আঠারো শতকের একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে লন্ডন তথা ব্রিটেনে কোনো প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনীর দেখা মেলেনি। এরপর ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনস্টারে জন্ম হয়েছিল বিশ্বের প্রাচীনতম মেট্রোপলিটন পুলিশ বাহিনী- ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’এর। এ নামটিই ব্রিটেনের মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যবস্থার একরকম সমার্থক হয়ে গেছে। আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসকে কে না চেনে! কল্পনার শার্লক হোমস কাজ করতেন বাস্তবের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। ফলে একটা শহরভিত্তিক বাহিনী হওয়া সত্ত্বেও এর পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। অনেকের কাছে এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা মেট্রোপলিটন পুলিশ বাহিনী।
এই স্থানে ব্রিটেনের প্রথম মেট্রোপলিটন পুলিশ বাহিনী গড়ে ওঠার পূর্বে কেমন ছিল রাজধানী লন্ডন ও তার আশেপাশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি? কোন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এবং কেন প্রতিষ্ঠা করা হলো এ বাহিনী? এই দুই প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আমাদের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সিরিজের প্রথম কিস্তি।
আঠারো শতকের গোড়ার কথা
আঠারো শতকে লন্ডন শহর ছিল এক অদ্ভুত বৈপরীত্যে মোড়া। লন্ডনের একপাশ ছিল বাগান আর বিলাসবহুল ঘরবাড়িতে সাজানো। অন্যদিকে, অপর পাশটি ছিল ছিন্নমূল মানুষদের আস্তানা; ঘিঞ্জি সেসব এলাকায় ঠিকমতো দম ফেলাই হয়ে যেতো দুষ্কর।
সে সময় লন্ডন ও তার আশেপাশের এলাকাগুলোতে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য খুব বেড়ে যায়। দিনে-দুপুরে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি লেগেই থাকতো। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও বো স্ট্রিটের ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ফিল্ডিং একদিন রাতের বেলায় শোরডিচের দু’টি বাড়িতে হানা দিয়ে দেখতে পান ৬০-৭০ জন লোক একটি খুপরির মতো ঘরে গাদাগাদি করে বাস করছে। এলাকার সকলেই জড়িত চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সাথে। এদের মধ্যে রয়েছে পাঁচ-ছয়জন শিশুও। নগরের এই বস্তি এলাকাগুলো ছিল অপরাধীদের অভয়াশ্রম।
ওদিকে সড়ক-মহাসড়কে প্রায়ই দিনে-দুপুরে ডাকাতি হতো। ডাকাতেরাও ছিল একেবারে বেপরোয়া, সকলের চোখের সামনে ডাকাতি করে তারা রীতিমতো উল্লাস করে বেড়াতো। কেউ কোনোভাবেই তাদের বাধা দেওয়ার সাহস পেতো না। যদি কেউ কখনো তাড়া করতো, তা হলে বহু সশস্ত্র লোক তাদের সাহায্য করতে ছুটে আসতো। আর খুন-জখমও ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন বিশৃঙ্খল দশায় সাধারণ মানুষ সবসময় ভয়ে তটস্থ থাকতো।
থিফ টেকার
আগেই বলা হয়েছে, আঠারো শতকে লন্ডন ও তার আশেপাশে কোনো প্রশিক্ষিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল না। ফলে প্রশ্ন আসে, তবে কি আইন-শৃঙ্খলা দেখভাল করবার জন্য কেউই দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল না? হ্যাঁ, ছিল। কোনো আইনি কাঠামো ছাড়াই সরকারের ওপর মহল থেকে কোনো ব্যক্তি বিশেষকে এ কাজে নিযুক্ত করা হতো। এদেরকে ‘থিফ টেকার‘ বলা হতো।
এই থিফ টেকারদের কোনো সরকারি স্বীকৃতি ছিল না। কোনো এলাকায় অপরাধ ঘটলে অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধীকে ধরিয়ে দেওয়া ও চুরির মালামাল ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে পুরস্কৃত হতেন তারা। চার্লস হুইটচেন ও তার সহযোগী জোনাথন ওয়াইল্ড লন্ডনে থিফ টেকার হিসেবে প্রথম দিকে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু একটা সময় তাদের দু’জনের পক্ষে অপরাধী ধরা এবং চুরির মালামাল খুঁজে আনা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই কাজ পরিচালনার সুবিধার্থে তারা বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলেন।
পরবর্তীকালে দেখা যায়, বেসরকারি এসব বাহিনীর আপাত স্বেচ্ছাশ্রমমূলক কার্যক্রমই সরকারি কর্তৃপক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে থাকে। কেননা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কাজে নিযুক্ত এসব ব্যক্তি অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য পরবর্তী সময়ে নিজেরাই তাদের বাহিনীর সাহায্যে নানারকম চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির কাজে জড়িয়ে পড়েন। পরে সেসব চুরি করা মালামালই অর্থের বিনিময়ে মালিকদের ফেরত দেবার পাশাপাশি সরকারের কাছ থেকেও পেতেন অর্থ-পুরস্কার!
দিনে দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে। সরকার প্রকৃত সমস্যা অনুধাবন করতে না পারায় থিফ টেকারদের জন্য আর্থিক পুরস্কারের মূল্য বৃদ্ধি করেন। ফলে থিফ টেকাররা হয়ে ওঠেন দ্বিগুণ বেপরোয়া। প্রচুর অর্থ লাভের আশায় অনেক সময় সাধারণ পথযাত্রীকে চুরির দায়ে বা মিথ্যে অভিযোগে ধরে আনা হতো। নিজেরা আড়ালে থেকে এ কাজ করতেন বলে প্রথম দিকে সরকার এবং সমাজের পক্ষ থেকে এই থিফ টেকারদের প্রশংসা করলেও পরবর্তীকালে নানা অনুসন্ধানে তাদের নানা কুকীর্তি সকলের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে।
কুখ্যাত জোনাথন ওয়াইল্ড ও তার অপরাধ-বাহিনী
জোনাথন ওয়াইল্ড আঠারো শতকে অপরাধ দলের এক দুর্ধর্ষ নেতা ছিলেন। সে সময়ে লন্ডন ও তার আশেপাশের অঞ্চলে কোনো প্রশিক্ষিত বাহিনী না থাকায় জোনাথান ওয়াইল্ড একদিকে যেমন তার বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন, অপরদিকে সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে কাজ করে নিজেকে সমাজের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তিনি নিজেকে ‘থিফ টেকার জেনারেল’ হিসেব পরিচয় দিতেন। অপরাধীদের ধরে আনা এবং তাদেরকে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের বিনিময়ে তাকে ৪০ পাউন্ড দেয়া হতো। বছরে তিনি যা আয় করতেন, তা ঐ সময়ের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির আয়ের চেয়ে বেশি ছিল।
ওয়াইল্ড ছিলেন ঝানু লোক, পুরস্কারের অর্থ তিনি ব্যয় করতেন তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অপরাধ চক্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে! বহু চোর-ডাকাত তার হয়ে নানা অপরাধে নিযুক্ত ছিল। তাদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি সুসজ্জিত অপরাধ বাহিনী। ওয়াইল্ডের সাজানো অপরাধী দলের জন্য একজন করে কর্মকর্তাও নিযুক্ত থাকতো। এই অপরাধ দলগুলোর একটি কাজ ছিল লন্ডন শহরের বড় বড় রাস্তায় ডাকাতি করা। আরেকটি দল ছিলো, যারা চুরি-ডাকাতির জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিল ধর্মীয় স্থানগুলোকে। একটি দল আবার ওঁত পেতে থাকতো গানবাজনার আসরে। এসব দলকে দেখভাল করার জন্য একটি স্পেশাল বিগ্রেডও ছিল। রাতের বেলায় তারাই আবার লোকের বাড়িতে সিঁধ কাটতো কিংবা দরজা খুলে রাখতো, যাতে চোরেরা ভালোভাবে কাজ সারতে পারে।
শুধু তাই নয়, ওয়াইল্ড তার এই কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি অফিস খুলে বসেন। অনেকেই তাদের ব্যক্তিগত হারিয়ে যাওয়া মালামাল খুঁজে পেতে ওয়াইল্ডের দ্বারস্থ হতেন। এই অফিস থেকেই ওয়াইল্ড তার মক্কেলদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। অর্থের বিনিময়ে তাদের হারিয়ে যাওয়া মালামাল খুঁজে দিতেন তিনি। অথচ এই হারিয়ে যাওয়া মালামাল ওয়াইল্ডের অপরাধ বাহিনীই চুরি করতো এবং ওয়াইল্ড অর্থের বিনিময়ে এসব মালপত্র মালিকদের ফেরত দিতেন! অর্থের একটি অংশ ওয়াইল্ড তার কর্মীদের জন্য বরাদ্দ রাখতেন, আর বাকি অর্থ তার পকেটস্থ হতো।
‘থিফ টেকার’ পরিচিতির কারণে সরকারি কর্তৃপক্ষের সাথে তার সবসময় একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। ফলে লন্ডনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দল গড়ে উঠতে চাইলে বা তার দলের কেউ তার বিপক্ষে যেতে চাইলে, তাদের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যে অভিযোগ এনে প্রভাব খাটিয়ে তাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তিবিধানের জন্য বাধ্য করতেন কর্তৃপক্ষকে। ফলে অপরাধ চক্রের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন জোনাথন ওয়াইল্ড।
এই জোনাথন ওয়াইল্ডের দলে ছিলেন জ্যাক শেফার্ড নামের একজন ছিঁচকে চোর। কর্মজীবনের শুরুতে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ওই চাকরিতে তার মন টিকলো না। তার ধারণা, ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং অন্যান্য সহকর্মীরা তার সাথে মোটেই ভালো ব্যবহার করছে না। তার উপর সে যে বেতন পেতো, তা-ও তার প্রয়োজন মেটতো না। তাই সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে বেশি অর্থের আশায় সে যোগ দেয় ওয়াইল্ডের অপরাধ বাহিনীতে।
দলের মধ্যে থেকে নানা চুরির কাজে সহায়তা করতো। এ কাজে বেশ আয়ও হতো। কিন্তু এই অর্থও তার কম মনে হতে লাগলো। ওয়াইল্ডের মতো নিজেও একটা দল গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল জ্যাক। ব্যাপারটি ওয়াইল্ডের কানে পৌঁছতেই জ্যাকের ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন তিনি। একটা ডাকাতি ও খুনের মামলায় জ্যাকের নাম জুড়ে দেয়া হয়। ১৭২২ সালে জ্যাককে গ্রেপ্তার করা হয়। দু’বার সে জেল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ১৭২৪ সালে আবার ধরা পড়ে। এবার আর জ্যাক পালাতে পারলো না। প্রায় দু’হাজার মানুষের সামনে জ্যাক শেফার্ডের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তখন তার বয়স মাত্র ২২।
শহর-সুরক্ষায় ব্রিটিশ সরকারের ঔদাসিন্য
আঠারো শতকের শুরুর দিকে লন্ডন ও তার আশেপাশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকার ছিল বেশ উদাসীন। চার্লি নামে দ্বিতীয় চার্লসের আমলের একদল পাহারাদার ছিল। এই পাহারাদারদের সকলেই ছিল বৃদ্ধ, দুর্বল চেহারার। জোনাথন ওয়াইল্ডের মতো অপরাধ বাহিনীর সাথে লড়াই করার কোনো ক্ষমতাই এদের ছিল না। কনকনে শীতের রাস্তায় রাত তিনটের ঘণ্টা পিটিয়ে সময় জানান দিত তারা। এটাই ছিল তাদের প্রধান কাজ।
এই পাহারাদাররা বড়জোর রাস্তায় ধূমপান করার অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করে ১২ ঘণ্টার জন্য হাজতে পুরতো। এমনকি কোনো ছিঁচকে চোর যদি কারো কিছু ছিনতাই করে অন্য ফুটপাত ধরে পালাতো, তা দেখেও চার্লি-পাহারাদাররা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। কেননা রাস্তার অন্য ফুটপাতটি তাদের আওতায় পড়ে না।
দক্ষ পুলিশবাহিনী গড়ে তোলার পেছনে সরকারের কোনো চেষ্টাই ছিল না। কারণ গণতান্ত্রিক উপায়ে গঠিত পার্লামেন্টের কাছে সরকার কোনোভাবেই দায়বদ্ধ ছিল না। সে সময় সরকার শুধু রানীকেই জবাবদিহি করতেন এবং যে পুলিশবাহিনী গঠন করা হতো, তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের গারদে ঢোকানো। চোর-ডাকাতদের নিয়ে যেন কারো কোনোই মাথাব্যথা ছিল না!
ঐ সময় ব্রিটিশ সরকারের আচরণও ছিল অদ্ভুত। রানীর সাথে যাদের ভাল সম্পর্ক থাকতো, তারাই থাকতো সরকারে। সরকারই দীর্ঘস্থায়ী হতো না। থিতু হবার মতো সুযোগ না থাকায় কোনো সরকারই পুলিশবাহিনী গঠন করাটা শ্রেয় মনে করতেন না। কে জানে, তাতে হয়তো পরের সপ্তাহে কোনো অপরাধের ছুতোয় তাদের কপালে হাজতবাস জুটতে পারে। কে-ইবা সাধ করে গলায় ফাঁস লাগাতে চায়! বেড়ালের গলায় তাই কেউই ঘণ্টা পরায়নি।
এই অদ্ভুত খেয়াল-খুশির জন্য লন্ডনের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা দিন-দিন খারাপ হতে শুরু করে। লন্ডন এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সরকার ১৭২৯ সালে সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মিডলসেক্স এবং ওয়েস্টমিনস্টারের শান্তি কমিশনে নিযুক্ত করেন।
ইংল্যান্ডের একটি সুসজ্জিত পুলিশবাহিনী গড়ে তোলার পেছনে এটি ছিল প্রথম ধাপ। পরের অধ্যায়ে আমরা জানতে চেষ্টা করবো কীভাবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গড়ে উঠলো ইংল্যান্ডের প্রথম সুশৃঙ্খল এবং কর্মঠ এক পুলিশবাহিনী।