নকশালবাদ নামটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি গ্রাম থেকে উদ্ভূত যা ষাটের দশকে স্থানীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে একটি উপজাতি কৃষক বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল। পরবর্তীতে এই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। শীঘ্রই উগ্রবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে নকশালবাড়ি নামটি মিশে যায়।
১৯৬৭ সালের গ্রীষ্মে, হিমালয়ের পাদদেশের এই ছোট্ট গ্রামটি কৃষকেরাই শিরোনাম করেছিল। নকশালবাড়ির কৃষকেরা মূলত চা বাগান এবং বড় বড় এস্টেটে কাজ করত। বহু শতাব্দী ধরে তারা ভূমি মালিকশ্রেণী এবং মহাজন দ্বারা শোষিত হয়ে আসছিল।
১৯৬৭ সালের ২৪ মার্চ, গ্রামের একজন অংশীদারি কৃষক, যাকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, তার জমি চাষ করার চেষ্টা করে। এ কারণে ভূমি মালিকশ্রেণী তার জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে নির্মমভাবে মারধর করে। এতে সে মারা যায়। জমিদারদের শোষণে ক্ষুব্ধ হয়ে সারা গ্রামের কৃষকেরা একত্রিত হয়ে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে। পরদিন সাঁওতাল একদল আদিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে একটি পুলিশ দলকে আক্রমণ করে যারা কৃষক হত্যার তদন্ত করতে এসেছিল। নকশালবাড়ির পুলিশ কনভয়ের উপর ধনুক ও তীর নিয়ে হামলায় একজন সাব-ইন্সপেক্টর নিহত হন।
অবশ্য ১৯৬৭ এর দু’বছর পূর্ব থেকেই, নকশালবাড়িতে বিদ্রোহের বীজ রোপন করছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-মার্কসবাদী (সিপিআই-এম) এর কর্মীরা, যা সিপিআই এর একটি বিভক্ত গোষ্ঠী। সিপিআই-এম এর অনুগতরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিল যে যখন শ্রমিক এবং কৃষকরা বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করবে তখনই প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব হবে। ২৫ মার্চ নকশালবাড়ির ঘটনার পরে তারা ভেবেছিল, সেই মুহুর্তটি এসে গেছে। সিপিআই-এম এর অন্যতম নেতা চারু মজুমদারের মতে, “সকল ক্লাসিক্যাল বার্তা নিয়ে দেশে একটি চমৎকার বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল।” ওই বছরেই তিনি অন্যতম দুই প্রধান কমরেড কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতালের সাথে নকশালবাড়িতে কৃষক বিদ্রোহ শুরু করেন। চারু মজুমদার ছিলেন প্রথমদিকের নকশাল নেতাদের অন্যতম অনুপ্রেরণা।
এদিকে চারু মজুমদার নিজে চীনের মাও সে তুংয়ের সাফল্য ও কর্মকৌশল দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। মাও ক্ষমতাসীন অভিজাতদের উৎখাত করে চীনের সাধারণ ও শোষিত জনগণকে সংগঠিত এবং নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। চারু মজুমদার পশ্চিম বাংলার প্রেক্ষাপটে মাও-এর মতবাদ প্রচার করেন। তিনি ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সাথে মানানসই কৌশল প্রণয়ন করেন। তার ঐতিহাসিক ‘আট নথি’ নকশাল মতাদর্শ উৎসাহিত করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক বিদ্রোহীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সেসব বড় জমিদারদের কাছ থেকে জমি ছিনিয়ে নেওয়া এবং কৃষক ও ভূমিহীন শ্রমিকদের মধ্যে তা বিতরণ করা। এরই প্রেক্ষিতে নক্সালবাদের জন্ম হয়।
নকশালবাড়ী বিদ্রোহের পরের দিনগুলোতে অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকাকুলামেও একই ধরনের বিদ্রোহ হয়। ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে শ্রীকাকুলামের বিদ্রোহ নকশালবাড়ী থেকে অনুপ্রাণিত বলে জানা যায়। কমিউনিস্টদের সাথে যুক্ত দুজন পুরুষ কোরান্না ও মঙ্গান্নাকে স্থানীয় জমিদাররা হত্যা করে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গ্রামের আদিবাসী জনগণ অস্ত্র নিয়ে জমিদারদের শস্য ও জমি লুট করে নিয়ে যায়।
১৯৬৮ সালে এই আন্দোলন আরও বেড়ে যায় যখন কৃষকদের একদল পুলিশ অফিসারদের আক্রমণ করার জন্য গেরিলা স্কোয়াডে নিজেদের সংগঠিত করে। নকশাল আন্দোলনের শিকড় জড়িয়ে ছিল তেলেঙ্গানা সংগ্রাম এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) সাথে। ১৯৪৮ সালের জুলাইয়ের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের ২,৫০০টি গ্রাম মিলে কৃষক আন্দোলনের অংশ হিসাবে ‘কম্যুন’ গঠন করা হয়, যা তেলেঙ্গানা সংগ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করে। বিখ্যাত অন্ধ্র থিসিসও এর একটি অংশ।
চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বিদ্রোহী ক্যাডাররা নকশালবাড়িতে কৃষক বিদ্রোহ এগিয়ে নিয়ে যান। তারা আদিবাসীদের সাহায্য করেন ভূ-মালিকদের প্রতি প্রতিশোধ নিয়ে জোর করে তাদের জমি দখল করতে। সিপিআই (এম) নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার গণজাগরণের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় এবং কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার এই অভিযানকে সমর্থন করে। এই ঘটনা সারা ভারত জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয় এবং নকশালবাদের উত্থান ঘটে।
যদিও এই বিদ্রোহ খুব দ্রুতই দমন করা হয়, তবু এটি বেশ কিছু কমিউনিস্ট-নেতৃত্বাধীন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে যা প্রাথমিকভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং পরবর্তীতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে এটি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের রূপ নেয়। এই আন্দোলন দ্রুত রাজ্য সরকারের ক্ষোভের মুখোমুখি হয় এবং পুলিশ নির্মমভাবে বিদ্রোহীদের দমন করতে শুরু করে। তা সত্ত্বেও, আগামী দশকগুলোতে নকশালবাড়ি বিদ্রোহ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। ভারতের জাতীয় ও রাজ্য সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে নকশাল গোষ্ঠীগুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং এদের অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী গেরিলা আক্রমণ মোকাবেলা এবং বিদ্রোহীদের তাদের অভয়ারণ্য থেকে বের করে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। যদিও এই অভিযানগুলোর সাফল্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
পাঁচ দশক পর ও এই আন্দোলন মূলত ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা এবং অন্ধ্র প্রদেশের কিছু অংশে চলমান রয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থার সময়ে এটি কঠোরভাবে মোকাবেলা করা হয়। পরবর্তী দশকগুলোতে, ভারতীয় পুলিশের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও, আন্দোলন টিকে থাকতে সক্ষম হয় পরিবর্তিত আকারে। ভারত সরকার নকশালবাদ ও মাওবাদকে বামপন্থী চরমপন্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পৃথক বিভাগ দ্বারা এটি মোকাবেলা করা হয়। ২০১০ এর এপ্রিলে ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াড়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় হামলা চালানো হয়, যেখানে ৭২ জন সিআরপিএফ এবং একজন পুলিশ জওয়ান নিহত হযন।
নকশালবাদী দলগুলো সাধারণত ভারতীয় সমাজের দরিদ্রতম এবং সামাজিকভাবে প্রান্তিক সদস্যদের, বিশেষ করে উপজাতি জনগোষ্ঠী এবং দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। কয়েক দশক ধরে এখনও তারা ভূ-স্বামী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মতো লক্ষ্যবস্তুদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। নকশালবাদী গোষ্ঠীগুলো পূর্ব ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যে, বিশেষ করে অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল এবং তাদের প্রভাব এই অঞ্চল ছাড়িয়ে আরও বিস্তৃত আকারে পুরো ভারতেই ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমান সময়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ষাটের দশকের শেষের দিকে এবং সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে নকশালবাড়ি বিদ্রোহ শহুরে তরুণ এবং গ্রামীণ জনগণের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়েছিল। পরের কয়েকমাসে, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র পর্যন্ত পুরো ওড়িশার কিছু অংশে বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে একই রকম বিদ্রোহ সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠল।
ইতিহাসবিদ সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে প্রথমবারের মতো এই আন্দোলন দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের দাবিকে এমনভাবে জোর দিয়েছিল যে তৎকালীন অত্যাচারী ভারতীয় রাজনৈতিক দৃশ্যে নাড়া দিয়েছে।” এই আন্দোলন শহুরে তরুণদের, বিশেষ করে দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যে প্রবলভাবে আন্দোলিত করেছে তা উল্লেখযোগ্য।
নকশাল বিদ্রোহের পর পরই ভারতের শহুরে তরুণরা, যাদের অনেকেই সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর অংশ, বিপ্লবে উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপ্রাণিত হয়। কলকাতা ও দিল্লির কলেজের দেয়ালে দেয়ালে নকশালবাড়ির পোস্টার টাঙানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। নকশালবাদে যোগদানের জন্য অনেক ছাত্র কলেজ পর্যন্ত ছেড়েছিল। চারু মজুমদার ছাত্রদের নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই বিপ্লব শুধুমাত্র গ্রামীণ জনগণের জন্য নয়, বরং যারা ‘শ্রেণী শত্রু’ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এই শ্রেণী শত্রুর তালিকায় পড়বে সরকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পুলিশ এবং আরো অনেকে। নকশালপন্থীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেয়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স নকশাল কার্যকলাপের জন্য অন্যতম ঘাটি হয়ে ওঠে।
নকশাল আন্দোলনের পেছনের কারণ হিসেবে অনেক পর্যবেক্ষক অসম্পূর্ণ কৃষি সংস্কারকে চিহ্নিত করেন। চরম দারিদ্র্য, ভূমিহীন চাষীদের শোষণ, যাদের অধিকাংশই দলিত ও উপজাতি সম্প্রদায়ের অংশ, এবং প্রশাসনের কর্তৃক সামাজিক ন্যায়বিচারের বঞ্চনা জনসাধারণ এবং বামপন্থী নেতাদের মধ্যে চরম অসন্তোষের জন্ম দেয়। স্বাধীনতার পরে সরকার কৃষি সংস্কারের অংশ হিসেবে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে। তবে কিছু দলের প্রতিবাদের কারণে জমি পুনঃবিতরণ করা সম্ভব হয়নি।
ইতোমধ্যে কৃষি উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যহত ছিল, যার ফলে খামারগুলো থেকে আরও ভাল আয় হচ্ছিল। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি এবং কৃষিতে উন্নততর পদ্ধতির সম্মিলিত প্রভাবের ফলে অনেক নব্য-ধনী কৃষক শ্রেণীর জন্ম হয়। কিন্তু তারা ভূমিহীন কৃষক ও মজুরদের সাথে তাদের লাভ ভাগ করে নিতে প্রস্তুত ছিল না। ফলে জমির মালিকরা দ্রুত সাফল্য লাভ করলেও ভূমিহীনদের খাদ্যের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হলো। বেশ কিছু কৃষিনির্ভর এলাকায় দারিদ্রের মাত্রা ৯৫ শতাংশের বেশি ছিল বলে জানা গেছে। অসন্তোষ বাড়তে থাকে। নকশালবাড়ি শুধুমাত্র আর্থ-সামাজিক ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
নকশালবাড়ি আন্দোলন বছরখানেকের মধ্যে অনেকটা স্তিমিত হয়ে এলেও অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পরও সেই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা এবং তাৎপর্য বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি। এটি স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসকে আমূলভাবে বদলে দিয়েছে। নকশাল আন্দোলের নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-গান-কবিতা লেখা হয়েছে। সমরেশ মজুদারের ‘উত্তরাধিকার’-এর চার প্রধান চরিত্র নকশালবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়। বুকার পুরষ্কারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-এর একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। মহেশ্বেতা দেবী তার ‘হাজার চুরাশির মা’ এই আন্দোলনের পটভূমিতেই লেখেন। পরে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ঝুম্পা লাহিড়ী, অনুরাগ মিশ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ আরো অনেকের লেখনীতে নকশাল আন্দোলন বারবার উঠে এসেছে।
আরো জানতে পড়ুন- নকশালবাড়ি আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ