অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে উনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে চলছিল দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলন। তারই জের ধরে পেনসিলভানিয়ার ক্রিস্টিয়ানা গ্রামে একদল আফ্রিকান-আমেরিকান এবং শ্বেতাঙ্গ মিলে মেরিল্যান্ডে এক দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে, যার পটভূমি ছিল ঐ শহরে লুকিয়ে থাকা পলায়নরত ক্রীতদাসের সন্ধান।
উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে মেরিল্যান্ড ছিল একটি দাসপ্রধান রাজ্য। ম্যাসন-ডিক্সন লাইন জুড়ে পেনসিলভানিয়া কেবল একটি স্বাধীন রাজ্যই ছিল না, বরং দাসবিরোধী আন্দোলনের সুতিকাগার হিসেবেও এর ব্যাপক পরিচিতি ছিল। দাসমুক্তি আন্দোলনের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজন কর্মী এবং কোয়াকার (প্রাথমিকভাবে খ্রিস্টধর্মের পক্ষে আন্দোলনকারী একটি সংগঠন, যারা পরবর্তীতে মানবাধিকার সংরক্ষণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে) পেনিসিলভেনিয়ায় সক্রিয় ছিলেন। কয়েক দশক ধরে তারা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে জোরদার প্রচারণা চালিয়ে যান এখান থেকেই।
পেনসিলভানিয়ার দক্ষিণাংশের ছোট কৃষিপ্রধান কমিউনিটিগুলোতে স্বাধীনতাকামী দাসদের স্বাগতম জানানো হয়। শুরুর দিকে পালাতে সফল হয়েছিল এমন কয়েকজন ক্রীতদাস স্বপ্রণোদিত হয়ে মেরিল্যান্ডে পালিয়ে আসা দাসদের সাহায্য করছিল। কিন্তু দাসপ্রথা চালিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠীর যে এমন পরিস্থিতি পছন্দ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। কাজেই তারা ঐ অঞ্চলের আফ্রিকান-আমেরিকানদের অপহরণ করে আনে এবং দক্ষিণের অন্য অংশে নিয়ে গিয়ে পুনরায় জোরপূর্বক দাস হিসেবে তাদের ব্যবহার করে। কাজেই দাসরাও একত্রিত হয়ে এই এলাকায় নতুন আসা লোকজনদের উপর নজরদারি শুরু করে, যাতে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ফন্দি এঁটে সফল হতে না পারে।
ক্রীতদাসদের সাথে মালিক পক্ষের এ জাতীয় সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের দ্বিতীয় দফা আইন পাস হওয়ার এক বছর পর থেকে। দক্ষিণের দেশগুলোতে যেসব ক্রীতদাস পালিয়ে গেছে, আবার নিজেদের বৈধ মালিকের কাছে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় কংগ্রেস। সঙ্গত কারণেই ক্রীতদাসদের পক্ষ থেকে শুরু হয় ঘোরতর বিরোধিতা। এই আইনের পক্ষপাতী এক ভূস্বামী এডওয়ার্ড গরসাক খুন ও কংগ্রেসের অন্য দুজন সদস্য গুরুতর আহত হয় এই দাঙ্গায়।
বহুল আলোচিত-সমালোচিত এই দাঙ্গার, যা মূলত ক্রিস্টিয়ানা রায়ট বা ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গা নামে ইতিহাসে উল্লেখিত, পরিণাম স্বরূপ ৩৭ জন আফ্রিকান-আমেরিকান এবং একজন শ্বেতাঙ্গকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ এনে দ্বিতীয় ক্রীতদাস আইনের আওতায় দীর্ঘমেয়াদি সাজা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে বেশিরভাগই অবশ্য নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করে বেকসুর খালাস পান।
১৭৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কংগ্রেসে পাস হয় পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের বিরুদ্ধে প্রথম দফা আইন। এ আইনে একদিকে যেমন অন্তর্ভুক্ত ছিল সকল রাজ্যে দাসপ্রথার উপর নিষেধাজ্ঞা, তেমনি সেখানে উল্লেখ করা ছিল প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে আসা দাসদের অবশ্যই স্ব স্ব রাজ্যে, মালিকের কাছে জোরপূর্বক ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে। আইনটি ছিল অনেকটা এরকম-
‘কোনো রাজ্যে কাউকে দিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করানো যাবে না। তবে যদি কেউ ইতোপূর্বে অন্য কোনো রাজ্যে দাসপ্রথার সাথে যুক্ত থাকে, তবে এই আইনের ক্ষমতাবলে তাকে পূর্বোক্ত রাজ্যে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। সেখানকার কোনো আইন তাকে দিয়ে জোরপূর্বক শারীরিক পরিশ্রম করাতে পারবে না। তবে স্ব স্ব মালিকের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের ক্রয়কৃত সম্পদ স্বরূপ আমানত হিসেবে পেশ করতে হবে।’
প্রাক্তন দাসকে ফিরে পেয়ে কেউ কাজে লাগানোর পরিবর্তে যত্ন সহকারে ঘরে বসিয়ে খাতিরদারি করবে না, এ কথা বলাই বাহুল্য। উত্তরাঞ্চলগুলোতে ইতোমধ্যে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে। ১৭৯৩ সালের এই আইনের নিরুত্তেজ দিকগুলোর প্রয়োগকারী হিসেবে তারা কৃতিত্বের দাবীদার। পলায়নরত ক্রীতদাসদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় এমন পাসকৃত আইনের বিরুদ্ধেও তারা প্রতিবাদ জানায় এবং আদালতে আপিল করে। বেশ কিছু উত্তরীয় রাজ্যে সরকারি কাজে দাসদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয় এবং পালিয়ে যাওয়া দাসদের ধরে এনে জেলে ঢুকিয়ে দেয়ার রীতি বন্ধ করা হয়।
পলায়নরত ক্রীতদাস বিরোধী প্রথম আইনের এহেন যথেচ্ছ অপব্যবহারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে দক্ষিণীয়রা। ১৮৫০ সালে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে যে ‘সমঝোতা চুক্তি’ হয়েছিল, তার বর্ধিত সংস্করণ হিসেবে পাস করা হয় পলায়নরত ক্রীতদাস বিরোধী দ্বিতীয় আইন। এই আইনে ফেরত পাঠানো দাসদেরকে অভিহিত করা হয় ‘ঘোরতর সাজার দাবীদার’ হিসেবে। কিন্তু নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য তারা আদালতে স্বপক্ষে সাফাই গাইতে পারবে, এমন একটি শর্তও ঐ আইনে জুড়ে দেয়া হয়। ১৮৫৭ সালে ম্যাসন-ডিক্সন লাইনের মামলাটিতে উভয়পক্ষ অর্থাৎ মালিকের পাশাপাশি তার ক্রীতদাসকেও কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়।
ইতোমধ্যে এই আইনের চোখকে ফাঁকি দিতে পলায়নরত বা পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা দাসরা মিলে গঠন করে একটি সংগঠন, যার নাম ‘আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড’। আফ্রিকান আমেরিকানদের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একদিকে যেমন দাসদের মুক্ত হওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হচ্ছিল, অপরদিকে যে দাসরা পালিয়ে যেতে চাচ্ছিল তারা কানাডার উত্তরাঞ্চলে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পেল।
১৮৫০ সালের পলায়নরত দাসবিরোধী আইনের পরে দক্ষিণাঞ্চলের দাস পাকড়াও বাহিনী বনাম উত্তরাঞ্চলের দাসপ্রথা বিলোপ বাহিনীর মধ্যে প্রকাশ্য সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। উত্তরীয়দের আদর্শ ছিল- এমন অমানবিক প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য প্রয়োজনে আইন ভাঙতে হলেও তারা পিছপা হবে না। এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে দুই অঞ্চলে বাকবিতণ্ডা থেকে শুরু করে সশস্ত্র প্রতিরোধও গড়ে ওঠে। মুক্ত রাজ্যে মুক্ত জীবনের দাবী, কোনো মানুষের উপর অন্য মানুষের মালিকানা না থাকার দাবী, সকল রাজ্যে প্রকৃত অর্থে জনগণের স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে উত্তরীয়রা। এই দাবীর মধ্যে শুরুর দিকের একটিকে বলা হয় ‘ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গা’।
১৮৫১ সালে পেনিসিলভেনিয়া রাজ্যের মেরিল্যান্ডে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড’ সংগঠনের দুটি শাখার সাথে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। মেরিল্যান্ড এবং এর আশেপাশের শহরগুলো থেকে অসংখ্য ক্রীতদাস ম্যাসন-ডিক্সন লাইন পার হয়ে নিজেদের পালানোর রাস্তা খুঁজে বের করছিল, কানাডা ছিল তাদের প্রথম পছন্দ। দাসপ্রথা বিরোধী কিছু সংস্থা তাদের মাঝে মাঝে সহায়তা করতো। ১৮৫০ সালের পর এই অবস্থার পরিবর্তন করতে দাসদের মালিকেরা বা তাদের প্রতিনিধিরা এসব অঞ্চলে বারংবার আসা-যাওয়া শুরু করে। তাদের হাতে অপহৃত হয় বেশ কয়েকজন পলাতক দাস, জোর করে তাদের আবারও নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণে।
১৮৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দাস আটক করার এক অভিযান ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গায় পরিণত হয়। জন বিয়ার্ড, থমাস উইলসন, আলেকজান্ডার স্কট আর এডওয়ার্ড থম্পসন (পেনিসিলভেনিয়ায় তারা এই নামেই পরিচিত ছিলেন) গরসাক পরিবারের দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি পেতে পালিয়ে যায় মেরিল্যান্ড থেকে। ল্যাঞ্চেস্টার কাউন্টিতে আশ্রয় নেয় তারা। পলায়নরত ক্রীতদাস বিরোধী প্রথম আইনের বিধান মেনে গরসাক পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য তাদের সাবেক ক্রীতদাসদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ১৮৫১ সালে মালিকপক্ষের প্রতিভূ এই পরিবারটির হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সংঘটিত হয় ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গা, যা পরবর্তীতে আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
এডওয়ার্ড গরসাক, বিত্তশালী এক ক্রীতদাস প্রতিপালক, দাস পাকড়াও কমিটির সদস্যদের নিয়ে ল্যাঞ্চেস্টার কাউন্টির দিকে অগ্রসর হয়। পথিমধ্যে বিশ্বস্ত সূত্র মারফত খবর আসে, দাসরা আশ্রয় নিয়েছে উইলিয়াম পার্কারের খামারে। উইলিয়াম পার্কার ছিলেন একজন ক্ষমতাবান স্বাধীন আফ্রিকান আমেরিকান দাস। তার সাথে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে ইউএস মার্শাল হেনরি ক্লাইন, অবৈধ ঐ গ্রেপ্তারি পরোয়ানার একটি বিহিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগে তারা সবাই। যে বিশ্বস্ত সূত্র তাদের এই খবর দিয়েছিল, পেশায় সে ছিল ভ্রাম্যমাণ ঘড়ি মেরামতকারী।
১১ সেপ্টেম্বর সকালে গরসাক আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখে বাঁশি বাজিয়ে ওঠে এলিজা, পার্কারের স্ত্রী। সে বাঁশির আওয়াজ শুনে মনে হবে এক সহানুভূতিশীল প্রতিবেশি অপর প্রতিবেশিকে জরুরীভাবে তলব করছে। সেই আওয়াজে একে একে হাজির হতে থাকে সশস্ত্র সাবেক দাসরূপী প্রতিবেশিরা, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ উভয়পক্ষের দাসবিরোধী মতাবলম্বীরা। পার্কারদের ফার্মে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হতে থাকে তারা, গোরসাক এবং তার দলের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সে যুদ্ধে গোরসাকদের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য নিহত হয়, আর তার পুত্র হয় আহত। ইউএস মার্শাল আর দাস শিকারীরা প্রাথমিক চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ওঠে।
ঘটনাটি সে সময়কার পত্রপত্রিকায় বেশ ফলাও করে ছাপা হয়। পালিয়ে যাওয়া দাসদের বিরুদ্ধে যে আইন প্রণয়ন করা হলো, তার যৌক্তিকতা নিয়ে নড়েচড়ে বসে বুদ্ধিজীবী মহল। কানাডার পথে এগিয়ে চলা দাসদের সহায়তায় সর্বাত্মক ভূমিকা রাখেন ফ্রেডরিক ডগলাস। তার মধ্যস্থতায় দাস পাকড়াও বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৮৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের বিশেষ সেই দিনটির সকালে ক্রিস্টিয়ানায় উপস্থিত জনগণের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাস্টনার হ্যানওয়ে নামক স্থানীয় এক শ্বেতাঙ্গকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে আটক করে প্রশাসন।
পুরো ঘটনাটি সাধারণ জনগণের কাছে কিছুটা গোলমেলে মনে হচ্ছিল। পত্রিকায় যখন একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হওয়া শুরু হলো, লোকমুখে বাতাসের বেগে খবর ছড়িয়ে পড়তে লাগল। দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে তৈরি হলো তীব্র প্রতিক্রিয়া। ক্ষুব্ধ জনতা প্রশাসনের উপর ফুঁসে উঠল। উত্তরাঞ্চলের গণমাধ্যম দাসদের সহায়তাকারীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো। এদিকে আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা দাসরা আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ের স্থানীয় নেটওয়ার্কে গা ঢাকা দেয়া শুরু করলো। প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করতে পুলিশ যখন হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, তখন পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় তাদের হাতে ছিল না।
ফিলাডেলফিয়ার নেভি ইয়ার্ডে দাসদের খুঁজতে ৪৫ জনের একটি দলকে পাঠানো হয়। ল্যাঞ্চেস্টার থেকে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ স্থানীয় অধিবাসীদের গ্রেপ্তার করে পেনসিলভানিয়ার জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফেডারেল সরকারের উপর প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে বলির পাঠা হিসেবে ফাঁসিয়ে দেয়া হয় কাস্টনার হ্যানওয়েকে। পালিয়ে যাওয়া দাসদের বিরুদ্ধে যে আইন প্রণয়ন করা হয়, সেই অনুযায়ী বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তাকে।
১৮৫১ সালের নভেম্বর মাসে হ্যানওয়েকে ফিলাডেলফিয়ার ট্রায়ালে পাঠায় ফেডারেল সরকার। তার পক্ষে ওকালতি করেন থ্যাডিউস স্টিভেনস নামক জাঁদরেল এক এটর্নি, কংগ্রেসে ল্যাঞ্চেস্টার শহরের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন তিনি। পলায়নরত দাসদের পক্ষ নিয়ে পেনসিলভানিয়ার আদালতে এর আগেও বহুবার লড়েছেন স্টিভেনস। তিনি নিজেও দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। সরকার পক্ষের আইনজীবীরা একে বিশ্বাসঘাতকতার মামলা বলে সাজিয়েছিল। বিবাদী পক্ষ জানায়, স্থানীয় এক কৃষকের পক্ষে ফেডারেল সরকারকে পরাস্ত করার এমন এক পরিকল্পনা সাজানোর দাবী এককথায় হাস্যকর নাটক ছাড়া আর কিছুই না।
থ্যাডিউস স্টিভেনসের এক সহ পরামর্শক উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধি প্রতিটি সমুদ্র বন্দরে উপস্থিত থাকে। ৩,০০০ মাইল এলাকা যারা টহল দিয়ে নিরাপদ দখলে রাখতে পারে, ভুট্টাক্ষেতে কাজ করা সামান্য এক কৃষক তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দাসদের কানাডায় পাঠিয়ে দেবে, এমন চিন্তাভাবনা করা নির্বুদ্ধিতারই সামিল। আর ফেডারেল সরকারের পতন ঘটানোর পরিকল্পনা তো সেখানে দুঃস্বপ্নই বলা চলে। থ্যাডিউস স্টিভেনসের মতো অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় উকিল হ্যানওয়েকে বাঁচানোর জন্য কী বলে তা দেখতে উৎসুক জনতার ভিড় জমে যায় আদালত প্রাঙ্গনে। কিন্তু সমালোচনার শিকার হওয়ার কথা বিবেচনা করে সেদিন আর কথা না বলার সিদ্ধান্ত নেন স্টিভেনস।
তবে পুরোটা সময় তার দলের উকিলদের নিয়ে দক্ষতার সাথে ছায়া হয়ে তিনি সঙ্গ দেন কাস্টনার হ্যানওয়েকে। তার আইনি প্যাঁচে পরাজিত হয়ে মাত্র ১৫ মিনিটের মাথায় বিচারকও দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হন, আসলেই এমন বিশ্বাসঘাতকতা করা হ্যানওয়ের ক্ষমতার বাইরে। এই ঘটনায় হ্যানওয়ে তো বেকসুর খালাস পানই, তার সাথে সেদিনকার ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে আটক করা সবাইকে আস্তে আস্তে মুক্তি দেয়া হয়। ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গা নিয়ে পরবর্তীতেও আর কোনো মামলা করা হয়নি। কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় প্রেসিডেন্ট মিলার্ড ফিলমোর ক্রিস্টিয়ানার এই ঘটনার প্রতি পরোক্ষ ইঙ্গিত করে বলেন, এরপর থেকে ফেডারেল সরকারের কাজে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু ঘটনাটি কর্তৃপক্ষ যেন অনেকটা স্বেচ্ছায় ভুলে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে পরে আর কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে চলে আসে উইলিয়াম পার্কারের কথা। মুক্তিকামী পালিয়ে যাওয়া দাসদের ইতিহাস বলতে গেলে এই নামটি চলে আসতে বাধ্য। ১৮২১ সালে জন্মগ্রহণ করা পার্কার নিজেও ছিলেন একজন ক্রীতদাস। মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে চলে আসেন পেনসিলভানিয়ায়, এখানকার ক্রিস্টিয়ানা গ্রামে নিজেকে দাসপ্রথা বিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত করেন তিনি। ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গায় দাসদের পক্ষ নিয়ে রাখা অনবদ্য ভূমিকা তাকে প্রবাদপুরুষে পরিণত করেছে। কৃষিকাজের পাশাপাশি আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড নামক সংগঠনটিরও তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৮৫০ সালের পলায়নরত দাসবিরোধী আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় সরকার।
গরসাকের মৃত্যুর পর পার্কার পালিয়ে আসেন। আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোডের পরিচয়ে নিউ ইয়র্কের রচেস্টারে গিয়ে দেখা করেন ফ্রেডরিক ডগলাসের সাথে। তার সহায়তায় নদী পার হয়ে কানাডার বাক্সটনে চলে যান পার্কার। বাক্সটনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে পড়ালেখা শেখেন তিনি, পরবর্তীতে ডগলাসের ‘নর্থ স্টার’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। নিজের এবং অপর কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে আজীবন করেছেন তিনি। তার নেতৃত্বে সেদিন ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গায় ক্রীতদাসের দল হয়েছিল বিজয়ী।
পার্কার ছাড়াও পালিয়ে আসা অন্যান্য দাসরা প্রশাসনের ভয়ে ক্রিস্টিয়ানা ছেড়ে আবারও পালিয়ে বেড়ায়, তারা ছুটে যায় কানাডার পথে। কেউ কেউ আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত আসে বলে জানা যায়। গৃহযুদ্ধের ঠিক ১০ বছর আগে সংঘটিত এ দাঙ্গা জনগণের মধ্যে প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তোলে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় গৃহযুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ সেনা হিসেবে এই পালিয়ে যাওয়া দাসদের অংশগ্রহণ থেকে। ১৮৬০ এর দশকে এসে কাস্টনার হ্যানওয়ের এটর্নি থ্যাডিউস স্টিভেনস দেশের অন্যতম ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। রেডিক্যাল রিপাবলিকান দলে যোগ দিয়ে ক্যাপিটল হিলের নেতা বনে যান তিনি।
এই দাঙ্গার বছর তিনেকের মধ্যে আবারও জাতীয় আলোচনায় উঠে আসে আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড এবং দাসপ্রথা বিলুপ্তির কথা। ফিলাডেলফিয়ায় ভিজিলেন্স কমিটির সহায়তায় পালিয়ে যায় জেন জনসন। মেয়েটি তার মালিক, নিকারাগুয়ার নব্য নির্বাচিত মন্ত্রী, কর্নেল জন হুইলারের কাছ থেকে পালিয়ে যায়।
আজকের দিনে ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গার কথা সেভাবে ঘটা করে স্মরণ করা না হলেও, ১৮৫০ এর দশকে এটি ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এই ঘটনার জের ধরে টনক নড়ে ফেডারেল সরকারের, পরাজয় মেনে নেয় বিচারব্যবস্থা, পরিবর্তন আসে আইনে। ’৫০ এর দশকের শেষভাগে শুরু হওয়া ‘রক্তাক্ত কানসাস’ সিরিজের প্রথম পর্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ‘ক্রিস্টিয়ানা দাঙ্গা’। এই দাঙ্গার জের ধরে ১৮৬১ সালে মার্কিন ফেডারেল সরকার ও দাসপ্রধান ১১টি প্রদেশের মাঝে সংঘটিত হয় গৃহযুদ্ধ।
রাষ্ট্রপতি জেফারসন ডেভিসের নেতৃত্বে নিজেদের মূল যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীন ঘোষণা করা এই ১১টি প্রদেশ নিজেদের নামকরণ করে ‘কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা’। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘ইউনিয়ন সরকার’ এবং মার্কিন রিপাবলিকান দল উভয়ই দাসপ্রথার ঘোর বিরোধী ছিল। ৪ বছর ব্যাপী চলমান এই যুদ্ধে স্পর্শকাতর ভূমিকা পালন করে দাসপ্রথা। পশ্চিমা বিশ্বের নানা অঙ্গরাজ্যে ধীরে ধীরে এই অমানবিক প্রথা ছড়িয়ে যেতে থাকলে সরকার নিজ উদ্যোগেই তা বন্ধ করার জন্য নানা ধরনের আইন জারি করে, যা দাসপ্রধান এলাকাগুলোর স্বার্থে আঘাত করে। কাজেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে তারা রাস্তায় নেমে আসে। বিদেশি কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই এই গৃহযুদ্ধে প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্য মারা যায় এবং দাসপ্রধান দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা ধ্বংসের মুখে পড়ে।
পরবর্তীতে কনফেডারেসির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, দাসপ্রথার বিলোপ ঘটে, গঠিত হয় জাতীয় ঐক্য এবং সদ্য স্বাধীন দাসদের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় সরকার ব্যবস্থা। ১৮৬০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আব্রাহাম লিঙ্কনের রিপাবলিকান পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোতে দাসপ্রথার বিরোধিতা করেন। তিনি জয়ী হলেও ১৮৬১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের আগেই ফেডারেশন সরকার তাঁতভিত্তিক অর্থনীতি চালু করে। ১৮৬২ সালে মেরিল্যান্ডে লিঙ্কন তার বিখ্যাত ‘ইমানসিপেশন প্রোক্লেমেশন’ বা ‘দাসমুক্তি ঘোষণা’ দেন এবং এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই মেরিল্যান্ডের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়।