যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। গুপ্তচরবৃত্তি যেমন একটি রাষ্ট্রকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে নিতে পারে, তেমনি রাষ্ট্রকে ধসিয়েও দিতে পারে। রাষ্ট্রের সুশাসন, প্রতিরক্ষা, এমনকি আভ্যন্তরীণ কাঠামো সচল রাখার জন্যেও গুপ্তচরবৃত্তির গুরুত্ব রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই গুপ্তবৃত্তির প্রচলন ছিল। চীন, মেসোপটেমিয়া, মিশরসহ বিভিন্ন সভ্যতায় প্রাচীন গুপ্তচরবৃত্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। সিন্ধু উপত্যকাও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন গুপ্তচরবৃত্তির নিদর্শন পাওয়া যায় বৈদিক যুগে।
যেমন: সীতার সতীত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষের মনোভাব জানতে রাম দুর্মুখ নামে এক চর নিযুক্ত করেন। তবে প্রাচীন ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী গুপ্তচরবৃত্তির নিদর্শন পাওয়া যায় মৌর্য আমলে, রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে। আর তা পরিচালিত হতো ইতিহাস বিখ্যাত কূটনীতিবিদ, অর্থবিদ চাণক্যের দ্বারা। শোনা যায়, তার গুপ্ত বাহিনী এত চৌকস ছিল যে, শক্তিশালী চীনা সম্রাটদের পর্যন্ত ভীত করে তুলত। চাণক্যের পৃষ্ঠপোষকতায় সেসময় প্রথমবারের মতো গুপ্তচরেরা রাজসভার সদস্য বলে পরিগণিত হয়। তাদের পদ অনুযায়ী পারিশ্রমিকও দেওয়া হতো। চাণক্য গুপ্তচর হিসেবে সাধারণত দরিদ্র, বুদ্ধিমান নরনারীদের নিযুক্ত করতেন। তাদের বিভিন্ন সাংকেতিক, ইশারায় কাজ হাসিল করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
তখনকার গুপ্তচরেরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল। শত্রুর হাজারও প্রলোভনেও নিজের বাহিনীর প্রতি আনুগত্য বজায় থাকত তাদের। তারা সাধারণত নাপিত, কৃষিজীবী, গায়ক, নর্তকী কিংবা বারবণিতার ছদ্মবেশে থাকত। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিভিন্ন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এই গুপ্তচরদের কয়েকটি দলে ভাগ করা হতো। যেমন: কপটিক, উদাস্থিত, গৃহপতিক, তাপস, সত্রী, তীক্ষ্ণ, রসদ ও পরিব্রাজিকা। ভিন্ন ভিন্ন দলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও কাজ ছিল।
কপটিক
সহজেই মানুষের মন বুঝতে পারে, এমন শ্রেণির চরদের এ দলে অন্তর্ভুক্ত করা হত। তারা সাধারণত রাজ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপর নজর রাখত।
উদস্থিত
এই শ্রেণিতে সাধারণত সচ্চরিত্র বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈন ধর্মযাজকদের নিয়োগ করা হতো। এদের কাজ ছিল, সাধুবেশে রাজ্যের জমিদারদের অর্থ-সম্পদের উপর নজর রাখা।
গৃহপতিক
তারা সাধারণত দরিদ্র ও পেশায় কৃষিজীবী। কথায় আছে, নাপিত আর চাষীদের নাকি কোনো খবর অজানা থাকে না। এ সুযোগ নিয়েই তাদেরকে অন্যান্য সাধারণ চাষীর সাথে মিলিয়ে দিত। এভাবে তারা চাষীদের কাছ থেকে সমাজের বিভিন্ন গুপ্ত, কানাঘুষা খবর সংগ্রহ করে রাজাকে অবহিত করত। দরিদ্র ব্যবসায়ীরাও এ ধরনের চর হিসেবে নিযুক্ত হতো।
তাপস
এ পদেও সাধুরাই নিয়োগ পেত। তবে তাদের কাজ ছিল একটু অন্যরকম, রাজার সাথে সাধারণ মানুষের জনসংযোগ। তারা সাধু হিসেবে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। সাধু হিসেবে সাধারণ মানুষ তাদের দর্শনলাভ করতে এলে রাজা ও সভাসদতা তাদের মনোভাব জেনে নিতেন। বিদ্রোহীদের সম্পর্কে রাজা ও মন্ত্রীকে (চাণক্য) অবহিত করা হতো। বিদ্রোহ দমনের জন্য ও রাজার প্রতি অনুগত করার জন্য রাজার পক্ষ হতে তাদেরকে উপঢৌকন পাঠানো হতো। এরপরও যারা বশে আসত না, তাদেরকে গুপ্তহত্যার প্রস্তুতি নিত ‘রসদ’ শ্রেণির চরেরা।
সত্রী
সত্রী শ্রেণির চর হিসেবে সাধারণত নৃত্যশিল্পী কিংবা বারবণিতারা নিযুক্ত হতো। তারা বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তির মজলিশে উপস্থিত থেকে তাদের উপর নজর রাখত।
তীক্ষ্ণ
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এরা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মালিক হতে পারে। তবে শুধু বুদ্ধিমানই নয়, এ শ্রেণির চরেরা প্রচণ্ড সাহসী। কাজের জন্য যেকোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত তারা।
রসদ:
এরা ছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতির। ‘তাপস’ শ্রেণির গুপ্তচরদের শনাক্তকৃত ব্যক্তিদের বিষপ্রয়োগে হত্যা করার দায়িত্ব ছিল তাদের কাজের অংশ। এছাড়া বিভিন্ন গুপ্তহত্যায়ও তারা অংশ নিত।
পরিব্রাজিকা
এদের কাজ অনেকটা ‘সত্রী’ শ্রেণির চরদের মতো। তবে তারা বিশেষত মজুদকারী কৃপণ স্বভাবের লোকেদের শনাক্ত করত, যারা পণ্যবাজারে শস্যসংকটের সাথে যুক্ত ছিল।
এভাবেই চাণক্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের আনাচে কানাচে তার গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখে রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেন। চার ধরনের বিক্ষুব্ধ জনতা চাণক্যের গুপ্তচরদের লক্ষ্যবস্তু হতো- ক্রুদ্ধবর্গ, ভীতবর্গ, লুব্ধবর্গ ও মানীবর্গ।
ক্রুদ্ধবর্গ
যেসব ব্যক্তি রাজা ও তার সৈন্য-সভাসদদের কুনজরে পড়ে অকারণে বঞ্চনার শিকার হতো। অর্থাৎ রাজার প্রতি যাদের রাগের কারণ থাকত, তাদেরকে রাজার পক্ষ থেকে উপঢৌকন পাঠিয়ে বশে আনা হতো।
ভীতবর্গ
এসব ব্যক্তি সাধারণত অসৎ কাজের জন্য অপমানিত ও শাস্তির শিকার হয়েছিল। তাদেরকেও রাজা উপঢৌকন পাঠিয়ে নিজের বশে আনতেন।
লুব্ধবর্গ
খাজনা দিতে না পেরে দরিদ্র, আসক্ত, নেশাগ্রস্ত, নারীগ্রস্ত মানুষেরা সাধারণত এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এদের রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন নিচু পর্যায়ের কাজ, যেমন: ঝাড়ুদার, ধোপা, শ্রমিক, সেবাদাতা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো।
মানীবর্গ
উচ্চাভিলাষী, ধনী, জমিদাররা এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এদেরকে রাজা-মন্ত্রী স্বয়ং উপহার দিতেন এবং ছোট ছোট বিষয়ের (তৎকালীন কয়েকটা গ্রাম মিলে হতো একটি বিষয়) ক্ষমতা দিতেন। তাতেও যদি তারা সন্তুষ্ট না হতো, তাহলে তাদের গুপ্তহত্যার শিকার হতে হতো।
বিশ্বাসঘাতক বা শত্রুর হাতে ধরা পড়া গুপ্তচরদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো। মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত করার নজির রয়েছে। গুপ্তচরদের দুর্নীতি ধরতে চাণক্য একটা চাল চালতেন। কোনো খবর সংগ্রহ করার জন্য তিনি একাধিক চর প্রেরণ করতেন। চররা থাকত একে অপরের অচেনা। এরপর প্রেরিত সব চরের খবর একই রকম হলে সেটি নিষ্কলুষ ও খাঁটি সংবাদ বলে ধরে নিতো। আর যার খবর ভিন্ন বা ভুল হতো, তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো।
নারায়ণ বন্দোপাধ্যায় ‘মৌর্যযুগের ভারতীয় সমাজ’ বইয়ের তথ্যমতে, মগধের নন্দবংশের রাজাদের কাছ থেকে চন্দ্রগুপ্তের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও চাণক্যের গুপ্তচরদের ভূমিকা ছিল। এরপর গুপ্ত সাম্রাজ্য ক্রমেই বিস্তার লাভ করতে থাকে। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আর চাণক্যের বুদ্ধিমত্তায় তখনকার সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছিল গুপ্ত সাম্রাজ্য। চাণক্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ বই থেকে জানা যায়, সে সময়ই গুপ্ত সাম্রাজ্য স্বাধীন ও একক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এ রাজত্বের সমৃদ্ধির পেছনে তাই চাণক্যের কূটকৌশল এবং গুপ্তচরদের অবদান অনস্বীকার্য।