হেনরি ‘বক্স’ ব্রাউন এমন একজন মানুষ ছিলেন যার জীবন থেকে সবকিছু হারিয়ে গিয়েছিলো। দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেয়া এই মানুষটি জীবনে যা কিছু পেয়েছিলেন, নিষ্ঠুর নিয়তি সেসব কিছুও এক এক করে কেড়ে নিয়েছিলো। তবে অনেক কিছু হারিয়েও এই ব্যক্তিটি তার নিজের স্বাধীনতা পাওয়ার পথও কিন্তু নিজেই বের করতে পেরেছিলেন! তাই আসুন আজ হেনরি ‘বক্স’ ব্রাউন সম্পর্কে জানা যাক।
জন্মেছিলেন ক্রীতদাস হয়ে
হেনরি ব্রাউন জন্মেছিলেন ভার্জিনিয়ার লুইজা কাউন্টিতে; ১৮১৫ সালে। জীবনের শুরুর দিকের বছরগুলো তিনি লুইজা কাউন্টির ১০ মাইল দূরের ইয়ানসিভিলের একটি আশ্রমে কাটান। তিনি সেখানে তার বাবা-মা, তার চার ভাই এবং তিন বোনের সাথে থাকতেন। তার মালিকের নাম ছিলো জন ব্যারেট। যিনি ছিলেন তৎকালীন রিচমন্ড, ভার্জিনিয়ার একজন সাবেক মেয়র। তবে ব্যবহারের দিক দিয়ে ব্যারেট অন্যান্য ক্রীতদাসের মালিকদের থেকে ছিলেন অন্যরকম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু প্রকৃতির।
ব্রাউন তার আত্মজীবনী ‘Narrative of the Life of Henry Box Brown‘-এ তার মালিক ব্যারেট সম্পর্কে নিজেই বলেছিলেন,
“আমাদের মালিক ছিলেন অসাধারণ দয়ালু এবং তার মর্যাদা এতটাই উচ্চ ছিলো যে আমরা তাকে ঈশ্বরের মতো করে দেখতাম। তিনি আমাদের অনেক কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানতেন, কিন্তু তিনি কখনোই আমাদের এসব ভ্রান্ত ধারণাকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। বরং তার প্রতি আমাদের এ ধরনের কিছু ধ্যানধারনায় তিনি বরং খুশিই হতেন।”
তো জন ব্যারেট একসময় বুড়ো হলেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি ব্রাউন এবং তার মাকে ডেকে পাঠালেন। তারা ভেবেছিলেন হয়তো তাদের মালিক এবার তাদেরকে মুক্ত করে দিবেন। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর তারা বিজয়ের আশায় ধুকপুক হৃদয়ে মালিকের কাছে গিয়ে হাজির হলেন।
তাদের স্বাধীনতা পাওয়ার এই আশার অন্যতম কারণ হচ্ছে বেশ কয়েক বছর আগেই ব্যারেটের এক পুত্র নিজের ৪০ জন দাসকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ভাগ্যে মুক্তি মেলেনি তখন। জন ব্যারেট তাদের ডেকে বলেছিলেন যে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্রাউন ও তার মাকে তিনি তার ছেলে উইলিয়াম ব্যারেটের অধীনে দিয়ে দিবেন এবং তারা অবশ্যই যেন উইলিয়ামকে তাদের নতুন মালিক হিসেবে মেনে চলে।
জন ব্যারেট তাদেরকে এ বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি উইলিয়ামের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন এবং উইলিয়াম বলেছে সে ব্রাউন পরিবারকে তার বাবার মতো করেই দয়া দেখাবে ও ভালো আচরণ করবে। জন ব্যারেট ব্রাউন পরিবারের সদস্যদের এভাবে তার চার পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যারেট এটা ভেবে দেখেননি যে তিনি আসলে এভাবে পুরো ব্রাউন পরিবারটিকেই ভেঙে ফেলছিলেন।
পরবর্তীতে ব্রাউনের মা এবং বোনকে উইলিয়ামের উত্তরাধিকারে দিয়ে দেওয়া হয় এবং ১৫ বছর বয়সে ব্রাউনকে রিচমন্ডের একটি তামাক কারখানায় কাজ করতে পাঠানো হয়। ব্রাউনের সেই বোন, মার্থা ব্রাউন পরবর্তীতে উইলিয়ামের মিস্ট্রেসে পরিণত হয়।
হেনরি ব্রাউনের পরবর্তী জীবন
বয়স যখন ২০ ছুঁইছুঁই, ব্রাউন তখন এক মেয়ের প্রেমে পড়েন। মেয়েটির নাম ছিলো ন্যান্সি। ন্যান্সি নিজেও একজন ক্রীতদাসী ছিলেন। পেশায় ব্যাংকের একজন করণিক মিস্টার লেই ছিলেন ন্যান্সির মালিক। ব্রাউন সময় বুঝে মিস্টার লেইয়ের কাছে গেলেন এবং ন্যান্সিকে বিয়ে করার অনুমতি চাইলেন। তিনি আরো একটি অনুরোধ করেছিলেন লেইয়ের কাছে যে তাকে এবং ন্যান্সিকে যাতে কখনো আলাদাভাবে বিক্রি করে দেওয়া না হয়। মিস্টার লেই ব্রাউনকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন যে তিনি কখনোই এ ধরনের হীন কাজ করবেন না।
আর এভাবে ১৮৩৬ সালে ব্রাউন এবং ন্যান্সির বিয়ে হয়ে যায়। তাদের তিনটি সন্তানও হয়ে যায়। আফ্রিকার প্রথম ব্যাপ্টিস্ট চার্চেও তারা অংশ নেন। হেনরি ব্রাউন এমনকি সেই চার্চের গায়কদলেও নাম লেখান। তিনি ইতোমধ্যে একজন দক্ষ তামাক কর্মী হিসেবে সুপরিচিত হয়ে যান এবং বেশ ভালোই টাকা আয় করতে থাকেন। যার ফলে রিচমন্ডে একটি নিজস্ব বাসা ভাড়াও নিয়ে নেন।
কিন্তু তার সেই সুখের সময়টি বেশি দিন টিকেনি। ১৮৪৮ সালের আগস্ট মাসে মিস্টার লেই তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন এবং ন্যান্সি ও তার তিন সন্তানকে নর্থ ক্যারিলোনার আরেকজন দাসমালিকের কাছে বিক্রি করে দেন। ব্রাউনকে প্রথমে এ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। তিনি যখন ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ব্রাউন নিজে এই ঘটনার ব্যাপারে বলেন,
“আমি আমার কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে ছিলাম যখন আমি জানতে পারলাম যে আমার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে তাদের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাদেরকে নিলামে তুলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে; এমনকি বন্দীশালায় কয়েদ করেও রাখা হয়েছে যেখান থেকে তারা উত্তর ক্যারিলোনায় তাদের নতুন মালিকের কাছে যাবে। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না সে মুহূর্তে আমার কতটা কষ্ট হচ্ছিলো!”
অন্তঃসত্ত্বা ন্যান্সি ও তার তিন সন্তানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ৩৫০ জন দাসের একটি দলে। যে দলটিকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিলো দাস কেনাবেচা সংগঠনের একজন উচ্চপদস্থ পরিচালকের কাছে। ফলে ব্রাউন আর কোনোদিন তার স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে পাননি। অনেক চেষ্টা করেও তাদের কোনো খবর পাননি।
ব্রাউনের দুঃসাহসী পলায়ন
বেশ কয়েক মাস নিজ পরিবার হারানোর ব্যথায় ব্যথিত থেকে ব্রাউন অবশেষে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি স্বাধীন হবেন। যে করেই হোক তিনি আর এই বন্দিদশায় থাকবেন না। চার্চে প্রার্থনারত অবস্থায় নিজের মুক্তি পাওয়ার এক উপায় তার মাথায় চলে আসে। ব্রাউন বলেন,
“হঠাৎ করেই চিন্তাটি আমার মাথায় চলে আসে, যে আমি নিজেকে একটা বাক্সে বন্দী করে ফেলবো এবং শুষ্ক খাবারের বাক্স হিসেবে নিজেকে কোনো স্বাধীন রাজ্যে বহন করে নিয়ে যাবো।”
চিন্তাটি মাথায় আসার সাথে সাথে তিনি সেখানকার একজন মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি ও তার চার্চের গায়কদলের একজনের কাছে সাহায্য চান। স্যামুয়েল স্মিথ নামের একজন শ্বেতাঙ্গ চর্মকার ব্যক্তিও তাকে সাহায্য করতে রাজি হয়। তবে স্মিথের নিজেরও অনেক ক্রীতদাস ছিলো। তাই হয়তো আপনারা ভেবে অবাক হতে পারেন যে, স্মিথ কেন ব্রাউনের এই পলায়নে সাহায্য করতে গেলো!
আসলে এখানে টাকার বিষয় জড়িত ছিলো। স্মিথকে তার সাহায্যের জন্য যথেষ্ট টাকা প্রদান করা হয়েছিলো। ফলে স্মিথ ব্রাউনের সাথে ফিলাডেলফিয়ার জেমস মিলার ম্যাককিম নামের একজন নেতার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন, যিনি পেনসিলভানিয়ার দাসবিরোধী সমাজের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সেই সাথে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড রেললাইন কর্মকান্ডের সাথেও জড়িত ছিলেন।
এরপর ব্রাউন একজন ছুতারমিস্ত্রীকে ভাড়া করলেন নিজের জন্য একটি বাক্স তৈরি করার কাজে। যে বাক্সটি ছিলো ৩ ফুট লম্বা, ২ ফুট প্রস্থে এবং ২.৮ ফুট গভীর। যার ভেতরটা মোটা উলের কাপড় দিয়ে মোড়ানো ছিলো। ব্রাউন যাতে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারেন সেজন্য বাক্সটিতে মাত্র একটি ছোট ছিদ্র তৈরি করা হয়েছিলো। ছিদ্রযুক্ত অংশটি যাতে উপরের দিকে থাকে, এজন্য সেখানে বড়বড় অক্ষরে লিখেও দেওয়া হয়েছিলো, “This Side Up With Care“। কারণ একবার বাক্সে ঢোকার পর ব্রাউনের আর কোনো উপায় থাকবে না পাশ বা স্থান বদলানোর।
১৮৪৯ সালের ২৩ মার্চ, হেনরি ব্রাউন তার নিজের তৈরি বাক্সে ঢুকে পড়েন পলায়নের উদ্দেশ্যে। বাক্সটি একে একে মালবাহী গাড়ি, রেলগাড়ি, বাষ্পচালিত নৌকা, আবার মালবাহী গাড়ি, রেলগাড়ি, ফেরী, রেলগাড়ি এবং সর্বশেষে একটি মালবাহী ডেলিভারি গাড়ির মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ শেষ করে। তবে প্রথমেই হেনরির বাক্সে ঢোকার মাত্র ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বাক্সটি উল্টে গিয়েছিলো। এতে করে ব্রাউনের মাথা নিচের দিকে আর পা উপরের দিকে থেকে যায়। এরপর থেকে বাক্সটি এক স্থান থেকে আরেকস্থানে চলে যাচ্ছিলো আর ধাক্কা খাচ্ছিলো। একসময় তো এমন অবস্থাও হয়েছিলো যে ব্রাউন মারাই যেতে লেগেছিলেন। তার সেই করুণ মুহূর্তের কথা স্মরণ করে ব্রাউন বলেছেন,
“মনে হচ্ছিলো আমার চোখ দুটি এতটাই ফুলে গিয়েছে যে সেগুলো তাদের কোটর থেকে ফেটে বের হয়ে আসবে। পুরো শরীরের রক্ত যেন মাথায় উঠে জমে গিয়েছিলো। সে অবস্থায় আমি চেষ্টা করলাম আমার হাতটি মুখের কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু হাতটি নড়ানোর মতো শক্তিও ছিলো না আমার শরীরে। অনুভব করছিলাম একটি ঠান্ডা স্রোত আমার দেহে এসে ভর করছে, যা হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছিলো আমার আসন্ন মৃত্যুর ব্যাপারে।”
বাক্সটির মধ্যে প্রায় ২৭ ঘন্টার বন্দীদশা কাটিয়ে হেনরি ব্রাউন ১৮৪৯ সালের ২৪ মার্চ তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেন। বাক্সটি যখন খোলা হয় তিনি চেষ্টা করেছিলেন উঠে দাঁড়ানোর, কিন্তু উল্টো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। যখন নিজের জ্ঞান ফিরে পেলেন এবং বুঝতে পারলেন এখন স্বাধীন তিনি, বলে উঠলেন,
“আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছিলাম, আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছিলাম ঈশ্বরের জন্য, আমার ঈশ্বরের জন্য; এবং তিনি আমার দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন, আমার প্রার্থনা শুনেছেন!”
একটি বাক্সে নিজেকে পুরে এভাবে স্বাধীনতা অর্জন করায় তাকে সবাই এখন হেনরি ‘বক্স’ ব্রাউন বলেই চেনে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: missedinhistory.com