মানব সভ্যতার উন্নয়নের শুরু থেকেই পৃথিবীতে ব্যবসা ও নানা রকম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্মলাভ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় নানা কোম্পানি। এসব ছোট বড় নানা রকমের, নানা ধরনের কোম্পানির মধ্যে কোনোটি টিকে থাকে বছরের পর বছর, কোনোটি আবার বন্ধ হয়ে যায় কয়েক বছরের মধ্যেই।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বেশিরভাগ কোম্পানি বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানই প্রায় ৪০-৫০ বছর পর বন্ধ হয়ে যায়। একটি কোম্পানি ঠিক কতদিন টিকে থাকবে তা স্থানীয় অর্থনীতির স্ফীতি, কোম্পানির সুনাম এবং ভোক্তার চাহিদার সাথে তাদের উপযোজন ক্ষমতার উপরেই নির্ভর করে।
তবে সব মিলিয়েই কিছু কিছু কোম্পানি টিকে থাকে কয়েক শত বছর পর্যন্ত। বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর দিয়ে খেয়াল করলে দেখা যায় এদের প্রায় সবগুলোই মানুষের মৌলিক চাহিদাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ এদের বেশিরভাগই খাদ্য, পানীয় কিংবা বাসস্থানভিত্তিক। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগই জাপানে অবস্থিত। এদের কোনো কোনোটি আবার হাজার বছরেরও পুরানো। এই কোম্পানিগুলো শত শত বছর ধরে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ সহ নানা ধ্বংসাত্মক সময় পেরিয়ে টিকে আছে আজও অবধি। চলুন আজকে জেনে নিই বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো এমনই কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে।
ম্যারিনেলি বেল ফাউন্ডারি
বয়স: ৯৭৮ বছর
প্রতিষ্ঠাকাল: ১০৪০ খ্রিস্টাব্দ
স্থান: ইতালি
ধরন: ঢালাই কারখানা
ফাউন্ডারি হলো এমন একটি কারখানা যারা ঢালাই ধাতু উৎপাদন করে। মানব ইতিহাসের বহুকাল ধরেই ধাতুর প্রয়োজন ও উৎপাদন চালু রয়েছে। ব্যবসা হিসাবে এটি খুব পুরানো না হলেও এই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি প্রায় এক হাজার বছরের কাছাকাছি সময় ধরে চলছে। শুধু তাই নয়, ইতালির বেশিরভাগ প্রাচীন গির্জায় আজ যে ঘন্টাগুলো দেখা যায় সেগুলো এই কোম্পানিরই তৈরি। বহুকাল পুরানো ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানেও চালু রয়েছে এবং পর্যটকরা চাইলেই জাদুঘরের মতো এটি ঘুরে দেখতে পারেন।
প্রতিষ্ঠানটির কিছু তথ্য:
* এটিই এখনো পর্যন্ত টিকে থাকা ও দীর্ঘকাল ধরে চালু থাকা সবচেয়ে প্রাচীন ঢালাই কারখানা।
* পর্যটকরা এখন চাইলেই এখান থেকে ৫০ ডলার খরচ করে তাদের নিজেদের জন্য পুঁচকে ঘন্টা কিনতে পারেন।
* প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো পর্যন্ত একই ধাতু ঢালাইয়ের পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে এরা।
* ইতালির ইতিহাসের প্রসিদ্ধ সব গির্জার বেশিরভাগ ঘন্টাই এরা নির্মাণ করেছে।
শুমিয়া শিনবাতসুগুতেন
বয়স: ৯৯৪ বছর
প্রতিষ্ঠাকাল: ১০২৪ খ্রিস্টাব্দ
স্থান: জাপান
ধরন: ধর্মীয় পণ্য নির্মাতা
প্রায় ১০০০ বছর ধরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য নানা রকম পণ্য প্রস্তুত করে আসছে এই প্রতিষ্ঠানটি। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে গৌতম বুদ্ধ জীবিত ছিলেন। সেই প্রাচীন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ব্যবহার্য নানা পোশাক ও অন্যান্য দ্রব্য তৈরির কাজ করে আসছে এরা। বর্তমানে যে কেউ বৌদ্ধ ধর্মীয় পোশাক, সাজসজ্জা কিংবা এধরনের কোনো ধর্মীয় পণ্য কিনতে চাইলে এখনো এই দোকানটিতে আসতে পারেন এবং প্রায় ১০০০ বছর আগের সন্ন্যাসীরা যেসব পণ্য কিনেছিলেন ঠিক তার মতোই পণ্য কিনতে পারেন এখান থেকে।
প্রতিষ্ঠানটির কিছু তথ্য:
* প্রায় ১০০০ বছর ধরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য পোশাক তৈরি করছে এরা।
* বৌদ্ধধর্মীয় পূজার বেদি, কুঠি ও অন্যান্য ধর্মীয় সাজসজ্জা তৈরি করে এরা।
* গৌতম বুদ্ধের আগমনের অনেকটাই কাছাকাছি সময়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
নাকামুরা শাজি
বয়স: ১,০৪৮ বছর
প্রতিষ্ঠাকাল: ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ
স্থান: জাপান
ধরন: ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান
১০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চালু থাকা এই ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি খুব প্রাচীন হলেও এটাই কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নয়। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীন ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তবে বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এটিই বর্তমানে টিকে থাকা ভবন নির্মাণ শিল্পের সবচেয়ে পুরানো প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানটির কিছু তথ্য:
* বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীন জাপানি ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এটি।
* কাঠের কাজে বিশেষ সুনাম রয়েছে এদের।
* বহু বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির ও শিন্তো মঠ তৈরি করেছে এরা।
রয়াল মিন্ট
বয়স: ১,১৩২ বছর
প্রতিষ্ঠাকাল: ৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ
স্থান: যুক্তরাজ্য
ধরন: টাঁকশাল
সরকার পরিচালিত যুক্তরাজ্যের এই প্রতিষ্ঠানটি ১০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টাকা তৈরি করে আসছে। বহু ব্রিটিশ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এই টাঁকশালের প্রধান কাজ হলো দেশের মুদ্রাব্যবস্থার জন্য ধাতব মুদ্রা তৈরি করা।
বর্তমানে পর্যটকরা জাদুঘর হিসেবে এখানে ঘুরে যেতে পারেন আর সেই সাথে দেখে নিতে পারেন কিভাবে বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তিত হয়ে ব্রিটিশ পাউন্ড বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এছাড়া কিভাবে বর্তমানে এখানে মুদ্রা তৈরি হয় সেটিও দেখা যাবে এখানে আসলে।
প্রতিষ্ঠানটির কিছু তথ্য:
* বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এটি।
* ১০০০ বছর ধরে নানা ভিন্ন ভিন্ন সদরদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে এটি।
* বর্তমানে এটি বছরে ৫ বিলিয়ন মুদ্রা তৈরি করে থাকে।
* মুদ্রার পাশাপাশি বিভিন্ন পুরষ্কারের জন্য মেডেলও তৈরি করে এরা।
স্টাফেল্টার হফ ওয়াইনারি
বয়স: ১,১৫৬ বছর
প্রতিষ্ঠাকাল: ৮৬২ খ্রিস্টাব্দ
স্থান: জার্মানি
ধরন: মদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান
আপনি যদি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন মদ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানটি দেখতে চান তবে আপনাকে যেতে হবে জার্মানির এই প্রতিষ্ঠানটিতে। বর্তমানে এটি গেস্ট হাউজ হিসাবেও চালু রয়েছে। ৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন এই স্থানটিতে একসময় রোমান সৈন্যরা মদ কিনতে আসতো।
শুধু রোমান সাম্রাজ্যের পতন নয়, এই প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পরও টিকে আছে এখনো পর্যন্ত।
প্রতিষ্ঠানটির কিছু তথ্য:
* বর্তমানে এটি গেস্ট হাউজ ও মদ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে একত্রে চালু রয়েছে।
* ৭ হেক্টরের বেশি জমিতে আঙ্গুরের চাষ করে এরা।
* একসময় প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের একটি অংশ ছিল এটি।
* হিটলারের থার্ড রাইখের উত্থানপতন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং জার্মান মিত্রবাহিনীর আক্রমণের পরও টিকে আছে এটি।
গেন্ডা শিগিও পেপার ইন্ডাস্ট্রিজ
বয়স: ১,২৪৭ বছর
প্রতিষ্ঠাকাল: ৭৭১ খ্রিস্টাব্দ
স্থান: জাপান
ধরন: কাগজ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান
কাগজের আবিষ্কার জাপানে না হলেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চালু থাকা কাগজ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান এটি। ১০০০ বছরের বেশি সময় ধরে অন্যান্য নানা প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে এখনো চালু রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির কিছু তথ্য:
* কাগজের পাশাপাশি বিয়ের মতো নানা অনুষ্ঠানের কার্ডও তৈরি হয় এখানে।
* বিশেষ নকশাযুক্ত কাগজ দিয়ে উপহারের মোড়কও তৈরি করে এরা।
কঙ্গো গুমি
বয়স: ১,৪২৮ বছর
প্রতিষ্ঠাকাল: ৫৭৮ খ্রিস্টাব্দ
স্থান: জাপান
ধরন: ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান
২০০৬ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই কোম্পানিটিই হলো বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে চালু থাকা ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও এটি। রোমান সাম্রাজ্য পতনের এক শতাব্দী পরেই জাপানে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। জাপানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বহু উত্থানপতনের পরও টিকে ছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। ১,৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী নির্মাণ পদ্ধতি ধরে রেখেছিল এরা। তবে এতো কিছুর পরও ২০০৬ সালে বড়সড় একটি দেনায় বন্ধ হয় যায় এই কোম্পানিটি।
প্রতিষ্ঠানটির কিছু তথ্য:
* রোমান সাম্রাজ্য পতনের ১০০ বছরের একটু বেশি সময় পর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
* ২০০৬ সালে বন্ধের পর এটি তাকামাতসু কন্সট্রাকশান গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়।
* ঐতিহাসিক ওসাকা দূর্গ এরাই নির্মাণ করেছিল।
ফিচার ইমেজ – bwbx.io