অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতকে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন একজন প্রথমসারির সমাজ সংস্কারক। বাঙালি সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তার সময়ের থেকে চিন্তাধারায় অনেকাংশে এগিয়ে ছিলেন তিনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাংলার মানুষদের চিন্তা-ধারার পরিবর্তন আনতে না পারলে এই সমাজ পিছিয়ে থাকবে এবং কখনও উন্নতির দিকে এগোতে পারবে না। আর এরকমটি যদি চলতে থাকে তাহলে কখনোই ইংরেজদের দাস হয়ে থাকা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। সেজন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে গিয়েছেন।
শিক্ষায় বাঙালি সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি ইংরেজি ভাষাকে জনপ্রিয় করেছেন, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন, আধুনিক প্রযুক্তি ও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বাংলার সমাজে প্রবেশ করিয়েছেন। আগের একটি লেখায় রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবদান, শিক্ষায় তার অবদান ইত্যাদি নিয়ে কিছু আলোচনা করা হয়েছিলো। আজকের লেখায় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাকে শক্তিশালী করার জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আরও বিষদভাবে আলোচনা করা হবে।
বৈজ্ঞানিক মনোভাবাপন্ন সমাজ গঠন- এই চর্চা বর্তমান সময়ে অনেক বেশি দেখা যায়। কিন্তু রাজা রামমোহন রায়ের সময়ে এরকম চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটেনি। শিক্ষা বলতে তখন কেবল সংস্কৃত পড়ানো হতো। কিন্তু নিজের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে থাকার কারণে রামমোহন রায় সবসময় তার যেকোনো বক্তৃতা কিংবা লেখার মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা এবং মনোভাবের কথা উল্লেখ করতেন। তার ধারণা ছিলো, বাংলায় সংস্কৃত ছাড়াও বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনার সূত্রপাত ঘটালে (যেটা ইউরোপে তখন ব্যাপকহারে হচ্ছিলো) সমাজ এবং তরুণদের জন্য ফলপ্রসূ হবে। তিনি জানতেন যে, বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনার সূত্রপাত ঘটলেই মানুষ যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শিখবে এবং যুক্তি দিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। রাজা রামমোহন রায় নিজেও একজন যৌক্তিক চিন্তাধারার মানুষ এবং মুক্তচিন্তার অধিকারী ছিলেন।
তখনকার সময়ে সমাজে ধর্মীয় প্রথা এবং গোঁড়ামির বিশেষ প্রশ্রয় ছিল। ধর্মীয় সংস্কারের নামে অনেক অধর্মীয় কাজে মানুষ জড়িয়ে গিয়েছিলো, যেটা সমাজের মানুষের জন্য ছিল এক বিভীষিকার নাম। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা ছিল তা হচ্ছে সমাজের ভিতর শ্রেণীবিভাগ। জাতিগত বিদ্বেষ (Caste System) এত বেড়ে গিয়েছিলো যে নিম্নশ্রেণীর মানুষদের মানুষ বলেই গণ্য করা হতো না। সেজন্য রামমোহন রায়ের উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনার সূচনা করা। একমাত্র বিজ্ঞানই পারবে মানুষের চিন্তার পরিবর্তন ঘটাতে। রাজা রামমোহন রায়ের প্রত্যাশা ছিল, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার নিজ দেশের মানুষদের ভিতরও যেন পরিবর্তন হয় এবং নিজ দেশের ধর্মীয় গোঁড়ামিগুলো থেকে যে ভুল সিদ্ধান্ত সমাজে নেয়া হচ্ছে তার যেন একটা সুরাহা হয়। একমাত্র শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমেই তা সম্ভব হবে।
অনেক গবেষক এবং সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করেন যে, তিনি অতিরিক্ত ইংরেজদের ভক্ত ছিলেন। পূর্ববর্তী লেখাটিতে কথাটি যে পুরোপুরি ঠিক না সেটা ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। আজকে ব্যাখ্যা করা হবে ইংরেজদের কাছ থেকে তার সুযোগ নেয়ার ব্যাপারটি নিয়ে।
এটা মানতেই হবে যে, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের ইংরেজরা শোষণ করেছে। কিন্তু এর সাথে সাথে নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য তারা এই দেশে প্রযুক্তিরও আনয়ন করেছে। শিল্প-কারখানা, রাস্তাঘাট, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি এই দেশে তারাই আনে। যদিও ইংরেজদের ব্যাপারে রামমোহন রায়ের অবস্থান একটু ঝাপসা, কিন্তু ধারণা করা যায় যে তিনি ইংরেজদের এসব কাজের সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন, যাতে তার নিজের দেশের ভেতরের গাঠনিক উন্নতি হয়।
এই বক্তব্য থেকে এটা কোনোভাবেই মনে করা উচিত হবে না যে বাংলার মানুষ ইংরেজদের কাছে ঋণী। এরকম মনে করলে ভুল হবে। কারণ এই বাংলার মানুষদের পশুর মতো খাটিয়ে এবং তাদের হকের টাকা-পয়সা ইংরেজরা নিজেদের দেশে পাঠিয়েছে এবং বিনিয়োগ করেছে। তাই ইংরেজদের করে দেয়া প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলো কোনো দয়া নয়, বরং এই দেশের মানুষদের অধিকারই বলতে হয়। এই দেশের মানুষদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার টাকা কিন্তু ঠিকই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিলো, তা-ও প্রায় দু’শ বছর ধরে।
রায় এবং ঠাকুর পরিবারের সদস্য দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংরেজদের বাংলায় প্রযুক্তি আনার পক্ষে ছিলেন। যদি দেশের উন্নতি রক্ষা করতে হয়, দেশকে অর্থনীতিতে শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করতে হয়, তাহলে প্রযুক্তিনির্ভর দেশ হওয়া জরুরি। ইংরেজদের হাতে দেশ চলে যাওয়ার পরে সবদিক দিয়েই বাংলার এগিয়ে যাওয়া থেমে গিয়েছিলো। গ্রামবাংলায় বিভিন্ন কলকারখানা তৈরি হলে সেখানকার মানুষদের কর্মসংস্থানও হবে, আবার প্রযুক্তির সাথে সেখানকার মানুষের পরিচয়ও ঘটবে। এতে দক্ষ জনসমাজ তৈরি হবে। রায়ের এরকম চিন্তাধারা সত্যিই পরবর্তীতে বাংলার মানুষকে আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করেছিলো এবং সেই সময়ে সাপেক্ষে এই ধরনের চিন্তা নিয়ে চলা সত্যিই সাহস এবং দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে। যদিও রাজা রামমোহন রায় এবং ঠাকুর পরিবারের প্রভাবশালীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইংরেজরা এই দেশে যা-ই করুক না কেন তাদের স্বার্থ ব্রিটেনের উন্নতি সাধন এবং বাংলাকে একটি কলোনি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তবুও তারা এটাকে একটি সুযোগ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন যাতে পশ্চিমাদের প্রযুক্তি উন্নয়নের ছোঁয়া বাংলার মানুষেরাও যেন পায়। এমন নয় যে এমনি এমনি ইংরেজরা দয়া করে এই দেশে প্রযুক্তির আমদানি করেছে। শক্ত শক্ত কাজ করিয়ে, অধিকার আদায় করতে না দিয়ে, লুটপাট করে সবই নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছে তারা। কিন্তু এসবের মধ্যেও একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিলো যাদের মধ্যে অনেকেই পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝতে পারে। মন্দের ভালোর মধ্যে এটাকে তখনকার সমাজে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনই বলতে হবে।
বাংলার মানুষ যেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সেজন্য তিনি সংস্কৃত কলেজ তৈরির বিপক্ষে ছিলেন। তার মনে হয়েছিলো, শুধু সংস্কৃত নিয়ে পড়ালেখা করলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত বিষয়ে এদেশের মানুষ পিছিয়ে থাকবে। তিনি “আত্মীয় সভা” নামের একটি মুক্ত চিন্তার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন যা পরে গিয়ে হিন্দু কলেজ হয়। সেখানে বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় এবং ইংরেজি, বাংলা ইত্যাদি পড়ানো হতো। পরবর্তীতে এর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ হয়। ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যাবে, বাংলার কত বিখ্যাত মেধাবী শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়েছে।
রামমোহন রায় খ্রিস্টান মিশনারিদের তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরির জন্য বিখ্যাত, তা তৈরির পেছনে রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল। রামমোহন রায়ের মতে, খ্রিস্টান মিশনারিদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান থাকলে তারা সহজে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান এখানকার মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারবে।
আগে বলা হয়েছে যে, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি রামমোহন রায়ের আলাদা একটি দুর্বলতা এবং শ্রদ্ধা ছিল। তিনি প্রচুর ভ্রমণ করেছেন বিধায় উন্নত দেশ কীভাবে উন্নতি করে সেটা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন এবং নিজ দেশের অবস্থার সাথে তুলনা করতে পেরেছিলেন। উন্নত দেশগুলো পড়াশোনায় আরও বেশি মনোনিবেশ করেছে, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদিতে উৎকর্ষ সাধন করেছে বিধায় তারা উন্নতি করেছে। যদি এসব বিষয়ে চর্চা উন্নত দেশগুলোকে আরও উন্নত করতে পারে, তাহলে কেন সেগুলো বাংলার মানুষদের জন্য খাটবে না? অবশ্যই খাটবে।
অনেকেই তাকে নিয়ে সমালোচনা করলেও তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকার বদৌলতেই বাংলার মানুষের জীবনধারা, চিন্তাধারা ও লেখাপড়ার ধারায় গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিবর্তন এসেছিলো, যার ফলাফল আমরা এখন ভোগ করছি।
তথ্যসূত্র
[১] Jayant Narlikar (2003) The Scientific Edge, Penguin Books
[২] রাজর্ষি রামমোহন- জীবনী ও রচনা – অনিলচন্দ্র ঘোষ
[৩] Mandal, MM., & Behera, S.K. (2015). Raja Ram Mohan Roy as an EducationalReformer: An Evaluation, International Journal of Humanitiesand Social Science Studies, pp. 91-95.
ফিচার ইমেজ সোর্সঃ youtube.com