১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬ এর এক চমৎকার সকাল। স্টেইনার পরিবার তাদের ব্যক্তিগত বিমানে চেপে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে উড়াল দিয়েছে নেব্রাস্কায় তাদের বাড়ির উদ্দেশে। তাদের বসবাস নেব্রাস্কার লিঙ্কনে। ক্যালিফোর্নিয়া এসেছিলেন বিয়ের দাওয়াতে।তাদের এই পারিবারিক যাত্রায় তারা যাত্রী মোট ছয়জন; জেমস স্টেইনার, তার স্ত্রী চার্লিন এবং তাদের তিন ছেলে যথাক্রমে ক্রিস (১০), রিক (৮) র্যান্ডি (৭) এবং মেয়ে কিম (৩)। বিমানের পাইলট জেমস স্টেইনার নিজেই, যিনি পেশায় একজন ডাক্তার। তাদের এই ফিরতি যাত্রার পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে তারা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউ মেক্সিকোর ফার্মিংটনে এলেন। সেখানে বিমানের জ্বালানী নেওয়া এবং দুপুরের খাবার গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় যাত্রা বিরতি শেষে আবার উড়াল দিলেন।
আগে থেকেই ভেবে রাখা ছিল, ফার্মিংটন থেকে নেব্রাস্কায় আসার পথে উপর থেকে রকি পর্বতমালার সৌন্দর্য উপভোগ করে আসবেন। সে উদ্দেশ্যেই উত্তরপূর্ব দিকে চলতে থাকলেন। কিন্তু ক্যানসাসে আসার পর হঠাৎ খারাপ আবহাওয়ার কবলে পরলেন। মূলত সেখানে তখন প্রচণ্ড বাতাস সহ ধূলিঝড় চলছিল৷ যার কারণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সব ধরনের বিমান চলাচল স্থগিত করেছিল। এমতাবস্থায় জেমস স্টেইনার জরুরি অবতরনের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাসের কারণে বিমানের ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হচ্ছিল এবং চারপাশ ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছিল। কিছু সময় পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেল এবং বিমান ক্রমেই নিচে নামতে শুরু করল। অন্ধকার এবং ধূলো-কুয়াশায় পাইলট কিছুই দেখতে না পেয়ে দিক হারিয়ে ফেললেন। অন্ধকারে এভাবে কিছুক্ষণ চলার পরপরই বিমান ভূমিতে পতিত হল। সময় তখন সন্ধ্যা ৬:৩০।
দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পর স্টেইনার জ্ঞান ফিরে পেলেন। তিনি ডান চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না এবং মাথায় আঘাতের কারণে রক্ত ঝরছিল। বুকেও ব্যথা অনুভব করলেন। তারপর কোনোক্রমে কেবিন হতে বেড়িয়ে এসে বাকিদের খুঁজতে লাগলেন। অন্ধকারে ঠিকমতো দেখতেও পাচ্ছিলেন না। সামনের সিটে স্টেইনার তার স্ত্রীকে না পেয়ে অন্য সদস্যদের খুজতে লাগলেন এবং এমন সময় তিনি ক্রিস আর কিমকে দেখতে পান। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগে চার্লিন, কিমকে ক্রিসের কোলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সিটবেল্ট খুলেছিলেন, যার কারণে তিনি বিমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। স্টেইনার কিমকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বাকি সদস্যদের জন্য আবার ধ্বংসাবশেষের কাছে ফিরে গেলেন। ক্রিস তার বাবার কাজে সাহায্য করার জন্য লাগেজ খুঁজে বের করলো, যা ওই সময় অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল, কেননা তাপমাত্রা তখন মাইনাস ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস!
স্টেইনার এরপর রিক আর র্যান্ডিকে খুঁজে বের করে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বাকিদের খুঁজতে লাগলেন। এবার তিনি তার স্ত্রীকে কিছু দূরত্বে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তাপমাত্রা যেহেতু খুবই কম, তাই হাইপোথার্মিয়া থেকে বাঁচার জন্য সকল জীবিত সদস্যদের নিয়ে তিনি বিমানের কেবিনে আশ্রয় নেন। প্রত্যেকে ছিল মারাত্মকভাবে আহত। জেমস স্টেইনার যেহেতু ডাক্তার, তাই সেখানেই তার সন্তানদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে জামাকাপড় দিয়ে বেঁধে রক্তপাত বন্ধ করা, অজ্ঞানদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনা, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা- এরকম কিছু জীবন রক্ষাকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সময় তখন সন্ধ্যা ৭টা বেজে ১৫।
কয়েক ঘণ্টা কেবিনে অপেক্ষা করার পর আস্তে আস্তে কুয়াশা এবং মেঘ কেটে গেল এবং তিনি পশ্চিম দিক হতে গাড়ির শব্দ শুনতে পেলেন। সময় তখন রাত দু’টো। তিনি ক্রিসকে বাকিদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে সাহায্যের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়লেন। তিনি পশ্চিম দিকে শব্দের উৎসের দিকে হাঁটতে থাকেন এবং এভাবে এক কিলোমিটারের মতো হাঁটার পর একটি রাস্তায় এসে উপনীত হন। তারপর একটি গাড়ি থামিয়ে গাড়ির লোকদের নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন এবং তাদের সহায়তায় সেই গাড়িতে করে স্থানীয় হেবরন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
ছোট্ট শহর হেবরনে দু’জন ডাক্তার এবং দু’জন নার্সসহ এই একটিমাত্র হাসপাতাল। সেদিন সেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছিল তালাবদ্ধ। কোনো রোগী না থাকায় নার্স দু’জন তালা লাগিয়ে দেন। ঠিক এ সময়ে স্টেইনার তার সন্তানদের নিয়ে সেখানে পৌঁছান। হাসপাতাল তালাবদ্ধ দেখে স্থানীয়দের সহায়তায় ডাক্তার এবং নার্সদের জরুরি ভিত্তিতে খবর দেন। ডাক্তার এবং নার্স আসার পর তাদেরকে ক্যাজুয়াল্টি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রিক, কিম এবং র্যান্ডি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। ক্রিসের হাত-পা ভেঙে যায় এবং বাকি সবাই মাথায় খুবই গুরুতর আঘাত পায়। স্টেইনার অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, স্থানীয় ডাক্তার দু’জন আহতদের তেমন কোনো চিকিৎসা দিতে পারছেন না।
তারা এই আঘাতের কোনো কূল-কিনারা ই করতে পারছেন না! প্রথমত, এটি ছিল খুবই ছোট হাসপাতাল। গুরুতর আঘাত ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব জিনিস দরকার, তার কিছুই ছিল না। সেইসাথে ডাক্তার দু’জনের কারোরই এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই জেমস স্টেইনার সেখানে চিকিৎসার জন্য সময় অপচয় না করে তার সহকর্মী ব্রুস মিলারকে ফোন করেন এবং জরুরি সহায়তা চান। মিলার একটি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেন এবং সেখান থেকে স্টেইনার এবং তার সন্তানদের লিঙ্কন জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর সবাই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।
মোটামুটি এটি সেই ঘটনা, যে ঘটনায় বদলে যায় অনেক কিছুই। হেবরন হাসপাতালে ডাক্তার জেমস স্টেইনারের সেই অভিজ্ঞতা তার মনের অনেক চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। তিনি খেয়াল করলেন, গুরুতরভাবে আহত রোগীদের চিকিৎসায় দেশে পদ্ধতিগত কোনো সাধারণ ব্যবস্থা নেই। অনেক ডাক্তার, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ডাক্তাররা এ বিষয়ে তেমন অভিজ্ঞ নন। অথচ একজন গুরুতর আহত ব্যক্তিকে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার উপরই নির্ভর করে তার মহামূল্যবান জীবন।
তখনকার সময়ে আহত রোগীদের ব্যবস্থাপনার কোনো সাধারণ চিকিৎসা প্রোটোকল না থাকায় একেক জায়গায় একেকভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো। তাই এই বিষয়টি নিয়ে তিনি কাজ করতে চাইলেন, বদলে দিতে চাইলেন সিস্টেমকে। তিনি আহত রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটি সাধারণ গাইডলাইন প্রস্তুত করতে চাইলেন। তারই ফলস্বরূপ তিনি লিঙ্কনের সহকর্মীদের সহায়তায় আহত রোগীদের ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসার উপর একটি একটি প্রটোকল তৈরি করেন এবং এর মাধ্যমে তার অধীনে থাকা ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি তার এই প্রটোকলের নাম দেন অ্যাডভান্সড ট্রমা লাইফ সাপোর্ট বা সংক্ষেপে এটএলএস। ধীরে ধীরে এটি স্থানীয় ডাক্তারদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে আমেরিকান কলেজ অব সার্জনস প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একে জাতীয় গাইডলাইন হিসেবে ঘোষণা দেয়।
একজন আহত ব্যক্তির আঘাতের পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা সময়কে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলে। এ সময়ে প্রাপ্ত চিকিৎসার উপরই নির্ভর করে রোগীর জীবন। তাই এই সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে রক্ষা করা সম্ভব মহামূল্যবান জীবন। তাই এই কর্মসূচীর প্রধান লক্ষ্য ছিল ট্রমা রোগীদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ডাক্তারদের সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগত দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে রোগী মৃত্যুহার কমিয়ে আনা।
বিশ্বে প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন মানুষ বিভিন্নভাবে আহত হন। অনেক রোগী মারাও যান। কিন্তু এই প্রটোকল অনুসরণ করে চিকিৎসা করার ফলে মৃত্যুহার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে এই প্রটোকল অনুসরণ করা হয়। উন্নত দেশগুলোতে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ কোর্সে এটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে, দক্ষ হাতে আহত রোগীদের সঠিক পদ্ধতিগত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। ফলস্বরূপ বেঁচে যাচ্ছে বিশ্বের অগণিত মানুষ।
বাংলাদেশে আগে এটি মেনে চলা হতো না। তাই দেশে প্রথমবারের মতো ২০১৯ সালে বিশ্বের ৮৪ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এন্ড সার্জনস (বিসিপিএস) আমেরিকান কলেজ অব সার্জনসের সহায়তায় অ্যাডভান্সড এটিএলএস তৈরি করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোর্স। কেননা, আমাদের দেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন উপায়ে আহত হয়৷ তাই কোর্সটি সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার ও যুদ্ধাহত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য পদ্ধতিগত এবং সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদানে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
শেষকথা
শুধুমাত্র একজন মানুষের সদিচ্ছা একটি বহু বছর ধরে চলে আসা ভুল সিস্টেমকে কীভাবে বদলে দিতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ উপরোক্ত এই ঘটনা। আমাদের ছোট্ট একটি দেশ, রয়েছে হাজারো সমস্যা, হাজারো সীমাবদ্ধতা। আধুনিক এই প্রতিযোগিতামূলক যুগের তুলনায় আমাদের সিস্টেমগুলো বড়ই অনুপযুক্ত, সেকেলে। তাই সিস্টেমকে বদলে দিতে, সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা দূর করতে আমাদের দক্ষযজ্ঞের আয়োজন করতে হবে কিংবা বিশাল এক বিপ্লব ঘটাতে হবে, ব্যাপারটা মোটেও এরকম নয়। বরং একটি আধুনিক, উপযুক্ত এবং কল্যাণময় নতুন সিস্টেম প্রবর্তনের জন্য শুধুমাত্র আমাদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।
আপাতত সেই সদিচ্ছারই অপেক্ষায়।