১৮৫৬ সাল। লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যার জেমস আউটরামের নির্দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় ফৌজ চলছে আউধ রাজ্যের রাজধানী লক্ষনৌ এর দিকে, উদ্দেশ্য নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের কাছ থেকে রাজ্যের দখল নেওয়া। অভিযোগ? খেলাধুলো আর সংস্কৃতিচর্চায় মনোনিবেশ করা নবাব তার রাজ্য ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছেন না! আউটরামের বিশাল বাহিনীকে থামানোর সামর্থ্য নেই নবাবের, বিনা যুদ্ধেই তার নওয়াবি হস্তান্তর করতে বাধ্য হলেন।
তবে এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর দিকে চোখ ফেরালেই বোঝা যাবে তাদের সামরিক বাহিনীর চিত্র। আউধ দখল করতে যে বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের খুব কম সৈন্যই খাস ব্রিটেন থেকে আসা, বাকিদের চেহারা একেবারে দেশীয়দের মতো। তবে ইউরোপীয়দের মতো উর্দি, ট্রাউজার, কোমরে ঝোলানো তলোয়ার, মাথার টুপি আর গোড়ালি-উঁচু বুট পরে তারা পরিণত হয়েছে ব্রিটিশদের আজ্ঞাবহ দাসে, যাদের ধর্ম ‘খালক-ই-খুদা, মুলক-ই-সরকার, হুকুম-ই-সাহেবান আলিশান’ অর্থাৎ, মানুষ খোদার, দেশ সরকারের এবং হুকুম হলো পরমপ্রতাব সাহেবদের।
মূলত ভারতের দেশীয় বাহিনীকে কাজে লাগিয়েই পলাশীর প্রান্তর থেকে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ কব্জা করে নিয়েছিল ব্রিটিশরা। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিপরীতে ব্রিটিশ উর্দি পরে যেসব সৈন্য দাঁড়িয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র ৭৫০ জন ছিলেন ধন-দৌলতের আশায় কালাপানি পার করে আসা ব্রিটিশ সৈন্যরা, আর বাকিরা ছিলেন এই ব্রিটিশদের কাছে অর্থের বিনিময়ে হাত পাতা তথাকথিত ‘চাকরিজীবী’ দেশীয় সেপাই। এই দুইয়ের সম্মিলনে আর মীর জাফর-উমিচাঁদদের সহযোগিতায় পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য হেলে পড়েছিল। কে ভাবতে পেরেছিল, আর কয়েক দশকের মধ্যেই বার্মার পূর্ব প্রান্ত থেকে আফগান মুল্লুক পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল পদানত হবে এই ব্রিটিশদের কাছে?
এই ইংরেজদের কৃতিত্ব ঠিক উন্নত প্রযুক্তি ছিল না, তাদের মূল কৃতিত্ব ছিল দেশীয় সেপাইদেরকে নিয়ে একটি ‘ভাড়াটে বাহিনী’ তৈরি করা, যারা ব্রিটিশদের সাথে নিমকহারামি করবে না। এক সিপাহী বিদ্রোহ ছাড়া ১৯০ বছরের ইতিহাসে আর কখনোই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের জন্য দেশীয়রা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়নি। বরং যে কয়বার অস্ত্র তুলেছে সেগুলো ছিল নিছকই ‘নিমক’-এর পরিমাণ বাড়ানোর জন্য, ইংরেজদেরকে প্রভু হিসেবে মেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে নয়। দেশীয়দের এই ইংরেজভক্তির পরিমাণ টের পাওয়া যায় শিখদের দিকে তাকালে, ১৮৪৮ সালে যে ইংরেজদের কাছে তারা স্বাধীনতা হারিয়েছিল, মাত্র ৯ বছর পরেই সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য তারা দলে দলে নাম লিখিয়েছিল ইংরেজ বাহিনীতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা ন্যূনতম উপলব্ধি না করেই।
সেপাই বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়েই ভবিষ্যতে যেন আর এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা-ই নতুন করে নিজেদের ভারতীয় ফৌজ ঢেলে সাজায় ব্রিটিশরা, প্রবর্তন করে নতুন কিছু নিয়ম-রীতি। আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত বলে মনে হলেও এই নিয়মগুলোই সিপাহী বিদ্রোহের মতো কোনো ঘটনার পুনর্জন্ম দেয়নি, বরং অগণিত দেশীয় সেপাইকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশরা তাদের সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়িয়ে নিয়েছে হংকং থেকে সুদূর আবিসিনিয়া, হিন্দুকুশ থেকে জাভাদ্বীপ পর্যন্ত। আর সিপাহীরা গেয়েছে, ‘কাভি সুখ আর কাভি দুখ, হাম ইংরাজকা নওকর’।
কোম্পানির সিপাহী দলের সূচনা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে প্রথম সেনাদল গঠিত হয় মূলত ইংরেজ কুঠি পাহারা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত দেশীয় দারোয়ানদেরকে নিয়ে। কোম্পানির সামরিক উদ্যোগ বাড়ার সাথে সাথে এই সিপাহী বাহিনীর আকারও বাড়তে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই কুটির দারোয়ানদেরকে নিয়ে এগুলো পরিণত হয় বিখ্যাত ৩ প্রেসিডেন্সি বাহিনীতে – বাংলা, মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের ৩টি প্রেসিডেন্সি বাহিনী। যোগাযোগের অসুবিধা থাকায় শুরুতে এই ৩ প্রেসিডেন্সি বাহিনী সম্পূর্ণ আলাদাভাবে পরিচালিত হতো। ১৭৪৮ সালে নামেমাত্র ৩টি বাহিনী একত্রিত হয় এবং ভারতীয় বাহিনী (Indian Army) নামধারণ করে, যার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন একজন কমান্ডার-ইন-চিফ। মেজর স্ট্রিংগার লরেন্স প্রথম কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে ইংরেজদের কোম্পানির সামরিক কার্যক্রমের হাল ধরেন।
১৭৫৬ সালে কর্নেল ক্লাইভ কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে ভারতবর্ষে পা রাখার পরই মূলত রাজনৈতিক কাজে এই বাহিনীকে কাজে লাগানোর পুরোদস্তুর পরিকল্পনা করা হয়। ক্লাইভের স্বপ্ন: ভারতবর্ষ হবে একটি রাজ্য এবং তার একমাত্র রাজা হবে ইংরেজ; মোগল, ফরাসি, ডাচ কিংবা পর্তুগিজ নয়। এই নীতি গৃহীত হবার পর ভারতবর্ষে ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য আর বাণিজ্য রইলো না, রাজনৈতিক ক্ষমতাই হয়ে উঠল প্রধান বিষয়।
পলাশীর আগে ক্লাইভ পুরো বাহিনীকে ঢেলে সাজান ইউরোপীয় মডেল অনুযায়ী। এর আগে সিপাহী দলগুলোকে নেতৃত্ব দিতো দেশীয় অফিসাররাই, কিন্তু ক্লাইভ এই প্রথা বদলে দেন। সমস্ত দেশীয় অফিসারকে সরিয়ে তাদের জায়গায় নিযুক্ত করেন ব্রিটিশ অফিসারদেরকে। পোশাক আর অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারেও পরিবর্তন আসে, দেশীয় সেপাইদের জন্যেও ইউরোপীয় ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করা হয়, হাতে তুলে দেওয়া হয় উন্নত ইউরোপিয়ান অস্ত্র।
প্রথমে অবশ্য এই ইংরেজ বাহিনী খুব বেশি সুগঠিত ছিল না। ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা ইংরেজ নাবিক তো রয়েছেই, এর সাথে যুক্ত হওয়া পলাতক শ্বেতাঙ্গ নাবিক, ভেঙে দেওয়া ফরাসি বাহিনীর সৈনিক, ইউরোপীয় ভ্যাগাবন্ড কিংবা যুদ্ধবন্দী, যাকেই পাওয়া যাচ্ছিল পল্টনে যুক্ত করে নেওয়া হচ্ছিল। মোট কথা, ভারতে যত ‘সাদা মাল’ জীবিকার প্রয়োজনে ঘুরছে, সবার জায়গা করে দেওয়া হলো ইংরেজ বাহিনীতে। মেজর ম্যাকমানের ভাষায়, ‘any white material in search of livelihood’।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য ভারতবর্ষে হাজির হওয়া প্রথম রাজকীয় বাহিনীর আগমন হয় ১৭৫৪ সালে- ৩৯ নং ইংরেজ পদাতিক (39th Regiment of Foot)। পলাশীর পর ভারতের রাজনৈতিক দখল নিয়ে ফরাসি, মারাঠা ও মহীশুর শক্তির পর নতুন শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটে ইংরেজদের। ১৭৯৩ সালে পন্ডিচেরীর পতনের সাথে সাথে ফরাসিদের ভারত সংযোগের অবসান হলে মহীশুরের দিকে চোখ ফেরায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মহীশুরে তখন রাজত্ব চালাচ্ছেন ‘দ্য টাইগার অফ মাইসোর’ হিসেবে পরিচিত টিপু সুলতান। রকেট আর্টিলারির অন্যতম পথপ্রদর্শক এই টিপু সুলতানকে পরাস্ত করতেই ৩ প্রেসিডেন্সির বাহিনীকে আবারো ঢেলে সাজানো হলো ১৭৯৫ সালে। ইউরোপিয়ান আর্টিলারি, ইউরোপিয়ান ইনফ্যান্ট্রি, নেটিভ ক্যাভালরি আর নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি, এভাবে বেঙ্গল, মাদ্রাজ ও বোম্বে, ৩টি বাহিনীকেই কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন, রেজিমেন্ট, ডিভিশন আকারে ভাগ করে ফেলা হয়।
এই বাহিনীর সেপাইরা মোটেই একজায়গার ছিল না। তখন মোঘল বাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। যারা বেশি পয়সা দিত, তাদের হয়েই ভাড়া খাটত এরা। ফলে এই পেশাদার বাহিনীকে সহজেই হাত করতে পেরেছে ইংরেজরা। এছাড়াও অজস্র ভাড়াটিয়া আরব, আফগান ও রোহিলা (পশতুভাষী উত্তর ভারতীয় জাতি) সৈনিকদের গ্রহণ করা হয়েছিল। স্থানীয় সমাজ থেকেও বেশ কিছু সৈনিক নেওয়া হতো, বিশেষ করে নিচু শ্রেণির হিন্দু, যারা আনন্দের সাথে অত্যাচারী উঁচু জাতের লোকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে দ্বিধা করতো না। কিছুকাল পর অবশ্য মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ে স্থানীয় লোকদেরকে নেওয়া হয়, যদিও বেঙ্গল বাহিনীতে কখনোই বাঙালিদের নেওয়া হয়নি।
ভারতীয় এই ফৌজকে ব্রিটিশরা মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করে। এর একটি হলো রেগুলার (নিয়মিত) বাহিনী, যেখানে মূলত পুরোপুরি ইউরোপীয় কায়দা অনুসরণ করা হতো। দলের ক্রমবিন্যাস একেবারে সেনাবাহিনীর মতো সাজানো হতো, অফিসার হিসেবে ব্রিটিশদেরকেই দায়িত্ব দেওয়া হতো। বীরত্ব কিংবা কৃতিত্বের জন্য দেশীয় সিপাইদের পদোন্নতির কোনো নিয়ম ছিল না, তাদের পদোন্নতি হতো কেবল বয়স অনুযায়ী। এজন্য বেশিরভাগ দেশীয় অফিসারদেরকে দেখা যেত কেবল চুল পাকা অবস্থাতেই। তবে লোকবলের অপ্রতুলতা ও অভিজ্ঞতার কারণে যুদ্ধের সময় বাধ্য হয়ে দেশীয়দের কাছেই কমিশনড অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হতো।
এই নিয়মিত বাহিনী ছাড়া বাকি সব কিছু ছিল ইরেগুলার (অনিয়মিত) বাহিনীর অধীনে। বিশেষ করে সিল্লাদাররা ছিল অনিয়মিত বাহিনীর মূল অংশ। সিল্লাদার মূলত একজন ফৌজী সর্দার, যিনি একদল সওয়ার বাহিনী পুষে রাখতেন এবং এজন্য ইংরেজরা তাকে খরচাস্বরুপ নিয়মিত বৃত্তি দিতেন। যুদ্ধের সময় ইংরেজদের ডাক আসলেই এই সিল্লাদাররা নিজেদের ঘোড়সওয়ার বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির হতেন ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য। যুদ্ধের জন্য এরা আরেকদফা অর্থ পেত। এই সওয়ারদের জন্যও ছিল আলাদা বিশেষ উর্দি। কুলীন সমাজ বা সম্পন্ন কৃষক পরিবারের সদস্যরাই এই সওয়ার বাহিনীতে যোগ দিতো।
সিপাহী বিদ্রোহের আগে ভারতীয় ফৌজকে ১৮২৪ সালে দ্বিতীয় দফা পুনর্গঠন করা হয়। আগের দলগুলোর সাথে নতুন করে যোগ হয় হর্স-আর্টিলারি বা ঘোড়-গোলন্দাজ ব্রিগেড, স্যাপার্স-মাইনার্স বা বেলদার বাহিনী এবং ইঞ্জিনিয়ার ও পাইওনিয়ার বাহিনী। ক্যাভালরি, ইনফ্যান্ট্রি আর আর্টিলারি বাহিনীও ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে, যুক্ত হয় অনেকগুলো রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়ন। ১৭৯৫ সালের বাহিনী ও ১৮২৪ সালের বাহিনীর তুলনা করলেই বোঝা যায় কত দ্রুত ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির ফৌজ জনবলে, অস্ত্রশস্ত্রে, পদ্ধতিতে বৃহদাকার হয়ে উঠছিল।
এগুলো ছাড়াও আরেকটি প্রথা কোম্পানি আমল থেকেই শুরু হয়। ইংরেজদের সাথে চুক্তিসূত্রে আবদ্ধ এবং ইংরেজদের আশ্রিত দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে কোম্পানি একটি নতুন ধরনের ফৌজী ব্যবস্থা করেন। লর্ড ওয়েলেসলি প্রথম এ প্রথার প্রবর্তন করেন। প্রথানুযায়ী, দেশীয় রাজ্যগুলো একটি ফৌজদল পরিচালনা করতো, যার ভরণপোষণের খরচ সেই রাজাকেই দিতে হতো, উপরন্তু দলটির অফিসারদের সবাই ছিল ইংরেজ। যেকোনো শক্তির বিরুদ্ধে কোম্পানি যুদ্ধ ঘোষণা করলে সেই রাজা তার পালিত দলকে যুদ্ধে পাঠাতে বাধ্য থাকত। মূলত এভাবেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে ইংরেজদের এক বণিক সংঘ ভারতের মানুষকে ভাড়াটিয়া বাহিনীতে পরিণত করে ১০০ বছরের মধ্যেই সমগ্র ভারতভূমি দখল করে নিল। এটি যেমন একদিকে ইংরেজদের জন্য বিস্ময় ও আনন্দের বিষয়, বিপরীতে ভারতবাসীর জন্য এটি ছিল বিস্ময় ও লজ্জার। ভারতবর্ষের কোম্পানির ইতিহাসকে তাই ভারতের রাজনৈতিক দৈন্যের ইতিহাস বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।
দ্বিতীয় পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: সিপাহী বিদ্রোহের পর (পর্ব-২)