ভারত-পাকিস্তানের যত সংঘাত

দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে দেশ দুটো অসংখ্যবার নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এ সংঘাতের প্রায় প্রতিটির কেন্দ্রে রয়েছে কাশ্মির। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ দুটোর মাঝে যে সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করছে তার কেন্দ্রস্থলও কাশ্মির। পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় দেশ দুটির মধ্যকার সংঘাত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলে বরাবরই বাড়তি আশংকার সৃষ্টি করে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়বার ও কী কী বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়েছে তা একনজরে দেখে নেয়া যাক।

১৯৪৭ সালের যুদ্ধ

ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক মাসের মাথায় ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ভারত-পাকিস্তানের মাঝামাঝি অবস্থিত জম্মু ও কাশ্মিরের আধিপত্য নিয়ে আগে থেকেই দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা ছিলো। ব্রিটিশরা যাবার সময় জম্মু-কাশ্মিরকে ভারত-পাকিস্তান যেকোনো দেশের অধীনে যাবার অধিকার দিলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু-কাশ্মিরের হিন্দু মহারাজা হারি সিং ভারতের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।

এর প্রেক্ষিতে স্থানীয় মুসলিম গোত্রগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় জম্মু-কাশ্মিরের কিছু অংশে আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে হারি সিং ভারতে পালিয়ে যান ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তা চান। সংঘাত চলাকালে ভারত জাতিসংঘের কাছে মধ্যস্থতার আবেদন জানায়। জাতিসংঘ উভয় দেশকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিতে বলে জম্মু-কাশ্মিরের মাঝে নিয়ন্ত্রণ সীমারেখা (Line of Control) টেনে দেয়। তবে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিলেও জম্মু-কাশ্মিরের দুই-তৃতীয়াংশ ভারত ও এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তান নিজের দখলে রাখে। নিয়ন্ত্রণ সীমারেখার দু’পাশে ভারত ও পাকিস্তানের সে সংঘাত আজও চলছে।

ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির; Image Source: Deutsche Welle

১৯৬৫ সালের যুদ্ধ

এপ্রিল ও নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভারত-পাকিস্তান আবারো কাশ্মির সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সৃষ্টিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিকল্পনার জবাবে ভারত পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ণমাত্রায় সেনা আক্রমণ চালায়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর আর কোথাও এর চেয়ে বড় বড় সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। ৭ দিন ব্যাপী চলা এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের হাজার হাজার সদস্য আহত ও অসংখ্য নিহত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ২২ সেপ্টেম্বর দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

১৯৭১ সালের যুদ্ধ

আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ আরেক দিক দিয়ে ছিল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধও। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ রাষ্টের জন্ম দেয়া এ যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তানসহ বহির্বিশ্বের কাছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নামেই বেশি পরিচিত।

ভারতের নাটক-সিনেমাগুলোতে হরহামেশাই ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বরকে ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে ভিজেয় দিওয়াস বা “বিজয় দিবস” হিসেবে পালন করে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটসসিআইএর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এ পর্যন্ত যতগুলো যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে সে তালিকায় ১৯৭১ সালের যুদ্ধও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন মার্কিন গোপন নথি থেকে দেখা যায়, যুদ্ধকালীন পুরো সময় (এপ্রিল ৬, মে ২৬, জুলাই ১৫, নভেম্বর ১৫, ডিসেম্বর ১৫, ডিসেম্বর ১৬) মার্কিন প্রশাসন এই যুদ্ধকে “ভারত-পাকিস্তান সিচুয়েশান” হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছে।

বিমান হামলার ভয়ে ১৯৭১ এর যুদ্ধ চলাকালীন তাজমহলকে ডাল-পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। Image Source: Younews.

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবিক দিক থেকে তৎকালীন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) এর বিরোধ ছিলো দীর্ঘদিনের। এ বিরোধ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লিগ ১৬০ আসনে বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩৯.২%) অর্জন করে। পক্ষান্তরে, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল পিপিপি বিজয়ী হয় ৭১টি আসনে (১৮.৬%)। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান প্রশাসন আওয়ামী লিগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। চলমান বৈষম্যের মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লিগকে ক্ষমতাবঞ্চিত করায় পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব আরো জোরদার হয়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লিগ দলীয় প্রধান শেখ মুজিবর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইঙ্গিত দেন। ৩ সপ্তাহ পর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান জনগণের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। আকস্মিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করে। পেছনে থেকে পুরো যুদ্ধপ্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকলেও ভারত সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি। ৩ ডিসেম্বর ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ১১টি বিমানঘাঁটিতে পশ্চিম পাকিস্তান বিমানবাহিনী হামলা চালানোর পর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করে। তার তিনদিন পর, ৬ ডিসেম্বর, ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে। জবাবে পশ্চিম পাকিস্তান ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে বিমান হামলা চালালেও পূর্ব পাকিস্তানে মূলত নৌপথে প্রবেশ করে;
Image Source: India Defence Forum

অন্যদিকে, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত যুদ্ধ জোরদার করতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে ১৫ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ও ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে, তবে পশ্চিম ভারত সীমান্তে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেয়। ঘোষণার একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর পশ্চিম সীমান্তেও পশ্চিম পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

১৯৯৯ সালের যুদ্ধ

“কার্গিল যুদ্ধ” নামে পরিচিত এ যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তানের আগের যুদ্ধগুলোর মতো রক্তক্ষয়ী ছিলো না। যুদ্ধের সূত্রপাত্র কাশ্মির সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যদের অবস্থান হারানোকে কেন্দ্র করে। শীতকালে কাশ্মিরের তীব্র আবহাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ রেখার উভয় পাশে ভারত-পাকিস্তানের সেনাসদস্যরা সাধারণত তাদের সামরিক চৌকি ত্যাগ করে। কিন্তু শীতকাল শেষে ভারতীয় সেনারা ফিরে এসে দেখে তাদের চৌকিগুলো পাকিস্তানপন্থী কাশ্মিরী গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে। জবাবে ভারত কাশ্মির সীমান্তে বড় ধরনের সামরিক হামলা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে ২ মাসের মাথায় এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

শীতকালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের সেনা চৌকি; Image Source: India Today

উপরে উল্লেখিত প্রধান সংঘাতের বাইরে ভারতের অভ্যন্তরে বা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে থাকে। এমন কিছু হামলা হচ্ছে-

  • ২০০১ সালের অক্টোবরে শ্রীনগরে কাশ্মীর বিধানসভায় এক হামলায় ৩৮ জন নিহত হয়।

  • সে বছরের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে ভারতের সংসদ ভবনে সশস্ত্র হামলায় ১৪ জন নিহত হয়।

  • ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলাচলকারী সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেনে বোমা হামলায় ৬৮ জন নিহত হয়।

  • ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন, বিলাসবহুল একটি হোটেল এবং একটি ইহুদি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে প্রায় ৬০ ঘণ্টা ধরে চলা জঙ্গি হামলায় নিহত হয় ১৬৬ জন। ঐ হামলার ব্যাপারে ভারত পাকিস্তানী গ্রুপ লস্কর-ই-তৈয়বাকে নির্দিষ্টভাবে দায়ী করে থাকে।

মুম্বাইয়ে অবস্থিত হোটেল তাজে সন্ত্রাসী হামলার দৃশ্য। Image Source: The Indian Express.
  • ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে পাঠানকোটে ভারতের বিমান ঘাঁটিতে চারদিন ধরে চলা হামলায় ৭ জন ভারতীয় সেনা ও ৬ জঙ্গি নিহত হয়।

  • ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের উরি সেনাঘাটিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হয় ১৯ সেনা সদস্য। জবাবে ভারত পাকিস্তানের কাশ্মিরের জঙ্গিদের ওপর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়। তবে এরকম কোনো হামলার কথা পাকিস্তান নাকচ করে দেয়।

  • ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মিরের পুলওয়ামায় ভারতীয় সামরিক কনভয়ে আত্মঘাতী হামলায় ৩৪ জন সেনাসদস্য নিহত হয়। পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জৈশ-এ মোহাম্মদ এই হামলার দায় স্বীকার করে। সে সময় সৌদি আরবের বাদশাহর পাকিস্তান ও ভারত সফর থাকায় ভারত কিছুটা কালক্ষেপণ করে ২ সপ্তাহ পর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কাশ্মীরে বিমান হামলা চালায়। জবাবে পাকিস্তান ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে গোলাবর্ষণ করে।

ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে এ পর্যন্ত যতগুলো সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় সবগুলোই ঘটেছে কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কাশ্মিরকে নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের এ সংঘাত চলবে আরো অনেকদিন।

This Bangla article is about the wars between India & Pakistan in the recent times. Necessary references have been hyperlinked.

Featured image: Deccan Chronicle

Related Articles

Exit mobile version