের সংবিধান প্রণয়ন করেছিল এবং নিজেদের নাগরিকদের একেবারে ছোট থেকে দুধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে গড় তুলতে সিদ্ধহস্ত ছিল।
স্পার্টার ইতিহাস সম্পর্কে একটি মজার বিষয় হলো, তাদের ইতিহাস মূলত লেখা হয়েছিল এথেন্সের ইতিহাসবিদদের হাতে। আর এথেন্স ছিল স্পার্টার প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি গ্রিক নগররাষ্ট্র, যেটি গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পৃথিবীবিখ্যাত হয়ে আছে। যখন শত্রুদের হাতে ইতিহাস লেখা হয়, তখন ‘খলনায়ক’ হিসেবে উপস্থাপিত হওয়ার সুযোগ থাকে, এবং এথেন্সের ক্ষেত্রে বর্তমান ইতিহাসবিদেরা এটাই সন্দেহ করে থাকেন। ইতিহাসবিদদের মতে, যেহেতু স্পার্টানদের সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য এথেন্সের ইতিহাসবিদদের বয়ানে আমরা জানতে পারি, তাই স্পার্টানদের বহুল প্রচলিত ইতিহাস ‘একপাক্ষিকতা’ ও ‘বিকৃতি’র দোষে দুষ্ট হতেই পারে। তবে এথেন্সের ইতিহাসবিদদের বয়ানে যে তথ্যগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোকে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ নেই, কারণ “যা রটে, তা কিছু তো বটে!” আর অনেক তথ্যের পেছনে আধুনিক সময়ে এসে গবেষণাগত সত্যতাও মিলেছে।
দ্য হেলট বা প্রাচীন স্পার্টার দাসদের পেছনের গল্প জানতে গেলে সেসময়ের সামাজিক কাঠামো, শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে জানা জরুরি। স্পার্টান সমাজে মোটা দাগে তিনটি শ্রেণী ছিল। স্পার্টার স্থানীয় নাগরিকরা পরিচিত ছিল স্পার্টিয়েট (Spartiate) হিসেবে, যারা সংখ্যায় অল্প হলেও স্পার্টার সকল রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতো ও যুদ্ধের সময় মূল ভূমিকা পালন করতে বাধ্য ছিল। স্পার্টান সমাজের একটি বড় অংশকে অভিহিত করা হতো ‘পেরিওইকোই’ (Perioikoi) হিসেবে, যারা রাজনৈতিক অধিকার ভোগ না করলেও রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য ছিল এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য ছিল। পেরিওইকোইদের স্বাধীনতা ছিল, তারা চাইলে কোনো অনুমতি ছাড়াই স্পার্টার বাইরে যেতে পারত। হেলট (Helot) বা কৃষিদাসরা ছিল সমাজের একেবারে নিচুশ্রেণীতে, যাদের কোনো অধিকার তো দূরে থাক, স্বাধীনতাই ছিল না, রাষ্ট্রের নির্দেশে তাদের জীবন পরিচালিত হতো।
হেলোস (Helos) নামে স্পার্টার দক্ষিণে একটি গ্রাম আছে। হেলানিকাস নামের একজন ইতিহাসবিদের মতে, এই গ্রামের অধিবাসীরাই সর্বপ্রথম স্পার্টানদের দাসত্ব বরণ করে এবং তাদেরকে ‘হেলোট’ (Helot) হিসেবে অভিহিত করা শুরু হয়। মেসেনিয়ার যুদ্ধে মেসেনিয়ার অধিবাসীরা পরাজিত হওয়ার পর তাদেরকে দাসত্ব বরণ করে নিতে হয় এবং তখন থেকেই ‘হেলোট’ শব্দটি প্রচলিত হয়– এ ধরনের দাবিও করেছেন বেশ কিছু ইতিহাসবিদ। তবে হেলোট শব্দটির অর্থ ও উৎপত্তি নিয়ে যত তর্ক-বিতর্ক থাকুক না কেন, এর মাধ্যমে যে স্পার্টানদের দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিদের বোঝানো হতো, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকা উচিত নয়।
এবার হেলোট কারা– সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। স্পার্টান সমাজের শ্রেণীগুলো সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমরা দেখেছি, হেলোট মূলত দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকা ব্যক্তিরা। এই দাসত্বের বন্ধনে থাকা ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্পার্টানদের মাধ্যমে পরাজিত হওয়ার অঞ্চলের অধিবাসী ছিল। স্পার্টানদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই বাইরের রাজ্যে আক্রমণ ও বাইরের রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করতে হতো। ধরা যাক, স্পার্টানরা প্রতিবেশী কোনো রাজ্যে আক্রমণ চালালো। এখন যদি তারা সেই রাজ্যের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে, তাহলে সেই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যও তাদের হাতে চলে আসবে। কারণ প্রাচীনকালে পরাজিত রাজার নিজ রাজ্য শাসন করার, নিজ রাজ্য থেকে কর নেয়ার অধিকার পরাজয় হওয়ার সাথে সাথেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। এজন্য স্পার্টানদের অনুগত দাসদের একটি বড় অংশ ছিল বাইরের রাজ্যের অধিবাসীরা। এছাড়াও স্পার্টা নগররাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী অধিবাসীদেরও মাঝে অনেককে দাসত্ব বরণ করতে হয়েছিল, যার কারণ নিয়ে ইতিহাসে খুব বেশি আলোচনা নেই।
এবার আসা যাক স্পার্টান নগররাষ্ট্রে ‘দ্য হেলোট’ নামে অভিহিত হওয়া দাসদের ভূমিকা নিয়ে। স্পার্টায় যেসব নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতো, অর্থাৎ স্পার্টিয়েটরা (Spartiate) মূলত একেবারে ছোট থেকেই নিজেদের দুধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলত, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। যেহেতু প্রাচীনকালে অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর, তাই স্পার্টার কৃষিজমিগুলোতে হেলোটদের বেগার খাটানো হতো। স্পার্টায় যত ফসল উৎপন্ন হতো, সবগুলো মূলত হেলোটদের মাধ্যমেই হতো। অর্থাৎ অভিজাত স্পার্টিয়েট ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ না করা পেরিওইকোইদের খাবারের জন্য হেলোটদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হতো। এছাড়াও স্পার্টানদের ঘরবাড়ি নির্মাণ, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ, যুদ্ধাস্ত্র মেরামত ও পরিষ্কার করা ও স্পার্টানদের খাবার তৈরির মতো কাজেও তাদের নিয়োজিত করা হতো।
এবার স্পার্টান দাস তথা হেলোটদের মালিকানার বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। দাস বলতেই মূলত স্বাধীনতাহীনতায় বসবাসরত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যার একজন মালিক থাকে। আমরা সাধারণত ব্যক্তিকেই দাসের মালিক হিসেবে দেখে, ইতিহাসের পাতায় পড়ে অভ্যস্ত। যেমন- একসময় আফ্রিকা থেকে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে ‘দাস’ হিসেবে ধরে আনা হতো, ইউরোপে তাদের একজন শ্বেতাঙ্গ মালিক থাকতো। স্পার্টান দাসদের ক্ষেত্রে এই ‘মালিক’ ছিল রাষ্ট্র। স্পার্টানরা ব্যক্তিগতভাবে কোনো দাস রাখতে পারতো না। রাষ্ট্রের নির্দেশনায় হেলোটরা স্পার্টার কৃষিজমিতে কাজ করত, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করত। যেহেতু স্পার্টানরা রাষ্ট্রের হয়ে নিজের সবটুকু নিংড়ে দিতো, তাই দাসদেরও মালিকানা রাষ্ট্রের হাতেই ছিলো।
স্পার্টানরা দাসদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে অত্যন্ত নির্মমপন্থা অবলম্বন করত। একসময় দেখা যায় প্রতি একজন স্পার্টান সৈন্যের তুলনায় সাতজন দাস নগররাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমানায় অবস্থান করছে। এত বেশি সংখ্যক দাস স্পার্টানদের জন্য ছিল রীতিমতো হুমকি, বিদ্রোহের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। এজন্য একসময় তাদের নির্বিচারে হত্যা করা শুরু করে স্পার্টানরা এবং এই হত্যার কারণে রাজা কিংবা সিনেট সদস্যদের কাছে কোনো জবাবদিহি করতে হতো না তাদের। স্পার্টানদের কিশোর, যারা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল, তারা কিংবা সদ্য সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করা যুবকদের ছুরি ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হতো হেলোটদের নির্বিচারে মেরে ফেলার জন্য, যাতে তারা ভবিষ্যতে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনোপ্রকার ভয় না পায় কিংবা আবেগতাড়িত হয়ে ছাড় না দেয়। এভাবে মেরে ফেলার সংস্কৃতির জন্য প্রত্যেক স্পার্টান দাসকেই সবসময় ভয়ে থাকতে হতো, কারণ স্পার্টানদের হত্যার কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি ছিল না।
স্পার্টানদের এরকম নির্মম হত্যাযজ্ঞের কারণে হেলোটরা বেশ কিছু বিদ্রোহ করেছিল, কিন্তু কোনোটিই শেষপর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি। বরং এসব বিদ্রোহের জন্য তাদের প্রতি স্পার্টানদের অবিশ্বাস আরও ঘনীভূত হয়, তাদেরও উপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। রোমানরা একসময় স্পার্টানদের পরাজিত করলে তারা স্পার্টান দাস থেকে রোমান দাসে পরিণত হয়।
স্পার্টানরা হেলোটদের উপর বেশ ভালো মাত্রায় নির্ভরশীল থাকলেও তাদের কখনও মানুষের স্বাভাবিক অধিকারগুলো প্রদান করেনি। দাসেরা কৃষিক্ষেত্রে কাজ করতো বলেই স্পার্টানরা নির্বিঘ্নে সামরিক দক্ষতা অর্জন করতে পারত, কোনো পরিশ্রম ও বিনিময় ছাড়াই হেলোটদের উৎপাদিত ফসল ভোগ করতে পারতো। স্পার্টান নগররাষ্ট্র হেলোটদের কখনও মানবিক মর্যাদা দেয়নি, বরং নির্দ্বিধায় গণহত্যা চালিয়েছে অনেকবার। দাসত্বের শৃঙ্খলে একবার আবদ্ধ হলে আর কখনও তা থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় ছিল না। স্পার্টান সামরিক বাহিনীর সেনাদের কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের হাল না ছাড়া মানসিকতা নিয়ে ইতিহাসে হাজার হাজার লাইন আলোচনা হলেও হেলোটরা সবসময় আড়ালেই রয়ে যায়।