রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে আরোহণ করলেন রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড। রাজসিংহাসনে বসার ঘন্টাখানেকের মাথায় রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড বরখাস্ত করলেন রানীর অতি ঘনিষ্ঠ এক কর্মচারীকে। ঐ ব্যক্তি রানীর শিক্ষকও ছিলেন। রানী এবং ঐ ব্যক্তির মধ্যকার সকল প্রকার চিঠিপত্র এবং কাগজ পুড়িয়ে ফেলারও আদেশ জারি করেন সপ্তম এডওয়ার্ড। তাৎক্ষণিকভাবে ভারতে ফেরত পাঠালেন সেই ব্যক্তিটিকে। ভারতীয় মুসলিম এই ব্যক্তিটিই ছিলেন রানীর উর্দু ভাষার শিক্ষক এবং রানীর ভারত বিষয়ক সচিব। রানী ভিক্টোরিয়ার জীবনের শেষ ১৫ বছরের অন্যতম কাছের সহকারীও ছিলেন এই ব্যক্তি। ভিক্টোরিয়ার ৮০ তম জন্মদিন উপলক্ষে রানী তাকে ‘কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার (CVO)’ নামক সম্মানেও ভূষিত করেছিলেন। কিন্তু সিংহাসনে বসেই কেন রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড দৃশ্যমান কোনো অপরাধ ছাড়াই বরখাস্ত করলেন তার মায়ের খুব কাছের এই মানুষটিকে?
রাজপরিবারে ভারতীয় কেন?
রানী ভিক্টোরিয়া ভারতীয়দের ব্যাপারে অনেক বেশি কৌতূহলী ছিলেন। তাই রানীর সিংহাসনে বসার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ভারত থেকে দুজন কর্মচারী আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেই মোতাবেক ‘মোহাম্মদ বকস’ আর ‘মোহাম্মদ আবদুল করিম’ নামের এই দুজন ভারতীয়কে ব্রিটেনে নিয়ে আসা হয়। তারা দুজন নিয়োগ পান রাজপরিবারের ‘খিদমতগার’ বা ‘রাজকীয় খাদ্য পরিবেশক’ হিসাবে। রানী ভিক্টোরিয়ার নোটবুক থেকে জানা যায়, তার সাথে ভারতবর্ষ থেকে আসা দুই কর্মচারীর সাথে তার প্রথম দেখা হয় ১৮৮৭ সালের ৩ জুন উইন্ডসর দুর্গে। এই দুই রাজ কর্মচারীর সাথে প্রথম দেখার কথা রানী তার দিনলিপিতে এভাবে লিখে রেখেছেন–
“The one Mohammed Buksh, very dark with a very smiling expression… and the other, much younger, called Abdul Karim, is much lighter, tall and with a fine, serious countenance. They both kissed my feet.”
খিদমতগার থেকে রানীর শিক্ষক
একদিন খাবার টেবিলে পরিবেশনকৃত একটি খাবার বেশ ভালো লাগে ভিক্টোরিয়ার। তিনি জানতে চান কে রান্না করেছে এই খাবার। ভারতীয় খিদমতগার মোহাম্মদ আবদুল করিম রেঁধেছিলেন সেটি। ২৪ বছর বয়সী সুঠাম ভারতীয় তরুণ করিমকে পুনরায় দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন রানী ভিক্টোরিয়া।
করিমকে নির্দেশ দেন ভালোভাবে ইংরেজি ভাষা শিখে নেয়ার জন্য। তরুণ করিম ইংরেজি ভাষা দ্রুত শিখে নেয়ার ফলে রানীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায়ই তার কথা হতো। মাত্র এক বছরের মাথায় রানীর এতোটাই কাছের লোক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন যে, খিদমতগারের কাজ তার ভালো লাগছে না শুনে রানী তাকে নিজের উর্দু ভাষার শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। ১৮৮৮ সালের আগস্ট মাসে আব্দুল করিমকে ‘মুন্সী’ উপাধি দিয়ে রানী তাকে নিজের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত করেন। অন্যদিকে ‘মোহাম্মদ বকশ’ ১৮৯৯ সালে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন উইন্ডসর ক্যাসেলের খিদমতগার হিসেবে।
কে এই আব্দুল করিম?
মুহাম্মদ আবদুল করিমের জন্ম ১৮৬৩ সালে ভারতবর্ষের ঝাঁসিতে। ব্রিটেনে আসার আগে তিনি নিযুক্ত ছিলেন আগ্রা জেলের কেরানই হিসেবে। জেলের পরিদর্শক জন টাইলারের সাথে আব্দুল করিমের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। রানী ভিক্টোরিয়ার ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে আরোহণের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ভারতবর্ষ থেকে ২ জন কর্মচারীকে নিয়োগ দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই দুজনকে বাছাই করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেল পরিদর্শক জন টাইলারকে। জন টাইলার বাছাই করেন আব্দুল করিম আর মোহাম্মদ বকশকে।
রানীর সেবক হওয়ার জন্যে প্রেরণ করার পূর্বে তাদের অল্পবিস্তর ইংরেজি ভাষা আর রাজপরিবারের চালচলন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়।
রাজপরিবারের রোষানলে আব্দুল করিম
ব্রিটিশ রাজপরিবারে ভারতীয়দের যে খুব উচ্চ সমাদর করা হয় না, সে ব্যাপারটি কারোই অজানা ছিলোনা। কিন্তু রানী বরাবরই তার নতুন দুই ভারতীয় কর্মচারীর ব্যাপারে কৌতূহলী ছিলেন। আব্দুল করিম দ্রুত ইংরেজি ভাষা শিখে নেয়ায় তার সাথে রানীর যোগাযোগও অনেক বেড়ে যায়। ভারতীয় তরকারি রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতি থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের সামগ্রিক রাজনীতির খবরাখবর আব্দুল করিমের কাছ থেকেই নিতেন রানী। এভাবেই খুব দ্রুত রানীর অন্তরঙ্গ সহকারী হয়ে ওঠেন তিনি।
কিন্তু আব্দুল করিম তার খিদমতগারের কাজ নিয়ে বড়ই অসন্তুষ্ট ছিলেন। রানীর কাছে তিনি ভারত ফিরে যাবার আবেদন করলে, তিনি তাকে থেকে যাবার আদেশ করেন। খিদমতগারের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে ‘মুন্সি’ উপাধি দিয়ে রানীর ভারতীয় ভাষার শিক্ষক হিসাবেও নিযুক্ত করেন। রানীর মৃত্যুর পরে আব্দুল করিমের কাছে থাকা তার সকল চিঠি জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
তবে আব্দুল করিমের দিনলিপিটি রাজপরিবারের রোষানল বাঁচিয়ে তার সাথে ভারতবর্ষে ফেরত এসেছিলো। আর সেখানে থাকা রানীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতেই আব্দুল করিমকে ব্রিটেনে তার শিক্ষক হিসেবে থেকে যাবার অনুরোধ করা হয়-
“I shall be very sorry to part with you for I like and respect you, but I hope you will remain till the end of this year or the beginning of the next that I may be able to learn enough Hindustani from you to speak a little.”
‘কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার’ উপাধি
রানীর সফরগুলোতেও সঙ্গী হিসেবে থাকতেন আব্দুল করিম। রানীর নির্দেশেই বালমোরাল ক্যাসেলের পাশে তার জন্য নির্মাণ করা হয় ‘করিম কটেজ’। সুসজ্জিত কটেজেই আব্দুল করিম সপরিবারে বসবাস করতেন। পাশাপাশি রানীর বিশেষ আদেশে তাকে ভারত বিষয়ক সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই ভারত সংক্রান্ত রাজসিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রানী ভিক্টোরিয়া তার পরামর্শ চাইতেন।
আব্দুল করিমকে সচিব নিয়োগ দেয়াকে কেন্দ্র করে রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে চাপা অসন্তোষও ছিলো। সাধারণ এক ভারতীয় খিদমতগার থেকে রানীর পরামর্শক হয়ে উঠায় রাজপরিবারে অনেকের চক্ষুশুলে পরিণত হয়েছিলেন আব্দুল করিম। রাজপরিবারের অনেকের মতামত উপেক্ষা করে ১৮৯৯ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মুন্সি আব্দুল করিমকে রাণী ‘Commander of the Order (CVO)‘ উপাধিতে ভূষিত করেন।
কমান্ডারদের সম্মানের অবস্থান মূলত নাইট উপাধিধারীদের পরেই। ‘কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার’ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার ফলে আব্দুল করিম রানীর দেয়া তলোয়ার বহন করার অনুমতি পেয়েছিলেন। সেই সাথে রাজদরবার এবং প্রাসাদে রানীর স্বাক্ষরিত অনুমতিপত্র ছাড়াও দেখা করার অনুমতি লাভ করেন।
রানী কি বুঝতে পেরেছিলেন?
রানীও আব্দুল করিমের উপর রাজপরিবারের সদস্যদের চাপা ক্ষোভের স্বরূপ অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাই তার ধারণা ছিলো তার মৃত্যুর পরেই হয়তো আব্দুল করিমকে তার কটেজ থেকে বিতাড়িত করে ভারতে ফেরত পাঠানো হতে পারে।
তাই তার জীবদ্দশাতেই ভারতে আব্দুল করিমের জন্যে জায়গা বরাদ্দ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি রাণীর আদেশ ছিলো আব্দুল করিম যদি ব্রিটেন থেকে ভারতে ফিরে যান, তাহলে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ভাইসরয় তাকে প্রতিবছর ৬০০ রুপি হারে ভাতা দিতে বাধ্য থাকবে।
ফিরতে হলো ভারতেই
রাণীর মৃত্যুর পরপরেই রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড তাৎক্ষণিকভাবে মুন্সি আব্দুল করিমকে ভারত ফিরে যাবার আদেশ দিলেন। তার সব কাগজপত্র আর চিঠি জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো। ভারতে ফিরে আসার পরেও তাকে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা চোখে চোখে রেখেছে।
তাই চিঠিগুলোতে কী ছিলো বা রানী ভিক্টোরিয়ার সাথে মুন্সি আব্দুল করিমের সম্পর্কের গোপন দিকগুলো নিয়ে জানাজানি হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে দেন সপ্তম এডওয়ার্ড। তাই রানী ভিক্টোরিয়ার সাথে মুন্সি আব্দুল করিমের সম্পর্ক হয়তো চিরদিনই রয়ে যাবে কুয়াশার আঁধারে।
শেষ নিঃশ্বাস
ভারতে ফিরে এসে আগ্রায় রানীর দেয়া জমিতেই ‘করিম লজ’ নামের বাড়ি তৈরি করেন আব্দুল করিম। ব্রিটেন থেকে ফেরার ৮ বছর পরে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান রানী অন্যতম কাছের সহকারী। তবে রাজচক্ষু ফাঁকি দিয়ে আব্দুল করিম তার যে দিনলিপিটি ভারতে নিয়ে এসেছিলেন সেটির তথ্য বিশ্লেষণ করে শ্রাবণী বসু নামে এক সাংবাদিক লিখেছেন ‘Victoria & Abdul: The True Story of the Queen’s Closest Confidant’ নামের একটি বই।
এই বইয়ের উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে ‘Victoria and Abdul’ নামের একটি চলচ্চিত্র, যেটি ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মুক্তি লাভের অপেক্ষায় আছে ।